আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প/ডম্বরু পণ্ডিত

ডম্বরু পণ্ডিত

চার্য রোহিত তাঁর শিষ্য ডম্বরুকে বললেন, বৎস, তুমি নিখিল বিদ্যায় পারদর্শী হয়েছ, স্নাতক হবার পরেও এখানে দশ বৎসর স্নাতকোত্তর গবেষণা করেছ, তোমার যৌবনও উত্তীর্ণ প্রায়। আর আমার কাছে বৃথা কালক্ষেপ করে লাভ কি? এখন তুমি এই ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গার্হস্থ্যে প্রবেশ কর।

 ডম্বরু প্রণিপাত করে রোহিতের চরণে একটি ক্ষুদ্র সুবর্ণখণ্ড রেখে বললেন, গুরুদেব, আমি অতি দরিদ্র, এই যৎকিঞ্চিৎ দক্ষিণা গ্রহণ করে আমাকে কৃতার্থ করুন।

 শিষ্যের মস্তকে করার্পণ করে রোহিত প্রসন্নবদনে বললেন, ওহে ডম্বরু তুমি পঁচিশ বৎসর আমার যে সেবা করেছ তাই প্রচুর দক্ষিণা, অর্থে আমার প্রয়োজন নেই। আমি জানি তুমি দরিদ্র, এই সুবর্ণখণ্ড তোমার পথের সম্বল হ’ক।

 ডম্বরু বললেন, গুরুদেব, আপনার দয়ার সীমা নেই। যাত্রার পূর্বে আপনার কাছে আরও কিঞ্চিৎ বিদ্যা ভিক্ষা চাচ্ছি।

 রোহিত সহাস্যে বললেন, বৎস, নিমজ্জিত কুম্ভের ন্যায় তুমি বিদ্যায় পরিপ্লুত হয়েছ, তোমার অন্তরে আর বিন্দুমাত্র ধারণের স্থান নেই। এখন কোনও গুণবান নৃপতিকে তুষ্ট করে তাঁর সভাকবি বা সভাপণ্ডিত হও। কিন্তু নির্বোধ আত্মগর্বী লোকের সংশ্রবে থেকো না, তাদের দানও নিও না।

 ডম্বরু নতমস্তকে যুক্তকরে বললেন, গুরুদেব, আমাকে একটি উপাধি দেবেন না?

 —কি উপাধি তুমি চাও?

 —যদি যোগ্য মনে করেন তবে কৃপা করে আমাকে বিশ্ববিদ্যোদধি উপাধি দিন।

 রোহিত হাস্য করে বললেন, তথাস্তু। হে পণ্ডিত ডম্বরু বিশ্ববিদ্যোদধি, তোমার সর্বত্র জয় হ’ক। দেবী সরস্বতী তোমাকে রক্ষা করুন, দেবগুরু বৃহস্পতি তোমাকে সুবুদ্ধি দিন।


থে যেতে যেতে ডম্বরু একটি প্রশস্তি রচনা করলেন। কিছু দিন পর্যটনের পর তিনি শুনলেন কাশীরাজ বিতর্দন অতি গুণবান নৃপতি। তাঁরই আশ্রয়ে বাস করবেন এই স্থির করে ডম্বরু রাজসভায় উপস্থিত হয়ে এই প্রশস্তি পাঠ করলেন—

চন্দ্র সূর্য ম্লান তব যশের প্রভায়,
পরাজিত শত্রু কুল ছটিয়া পালায়।
দেববৃন্দ হতমান নিরানন্দ অতি,
অসূয়ায় শয্যাগত ইন্দ্র সুরপতি।
উর্বশী মেনকা রম্ভা ছাড়ি স্বর্গধাম
তোমারে ঘিরিয়া নৃত্য করে অবিরাম।
পদ্মালয়া করেছেন তোমারে বরণ,
একাকী বৈকুণ্ঠে হরি করেন ক্রন্দন।
ডম্বরু পণ্ডিত আমি গাহি তব জয়,
মহারাজ, মোর প্রতি কিবা আজ্ঞা হয়?

 কাশীরাজ বিতর্দন প্রীত হয়ে বললেন, বাঃ, অতি সুন্দর প্রশস্তি। কোষপাল, এই বিপ্রকে এক শত স্বর্ণমুদ্রা দাও।

 ডম্বরু মাথা নেড়ে বললেন, না মহারাজ, নির্বোধ আত্মগর্বী লোকের দান আমি নিতে পারি না।

 আশ্চর্য হয়ে রাজা বললেন, নির্বোধ আত্মগর্বী বলছ কাকে?

 —আপনাকে। আমার প্রশস্তিতে যে উৎকট অত্যুক্তি আছে তা আপনি অম্লানবদনে মেনে নিয়েছেন।

 অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বিতর্দন বললেন, নির্বোধ আত্মগর্বী তুমি নিজে। যদি ব্রাহ্মণ না হতে তবে ধৃষ্টতার জন্য তোমাকে শূলে চড়াতাম। কোষপাল, এক রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে এই গণ্ডমূর্খকে বিদায় কর।

 মুদ্রা না নিয়েই ডম্বরু কাশীরাজসভা ত্যাগ করলেন। তার পর বহু দিন পর্যটন করে বৎসরাজধানী কৌশাম্বী নগরীতে উপস্থিত হলেন এবং বৎসরাজ পুরঞ্জয়ের সভায় গিয়ে পূর্ববৎ প্রশস্তি পাঠ করলেন।

 পুরঞ্জয় বললেন, অতি উত্তম রচনা। কোষপাল, এই পণ্ডিতপ্রবরকে এক শত স্বর্ণমুদ্রা দাও।

 ডম্বরু পূর্ববৎ মাথা নেড়ে বললেন, না মহারাজ, নির্বোধ আত্মগর্বীর দান আমি নিতে পারি না, গুরুদেবের নিষেধ আছে। আমার প্রশস্তিতে যে উৎকট চাটুবাক্য আছে তা আপনি বিনা দ্বিধায় মেনে


 ক্রুদ্ধ হয়ে পুরঞ্জয় বললেন, ওহে দ্বিজগদর্ভ, দেবতা রাজা আর প্রণয়িনীর স্তুতিতে অতিরঞ্জন থাকেই, তা অলংকারশাস্ত্রসম্মত। আমি তোমার কবিত্বই বিচার করেছি, সত্যাসত্য গ্রাহ্য করি নি। কোষপাল, এই কাণ্ডজ্ঞানহীন মূর্খ ব্রাহ্মণকে এক রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে বিদায় কর।

 দক্ষিণা না নিয়েই ডম্বরু প্রস্থান করলেন। অনেক দিন পরে তিনি দশার্ণ দেশে উপস্থিত হলেন এবং সেখানকার রাজা উদায়ুধের সভায় গিয়ে পূর্ববৎ প্রশস্তি পাঠ করলেন।

 উদায়ুধ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ওহে চাটুকার মিথ্যাভাষী ব্রাহরণ, ব্যাজস্তুতি দ্বারা তুমি আমার অপমান করেছ। দূর হও রাজ্য থেকে।

 উৎফুল্ল হয়ে ডম্বরু বললেন, সাধ্য সাধন! মহারাজ, আপনার জয় হ’ক, আপনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, আমার প্রশস্তিতে যে অত্যুক্তি আছে তা মেনে নেন নি। আপনি নির্বোধ নন, আত্মগর্বীও নন, তবে উদ্ধত বটে। আমি আপনারই আশ্রয়ে বাস করব। আমার সংসারযাত্রার জন্য যথোচিত বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিন এবং একটি সুলক্ষণা সুপাত্রীও যোগাড় করে দিন যাকে বিবাহ করে আমি গৃহী হতে পারি।

 অট্টহাস্য করে উদায়ুধ বললেন, হে পণ্ডিতমূর্খ, তোমার স্পর্ধা কম নয় যে আমাকে পরীক্ষা করতে এসেছ! তোমার তুল্য ধৃষ্ট কপটভাষী পুরুষকে আমি আশ্রয় দিতে পারি না। কোষপাল, দশ রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে এই উন্মাদকে বিদায় কর।

 ডম্বরু মুদ্রা নিলেন না।


ক্ষুব্ধ ডম্বরু আবার পথ চলতে লাগলেন। তাঁর সম্বল সেই ক্ষুদ্র সুবর্ণখণ্ড বিক্রয় করে যে অর্থ পেয়েছিলেন তা নিঃশেষ হয়ে গেছে। অপরাহ্ণকালে অত্যন্ত শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে তিনি মালব রাজ্যে উপস্থিত হলেন। শিপ্রা নদীর তীরে এসে ডম্বরু ভাবতে লাগলেন, অহো দূরদৃষ্ট! রাজাদের পরীক্ষার জন্য আমি যে উপায় অবলম্বন করেছিলাম তা বিফল হয়েছে, দুই রাজা নির্বোধ প্রতিপন্ন হয়েছে, তৃতীয় রাজা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও অকারণে আমার প্রতি বিমুখ হয়েছেন। এখন কি করা যায়? হে দেবী সরস্বতী, আমাকে রক্ষা কর।

 নদীতীরে উপবিষ্ট হয়ে ডম্বরু ব্যাকুল মনে বাগ্‌দেবীকে ডাকতে লাগলেন। সহসা শুনতে পেলেন, মধুর কণ্ঠে কে বলছে— দ্বিজবর, আপনি কি বিপদাপন্ন?

 চমকিত হয়ে ডম্বরু দেখলেন, এক সদ্যঃস্নাতা সিক্তবসনা সুন্দরী তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করে ডম্বরু বললেন, ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে! আমাকে রক্ষা কর।

 বীণানিক্বণের ন্যায় হাস্য করে সুন্দরী বললেন, দেবী টেবী নই, আমি সামান্যা শিল্পিনী। আমার নাম শিলীন্ধ্রী, রাজপুরীর অঙ্গনাদের জন্য পুষ্পালংকার রচনা করে জীবিকা নির্বাহ করি। নদীতে স্নান করে উঠে দেখলাম আপনি কাতরোক্তি করছেন। দয়া করে বলুন কি হয়েছে।

 ডম্বরু বললেন, আমি বৃহস্পতিকল্প আচার্য রোহিতের প্রিয় শিষ্য পণ্ডিত ডম্বরু বিশ্ববিদ্যোদধি। নিখিল শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে সম্প্রতি গুরুর আশ্রম থেকে হয়েছি। তিনি বলেছেন, বৎস, তুমি বিদ্যায় পরিপ্লুত হয়েছ, এখন কোনও নৃপতিকে তুষ্ট করে তাঁর সভাকবি বা সভাপণ্ডিত হও, কিন্তু নির্বোধ আর আত্মগর্বী লোকের সংশ্রবে থেকো না, তাদের দানও নিও না। আমি একে একে কাশীরাজ বৎসরাজ ও দশার্ণরাজের সকাশে উপস্থিত হয়ে তাঁদের পরীক্ষা করলাম। কিন্তু দেখলাম প্রথম দুই রাজা নির্বোধ আত্মগর্বী, এবং তৃতীয় রাজা বুদ্ধিমান হলেও অত্যন্ত উদ্ধত ও ক্রোধী, আমার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমি এখন নিঃস্ব শ্রান্ত ক্ষুধাতুর, কি করা উচিত স্থির করতে পারছি না।

 শিলীন্ধ্রী বললেন, আপনি দয়া করে আমার কুটীরে এসে বিশ্রাম ও ক্ষুন্নিবৃত্তি করুন। সংকোচ করবেন না, আমি আমার বৃদ্ধা জননীর সহিত বাস করি। কাল অবন্তীরাজের সভায় যাবেন। তিনি অতি বুদ্ধিমান নরপতি, নিশ্চয় আপনার প্রার্থনা পূর্ণ করবেন।

 ডম্বরু বললেন, ভদ্রে, আমি আজই অবন্তীরাজের কাছে গিয়ে তাঁকে পরীক্ষা করতে চাই। যদি সফলকাম হই তবেই তোমার আতিথ্য গ্রহণ করব, নতুবা দেবী সরস্বতীর আরাধনায় প্রায়োপবেশনে প্রাণ বিসর্জন দেব।

 শিলীন্ধ্রী প্রশ্ন করলেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আপনি নৃপতিদের কিরূপে পরীক্ষা করেছিলেন?

 ডম্বরু আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বিবৃত করলেন। শিলীন্ধ্রী স্মিতমুখে বললেন, পণ্ডিতবর, আপনি মিথ্যা প্রিয়বাক্য বলেছিলেন সেজন্য অভীষ্ট ফল পান নি। অবন্তীরাজ তীক্ষ্ণবুদ্ধি গুণগ্রাহী, তাঁর কাছে গিয়ে আপনি সত্যভাষণ করুন, তাঁর দোষ গুণ সবই কীর্তন করুন।

 ডম্বরু বললেন, সুন্দরী, তোমার মন্ত্রণা মন্দ নয়, মিথ্যা স্তুতি করে তিন বার ব্যর্থকাম হয়েছি, এবারে সত্য স্তুতি করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এদেশের রাজার দোষ গুণ আমি কিছুই জানি না, সত্যভাষণ কি করে করব?

 শিলীন্ধ্রী বললেন, ভাববেন না, আমি আপনাকে সমস্ত শিখিয়ে দিচ্ছি। একটু পরেই মহারাজ সান্ধ্যসভায় সমাসীন হবেন, আপনি সেখান চলুন, আপনাকে পথ দেখিয়ে দেব।

 ডম্বরুকে উপদেশ দিতে দিতে কিছু দূর তাঁর সঙ্গে গিয়ে শিলীন্ধ্রী বললেন, বামে ওই কুঞ্জবনের মধ্যে আমার গৃহ। দক্ষিণের ওই পথ রাজভবনের সিংহদ্বারে শেষ হয়েছে, আপনি সোজা চলে যান।

 শিলীন্ধ্রী প্রণাম করে বিদায় নিলেন।


মালবরাজ বিক্রমাদিত্য তাঁর রাজধানী অবন্তী অর্থাৎ উজ্জয়িনীর সভা অলংকৃত করে বসে আছেন। দৈনিক রাজকার্য তিনি প্রাতঃকালীন সভাতেই সম্পন্ন করে থাকেন, এখন এই সান্ধ্যসভায় চিত্তবিনোদনের জন্য সভাসদ্বর্গের সহিত মিলিত হয়েছেন।

 রুক্ষকেশ মলিনবেশ ধূলিধূসরদেহ ডম্বরু রাজসভায় প্রবেশ করলেন, ব্রাহ্মণ দেখে কেউ তাঁকে বাধা দিল না। রাজার সম্মুখে এসে আশীর্বাদের ভঙ্গীতে করতল বিন্যস্ত করে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর বাক্যস্ফূর্তি হল না।

 রাজা বললেন, ব্রাহ্মণ, আপনাকে অত্যন্ত অবসাদগ্রস্ত দেখছি। আপনি হস্ত পদ মুখ প্রক্ষালন করুন, দুগ্ধপান করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন, তার পর সুস্থ হলে আপনার বক্তব্য বলবেন। প্রতিহারী, এই বিপ্রকে বিশ্রামকক্ষে নিয়ে গিয়ে সেবার ব্যবস্থা কর।

 ডম্বরু বললেন, মহারাজ, আমি সংকল্প করেছি, আমার বক্তব্য শুনে যদি আপনি প্রসন্ন হন তবেই জলস্পর্শ করব। অতএব যা বলছি অবধান করুন—

মহাবল মহামতি বিক্রম ভূপতি,
তব রাজ্যে প্রজাগণ সুখে আছে অতি।

শিষ্ট জন দুগ্ধ ঘৃত মৎস্য মাংসে তুষ্ট,
শূলে চড়িয়াছে যত দূরাচার দুষ্ট।
বহ জ্ঞানী গুণী আছে আশ্রয়ে তোমার,
অধিকন্তু কতিপয় আছে চাটুকার।
আছে নবরত্ন তব যশস্বী প্রচণ্ড,
যদিও কয়েক জন শুধু কাচখণ্ড।
আছে তব তিন ভার্যা মহিষী প্রেয়সী,
দশ উপভার্যা নৃত্যগীতপটীয়সী।
তথাপি অবলা বালা শিলীন্ধ্রীর প্রতি
কেন তব লোভ ওহে প্রৌঢ় নরপতি?
বিশ্ববিদ্যোদধি আমি ডম্বরু পণ্ডিত,
নির্ভয়ে কহিয়া থাকি যাহা সমুচিত।
নিবেদন করিলাম লোকে যাহা কয়,
মহারাজ, মোর প্রতি কিবা আজ্ঞা হয়?

 ডম্বরুর ভাষণ শনে বিক্রমাদিত্যের গৌরবর্ণ মখমণ্ডল আরক্ত হল। নবরত্নসভার দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনারা কি বলেন?

 বেতালভট্ট বললেন, মহারাজ, এই বিশ্ববিদ্যোদধির উপযুক্ত পুরস্কার— মস্তকমুণ্ডন, দধিলেপন ও গদর্ভবাহনে বহিষ্কার।

 রাজা আবার প্রশ্ন করলেন, কবি কালিদাস কি বলেন?

 কালিদাস বললেন, মহারাজ, অনুমতি দিন এই ব্রাহ্মণকে আমি অন্তরালে নিয়ে যাই। কিছুক্ষণ পরে আবার এঁকে আপনার সকাশে আনব।

 রাজা অনুমতি দিলেন। ডম্বরুর হাত ধরে কালিদাস বললেন, পণ্ডিত, এস আমার সঙ্গে। মাথা নেড়ে হাত টেনে ডম্বরু বললেন, রাজার অভিপ্রায় না জেনে আমি পাদমেকং ন গচ্ছামি।

 ডম্বরুর কানে কানে কালিদাস বললেন, রাজা প্রসন্ন হয়েছেন। আমার সঙ্গে এস, তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।


দুই দণ্ড কাল অতীত হলে কালিদাস রাজসভায় ফিরে এলেন, তাঁর পশ্চাতে দু জন রাজভৃত্য ডম্বরুকে ধরাধরি করে এনে রাজার সম্মুখে অর্ধশয়ান অবস্থায় রাখল। ডম্বরুর দেহ পরিষ্কৃত, মস্তক তৈলাক্ত, উদর স্ফীত, চক্ষু অর্ধনিমীলিত।

 উদ বিগ্ন হয়ে বিক্রমাদিত্য প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে এই ব্রাহ্মণের?

 কালিদাস বললেন, ভয় নেই মহারাজ। এই ডম্বরু পণ্ডিত পথশ্রমে ও ক্ষুধায় অবসন্ন ছিলেন, তার ফলে এঁর কিঞ্চিৎ বুদ্ধিভ্রংশও হয়েছিল। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধে ইনি স্নান ক’রে নব বস্ত্র প’রে খাদ্য গ্রহণ করেছেন। দীর্ঘ উপবাসের পর গুরুভোজনের জন্য ইনি উত্থানশক্তিহীন হয়ে পড়েছেন। তথাপি এঁর ভাষণের পরিশিষ্টম্বরূপ আরও কিছু আপনাকে এখনই নিবেদন করতে চান।

 —বেশ তো, কি বলতে চান বলুন না।

 —মহারাজ, আকণ্ঠ দধি চিপিটক রম্ভা ল্ড্ডু, ভোজনের ফলে এঁর বাক্‌শক্তিও এখন লোপ পেয়েছে, অথচ নিজের বক্তব্য জানাবার জন্য ইনি ব্যগ্র। যদি অনুমতি দেন তবে এঁর প্রতিনিধি হয়ে আমিই নিবেদন করি।

 বিক্রমাদিত্য অনুমতি দিলেন। ডম্বরুর পূর্ব ইতিহাস বিবৃত করে কালিদাস বললেন, মহারাজ, এই ডম্বরু পণ্ডিত বিশ্ববিদ্যোদধি হলেও অতি সরলমতি এবং লোকব্যবহারে অনভিজ্ঞ। রাজসভায় আসার পূর্বে দুর্দৈবক্রমে শিলীন্ধ্রীর সঙ্গে এঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই ব্যাপিকা প্রগল্‌ভা দুর্বিনীতা রমণী এঁকে যা শিখিয়েছে তাই ইনি শুক পক্ষীর ন্যায় আবৃত্তি করেছেন।

 রাজা বললেন, ডম্বরু তাঁর ভ্রম বুঝতে পেরেছেন?

 —মহারাজ, ডম্বরু বলতে চান, আপনার সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান না থাকায় শিলীন্ধ্রীর বাক্যই উনি মেনে নিয়েছিলেন। এখন উদরপূর্তির পর ইনি বুঝেছেন যে পরপ্রত্যয়ে চালিত হওয়া মূঢ়বুদ্ধির লক্ষণ। অতএব ইনি আপনার আশ্রয়ে থেকে আপনার সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করে যথার্থ প্রশস্তি রচনা করতে চান। আপনি কৃপা করে ডম্বরুর প্রার্থনা পূরণ করুন, এঁকে অন্যতম সভাসদের পদ দিন।

 —কোন্ কর্মের ইনি যোগ্য?

 —মহারাজ, আপনার সভায় বিদুষক নেই, ডম্বরুকে বিদূষক নিযুক্ত করুন।

 —বলেন কি! ইনি তো শুষ্ককাষ্ঠতুল্য নীরস, কৌতুকের কিছমাত্র বোধ আছে মনে হয় না।

 —মহারাজ, কৌতুক উৎপাদনের সহজাত শক্তি এঁর আছে, নিজের অজ্ঞাতসারেই ইনি আপনার এবং এই রাজসভার সকলের মনোরঞ্জন করতে পারবেন, যেমন আজ করেছেন।

 রাজা সহাস্যে বললেন, উত্তম প্রস্তাব। ওহে ডম্বরু পণ্ডিত, তোমাকে বিদুষকের পদ দিলাম। মন্ত্রী, কবি কালিদাসের সঙ্গে পরামর্শ করে তুমি ডম্বরুর জন্য উপযুক্ত বৃত্তি ও বাসগৃহের ব্যবস্থা করে দাও।

 এতক্ষণে ডম্বরু কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ করলেন। চক্ষু উন্মীলিত করে হাতে ভর দিয়ে উঠে বললেন, মালবপতি মহামতি বিক্রমাদিত্যের জয়! মহারাজ, আমার আর একটি প্রার্থনা আছে। গুরুদেব আমাকে গৃহী হতে বলেছেন, অতএব আমার জন্য একটি সুলক্ষণা সৎকুলোদ্ভবা সুবিনীতা সসুপাত্রীর সন্ধানের আজ্ঞা হ’ক।

 বিক্রমাদিত্য তাঁর দণ্ডনায়ককে সম্বোধন করে বললেন, ওহে বীরভদ্র, এই ব্রাহ্মণের জন্য একটি সুপাত্রীর সন্ধান কর। আর, শিলীন্ধ্রীনাম্নী যে রমণী আমার মহিষীদের জন্য পুষ্পালংকার রচনা করে, তাকে রাজনিন্দার অপরাধে দণ্ড দাও — মস্তকমুণ্ডন, দধিলেপন, এবং গর্দভারোহণে বহিষ্কার।

 ব্যাকুল হয়ে ডম্বরু বললেন, মহারাজ, বুদ্ধিহীনা অবলা সরলা বালার অপরাধ মার্জনা করুন।

 রাজা বললেন, ওহে বীরভদ্র, এই ডম্বরু পণ্ডিত যদি সেই দুর্বিনীতা নারীর পাণিগ্রহণ করেন তবে তাকে নিষ্কৃতি দেবে।

 ডম্বরু পাণিগ্রহণ করেছিলেন।

১৮৭৮