আফগানিস্থান ভ্রমণ/আমানউল্লা
আমানউল্লা সম্বন্ধে কিছু বলতে যাওয়া ভ্রমণ এ কাহিনীর অন্তর্ভূক্ত নয়। এটা আমি জানি এবং সকলেই অবগত আছেন তবুও আমানউল্লা সম্বন্ধে কিছু বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমানউল্লাকে অসাধারণ মানুষ বলতেই হবে। আমানউল্লা রাজারূপে আমার কাছে অসাধারণ মানুষ নন, মানুষরূপে অথবা সাধারণ মানুষরূপে বিশেষত্ব অর্জন করেছেন। সেই বিশেষত্ব কোন দিক দিয়ে সকলেরই জানবার ইচ্ছা হবে। আমানউল্লার অসাধারণত্ব অতীব নৃতন ধরণের যাহা সহজে সকল মানুষের কল্পনারও বাইরে। বর্তমানে আমানউল্লা ইতালীয় রোমে অবস্থান করছেন। একদা আফগানিস্থান বৃটিশের অধীন ছিল, আমানউল্লাই সেই পরাধীন দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, তারপরও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা আফগানিস্থানে অনেক রকমের কুটনীতির চাল চেলেছে এবং এখনও যে আফগানিস্থান হতে হাত ধুয়ে চলে গেছে বলা চলে না। আফগানিস্থান ও বিদেশীক রাষ্ট্রনৈতিক চালিয়াৎদের হাত থেকে রক্ষা পাবে সেই আশা বৃথা। রাজতন্ত্র ধনতন্ত্র ইত্যাদি বজায় রাখতে হলে আফগানিস্থান বৈদেশিক ধনতান্ত্রিক দেশগুলির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা অসম্ভব। আফগানিস্থানের চারিদিকে যেসকল রাজ্য আছে সেই দেশগুলির মধ্যে শুধু রুশ এবং চীন দেশই গণতান্ত্রিক। অন্য দুই দিকে বর্তমানে যে দুটি দেশ রয়েছে সেই দেশ দুটিতে শুধু ধনতন্ত্র কায়েম নাই, ইচ্ছাতন্ত্রেরও প্রাচুর্য দেখা যায়। অবশ্য পাকিস্থান সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য চলে না। পাকিস্থানের শাসনতন্ত্র এখনও গড়ে উঠে নি। পাকিস্থানে কিরূপ গঠনতন্ত্র হবে। এখনও জানা যায় নি। তবে এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যেহেতু, পাকিস্থান ইণ্ডিয়ারই অংশ ছিল। সেজন্য ইণ্ডিয়াতে যেরূপ শাসনতন্ত্র প্রচলিত হবে পাকিস্থানে ও সেরূপই হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু পারস্যে এখনও যথা পূর্ব্বং তথা পরং ব্যবস্থা। বাহাইদের স্থান পারস্যে নাই, সিয়া এবং সুন্নিতে যে পার্থক্য ছিল অনেকটা এখনও বর্তমান। উন্নতিকামী দল বিধ্বস্ত এবং ধনতান্ত্রিকরা শক্তিশালী।
এরূপ অবস্থায় আফগানিস্থান কোনও প্রকারে স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছে। সেজন্য বর্তমান আফগান সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়া চলে। অবশ্য এর মধ্যে একটি কথা আছে। আফগান সরকার বর্তমানে “বাফার” ষ্টেটের কাজ করে যাচ্ছে। যেমন করেছিল এবং করছে ইউরোপের সুইজারল্যাণ্ড। সুইজারল্যাণ্ড এবং আফগানিস্থানের মধ্যে আর্থিক এবং সামাজিক পার্থক্য আকাশ পাতাল। নিজের দেশকে সুইডিশরা আধুনিক সভ্যতার আওতার মধ্যে এনেছে, আফগানিস্থান পূর্বে যেমন ছিল তেমনি রয়েছে।
আমানউল্লা আফগানিস্থানকে সুইজারল্যাণ্ড পরিণত করতে চেয়েছিলেন, বৃটিশ বৈরী হয়ে তাঁকে দেশত্যাগী করেছিল। আফগানিস্থান যদি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে নিজের নাম অর্জন করতে পারত। তবে ইণ্ডিয়া দ্বিখণ্ডিত হবার সম্ভাবনা ছিল না। বৃটিশ বড়ই চতুর। আমরা যাহা আজি চিন্তা করি বৃটিশ সেই চিন্তা পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে করে।
শোনা যায় আমানউল্লা অল্প বয়সেই ভারতীয় বিপ্লবী-সুলভ-মনোবৃত্তিও অর্জন করেন। আমরা যাকে ধর্ম বলি আমানউল্লা সেই বিষয়টারই সমালোচনা করেন প্রথম। ধর্ম সমালোচনা করে বুঝতে পারেন আমরা যাকে ধর্ম বলি বাস্তবিক পক্ষে তাহা ধর্ম নয়, মতবাদ মাত্র। ধর্ম সম্পূর্ণরূপে এক পৃথক তথ্য, মহম্মদ কথিত কোরাণ মহম্মদের মতবাদ মাত্র, যিশুখৃষ্ট, শ্রীকৃষ্ণ এবং অন্যান্য অবতারগণ যাহা বলেছেন সবই তাদের মতবাদ। মতবাদ অবশ্য পালনীয় বিষয় নয়। হিন্দুর শ্রীকৃষ্ণের কথিত গীতা মেনে চলে, মুসলমানেরা মানে না; তা’বলে মুসলমানেরা কি জাহান্নামে চলে গেছে! এর জন্য কেহই জাহান্নামে যায় না এবং যাবেও না। কিন্তু ধর্ম কেহই পরিত্যাগ করতে পারে না। আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করে কি কোনও মানুষ বাঁচতে পারে? মিথ্যা গল্পে অর্থাৎ মাইথোলজীিতে অনেক কাহিনী আছে যে অমুক লোক এত হাজার বৎসর না খেয়েও বেঁচে ছিলেন। মাইথোলজীির তুলনা সেই ধরণের গালগল্প পুস্তকেই বর্ণিত হয়েছে কিন্তু এটা সত্যকথা, না খেয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। বুদ্ধ কয়েক দিনের জন্য খাদ্য ছেড়ে দেবার পর যখন বুঝতে পেরেছিলেন উপবাস করলে মস্তিস্ক নিক্রিয় হয়ে যায়। তখন তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন। তাঁকে খাদ্য গ্রহণ করতে দেখে তাঁর কয়েকজন শিষ্য তাঁর সংগ পরিত্যাগ করেছিল। এতে তিনি একটুও কাতর হন্ নি।
এই ধরণের অবতারবাদী বিপ্লবাত্মক আলোচনাতেই আমানউল্লার যৌবনের অনেক বৎসর কেটেছিল। আবদুল্লা, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, লালা লাজপত রায়, এই ধরণের বিপ্লবীদের সংগে আমানউল্লা ভাবের আদান-প্রদান করতে পেরেছিলেন।
নূতন চিন্তাধারায় উদ্ভাসিত হয়েই দেখলেন দুইলক্ষ পঞ্চাশ হাজার মাইল রাজ্য বর্বর এবং অশিক্ষিতদের দ্বারা আধুষিত। মোল্লারা পরোক্ষ শাসন এবং শোষণ করছে এবং মোল্লাশ্রেণীর লোক বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে উৎকোচ পেয়ে যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে।
আমানউল্লার পিতা পুরোপুরি বৃটিশের পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ ১৯১৭ খৃঃ অঃ রুশিয়াতে বিপ্লব হবার পর আফগানিস্থানের নিকটস্থ সোভিয়েট ষ্ট্রেটগুলিতে অনেক রকমের আন্দোলন, গোলমাল, মারামারি কাটাকাটি চলতে থাকে। হবিবুল্লা হয়ত ভেবেছিলেন যদি তার রাজ্যেও সেরূপ অঘটন ঘটতে আরম্ভ করে তবে বৃটিশ সরকার এক থাবায় আফগানিস্থান কেড়ে নেবে।
হবিবুল্লার বৃটিশ প্রীতি সকলের সহ্য হয় নি। কতকগুলি তথাকথিত দেশপ্রেমিক লোক বিশেষ করে হবিবুল্লার আত্মীয়েরা তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টায় অগ্রণী হয় এবং নাসেরউল্লাকে শাসকরূপে গ্রহণ করতে মনস্থ করে। নাসেরউল্লা আমীর হবিবুল্লার সাক্ষাৎ ভাই। বোধহয় অর্থাৎ কেহ কেহ মনে করেন নাসেরউল্লা এই হত্যাকার্যে পরোক্ষ সমর্থক ছিলেন।
প্রশ্ন জাগে কেন রাজাকে হত্যা করে রাজভ্রাতাকে রাজ্য দেওয়া হবে। উত্তরে বলা যেতে পারে আফগানিস্থানে অনেক ভারতীয় বিপ্লবী আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাঁরা মনে করেছিলেন যে কোনও প্রকারে যদি আফগানিস্থানে কিছু ঘটাতে পারা যায় তবে ভারতেও বিপ্লবের প্রভাব বৃদ্ধি হবে। মোল্লা শ্রেণীর লোক কিন্তু হবিবুল্লার হত্যার জন্য একটুও উস্কানি দেয় নি, সেজন্য আফগানিস্থানের মোল্লাশ্রেণীকে বৃটিশের স্পাই বলতেও অনেকে কসুর করত না।
হবিবুল্লাকে হত্যা করার পর নাসেরউল্লারই রাজা হবার কথা ছিল কিন্তু আমানউল্লা পিতৃ-সিংহাসন পরিত্যাগ না করে নিজেই সিংহাসন দখল করেন। সেইজন্য অনেকে মনে করেন আমানউল্লাও তার পিতৃহত্যাতে সংযুক্ত ছিলেন। এই প্রকারের ধারণা স্বদেশী এবং বিদেশী কয়েকজনের ধারণা মাত্র। কাবুলের হিন্দুরা এই ধারণাকে একটুও বিশ্বাস করতেন না এবং যখনই হাবিবউল্লার মৃত্যুর কারণ অন্বেষণ করতে কেহ চেষ্টা করছেন সব সময়ই আমানউল্লাকে বাদ দিয়ে কথা বলেছেন।
যখন হাবিবুল্লা নিহত হন তখন আমানউল্লা সহরের বাইরে শিকারে গিয়েছিলেন। আরও একদল লোকের মুখে শুনেছি হবিবুল্লার মৃত্যুর জন্য আমানউল্লাও অনেকটা দায়ী। কারণ তখন দেশের মধ্যে বৃটিশের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করতে চাইছিল হাবিবুল্লা তাদের কঠোর হস্তে দমন করেছিলেন, আমানউল্লা সেই দমনকার্যের পক্ষপাতী ছিলেন না। শুধু তাই নয় হিজ্ হাইনেস্ দি আমীর অফ্ আফগানিস্থান বেশ ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে বিপ্লবের পেছনে মোল্লাইজম নাই সেই বিপ্লব বড়ই মারাত্মক এবং তাকে দমন করা অতীব কঠিন কাজ। হবিবুল্লার হত্যার পর আমানউল্লা নিজেই রাজ্যভার গ্রহণ করেন এবং বিপ্লবীদের সাহায্যে বৃটিশ অধিকৃত উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের পেছনে অভিসন্ধি ছিল। ভারতীয় বিপ্লবীরা আমানউল্লাকে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করেন এবং আফগানিস্থানের বিপ্লবীরা পাঠান অধিকৃত এলাকা উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশ করায়ত্ব করার জন্য বদ্ধপরিকর হন্ কিন্তু এটা জানিবার কথা অবশ্য সকলের কাছে নয়, উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশের লোকের মধ্যে শিক্ষা না থাকায় সেই এলাকার লোক কতকগুলি কমিউনিটিতে বিভক্ত ছিল এবং এক কমিউনিটি অন্য কমিউনিটিকে আক্রমণ করত, অবস্থা ছিল ফিউডেলইজম। ফিউডেলইজমের অন্তর্ভুক্ত যারা তাদের শাসন করা অতি সহজ, কারণ তাদের আত্মরক্ষা করার ক্ষমতাও কম। বৃটিশ প্রচারের ফলে উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশ বিপজ্জনক এলাকাতে পরিগণিত হয়েছিল বটে। কিন্তু যে কোনও অরগেনাইজড্ সৈন্য যে উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশকে করায়ত্ব করার ক্ষমতা রাখত তা বৃটিশ ভাল করেই জানত।
উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশকে ভয়াবহ করে রাখারও একটি কারণ ছিল। সেই কারণ হ’ল ভারতীয় অর্থে কতকগুলি বৃটিশ পণ্টনকে উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশে প্রতিপালিত হবার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় বড় বড় হিন্দু রাজারা তাই মনে করতেন এবং অম্লানবদনে বৃটিশ কার্যাবলী সমর্থন করে যেতেন। উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্থানের দুর্বল আর্থিক অবস্থা এবং অধিবাসীর মানসিক দুরাবস্থা বৃটিশ শাসকশ্রেণী জনাত কিন্তু যখনই শুনতে পাওয়া গেল উত্তর-পশ্চিম-সীমান্তবাসীদের মধ্যে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়েছে তখন বৃটিশ বিষয়টা মোটেই মেনে নিল না। ভারতের হিন্দুরা চিন্তিত হ’ল এবং বৃটিশ সরকারকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। বৃটিশ কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে দিল আফগানদের আক্রমণের প্রক্রিয়া দেখতে। যখন বৃটিশ দেখতে পেল সত্যই আফগান এবং সীমান্তবাসীরা বৃটিশের কয়েকটি ঘাঁট আক্রমণ করছে। তখন আর চুপ করে থাকা নিরাপদ মনে করে আন্তর্জাতিক নিয়মমত আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল এবং ভারতের রাজন্যবর্গের সমর্থন লাভ করল।
ইংলণ্ড এবং আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলি চিৎকার করে বলতে লাগল “গেল রাজ্য গেল মান।” এই সময়ে বাংলা দেশের যত সাপ্তাহিক এবং দৈনিক সংবাদপত্র ছিল বৃটিশকে সমস্বরে চিৎকার করে সমর্থন করে। বাঙ্গালী মুসলমান পরিচালিত মহম্মদী এবং লাহোরের কয়েকখানা সংবাদপত্র অতীব গাম্ভীর্যের সহিত বাজে কথা বকতে আরম্ভ করে। তাদের ধারণা ছিল আমানউল্লা সত্বরই দিল্লী পর্যন্ত মার্চ করে পৌছতে পারবেন। বৃটিশ জানত পাতিয়ালার মহারাজা যদি ইচ্ছা করেন তবে মারাঠা সৈন্য হটিয়ে দিয়ে পনর দিনের মধ্যে কাবুল পর্যন্ত পৌছতে পারতেন। সেজন্য পাকা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ ধীরে অগ্রসর হ'তে থাকে। ভারতীয় সৈন্য পাঠান, কোহাট, থাল প্রভৃতি স্থানে মামুলী বাধা প্রাপ্ত হয়। তারপর ভারতীয় সৈন্য ধীরে ধীরে উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশের খান্দের তারা যেমন ছিল তেমনি থাকতে আদেশ দিয়ে উত্তম পথে ভারতসীমান্তে পৌঁছে।
এখানেই যুদ্ধের শেষ হবার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু আমানউল্লা ইচ্ছা করেই যুদ্ধ করতে থাকেন। আমানউল্লা এক কোটি লোকের অধিপতি ছিলেন কিন্তু সেই এক কোটি লোক এক সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল না, দ্বিতীয়তঃ মোল্লারা এই যুদ্ধের পক্ষপাতী না থাকায় সামান্য ক্ষয় স্বীকার করে বৃটিশ সৈন্য জালালাবাদ পৌঁছে। ঠিক সেই সময় আমানউল্লা বৃটিশকে হুমকী দিয়ে জানিয়ে দেন, আর অগ্রসর হলে তিনি সোভিয়েট রুশের সাহায্য নিতে বাধ্য হবেন। বাস, এখানেই যুদ্ধের শেষ।
লয়েড জর্জ বিশেষ করে সোভিয়েট রুশিয়ার শক্তি অবগত ছিলেন। কোনরূপ বাক্যাড়ম্বর না করে বৃটিশ সরকার নিজের সৈন্য সীমান্তে অপসরণ করে এবং আফগানিস্থানের হিন্দু জেনারেল নিরঞ্জন সিং এমনই একটি চাল দেন যার সাহায্যে আফগানিস্থান স্বাধীন রাজ্য বলে স্বীকৃত হয় এবং আমানউল্লা আফগানিস্থানের প্রথম রাজা স্বীকৃত হয়ে রাজ্যভার গ্রহণ করেন।
আমানউল্লার রাজত্বকালে অদম্য উৎসাহ নিয়ে সামাজিক উন্নতি হতে থাকে। হিন্দুরা অনেক দিক দিয়ে সরকারী সাহায্যে নিযুক্ত হয় এবং উপজাতিদের মধ্যে নব-জীবনের সঞ্চার হতে থাকে। চারিদিকে উন্নতির লক্ষণ সর্বত্র লক্ষিত হয়। কিন্তু মোল্লা এবং মৌলবী শ্রেণীর লোক যেন কিছুতেই নাই এটাও লক্ষিত হচ্ছিল।
সিংহাসন লাভ করার পর আমানউল্লা বিদেশে যান নি। সেজন্য তাঁর বিদেশ দেখা সমূহ দরকার মনে করেন এবং ইউরোপ ভ্রমণে বাহির হন। সংগে যান। তাঁর স্ত্রী সুরিয়া। সুরিয়া পর্দা হতে মুক্ত হয়ে সভ্য সমাজের রাজ-পরিবারগুলির সহিত মেলামেশা করতে থাকেন। ইংলেণ্ডের পত্রিকাগুলি অত্যধিক উৎসাহী হয়ে রাণী সুরিয়ার ছবিসমেত সকল বিষয় ছাপাতে আরম্ভ করে। পৃথিবীর সাধারণ লোক মনে করতেছিল কি আনন্দের সংবাদ! একটি পশ্চাদপদ জাত ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে রাজা আমানউল্লার অবর্তমানে মোল্লারা প্রচুর স্বর্ণমুদ্রার মালিক হয়ে সাধারণ লোককে ক্রমাগত উস্কাণী দিতে থাকে এবং তার ফলে রাজ্যের মধ্যে নানা বিশৃঙ্খলতা দেখা দেয়। রাজা আমানউল্লা মস্কোএর পথে কাবুলে প্রত্যাবর্তন করেন এবং রাজ্যের দারিদ্র্য এবং বিশৃঙ্খলতা দূর করতে মন দেন।
বাচ্চ-ই-সিক্কা নামে একটি লোক তখন জেলে ছিল। জেলের লোক তাকে বেশ ভাল লোকই মনে করত এবং তার আদেশে অনেক কাজও করত। বাচ্চ-ই-সিক্কা প্রায়ই মশক দিয়ে জল বহন করে মানুষের বাড়ীতে দিয়ে আসতেন। এতেই তাঁর আহারের বন্দোবস্ত হয়ে যেত। তখনকার আফগান জেলআইন মতে কয়েদীকে খাদ্যরূপে কিছুই দেওয়া হ’ত না অথবা এমনই সামান্য কিছু খাদ্য দেওয়া হ’ত যার দ্বারা মোটেই তার পেট ভরত না। সেজন্য কয়েদীয়া বাইরে যাওয়া আসা করতে পারত।
মোল্লারা বিদেশীর কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে বেশ মজা লুটছিল। কিন্তু তখন এমন একটি লোকের সন্ধান পাওয়া যায় নি যে আমানউল্লার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে পারবে। অবশেষে এক দিন বাচ্চা কোনও মোল্লার বাড়ী হতে রুটি আনার সময় মোল্লার সংগে কথা বলতে আরম্ভ করে এবং আমানউলার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে সেরূপ মনোভাবও প্রকাশ করে। বাচ্চ-ই-সিক্কা মোল্লার কাছ থেকে কিছু বৃটিশ স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে জেলের মধ্যে এসেই দল পাকাতে আরম্ভ করে। তখন একটি স্বর্ণমুদ্রার দাম প্রায় পঁচাত্তর আফগানী ছিল। পাঁচাত্তর আফগানী একটি স্বর্ণমুদ্রায় যেখানে পাওয়া যেত সেখানে যদি কারো কাছে একশত স্বর্ণমুদ্রা থাকত। তবে তাকে মস্তবড় একজন ধনী ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? এত টাকা পেয়েও বাচ্চার মাথা খারাপ হ’ল না, তার মনে বড় হবার বাসনার উদ্রেক হল। সে মনে করল ইচ্ছা করলেই রাজা হওয়া যায়। সর্বপ্রথম জেলের মধ্যেই বাচ্চা কাজ আরম্ভ করে দিল—জেলের মধ্যে আরম্ভ হ’ল গোপনে আলোচনা। সেই সময় কয়েকজন হিন্দুও জেলে ছিল। হিন্দুদের কেউ চিনতে পারত না এমন কি হিন্দুরা কেহ হিন্দু বলে পরিচয় দিত না। কোনও পর্যটক বলতে ইচ্ছুক নন। কুকথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। পৃথিবীতে বর্বর যুগ। তখনও ছিল এবং এখনও যে নাই তা বলা চলে না। এখনও এমন অনেক লোক আছে যারা অবতারবাদের অন্ধ বিশ্বাসে নরহত্যা করতে অগ্রসর হয়। এই বর্বরগণ যদি জানত তাদের পূর্ব-পুরুষ কত দুঃখ কষ্টের ভেতর দিয়ে এই পৃথিবীতে মানুষের প্রাধান্য অর্জন করেছেন। তবে অবতারবাদকে ঢেলে ফেলে দিয়ে মানুষের উন্নতিবাদই আকড়িয়ে ধরত।
একদিন দেখা গেল একটা টিকিধারী লোক আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। আর কি রক্ষা আছে? অন্যান্য কয়েদীরা সেই লোকটাকে আক্রমণ করল। যখন সে বুঝতে পারল তার বাঁচবার আর কোন উপায় নাই তখন সে সাক্কোর পা জড়িয়ে ধরল। বাচ্চা-ই-সাক্কোর ইঙ্গিতে সবাই সরে দাঁড়াল। লোকটাও বেঁচে গেল। এর নাম চেলারাম। কাংড়া জেলাতে এর বাড়ী ছিল। বাচ্চা-ই-সাক্কো চেলারামকে সাহায্যকারী পেয়ে সুখী হয়েছিল এবং চেলারামও বাচ্চা-ই-সাক্কোকে বন্ধুরূপে পেয়ে স্বাধীন ভারতের চিন্তা করতে পারছিল।
যৌবনের প্রথমাবস্থায় চেলারাম কলিকাতা আসে এবং প্রথম মহাযুদ্ধে সেপাই হয়ে ইরাকে যায়। ইরাকে ইরাকীদের হালচাল দেখে তার মন দমে যায় এবং ডিসচার্জ হয়ে উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশে মোটর ড্রাইভারের কাজ আরম্ভ করে। আফগান যুদ্ধ আরম্ভ হবার পূর্বে সে আফগানিস্থানে যায় এবং মোটর একসিডেণ্ট করার জন্য জেল হয়। চেলারাম আফগানিস্থানের জেলের অবস্থা জানত না, দ্বিতীয়ত সেখানকার হিন্দুদের সংগেও মিলামিশা করত না, সেজন্যই সে দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছিল। চেলারাম মনে করত আফগানিস্থান অনেক উন্নত হয়েছে কিন্তু আলোর কাছেই ঘন অন্ধকার এ ধারনা সে করতে পারে নি। এই সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা কান্দাহার অধ্যায়ে কিছু বলেছি।
চেলারাম ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল তথাকথিত ধর্ম এবং বর্তমান অর্থনীতি মানুষের শত্রু। কিন্তু সে জানত না তথাকথিত ধর্ম এবং বর্তমান অর্থ নীতির আওতা হতে কি করে রক্ষা পাওয়া যায়। মূর্খ হয়েও সে পণ্ডিতের মতই কাজ করে চলল্। বিদ্রোহ কি করে করতে হবে সেই সম্বন্ধে যখনই আলোচনা হ’ত তখন সেও থাকত। অন্যান্য হিন্দু কয়েদীরাও যোগ দিত। হিন্দু কয়েদীরা জেলে স্বাধীনতা পেয়েছিল।
অবশেষে বিপ্লব আরম্ভ হয়। বিদ্রোহ বিদেশী সৈন্য মুকতি পোশাকে যোগ দেয়। প্রথমত আমানউল্লা জয়ী হতে থাকেন পরে মুফতী সৈন্যের সাহায্যে বিদ্রোহীরা বিজয়ী হয়। আমানউল্লা কান্দাহারে পলায়ন করেন। হিরাতের সুবেদার কান্দাহার আক্রমণ করার পূর্বেই আমানউল্লা চামন হয়ে বম্বে আসেন এবং ইটালীতে চলে যান। এখনও আমানউল্লা ইটালীতেই বসবাস করছেন।
সাম্রাজ্যবাদ বড়ই নির্মম। যে সাম্রাজ্যবাদ বাচ্চা-ই-সাক্কোকে রাজা করল সেই সাম্রাজ্যবাদ বাচ্চা-ই-সাক্কোকে পরে অনুপযুক্ত বলে মনে করল। নাদীর সাহ ফ্রান্সে ছিলেন। তিনি উপজাতির সাহায্য নিয়ে বাচ্চা-ই-সাক্কোকে পরাজিত করেন। বাচ্চা-ই-সাক্কো পালাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সক্ষম হন। নি। কাবুলে এনে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনা ১৯২৯ সালের শেষের দিকে ঘটে।
নাদীর সাহও প্রগতিশীল মোল্লাবিরোধী ছিলেন। সাড়ে তেরশত বৎসর পূর্বে আরবদেশ যেমন ছিল মোল্লারাও ঠিক তেমনি থাকতে চায় সেজন্যই বোধহয় ফুটবল মাঠে যখন নাদীর সাহ পুরস্কার বিতরণ করতে ছিলেন আততায়ী সেই সময় তাঁকে হত্যা করে। এই ঘটনা ১৯৩৩ সালের ৮ই এপ্রিল ঘটেছিল। ঐতিহাসিকগণ এর বেশি কিছুই বলতে ইচ্ছা করেন নি। সেজন্য আমিও এখানে সংক্ষেপে আফগান ইতিহাসের কিছুটা বলে ফেল্লাম।