আনন্দমঠ (১৯৩৮)/প্রথম খণ্ড/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ
রাত্রি প্রভাত হইয়াছে। সেই জনহীন কানন,—এতক্ষণ অন্ধকার, শব্দহীন ছিল— এখন আলোকময়—পক্ষিকৃজনশদিত হইয়া আনন্দময় হইল। সেই আনন্দময় প্রভাতে আনন্দময় কাননে, “আনন্দমঠে,” সত্যনিন্দ ঠাকুর হরিণচর্ম্মে বসিয়া সন্ধ্যাহিক করিতেছেন। কাছে বসিয়া জীবানন্দ। এমন সময়ে ভবানন্দ মহেন্দ্র সিংহকে সঙ্গে লইয়া আসিয়া. উপস্থিত হইল। ব্রহ্মচারী বিনাবাক্যব্যয়ে সন্ধ্যাহ্যিক করিতে লাগিলেন, কেহ কোন কথা কহিতে সাহস করিল না। পরে সন্ধ্যাহিক সমাপন হইলে, ভবানন্দ, জীবানন্দ উভয়ে উাহাকে প্রণাম করিলেন এবং পদধূলি গ্রহণপূর্বক বিনীতভাবে উপবেশন করিলেন। তখন সত্যানন্দ ভবানন্দকে ইঙ্গিত করিয়া বাহিরে লইয়া গেলেন। কি কথোপকথন হইল, তাহা আমরা জানি না। তাহার পর উভয়ে মন্দিরে প্রত্যাবর্তন করিলে, ব্রহ্মচারী সকরুণ সহস্তে বদনে মহেশ্রকে বলিলেন, “বাবা, তোমার দুঃখে আমি অত্যন্ত কাতর হইয়াছি, কেবল সেই দীনবন্ধুর কৃপায় তোমার স্ত্রী কস্তাকে কাল রাত্রিতে আমি রক্ষা করিতে পারিয়ছিলাম।” এই বলিয়া ব্রহ্মচারী কল্যাণীর রক্ষাবৃত্তান্ত বর্ণিত করিলেন। তার পর বলিলেন যে, “চল, তাহারা যেখানে আছে, তোমাকে সেখানে লইয়া যাই।”
এই বলিয়া ব্রহ্মচারী অগ্রে অগ্রে, মহেন্দ্র পশ্চাৎ পশ্চাৎ দেবালয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্র দেখিল, অতি বিস্তৃত, অতি উচ্চ প্রকোষ্ঠ। এই নবারুণপ্রফুল্ল প্রাতঃকালে, যখন নিকটস্থ কানন সূর্য্যালোকে হীরকখচিতবৎ জ্বলিতেছে, তখনও সেই বিশাল কক্ষায় প্রায় অন্ধকার। ঘরের ভিতর কি আছে, মহেন্দ্র প্রথমে তাহা দেখিতে পাইল না—দেখিতে দেখিতে, দেখিতে দেখিতে, কমে দেখিতে পাইল, এক প্রকাণ্ড চতুভুজ মূর্তি, শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, কৌস্তুভশোভিতহৃদয়, সম্মুখে সুদর্শনচক্র ঘূর্ণমানপ্রায় স্থাপিত। মধুকৈটভ খরূপ দুইটি প্রকাণ্ড ছিন্নমস্ত মূর্তি রুধিরপ্লাবিতবৎ চিত্রিত হইয়া সম্মুখে রহিয়াছে। বামে লক্ষ্মী আলুলায়িতকুন্তলা শতদলমালামণ্ডিতা ভয়ত্রস্তার ন্যায় দাড়াইয়া আছেন। দক্ষিণে সরস্বতী, পুস্তক, বাদ্যযন্ত্র, মূর্তিমান্ রাগ রাগিণী প্রভৃতি পরিবেষ্টিত হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। বিষ্ণুর অঙ্কোপরি এক মোহিনী মূর্তিলক্ষ্মী সরস্বতীর অধিক সুন্দরী, লক্ষ্মী সরস্বতীর অধিক ঐশ্বর্য্যান্বিতা। গন্ধর্ব, কিন্নর, দেব, যক্ষ, রক্ষ তাঁহাকে পূজা করিতেছে। ব্রহ্মচারী অতি গম্ভীর, অতি ভীত স্বরে মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সকল দেখিতে পাইতেছ?” মহেন্দ্র বলিল, “পাইতেছি।”
ব্রহ্ম। বিষ্ণুর কোলে কি আছে দেখিয়াছ?
মহে। দেখিয়াছি। কে উনি?
ব্রহ্ম। মা।
মহে। মা কে?
ব্রহ্মচারী বলিলেন, “আমরা যার সন্তান।”
মহেন্দ্র। কে তিনি?
ব্রহ্ম। সময়ে চিনিবে। বল-বন্দে মাতরম্। এখন চল, দেখিবে চল।
তখন ব্রহ্মচারী মহেন্দ্রকে কক্ষান্তরে লইয়া গেলেন। সেখানে মহেন্দ্র দেখিলেন, এক অপরূপ সর্বাঙ্গসম্পন্ন সৰ্বাভরণভূষিত জগদ্ধাত্রী মূর্তি। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে?”
ব্র। মা— মা ছিলেন।
ম। সে কি?
ব্র। ইনি কুঞ্জর কেশরী প্রভৃতি বন্য পশুসকল পদতলে দলিত করিয়া, বন্য পশুর আবাসস্থানে আপনার পদ্মাসন স্থাপিত করিয়াছিলেন। ইনি সৰ্বালঙ্কারপরিভূষিত। হাস্যময়ী সুন্দরী ছিলেন। ইনি বালাকবর্ণা, সকল ঐশ্বর্যশালিনী। ইহাকে প্রণাম
মহেন্দ্র ভক্তিভাবে জগদ্ধাত্রীরূপিণী মাতৃভূমিকে প্রণাম করিলেপর, ব্রহ্মচারী ভঁহাকে এক অন্ধকার সুরঙ্গ দেখাইয়া বলিলেন, “এই পথে আইস।” ব্রহ্মচারী স্বয়ং আগে আগে চলিলেন। মহেন্দ্র সভয়ে পাছু পাছু চলিলেন। ভূগর্ভস্থ এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কোথা হইতে সামান্য আলো আসিতেছিল। সেই ক্ষীপালোকে এক কালীমূর্ত্তি দেখিতে পাইলেন।
ব্রহ্মচারী বলিলেন,
“দেখ, মা যা হইয়াছেন।”
মহেন্দ্র সভয়ে বলিল, “কালী।”
ব্র। কালী—অন্ধকারসমাচ্ছন্ন কালিমাময়ী। হৃতসর্ব, এই জন্য নয়িকা। আজি দেশে সর্বত্রই শ্মশান—তাই মা কঙ্কালমালিনী। আপনার শিব আপনার পদতলে দলিতেছেন—হায় মা।
ব্রহ্মচারীর চক্ষে দর দর ধারা পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাতে ধেটক খর্পর কেন?”
ব্রহ্ম। আমরা সন্তান, অস্ত্র মার হাতে এই দিয়াছি মাত্র-বল, বন্দে মাতরম্।
“বন্দে মাতরম্” বলিয়া মহেন্দ্র কালীকে প্রণাম করিল। তখন ব্রহ্মচারী বলিলেন, “এই পথে আইস।” এই বলিয়া তিনি দ্বিতীয় সুরঙ্গ আবোহণ করিতে লাগিলেন। সহসা তাঁহাদিগের চক্ষে প্রাতঃসূর্যের রশ্মিরাশি প্রভাসিত হইল। চারিদিক হইতে মধুকণ্ঠ পক্ষিকুল গায়িয়া উঠিল। দেখিলেন, এক মর্ম্মরপ্রস্তরনির্মিত প্রশস্ত, মন্দিরের মধ্যে সুবর্ণনির্মিতা দশভুজা প্রতিমা নবারুণকিরণে জ্যোতির্ময়ী হইয়া হাসিতেছে। ব্রহ্মচারী প্রণাম করিয়া বলিলেন,—
“এই মা যা হইবেন। দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত,—তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদাশ্রিত বীর কেশরী শত্রুনিপীড়নে নিযুক্ত। দিগভুজা—” বলিতে বলিতে সত্যানন্দ গদগদকণ্ঠে কঁদিতে লাগিলেন। “দিগভুজা নানাপ্রহরণধারিণী শত্রুবিমর্দিনী-বীরেন্দ্র-পৃষ্ঠবিহারিণী-দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী-বামে বাণী বিদ্যা-বিজ্ঞানদায়িনী—সঙ্গে বলরূপী কার্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরূপী গণেশ; এস, আমরা মাকে উভয়ে প্রণাম করি।” তখন দুই জনে যুক্তকরে উর্ধমুখে এককণ্ঠে ডাকিতে লাগিল,
“সর্বমঙ্গল-মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ-সাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহও তে”
উভয়ে ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া গাজোখান করিলে, মহেন্দ্র গদগদকতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মার এ মূর্তি কবে দেখিতে পাইব?”
ব্রহ্মচারী বলিলেন, “শবে মার সকল সন্তান মাকে না বলিয়া ডাকিবে, সেই দিন উনি প্রসন্ন হইবেন।
মহেন্দ্র সহসা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার স্ত্রী কন্যা কোথায়?”
ব্রহ্ম। চল—দেখিবে চল।
মহে। তাহাদের একবারমাত্র আমি দেখিয়া বিদায় দিব।
ব্রহ্ম। কেন বিদায় দিবে।
ম। আমি এই মহামন্ত্র গ্রহণ করিব।
ব্রহ্ম। কোথায় বিদায় দিবে?
মহেন্দ্র কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আমার গৃহে কেহ নাই, আমার আর সুনিও নাই। এ মহামারীর সময় আর কোথায় বা স্থান পাইব?”
ব্রহ্ম। যে পথে এখানে আসিলে, সেই পথে মন্দিরের বাহিরে যাও। মন্দির-দ্বারে তোমার স্ত্রী কন্যাকে দেখিতে পাইবে। কল্যাণী এ পর্যন্ত অভুক্ত। যেখানে তাহারা বসিয়া আছে, সেইখানে ভক্ষ্য সামগ্রী পাইবে। তাহাকে ভোজন করাইয়া তোমার যাহা অভিরুচি, তাহা করিও, এক্ষণে আমাদিগের আর কাহারও সাক্ষাৎ পাইবে না। তোমার মন যদি এইরূপ থাকে, তবে উপযুক্ত সময়ে, তোমাকে দেখা দিব।
তখন অকস্মাৎ কোন পথে ব্রহ্মচারী অন্তর্হিত হইলেন। মহেন্দ্র পূর্বপ্রদৃষ্ট পথে নির্গমনপূর্বক দেখিলেন, নাটমন্দিরে কল্যাণী কন্যা লইয়া বসিয়া আছে।
এদিকে সত্যানন্দ অন্য সুরঙ্গ দিয়া অবতরণপূর্বক এক নিভৃত ভূগর্ভক্ষায় নামিলেন। সেখানে জীবানন্দ ও ভবানন্দ বসিয়া টাকা গণিয়া থরে থরে সাজাইতেছে। সেই ঘরে স্থূপে স্কুপে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, হীরক, প্রবাল, মুক্তা সজ্জিত রহিয়াছে। গত রাত্রে লুঠের টাকা, ইহারা সাজাইয়া রাখিতেছে। সত্যানন্দ সেই কমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “জীবানল। মহেন্দ্র আসিবে। আসিলে সন্তানের বিশেষ উপকার আছে। কেন না, তাহা হইলে উহার পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত অর্থশি মার সেবায় অর্পিত হইবে। কিন্তু যত দিন সে কায়মনোবাক্যে মাতৃভক্ত না হয়, তত দিন তাহাকে গ্রহণ করিও না। তোমাদিগের হাতের কাজ সমাপ্ত হইলে তোমরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উহার অনুসরণ করিও, সময় দেখিলে উহাকে বিষ্ণুমণ্ডপে উপস্থিত করিও। আর সময়ে হউক, অসময়ে হউক, উহাদিগের প্রাণ রক্ষা করিও। কেন না, যেমন দুষ্টের শাসন সন্তানের ধর্ম্ম, শিষ্টের অক্ষাও সেইরূপ ধর্ম্ম।”