আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প/দুই সিংহ

দুই সিংহ

বেচারাম সরকার খুব ধনী লোক, যুদ্ধের সময় কনট্রাক্টরি করে প্রচুর রোজগার করেছেন। এখন তাঁর কারবার বিশেষ কিছু নেই, কিন্তু তার জন্যে খেদও নেই। বেচারামের লোভ অসীম নয়, তিনি থামতে জানেন। যা জমিয়েছেন তাতেই তিনি তুষ্ট, বরং ব্যবসার ঝঞ্ঝাট আর পরিশ্রম থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে এখন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।

 বেচারাম সুশিক্ষিত নন। তাঁর পত্নী সুবালা সেকেলে পাড়াগেঁয়ে মহিলা, একটু আধটু গল্পের বই পড়েন, তাও সব বুঝতে পারেন না। তাঁদের দুই সন্তান সুমন্ত আর সুমিত্রা কলেজে পড়ছে, তাদের রুচি আধুনিক, বাপ-মায়ের কথাবার্তা আর চালচলনে লজ্জা পায়। তারা স্পষ্টই বলে— বাবা কেবল টাকাই রোজগার করেছেন, শুধু পঞ্জাবী গুজরাটী মারোয়াড়ী আর বড়-সায়েব ছোট-সায়েবদের সঙ্গে মিশেছেন, কালচার কৃষ্টি সংস্কৃতি কাকে বলে জানেন না। আর মা তো কেবল সেকরা আর গহনা আর গোছা গোছা পান আর জরদা-সুরতি নিয়েই আছেন। বাবা, তুমি তোমার ওই সেকেলে ঝোলা গোঁফটা কামিয়ে ফেল, চুল ব্যাক-ব্রশ করতে শেখ। এখনও তো তেমন বুড়ো হও নি, একটু স্মার্ট হও। আর মা, তোমার দাঁতের দিকে তো চাওয়া যায় না, পান-দোক্তা খেয়ে আতা-বিচির মতন কালো করেছ। সব তুলে ফেলে নতুন দাঁত বাঁধাও। আর তো বাবার কাজের চাপ নেই, এখন তোমরা দুজনে চালচলন বদলাও, সভ্য সমাজে যাতে মিশতে পার তার চেষ্টা কর।

 বেচারাম আর সুবালা অতি সুবোধ বাপ-মা। ছেলেমেয়ের কথা শুনে হেসে বললেন, বেশ তো, এতদিন আমরা তোদের মানুষ করেছি, লেখাপড়া শিখিয়েছি, এখন তোরাই আমাদের তালিম দিয়ে সভ্য করে নে।

 বাপ-মাকে অভিজাত সভ্য সমাজের যোগ্য করবার জন্যে ছেলেমেয়ে উঠে-পড়ে লেগে গেল। বিখ্যাত ক্লাব ‘সজ্জন সংগতি’র নাম আপনারা শুনে থাকবেন। তার সেক্রেটারি কপোত গুহ বার-অ্যাট-ল আর তাঁর স্ত্রী শিঞ্জিনী গুহর সঙ্গে সুমন্ত আর সুমিত্রার আলাপ আছে। দুজনে গুহ দম্পতিকে ধরে বসল তাঁরা যেন বেচারাম আর সুবালাকে পালিশ করবার ভার নেন। কপোত আর শিঞ্জিনী সানন্দে রাজী হলেন এবং বেচারামের বাড়িতে ঘন ঘন আসতে লাগলেন। কর্তার তালিমের ভার মিস্টার গুহ আর গিন্নীর ভার মিসিস গুহ নিলেন। বেচারাম কৃপণ নন, নিজেদের শিক্ষার জন্যে উপযুক্ত মাসিক দক্ষিণার প্রস্তাব করলেন। কপোত গুহ প্রথমে ভদ্রোচিত কুণ্ঠা প্রকাশ করে অবশেষে নিতে রাজী হলেন। ঘর সাজানো, খাবার ব্যবস্থা, পোশাক, গহনা, কথাবার্তার কায়দা, সব বিষয়েই সংস্কারের চেষ্টা হতে লাগল। বেচারাম গোঁফহীন হলেন, ব্যাক-ব্রশ করলেন, বাড়িতে ধুতির বদলে ইজার পরতে লাগলেন। কিন্তু সুবালা কিছুতেই পানদোক্তা ছাড়লেন না, দাঁত বাঁধাতেও রাজী হলেন না। শিঞ্জিনী বার বার সতর্ক করে দিলেও সুবালার গ্রাম্য উচ্চারণ দূর হল না।


ম্প্রতি বিম্বিসার রোডে বেচারামবাবুর প্রকাণ্ড বাড়ি হয়েছে, তার প্ল্যান কপোত গুহই আগাগোড়া দেখে দিয়েছেন। গৃহপ্রবেশ হয়ে যাবার কিছুদিন পরে সামন্ত বলল, বাবা, এবারে বাড়িতে একটা পার্টি লাগাও। তোমার আত্মীয় কুটুম্ব বড়-সায়েব ছোট-সায়েব লোহাওয়ালা সিমেণ্টওয়ালা ওরা তো সেদিন চর্ব্য চূষ্য ভোজ খেয়ে গেছে, ওদের ডাকবার দরকার নেই। পার্টিতে শুধু বাছা বাছা লোক নিমন্ত্রণ কর।

 বেচারাম বললেন, আমার তো বাপ, রাজা-রাজড়া আর বনেদী লোকের সঙ্গে আলাপ নেই, গায়ে পড়ে নিমন্ত্রণ করতেও পারি না। দু-একজন মন্ত্রী-উপমন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় আছে, তাঁদের বলতে পারি। গুহ সায়েব কি বলেন?

 কপোত গুহ বললেন, অ্যারিস্টোক্রাটদের এখন নাই বা ডাকলেন, দিন কতক পরে তারা নিজেরাই আপনার সঙ্গে আলাপ করতে ব্যস্ত হবে। আমি বলি কি, বাড়িতে নামজাদা হোমরাচোমরা সাহিত্যিকদের একটা সম্মিলন করুন, জাঁকালো টি-পার্টি। যদি দু-একটি সিংহ আনবার ব্যবস্থা হয় তবে সকলেই খুব আগ্রহের সঙ্গে আসবেন।

 —বলেন কি মিস্টার গুহ, সিংহ কোথায় পাব?

 —সিংহ বুঝলেন না? যাকে বলে লায়ন। অর্থাৎ খুব নামজাদা গুণী লোক, যাকে সবাই দেখতে চায়।

 সুমন্ত বলল, লায়নের চাইতে লায়নেস আরও ভাল। যদি দু-একটি এক নম্বরের সিনেমা স্টার আনতে পারেন, এই ধরুন হ্লাদিনী মণ্ডল আর মরালী ব্যানার্জি—

 কপোত গুহ মাথা নেড়ে বললেন, ঘরোয়া পার্টিতে ও রকম সিংহিনী আনা চলবে না, আমাদের সমাজ এখনও অতটা উদার হয় নি। তা ছাড়া সাহিত্যিকদের মধ্যে বুড়ো অনেক আছেন, তাঁরা একটু লাজুক, হয়তো অস্বস্তি বোধ করবেন। সাহিত্যিক সিংহিনী পাওয়া গেলে ভাল হত, কিন্তু এখন তাঁরা দুর্লভ। কবে পার্টি দিতে চান?

 সুমন্ত আর সুমিত্রা বলল, সরস্বতী পুজোর দিন পার্টি লাগান, বেশ হবে।

 কপোত গুহ বললেন, উঁহু, সেদিন চলবে না, সাহিত্যিক সুধীদের নানা জায়গায় বাণীবন্দনায় যেতে হবে। দু-তিন দিন পরে করা যেতে পারে।

 বেচারাম বললেন, বেশ, পঁচিশে জানুআরি হল রবিবার, সেই দিনই পার্টি দেওয়া যাক। কাকে কাকে ডাকবেন?

 —শিঞ্জিনীর সঙ্গে পরামর্শ করে ফর্দ করব। বেশী নয়, জন পঁচিশ-ত্রিশ হলেই বেশ হবে। এখন যাঁদের নাম মনে পড়ছে বলি শুনুন। বটেশ্বর সিকদার আর দামোদর নশকর গল্পসরস্বতী এঁরাই হলেন এখনকার লিটেরারি লায়ন, এই দুই সিংহকে আনতেই হবে।

 সুমিত্রা বলল, ওঁদের দুজনের বনে না শুনেছি।

 —তাতে ক্ষতি হবে না, এখানে পার্টিতে এসে তো ঝগড়া করতে পারবেন না। তার পর গিয়ে রাজলক্ষী দেবী সাহিত্যভাস্বতীকে বলতে হবে, উনি সিংহিনী না হলেও ব্যাঘ্রিনী বটেন। সেকেলে আর একেলে কবি গোটা চারেক হলেই চলবে, কবিদের আকর্ষণ গল্পওয়ালাদের চাইতে ঢের কম। প্রগামিণী পত্রিকার সম্পাদক অনুকূল চৌধুরী মশায়কে সভাপতি করা যাবে। আর কালাচাঁদ চোঙদারকে তো বলতেই হবে।

 সুমন্ত প্রশ্ন করল, তিনি আবার কে?

 —জান না? দুন্দুভি পত্রিকার সম্পাদক।

 সুমিত্রা বলল, সেটা তো শুনেছি একটা বাজে পত্রিকা।

 —মোটেই বাজে নয়, বিস্তর পাঠক। প্রতি সংখ্যায় বাছা বাছা নামজাদা লেখকদের গালাগাল দেওয়া হয়, লোকে খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়ে।

 —পাঠকরা রাগ করে না?

 —রাগ করবে কেন। নামী লোকের নিন্দে সকলেরই ভাল লাগে। সেকালে যে সব পত্রিকা রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করত তাদের বিস্তর পাঠক জুটত। কবির ভক্তরাও পড়ে বলত, হে হে হে, কি মজার লিখেছে দেখ! তবে কালাচাঁদ চোঙদারের একটা প্রিনসিপ্‌ল আছে, ছোটখাটো লেখকদের গ্রাহ্য করে না, আর যে সব বড় বড় লেখক নিয়মিত বার্ষিক বৃত্তি দেন তাঁদেরও রেহাই দেয়।

 —বার্ষিক বৃত্তি কি রকম? ব্ল্যাকমেল নাকি?

 —তা বলতে পার। শুনেছি দামোদর নশকর প্রতি বৎসর পূজোর সময় কালাচাঁদকে আড়াই শ টাকা দেন। উনি যে গল্পসরস্বতী উপাধি পেয়েছেন তা কালাচাঁদেরই চেষ্টায়। বটেশ্বর সিকদার একগুঁয়ে কঞ্জুস লোক, এক পয়সা দেন না, তাই দুন্দভির প্রতি সংখ্যায় তাঁকে গালাগাল খেতে হয়। তবে কালাচাঁদ উপকারও করে। জন তিন-চার ছোকরা কতকগুলো অশ্লীল বই লিখেছিল, কিন্তু তেমন কাটতি হয় নি। তারা কালাচাঁদকে বলল, দয়া করে আপনার পত্রিকায় আমাদের ভাল করে গালাগাল দিন, আমাদের লেখা থেকে চয়েস প্যাসেজ কিছু কিছু তুলে দিন। বেশী দেবার সামর্থ্য আমাদের নেই, পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি, তাই নিন সার। কালাচাঁদ রাজী হল, তার ফলে সেই বইগুলোর কাটতি খুব বেড়ে গেল। তার পর গিয়ে দামামা পত্রিকার সম্পাদক গোরাচাঁদ সাঁপুইকেও বলতে হবে। সে ছোকরা ব্ল্যাকমেল নেয় না, তবে বড়লোক লেখকদের টাকা খেয়ে তাদের রাবিশ রচনার প্রশংসা ছাপে, তা ছাড়া প্রতি সংখ্যায় কালাচাঁদকে চুটিয়ে গাল দেয়। যাক ও সব কথা। আমি কালকেই ফর্দ করে ফেলব—কাদের ডাকতে হবে, কি খাওয়ানো হবে, বসবার কি রকম ব্যবস্থা হবে—সবই স্থির করে ফেলব।

নির্দিষ্ট দিনে প্রীতিসম্মিলন বা টি-পার্টির আয়োজন হল। বাড়ির সামনের মাঠে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে, ছোট ছোট টেবিলের চার পাশে চেয়ার সাজিয়ে নিমন্ত্রিতদের চা খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। শামিয়ানার এক দিকে বেদীর উপর সভাপতি অনুকূল চৌধুরী, দুই সিংহ অর্থাৎ প্রধান অতিথি বটেশ্বর আর দামোদর,, রাজলক্ষ্মী দেবী, এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট লোক বসবেন। সভায় বক্তৃতা বিশেষ কিছু হবে না, শুধু বেচারাম অভ্যাগতদের স্বাগত জানাবেন, তার পর অনুকূল চৌধুরী গৃহস্বামীর কিঞ্চিৎ গুণকীর্তন করে তাঁর সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দেবেন। আশা আছে বটেশ্বর আর দামোদরও বেচারামের কৃতিত্ব আর বদান্যতা সম্বন্ধে কিছু বলবেন।

 সভাপতি এবং দুই সিংহের জন্যে তিনটি ভাল চেয়ার আনা হয়েছে, একটি মাইসোরের চন্দন কাঠের আর দুটি কাশ্মীরী আখরোট অর্থাৎ ওআলনট কাঠের। প্রথম চেয়ারটির পিছন দিকে একটু বেশী উঁচু আর নকশাদার, সেজন্যে খুব জাঁকালো দেখায়। কপোত গুহ একই রকম তিনটি চেয়ার আনবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যোগাড় করতে পারেন নি। শামিয়ানার নেপথ্যে চড়কডাঙা স্ট্রিংব্যাণ্ডের তিনজন বেহালাবাদক মোতায়েন আছে। তারা খুব আস্তে বাজাবে, যাতে অতিথিদের কথাবার্তার ব্যাঘাত না হয়।

 নিমন্ত্রিত লোকেরা ক্রমে ক্রমে এসে পৌঁছলেন। বেচারাম, তাঁর ছেলে-মেয়ে, এবং কপোত আর শিঞ্জিনী গৃহ অতিথিদের সমাদর করে বসিয়ে দিলেন। বেচারাম-গৃহিণী সুবালা কিছুতেই এই দলের মধ্যে থাকতে রাজী হলেন না, তিনি রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে ফিসফিস করে একটু আলাপ করেই সরে পড়লেন এবং মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। প্রায় সকলের শেষে বটেশ্বর সিকদার আর দামোদর নশকর উপস্থিত হলেন। দৈবক্রমে এঁদের আগমন এক সঙ্গেই হল, প্রত্যেকের সঙ্গে গুটি কতক কমবয়সী খাস ভক্তও এল। বেচারাম আর কপোত সসম্ভ্রমে অভিনন্দন করে দুই মহামান্য সিংহকে শামিয়ানার ভিতরে নিয়ে গেলেন।

 সভাপতি অনুকূল চৌধুরী আগেই এসেছিলেন। তিনি একটি কাশ্মীরী চেয়ারে বসলেন। বটেশ্বর বয়সে বড়, সেজন্য কপোত গুহ তাঁকে চন্দন কাঠের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। সুমিত্রা তাঁর গলায় একটি মোটা রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিল। পাশের কাশ্মীরী চেয়ারটা দেখিয়ে কপোত গুহ দামোদরকে বললেন, বসতে আজ্ঞা হক। দামোদর বসলেন না, মুখ উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কপোত গুহ আবার বললেন, দয়া করে বসুন সার। দামোদর ভ্রূকুটি করে উত্তর দিলেন, ও চেয়ারে আমি বসতে পারি না।

 সভায় একটা গঞ্জন উঠল। জন কতক অতিথি দুই সিংহের কাছে এগিয়ে এলেন। দুন্দুভি-সম্পাদক কালাচাঁদ চোঙদার বলল, দামোদর বাবু এই দু নম্বর চেয়ারে কিছুতেই বসতে পারেন না, তাতে এঁর মর্যাদার হানি হবে, ইনিই এখনকার সাহিত্যসম্রাট। বটেশ্বরবাবুর প্রতি আমি কটাক্ষ করছি না, তবে আমরা চাই উনি ওই ভাল চেয়ারটি দামোদরবাবুর জন্যে ছেড়ে দিন।

 দামামা-সম্পাদক গৌরচাঁদ সাঁপুই চেচিয়ে বলল, খবরদার বটেশ্বরবাবু উঠবেন না, গট হয়ে বসে থাকুন। এখনকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট আপনিই।

 কালাচাঁদ বলল, ননসেন্স। দামোদরবাবুর উপাধি আছে গল্পসরস্বতী, বটেশ্বরের কি আছে শুনি? ঘোড়ার ডিম।

 গৌরচাঁদ বলল, এই কথা? ওহে ভূপেশ রাজেন অবনী নুরুদ্দিন নবকেষ্ট, এগিয়ে এস তো। আমরা ছ জন ছোট-গাল্পিক, বড়-গাল্পিক, রম্য-লিখিয়ে, কবি, সম্পাদক আর সমালোচক— আমরা নিখিল বাঙালী সাহিত্যিকবর্গের প্রতিনিধিরূপে অত্র সভায় অস্মিন মুহূর্তে শ্রীযুক্ত বটেশ্বর সিকদার মহাশয়কে উপাধি দিলাম—অপ্রতিদ্বন্দ্বী গল্পশিল্পসম্রাট। যার সাহস আছে সে আপত্তি করুক। আমার দস্তানা নেই, এই বাঁ পায়ের মোজাটা খুলে ফেলে চ্যালেঞ্জ করছি, আমার সঙ্গে যে লড়তে চায় সে মোজা তুলে নিক। সবতাতে আমি রাজী আছি—ঘুষি, গাঁট্টা, লাঠি, থান ইট, যা চাও।

 মোজা তুলে নিতে কেউ এগিয়ে এল না। গৌরচাঁদ বলল, নুরু ভাই, জোরসে শাঁখ বাজা। নুরুদ্দিনের মুখ থেকে বিজয়সসূচক কৃত্রিম শঙ্খধ্বনি নির্গত হল—পোঁ-ও-ও।

 কালাচাঁদ চিৎকার করে বলল, বটেশ্বরবাবু, ভাল চান তো এখনই চেয়ার ভেকেট করুন। কি, উঠবেন না? ও দামোদরবাবু দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন, আপনার হকের আসন দখল করুন, এই চেয়ারটাতেই আপনি বসে পড়ুন।

 দামোদর বললেন, ওতে বসবার জায়গা কই?

 কালাচাঁদ আর তার দু জন বন্ধু দামোদরকে ধরে বটেশ্বরের কোলের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল— খবরদার উঠবেন না, আমরা আপনাকে ব্যাক করব। এই বুড়ো বটেশ্বর কতক্ষণ আপনার আড়াইমনী বপু ধারণ করতে পারে দেখা যাক।

 হট্টগোল আরম্ভ হল। রাজলক্ষ্মী সাহিত্যভাস্বতী বললেন, ছি ছি ছি, আপনাদের লজ্জা নেই, ছোট ছেলের মতন ঝগড়া করছেন! দু জনেই নেমে পড়ুন চেয়ার থেকে, আসুন আমরা সবাই চায়ের টেবিলে গিয়ে বসি।

 কালাচাঁদ বলল, কারও কথা শুনবেন না দামোদরবাবু, গ্যাঁট হয়ে বটেশ্বরের কোলে বসে থাকুন।

 গৌরচাঁদ বলল, ঠেলা মেরে দামোদরকে ফেলে দিন বটেশ্বরবাবু, চিমটি কাটুন, কাতুকুতু দিন।

 সমাগত অতিথিদের এক দল বটেশ্বরের পক্ষে আর এক দল দামোদরের পক্ষে হল্লা করতে লাগল। অবশেষে মারামারির উপক্রম হল। অনুকূল চৌধুরী হাত জোড় করে দুই দলকে শান্ত করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনও ফল হল না।

 কপোত গুহ চুপি চুপি বেচারামকে বললেন, গতিক ভাল নয়, পুলিসে খবর দেওয়া যাক, কি বলেন?

 সুমন্ত বলল, উঁহু, বরং ফায়ার ব্রিগেডে টেলিফোন করি, হোজ পাইপ থেকে জলের তোড় গায়ে লাগলে দুই সিংগি আর সব কটা শেয়াল ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

 সুমিত্রা বলল, ও সবের দরকার নেই, বিশ্রী একটা স্ক্যাণ্ডাল হবে। লড়াই থামাবার ব্যবস্থা আমি করছি। এই বলে সে সভা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির ফটকের বাইরে গেল।


বেচারাম সরকারের বাড়ির পাশে একটা খালি জমি আছে, পাড়ার জয়-হিন্দ ক্লাবের ছেলেরা সেখানে পাণ্ডাল খাড়া করে খুব জাঁকিয়ে বাণীবন্দনা করেছে। তিন দিন আগে পূজো চুকে গেছে, কিন্তু স্ফূর্তির জের টানবার জন্যে এ পর্যন্ত বিসর্জন হয় নি, আজ সন্ধ্যায় তার আয়োজন হচ্ছে। পাণ্ডালের ভিতর থেকে দেবীমূর্তি বার করা হয়েছে। লাউড স্পীকারটা মাটিতে নামানো হয়েছে, কিন্তু বিজলীর তার খোলা হয় নি, এখনও একটানা রেকর্ড-সংগীত উদ্‌গিরণ করছে। সামনে একটা লরি দাঁড়িয়ে আছে। গুটিকতক ছেলে-মেয়ে মুখোশ পরে তৈরী হয়ে আছে, তারা চলন্ত লরির উপর দেবীমূর্তির সামনে নাচবে।

 এই জয়-হিন্দু, ক্লাবের পূজোয় বেচারামবাবু মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছেন, অন্য রকমেও অনেক সাহায্য করেছেন, সেজন্যে তাঁর বাড়ির সবাইকে ক্লাবের ছেলেরা খুব খাতির করে। সেক্রেটারি প্রাণধন নাগের কাছে এসে সুমিত্রা বলল, দেখুন, বাড়িতে মহা বিপদ, আপনাদের সাহায্য চাচ্ছি—

 ব্যস্ত হয়ে প্রাণধন বলল, কি করতে হবে হুকুম করুন, সব তাতে রেডি আছি, আমরা যথাসাধ্য করব, যাকে বলে আপ্রাণ।

 সুমিত্রা সংক্ষেপে জানাল, তাদের বাড়ির পার্টিতে যাঁরা এসেছেন তাঁদের মধ্যে জনকতক গুণ্ডা মারামারির মতলবে আছে। দুই সিংহ অর্থাৎ প্রধান অতিধি একই চেয়ারে বসেছেন, তাঁদের রোখ চেপে গেছে কেউ চেয়ারের দখল ছাড়বেন না। ওঁদের সরিয়ে দেওয়া দরকার, নইলে বিশ্রী একটা কাণ্ড হবে।

 প্রাণধন বলল, ঠিক আছে, আপনি ভাববেন না। আগে আপনার দুই সিংগির গতি করব, তার পর আমাদের বিসর্জন। মা সরস্বতী না হয় ঘণ্টাখানিক ওয়েট করবেন। ওরে ভূতো বেণী মটরা হেবো, জলদি আমার সঙ্গে আয়। নিরঞ্জন সিং, লরিতে স্টার্ট দাও, আমরা এখনই আসছি।

 চারজন অনুচরের সঙ্গে তাড়াতাড়ি শামিয়ানায় ঢুকে প্রাণধন বলল, ও সিংগি মশাইরা, শুনছেন? চেয়ার থেকে নেমে পড়ুন কাইণ্ডলি, কেন লোক হাসাবেন?

 কালাচাঁদ আর গৌরচাঁদ এক সঙ্গে বলল, খবরদার চেয়ার ছাড়বেন না।

 প্রাণধন বলল, বটে? এই ভূতো বেণী মটরা হেবো, এগিয়ে আয় তুরন্ত। সিংগি মশাইরা, যদি নিতান্তই না নামেন তবে দুজনেই চেয়ারের হাতল বেশ শক্ত করে ধরে টাইট হয়ে বসুন।

 নিমেষের মধ্যে প্রাণধনের দল দুই সিংহ সমেত চেয়ারটা তুলে বাইরে এনে লরিতে চাপিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও উঠে পড়ে বলল, চালাও নিরঞ্জন সিং, সিধা আলীপুর চিড়িয়াখানা। লাউড স্পীকারটা তখনও মাটিতে পড়ে গর্জন করছে—অত কাছাকাছি বঁধু থাকা কি ভালো-ও-ও।

 জুএর সামনে এসে লরি থামল। বটেশ্বর আর দামোদরকে খালাস করে প্রাণধন করজোড়ে বলল, কিছু মনে করবেন না মশাইরা। শুনেছি আপনারা বিশ্ববিখ্যাত লোক, শুধু দু বেটা গুণ্ডার খপ পরে পড়ে খেপে গিয়েছিলেন। সবই গেরোর ফের দাদা, কি করবেন বলুন। ঘাবড়াবেন না, আপনাদের ড্রাইভারদের বলা আছে, তারা আধ ঘণ্টার মধ্যে মোটর নিয়ে এসে পড়বে। ততক্ষণ আপনারা একটু গল্প-গুজব করুন, দুটো সুখ দুঃখের কথা ক’ন। আচ্ছা, আসি তবে, নমস্কার।


সিংহসমাগমের অতর্কিত পরিণাম দেখে প্রীতিসম্মিলনের সকলেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। কালাচাঁদ আর গৌরচাঁদ বেগতিক দেখে সদলে সরে পড়ল। অতিথিরাও অনেকে বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন।

 কিন্তু আয়োজন একবারে পণ্ড হল বলা যায় না। অতিথিদের মধ্যে অনুকূল চৌধুরী, রাজলক্ষ্মী দেবী প্রভৃতি চোদ্দ-পনরো জন মাথাঠাণ্ডা স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, তাঁরা রয়ে গেলেন। সকলেই বেচারামবাবুকে আন্তরিক সমবেদনা জানালেন, বটেশ্বর-দামোদরের কেলেঙ্কারি আর কালাচাঁদ-গৌরচাঁদের গুণ্ডামির নিন্দা করলেন, বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নৈরাশ্য প্রকাশ করলেন, মাছের কচুরি, মাংসের চপ, চিঁড়ে ভাজা, কেক সন্দেশ চা প্রচুর খেলেন, তার পর গৃহস্বামীকে ধন্যবাদ এবং আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন।

১৮৭৮