আনন্দমঠ (১৯৩৮)/তৃতীয় খণ্ড/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ
এই সময়ে টমাসের তোপগুলি দক্ষিণে আসিয়া পৌঁছিল। তখন সন্তানের দল একেবারে ছিন্ন ভিন্ন হইল, কেহ বাঁচিবার আর কোন আশা রহিল না। সন্তানেরা যে যেখানে পাইল, পলাইতে লাগিল। জীবানন্দ ধীরানন্দ তাহাদিগকে সংযত এবং একত্রিত করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কিছুতেই পারিলেন না। সেই সময় উচ্চৈঃশব্দ হইল, “পুলে যাও, পুলে যাও! ও পারে যাও। নহিলে নদীতে ডুবিয়া মরিবে, ধীরে ধীরে ইংরেজসেনার দিকে মুখ রাখিয়া পুলে যাও।”
জীবানন্দ চাহিয়া দেখিলেন, সম্মুখে ভবানন্দ। ভবানন্দ বলিলেন, “জীবানন্দ, পুলে লইয়া যাও, রক্ষা নাই।” তখন ধীরে ধীরে পিছে হঠিতে হঠিতে সন্তানসেনা পুলের পারে চলিল। কিন্তু পুল পাইয়া বহুসংখ্যক সন্তান একেবারে পুলের ভিতর প্রবেশ করায় ইংরেজের তোপ সুযোগ পাইল। পুল একেবারে ঝাঁটাইতে লাগিল। সন্তানের দল বিনষ্ট হইতে লাগিল। ভবানন্দ জীবানন্দ ধীরানন্দ একত্র। একটা তোপের দৌরাত্ম্যে ভয়ানক সন্তানক্ষয় হইতেছিল। ভবানন্দ বলিলেন, “জীবানন্দ, ধীরানন্দ, এস—তরবারি ঘুরাইয়া আমরা তিন জন এই তোপটা দখল করি।” তখন তিন জনে তরবারি ঘুরাইয়া সেই তোপের নিকটবর্ত্তী গোলন্দাজ সেনা বধ করিলেন। তখন আর আর সন্তানগণ তাহাদের সাহায্যে আসিল। তোপটা ভবানন্দের দখল হইল। তোপ দখল করিয়া ভবানন্দ তাহার উপর উঠিয়া দাঁড়াইলেন। করতালি দিয়া বলিলেন, “বল বন্দে মাতরম্।” সকলে গায়িল, “বন্দে মাতরম্।” ভবানন্দ বলিলেন, “জীবানন্দ, এই তোপ ঘুরাইয়া বেটাদের লুচির ময়দা তৈয়ার করি।” সন্তানেরা সকলে ধরিয়া তোপ ঘুরাইল। তখন তোপ উচ্চনাদে বৈষ্ণবের কর্ণে যেন হরি হরি শব্দে ডাকিতে লাগিল। বহুতর সিপাহী তাহাতে মরিতে লাগিল। ভবানন্দ সেই তোপ টানিয়া আনিয়া পুলের মুখে স্থাপন করিয়া বলিলেন, “তোমরা দুই জনে সন্তানসেনা সারি দিয়া পুল পার করিয়া লইয়া যাও, আমি একা এই ব্যুহমুখ রক্ষা করিব—তোপ চালাইবার জন্য আমার কাছে জন কয় গোলন্দাজ দিয়া যাও।” কুড়ি জন বাছা বাছা সন্তান ভবানন্দের কাছে রহিল।
তখন অসংখ্য সন্তান পুল পার হইয়া জীবানন্দ ও ধীরানন্দের আজ্ঞাক্রমে সারি দিয়া পরপারে যাইতে লাগিল। একা ভবানন্দ কুড়ি জন সন্তানের সাহায্যে সেই এক কামানে বহুতর সেনা নিহত করিতে লাগিলেন—কিন্তু যবনসেনা জলোচ্ছ্বাসোত্থিত তরঙ্গের ন্যায়! তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ!— ভবানন্দকে সংবেষ্টিত, উৎপীড়িত, নিমগ্নের ন্যায় করিয়া তুলিল। ভবানন্দ অশ্রান্ত, অজেয়, নির্ভীক—কামানের শব্দে শব্দে কতই সেনা বিনষ্ট করিতে লাগিলেন। যবন বাত্যাপীড়িত তরঙ্গাভিঘাতের ন্যায় তাঁহার উপর আক্রমণ করিতে লাগিল, কিন্তু কুড়ি জন সন্তান, তোপ লইয়া পুলের মুখ বন্ধ করিয়া রহিল। তাহারা মরিয়াও মরে না—যবন পুলে ঢুকিতে পায় না। সে বীরেরা অজেয়, সে জীবন অবিনশ্বর। অবসর পাইয়া দলে দলে সন্তানসেনা অপর পারে গেল। আর কিছুকাল পুল রক্ষা করিতে পারিলেই সন্তানেরা সকলেই পুলের পারে যায়—এমন সময় কোথা হইতে নূতন তোপ ডাকিল—“গুড়ুম্ গুডুম্ বুম্ বুম্।” উভয় দল কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধে ক্ষান্ত হইয়া চাহিয়া দেখিল—কোথায় আবার কামান! দেখিল, বনের ভিতর হইতে কতকগুলি কামান দেশী গোলন্দাজ কর্ত্তৃক চালিত হইয়া নির্গত হইতেছে। নির্গত হইয়া সেই বিরাট্ কামানের শ্রেণী সপ্তদশ মুখে ধূম উদগীর্ণ করিয়া হে সাহেবের দলের উপর অগ্নিবৃষ্টি করিল। ঘোর শব্দে বন নদ গিরি সকলই প্রতিধ্বনিত হইল। সমস্ত দিনের রণে ক্লান্ত যবনসেন। প্রাণভয়ে শিহরিল। অগ্নিবৃষ্টিতে তৈলঙ্গী, মুসলমান, হিন্দুস্থানী পলায়ন করিতে লাগিল। কেবল দুই চারি জন গোরা খাড়া দাঁড়াইয়া মরিতে লাগিল।
ভবানন্দ রঙ্গ দেখিতেছিলেন। ভবানন্দ বলিলেন, “ভাই, নেড়ে ভাঙ্গিতেছে, চল একবার উহাদিগকে আক্রমণ করি।” তখন পিপীলিকাস্রোতবৎ সন্তানের দল নূতন উৎসাহে পুল পারে ফিরিয়া আসিয়া যবনদিগকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল। অকস্মাৎ তাহারা যবনের উপর পড়িল। যবন যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল না—যেমন ভাগীরথীতরঙ্গ সেই দম্ভকারী বৃহৎ পর্ব্বতাকার মত্ত হস্তীকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সন্তানেরা তেমনি যবনদিগকে ভাসাইয়া লইয়া চলিল। যবনেরা দেখিল, পিছনে ভবানন্দের পদাতিক সেনা, সম্মুখে মহেন্দ্রের কামান। তখন হে সাহেবের সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইল আর কিছু টিকিল না—বল, বীর্য্য, সাহস, কৌশল, শিক্ষা, দম্ভ, সকলই ভাসিয়া গেল। ফৌজদারী, বাদশাহী, ইংরাজী, দেশী, বিলাতী, কালা, গোরা সৈন্য নিপতিত হইয়া ভূতলশায়ী হইল। বিধর্ম্মীর দল পলাইল। মার মার শব্দে জীবানন্দ, ভবানন্দ, ধীরানন্দ, বিধর্ম্মী সেনার পশ্চাতে ধাবমান হইলেন। তাহাদের তোপ সন্তানেরা কাড়িয়া লইল, বহুতর ইংরেজ ও সিপাহী নিহত হইল। সর্ব্বনাশ হইল দেখিয়া কাপ্তেন হে ও ওয়াট্সন্ ভবানন্দের নিকট বলিয়া পাঠাইল, “আমরা সকলে তোমাদিগের নিকট বন্দী হইতেছি, আর প্রাণিহত্যা করিও না।” জীবানন্দ ভবানন্দের মুখপানে চাহিলেন। ভবানন্দ মনে মনে বলিলেন, “তা হইবে না, আমায় যে আজ মরিতে হইবে।” তখন ভবানন্দ উচ্চৈঃস্বরে হস্তোত্তোলন করিয়া হরিবোল দিয়া বলিলেন, “মার মার।”
আর এক প্রাণী বাঁচিল না—শেষ এক স্থানে ২০।৩০ জন গোরা সৈন্য একত্রিত হইয়া আত্মসমর্পণে কৃতনিশ্চয় হইল, অতি ঘোরতর রণ করিতে লাগিল। জীবানন্দ বলিলেন, “ভবানন্দ, আমাদের রণজয় হইয়াছে, আর কাজ নাই, এই কয় জন ব্যতীত আর কেহ জীবিত নাই। উহাদিগকে প্রাণ দান দিয়া চল আমরা ফিরিয়া যাই।” ভবানন্দ বলিলেন, “এক জন জীবিত থাকিতে ভবানন্দ ফিরিবে না—জীবানন্দ, তোমায় দিব্য দিয়া বলিতেছি যে, তুমি তফাতে দাঁড়াইয়া দেখ, একা আমি এই কয় জন ইংরেজকে নিহত করি।”
কাপ্তেন টমাস অশ্বপৃষ্ঠে নিবদ্ধ ছিল। ভবানন্দ আজ্ঞা দিলেন, “উহাকে আমার সম্মুখে রাখ, আগে ঐ বেটা মরিবে তবে ত আমি মরিব।”
কাপ্তেন টমাস বাঙ্গালা বুঝিত, বুঝিয়া ইংরেজসেনাকে বলিল, “ইংরেজ! আমি ত মরিয়াছি, প্রাচীন ইংলণ্ডের নাম তোমরা রক্ষা করিও, তোমাদিগকে খ্রীষ্টের দিব্য দিতেছি, আগে আমাকে মার, তার পর এই বিদ্রোহীদিগকে মার।”
ভোঁ করিয়া একটি বুলেট ছুটিল, এক জন আইরিস্ম্যান্ কাপ্তেন টমাসকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুঁড়িয়াছিল। ললাটে বিদ্ধ হইয়া কাপ্তেন টমাস প্রাণত্যাগ করিল। ভবানন্দ তখন ডাকিয়া বলিলেন, “আমার ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হইয়াছে, কে এমন পার্থ বৃকোদর নকুল সহদেব আছে যে, এ সময় আমাকে রক্ষা করিবে! দেখ, বাণাহত ব্যাঘ্রের ন্যায় গোরা আমার উপর ঝুঁ কিয়াছে। আমি মরিবার জন্য আসিয়াছি; আমার সঙ্গে মরিতে চাও, এমন সন্তান কেহ আছে?”
আগে ধীরানন্দ অগ্রসর হইল, পিছে জীবানন্দ——সঙ্গে সঙ্গে আর ১০।১৫।২০।৫০ জন সন্তান আসিল। ভবানন্দ ধীরানন্দকে দেখিয়া বলিলেন, “তুমিও যে আমাদের সঙ্গে মরিতে আসিলে?”
ধীর। “কেন, মরা কি কাহারও ইজারা মহল না কি?” এই বলিতে বলিতে ধীরানন্দ এক জন গোরাকে আহত করিলেন।
ভব। তা নয়। কিন্তু মরিলে ত স্ত্রীপুত্ত্রের মুখাবলোকন করিয়া দিনপাত করিতে পারিবে না!
ধীর। কালিকার কথা বলিতেছ? এখনও বুঝ নাই?—(ধীরানন্দ আহত গোরাকে বধ করিলেন।)
ভব। না—(এই সময়ে এক জন গোরার আঘাতে ভবানন্দের দক্ষিণ বাহু ছিন্ন হইল।)
ধীর। আমার সাধ্য কি যে, তোমার ন্যায় পবিত্রাত্মাকে সে সকল কথা বলি। আমি সত্যানন্দের প্রেরিত চর হইয়া গিয়াছিলাম।
সে কি? মহারাজের আমার প্রতি অবিশ্বাস? (ভবানন্দ তখন এক হাতে যুদ্ধ করিতেছিলেন) ধীরানন্দ তাঁহাকে রক্ষা করিতে করিতে বলিলেন, “কল্যাণীর সঙ্গে তোমার যে সকল কথা হইয়াছিল, তাহা তিনি স্বকর্ণে শুনিয়াছিলেন।”
ভব। কি প্রকারে?
ধীর। তিনি তখন স্বয়ং সেখানে ছিলেন। সাবধান থাকিও। (ভবানন্দ এক জন গোরা কর্ত্তৃক আহত হইয়া তাহাকে প্রত্যাহত করিলেন।) তিনি কল্যাণীকে গীতা পড়াইতেছিলেন, এমত সময়ে তুমি আসিলে। সাবধান! (ভবানন্দের বাম বাহুও ছিন্ন হইল।)
ভব। আমার মৃত্যুসংবাদ তাঁহাকে দিও! বলিও, আমি অবিশ্বাসী নহি।
ধীরানন্দ বাষ্পপূর্ণলোচনে যুদ্ধ করিতে করিতে বলিলেন, “তাহা তিনি জানেন। কালি রাত্রের আশীর্ব্বাদবাক্য মনে কর। আর আমাকে বলিয়া দিয়াছেন, ‘ভবানন্দের কাছে থাকিও, আজ সে মরিবে। মৃত্যুকালে তাহাকে বলিও, আমি আশীর্ব্বাদ করিতেছি, পরলোকে তাহার বৈকুণ্ঠপ্রাপ্তি হইবে’।”
ভবানন্দ বলিলেন, “সন্তানের জয় হউক, ভাই! আমার মৃত্যুকালে একবার ‘বন্দে মাতরম্’ শুনাও দেখি।”
তখন ধীরানন্দের আজ্ঞাক্রমে যুদ্ধোন্মত্ত সকল সন্তান মহাতেজে “বন্দে মাতরম্” গায়িল। তাহাতে তাহাদিগের বাহুতে দ্বিগুণ বলসঞ্চার হইয়া উঠিল। সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্ত্তে অবশিষ্ট গোরাগণ নিহত হইল। রণক্ষেত্রে আর শত্রু রহিল না।
সেই মুহূর্ত্তে ভবানন্দ মুখে “বন্দে মাতরম্” গায়িতে গায়িতে, মনে বিষ্ণুপদ ধ্যান করিতে করিতে প্রাণত্যাগ করিলেন।
হায়! রমণীরূপলাবণ্য! ইহসংসারে তোমাকেই ধিক্।