আনন্দ-তুফান/আনন্দময়ীর আবাহন

আনন্দময়ীর আবাহন।
(বোধন।)

একি শুনি, প্রকৃতি-বদনে নিরন্তর?
কহে জীব, কহে বসুন্ধরা, এ কি কথা?
করিতে জীবের শান্তি, শান্তি-বিধায়িনি—দুর্গে!
আসিবে সংসারে নাকি তুমি—অসময়ে?
বড় সাধ হেরিতে মা, রাঙা পা দু’খানি।
বহুদিন এসেছি সংসারে,
শুনি, বরষে বরষে আ’স নাকি তুমি
ভবদারা! নিস্তারিতে গতিহীন জনে?
কিন্তু দেখে না মা তোরে, অন্ধ এ নয়ন মোর।
যদি পাই মা দেখিতে আমি একবার,—
কত খেলা শিখেছি সংসারে আসি’,
দেখাই তা’ তোমারে জননি!
ভালবেসে, রাখিতে যতনে,—
দিয়াছ মায়ার কোলে তুমি;
বড় ভাল বাসে সে আমারে।
কত খেলা দিয়াছে খেলিতে মায়া,
খেলি সে সবারে লয়ে নিরন্তর,—
ক্ষুধা তৃষ্ণা না জ্বালায় আর;

যে ক্ষুধা,—তোমার কাছে থাকি,
অমৃতেও হইত কাতর;—
শান্তি-বারি পিয়া, শান্ত নাহি হ’ত যে পিপাসা।
দিন যায়, নিশি আ’সে যবে,
সুখে ঘুম পাড়ায় আমারে—মায়া;
ভুলে যাই সে সময়, মায়া-ঘোরে
তোমার প্রেমের কথা সব।
আহা! কেমন সুন্দর এ সংসার
রেখেছে সাজায়ে মায়া!
এস না মা ঘরে মোর;
কত ভাল বাসে মায়া,
বিরলে তা’ দেখাই তোমারে।
বলি যদি তারে কভু, “যা’ব মার কাছে,”
কত মতে ভুলায় আমায়।
কহে;—“কোথা যাবি বাবা!
কোথা তুই, কোথা তোর মাতা?
বহুদূর সেই পথ; বড় ক্লেশ, নারিবি যাইতে।
কণ্টক কঙ্কর পথে, শত্রু পদে পদে,
ঘোর বন, অন্ধকারে ভরা;
সিংহ ব্যাঘ্র ফিরে সদা পথে!—
যেও না যেও না যাদুমণি!—

রাখিব যতন করি, কোন ক্লেশ না পাবে এখানে।”
কিন্তু গো মা, কেঁদে উঠে প্রাণ,
যখনি নিরখি তোরে তারা—হৃদি-মাঝে,
অন্ধকার হেরি এ সংসার;
শান্তি সুখ, নকল সকলি—হয় জ্ঞান।
ভয়ঙ্করী হেরি তবে মায়া-পিশাচীরে।
বড় জ্বালা বাজে গো জননি!
সাধ হয়, না রহি সংসারে আর ক্ষণকাল!
সুখ-সুধা না চাহি ভুঞ্জিতে—পৃথিবীর।
কিন্তু, না জানি কোথায় আছ তুমি,
অন্ধ আমি, না পারি খুঁজিতে;
কাঁদি তা’ই মা, মা, ব’লে;—
ঘুমাইলে মায়া, জাগি ‘আমি’;
হাসি খেলি, জাগিলে রাক্ষসী পুনঃ।
যবে ডাকি মা তোমায় মনে মনে,
শুনি অন্তরযামিনি! অন্তর-অন্তরে মোর,—
“কাট মায়ার বন্ধনে,
দেখ খুলিয়া নয়ন, কোলে তুমি
রয়েছ আমার!” এই কথা নিরন্তর;—
মন বলে, বল নাকি তুমি?

না পারি কাটিতে কিন্তু মায়ার বন্ধনে।
যত্ন যদি করি গো জননি! হেরি পুনঃ
অসংখ্য বন্ধনে বাঁধা পদযুগ।
আহা! শুনিলাম যবে, আসিবে
সংসারে তুমি তারা। নিস্তারিতে তা’রে,
কাঁদিছে যে তোমারি লাগিয়া;
শুনিছে যে তোমারি সান্ত্বনা—নিরন্তর।
আশা তা’ই হইয়াছে চিতে,
হেরিব মা তোমারে শঙ্করি—হৃদি মাঝে।
যায় দিন বৎসরপ্রমাণ,—
ক্ষণে ক্ষণে নিরখি স্বপন,—
“এই তুমি! এই তুমি! আমি পদতলে!
ধরিনু ধরিনু পা দু’খানি।” কিন্তু, চেয়ে দেখি,
মায়ার আগার, অন্ধকার, কদাকার সব।
এস মা, দুর্গতিহরা! এস গো ‘সপ্তমি’!
বল মাকে,—‘কাঁদিব না সঙ্গে যেতে তাঁ’র।
খুলিলে মায়ার বাঁধা, যা’ব চলি হাসি,—
নিরখিব তাঁহারে কেবল।
ভালবাসি দেখিতে তাঁহারে,
তাই শুধু দেখিতে বাসনা।’