আফগানিস্থান ভ্রমণ/কাবুলে শীতের সকাল

কাবুলে শীতের সকাল

 সকালবেলা হতেই তুষারপাত শুরু হয়েছে। সারাদিন ঘরে বসেই কাটাতে হ’ল। তুষারপাতকে উপেক্ষা করেই জন কয়েক হিন্দু এবং মুসলমান আমার সংগে সাক্ষাৎ করতে এলেন। ভ্রমণ-কাহিনী শোনার জন্য আসেন নি, তাঁরা এসেছিলেন আসামাই মন্দিরে ঘোল ঢালতে এবং আমার নিকট থেকে বসন্ত রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য কবচ নিতে। আগন্তুকদের ধারণা, আসামাই মন্দিরের কোনও বিশিষ্ট স্থানে ঘোল ঢাললেই বসন্ত রোগের হাত হতে রোগী বেঁচে যাবে। তাদের আরও ধারণা ছিল, যারা দেশ ভ্রমণ করে তারা কবচ তাবিজ দিয়ে থাকে। এদের ভুল বিশ্বাস ভাংতে গিয়ে আমাকে বড় রকমের একটা চোট সামলাতে হ'ল। পূজারী আমাকে বললেন, “আপনি দেখছি এখানে বসেই মন্দিরের অবমাননা করতে শুরু করেছেন। আসামাই জাগ্রত গংগা। শ্রীকৃষ্ণ এই গংগাজলকেই কলিযুগে মুক্তির হেতু বলে গিয়েছেন। এখানে ঘোল ঢেলে কত বসন্ত রোগী নিরাময় হয়েছে তার হিসাব রাখেন? আপনি হয়তো কবচ দেবার শক্তি অর্জন করেন নি, কিন্তু যারা কবচে বিশ্বাস করে তাদের বিভ্রান্ত করা আপনার পক্ষে অন্যায় এবং এরূপ করলে এখানে আপনি থাকতে পারবেন না।” আমি চুপ করে থেকে পুঁজিবাদী পরিচালিত অর্থনীতির কথা ভাবতেছিলাম এবং সুযোগ পেলে আজই এখান হতে সরে পড়ব, এটাও মনে ছিল।

 বেলা তখন চারটা। আকাশ পরিষ্কার। প্রবল হাওয়া বইছিল। এসময়ে পথে কেউ বের হয় না, তবুও বের হলাম। শেষে প্রধান মন্ত্রীর বাড়ির সদর দরজায় উপস্থিত হলাম। দরজায় দুটি তুর্কীস্থানের পাঠান পাহারা দিচ্ছিল। এদের প্রতি হৃক্ষেপ না করে সদর দরজা পেরিয়ে গেলাম। মনে মনে শোলাহেটটিকে ধন্যবাদ দিলাম। কোনও এক সময়ে ইউরোপীয়ানরা বোখারায় শোলা হেট ব্যবহার করত। এসব ইউরোপীয়গণ সাধারণত কূট রাজনীতিক—কাজেই আসতেন। রাজার প্রাসাদে তাঁদের অবাধ যাতায়াত ছিল। দুটি সান্ত্রীও বোধ হয় আমাকে সেরূপ একজন কূট রাজনৈতিক ভেবেই পথ ছেড়ে দিয়েছিল।

 দ্বিতীয় দরজাও তেমনি গম্ভীরভাবে পার হয়ে চলে গেলাম। দ্বিতীয় দরজার সান্ত্রী হয়তো ভেবেছিল প্রথম দরজায় ‘পাস’ দিয়ে এসেছি। তারপর একটি উঠান। এখান থেকে দুদিকে দুটো পথ প্রধান মন্ত্রীর খাস দরজা অবধি চলে গিয়েছে। ডানদিকের পথ ধরে ডান-বাঁ না তাকিয়ে সেক্রেটারীর দরজায় উপস্থিত হলাম। পথে চলার সময় লক্ষ্য করলাম, দোতলার একটা ঘরের তিনদিকের এবং তেতলার সবদিকের দেওয়ালই কাঁচের। তারপর লক্ষ্য করলাম, তেতলার ঘরটাতেই অনেক লোক বসে আছেন, অনেকে দাড়িয়েও আছেন।

 সেক্রেটারী বেশ ভাল ইংলিশ জানতেন। তার সংগে ইংলিশেই কথা হ'ল। প্রধান মন্ত্রীর সংগে সাক্ষাৎ করতে এসেছি জানালে তিনি আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। আমি নামগোত্রহীন একজন ভবঘুরে বলায় তাঁর মুখে অবজ্ঞার ভাব ফুটে উঠল। তবুও ভদ্রলোকটি লোক ভাল, একথা বলতে হবেই। তিনি আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে জেনে আসতে গেলেন, আমার সংগে সাক্ষাৎ করতে প্রধান মন্ত্রী মহাশয়ের সময় হবে কি না। জানতাম, আমার মত অখ্যাত ব্যক্তিদের সংগে সাক্ষাৎ করার সময় কোন বড় লোকেরই হয় না। আমার মত লোক তাঁদের কাছে পোঁছুলেই তাঁদের কাজের হিড়িক লেগে যায়। ভাবছিলাম আমার কাছে যে পরিচয়-পত্রখানা আছে তা সেক্রেটারীর হাতে দেওয়া যায় কি না, এমনি সময় সেক্রেটারী এসে জানালেন, “প্রধান মন্ত্রীর সময়ের বড়ই অভাব, তিনি দুঃখের সহিত জানাচ্ছেন তার সংগে সাক্ষাৎ হবে না।” ভেবে দেখলাম অহমিকা বাজে কথা, কাজ করতে হবে। দেরী না করে, পকেট থেকে একখানা পরিচয়পত্র বের করে সেক্রেটারীর হাতে দিলাম এবং বললাম, “এখন একবার আপনি ওপরে যান, এখন হয়তো আমার সংগে সাক্ষাৎ করতে তাঁর সময় হতে পারে।” সেক্রেটারী কাগজখানা খুলেই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বেল বাজালেন যেন ঘরে আগুন লেগেছে। তিনজন চাকর হাজিয়া হ’ল। তাদের আমার খিদমত কয়ায় জন্য বলে দিয়ে তিনি উপরে চলে গেলেন এবং অল্পক্ষণ পরে আমাকে হাত ধয়ে প্রধান মন্ত্রীর সকাশে নিয়ে গেলেন।

 প্রধান মন্ত্রী বাদশাহী চালে সোফার উপর বসেছিলেন, ভাবছিলেন হয়তো আমিও সেই শ্রেণীরই পর্যটক অথবা দর্শনপ্রার্থী হব যারা এখনও কুর্ণিশ করে নিজেদের ধন্য মনে করে। আমি তাঁকে মাত্র ছোট একটা নমস্কার করলাম।

 যে পরিচয়-পত্র আশাতীত সুফল প্রসব করল, সেখানি মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট তাঁরই আত্মীয়ের দেওয়া ছিল। তিনি চীনের হার‍্বিন্ শহরে বাস করতেন। মন্ত্রী মহাশয় প্রথমত তাঁর আত্মীয়ের সংবাদাদি জেনে নিলেন। তাঁর সেই আত্মীয় জার্মানীতে ছিলেন এবং সেখানেই বিয়ে করে স্ত্রীকে সংগে নিয়ে সোভিয়েট রুশিয়ার ভেতর দিয়ে চীনে পৌছানোর পর হার‍্বিন শহরে স্থায়িভাবে বসবাস করতে থাকেন।

 তারপর আমরা অনেকক্ষণ দেশ-বিদেশের নানা কথা আলোচনা কয়লাম। প্রধান মন্ত্রী আমাকে রাজ-অতিথিরূপেই গ্রহণ করলেন এবং কাবুল হতে হিরাত পর্যন্ত ভ্রমণের সকল রকম সুবিধা করে দিলেন। কাবুল হোটেলে থাকবার জন্য তিনি বলেছিলেন, কিন্তু তাতে রাজী হই নি। আসামাই মন্দিরেই থাকা ভাল হবে বললে তিনি তৎক্ষণাৎ বৈদেশিক আফিসে নির্দেশ দিলেন, আসামাই মন্দিরে থাকতে আমার যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার যেন বন্দোবস্ত করা হয়। আমিও সেদিনের মত নিশ্চিন্ত মনে আসামাই মন্দিরে ফিরে গেলাম।

 পৃথিবীতে মানুষের, প্রচারিত যত ধর্ম আছে, তার স্থায়িত্ব রাজশক্তির সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। রাজাদেশ ধর্মের প্রচলিত বিধি-নিষেধকেও ভিংগিয়ে যায়। পাথরের দেবতা নির্জীব, রাজশক্তি সজীব; সেজন্য ধার্মিকগণ ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক রাজাদেশ মানতে বাধ্য হন। আসামাই মন্দির হিন্দুর। আমি মন্দির হতে বহিষ্কৃত হতে চলেছিলাম, কিন্তু রাজানুগ্রহে সেই আসামাই মন্দিরে বিগ্রহের মতই অচলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাস করবার অধিকার পেলাম। পূজারী যখন দেখল, বৈদেশিক সচিবের আফিস হতে লোক এসে আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের তত্ত্বাবধান করছে, এবং জনরব রটেছে, হয়ত রাজা জাহির শা একদিন আমাকে নিমন্ত্রণ করবেন, তখন পুরোহিত ধরে নিল আমি একটা যে-সে লোক নই, নিশ্চয় উচ্চস্তরের লোক।

 লোকে দেবতার পূজা করে না, পূজা করে দেবতারূপী ভয়কে। ভক্তি হ’ল ভয়ের একটা অংগ। ভক্তিভরে পাথরের দেবতার চরণসেবা করি কেন? অন্তিমে সুখশান্তি পাব বলেই। পেছনে রয়েছে নরকের সেই চিত্র দেখিয়ে দেয় স্বর্গের সুখশাস্তি। কল্পিত নরক যদি না সৃষ্টি করা হত, তবে কল্পনায় স্বর্গের সৃষ্টিও মানুষের দ্বারা হত না। হয়তো পূজারী ঠাকুরের কাছে মূর্তিমান নারকীয় জীব বলেই প্রতিপয় হয়েছিলাম, কিন্তু আমার সহায় ছিল রাজানুগ্রহ। সেজন্যই পূজারী আমার প্রতি মনে মনে ঘৃণার ভাব পোষণ করলেও বাইরে দেবতার মতই ভক্তি প্রদর্শন করতে বাধ্য হলেন।

 প্রধান মন্ত্রী শুধু থাকবার ব্যবস্থা করলেন না, আর্থিক দুর্গতিরও অবসান ঘটালেন। এতে আমার লাভ হ’ল প্রচুর। এখানে পেট ভরাবার জন্য আসি নি, এসেছি কাবুল শহর দেখতে। কাবুলের কথা ভারতের লোক অতি অল্পই অবগত আছে। যতটুকু জানবার সুবিধা হয় ততটুকুই জেনে নিতে হবে।

 পরদিন যখন বের হব, এমন সময় পূজারী বললেন, “আপনার একাকী পথে বের হওয়া উচিত হবে না, সংগে লোক থাকা সমীচীন। লোৰু সংগে থাকলে সর্বসাধারণ আপনাকে সম্মান প্রদর্শন করবে।” পূজারীকে বললাম, “আমার লোকের দরকার নেই। ভাবলাম, আমার আবার ইজ্জত! আমার দেশ পরাধীন, আমরা দাসখত লিখে দিয়েছি। এরূপ পরাধীন জাতের লোকের পক্ষে ইজ্জতের ভয় করা মূর্খতা ছাড়া আর কি হতে পারে? আর কোন কথা না বলে একাই বের হয়ে পড়লাম।

 চলছিলাম বৃটিশ কন‍্সালের বাড়ির দিকে। বৃটিশ কন‍্সালের সংগে আমার একটু দরকার ছিল। পথ বরফে ঢাকা। সাদা বরফের ওপর সূর্যের কিরণ পড়ায় চোখ ঝলসে যাচ্ছিল। চোখে রংগিন চসমা থাকায় বিশেষ কষ্ট হচ্ছিল না, কিন্তু খালি চোখে এরূপ অবস্থায় বাইরে বেশিক্ষণ থাকলে অন্ধ হবার সম্ভাবনা থাকে। পাঠানরা অনেকেই সেজন্য পাগড়ির পিছনের ঝুলানো কাপড়টা দিয়ে চোখ ঢেকে পথ চলে।

 বিদেশে যাবার পর বৃটিশ কনসালের সংগে দেখা-সাক্ষাৎ করতে আমার মোটেই ইচ্ছা হত না, কারণ প্রায় স্থলেই দেখা-সাক্ষাৎ করতে গিয়ে অপমানিত হতে হয়েছে। কিন্তু সোফিয়া, তেহরান, কোবি, সান‍্ফ্রান‍্সিস‍্কো এই কটি স্থানের বৃটিশ কন‍্সালগণ আমার সংগে আপন লোকের মতই ব্যবহার করেছিলেন। কেন যে তাঁরা আমার প্রতি সদয় ব্যবহার করেছিলেন তার কারণ আমার অজানা নয়। কারণ হ’ল তারা অন্তরে কমিউনিস্ট মনোবৃত্তিসম্পন্ন ছিলেন। দুনিয়ায় যারা কমিউনিস্ট মনোভাব পোষণ করে তাদের কারো দ্বারা আর আমি অপমানিত হই নি, নিগৃহীত জাতের লোক বলে তাদের কাছ থেকে বরং সহানুভূতিই পেয়েছি। চীনা বল, জাপানী বল, জার্মানী বল আর আমেরিকানই বল, যদি সে ন্যাশনেলিস্ট হয় তবে সে ভারতবাসীকে ভালবাসতে পারে না। সে মৌখিক ভালবাসা দেখাবে নিজের মতলব হাসিল করবার জন্য। সময় এবং সুযোগ পেলেই সর্বনাশ করবার চেষ্টা করবে। এটা ধ্রব সত্য।

 চীন, জাপান এবং অন্যান্য পূর্বদেশ ভ্রমণ করে দেশে ফেরবার পর বুঝতে পেয়েছিলাম, লোকে জানে শুধু সাদা চামড়ার পূজা করতে। আমারই সামনে দু'হাত খুলে এদেশের ধনীরা দান করছে শুধু সাদা চামড়াওয়ালা পর্যটকদের। কিন্তু আমি যখনই আমার দেশবাসীর কাছে উপস্থিত হয়েছি তখনই তার চেষ্টা করেছে আমার বিদ্যাবুদ্ধির পরিমাপ করতে, অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করবার চেষ্টাও যে কেউ কেউ করেনি তা নয়। কিন্তু আমি উপলব্ধি করেছিলাম, আমার দেশের ছাত্র-সমাজ দরিদ্র অথচ তাদেরই কাছে হাত পাততে হত। তারা যা দিত তাতে আমার পেট ভরত না, কিন্তু আধাপেটা খেয়েও আত্মতৃপ্তি লাভ করতাম। ছাত্র-সমাজের প্রতি আমার অন্তরের শুভকামনা স্বতঃই উৎসারিত হয়ে উঠত। চীনের ছাত্রছাত্রীরা আজ চীনকে বাঁচিয়ে রেখেছে সে দৃশ্য আমি দেখেছি। তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু ব্যক্তিগত উন্নতিসাধন নয়। দেশের স্বাধীনতা, দেশের সর্বাংগীন কল্যাণসাধনের আদর্শই তাদের উদ্ব‍‌ুদ্ধ করে তুলেছে।

 ক্রমাগত বিফল মনোরথ হয়ে দিল্লীতে পৌছে ভেবেছিলাম আফগানিস্থানে গিয়ে হয়তো সাহায্য পাব না। আফগান জাত হয়তো পর্যটক কাকে বলে তাও জানে না। কিন্তু তা বলে আমার পর্যটন বন্ধ করি নি। এগিয়ে চলছিলাম।

 কর্মত্যাগের পর আমার যা জমানো অর্থ ছিল, তা সবই ভারতীয় বেকারদের সাহায্যার্থে দিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভুলক্রমে একটি বেঙ্কে টাকা দান করতে ভুলে গিয়েছিলাম। সিংগাপুরে ফিরে আসবার পর বেঙ্ক-মেনেজার সংবাদপত্রে সিংগাপুরে ফিরে এসেছি সংবাদ পেয়ে আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমার হিসাবে একুশ পাউণ্ড জমা আছে জানিয়ে দেন। এবার কিন্তু জমানো টাকা দান করতে ইচ্ছা হ’ল না; কারণ কেনেডা সরকার আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পৃথিবীতে মনুষ্য-প্রীতি বলে কিছু নেই। কাজেই টাকা অপরিহার্য। সেই কথাটা 'প্রশান্ত মহাসাগরের অশান্তি’ নামক বইএ বলা হয়েছে। বেঙ্ক-মেনেজারকে জানিয়েছিলাম, গচ্ছিত টাকা যেন কাবুলের বৃটিশ কন‍্সালের কাছে পাঠিয়ে দেন। কাবুলের বৃটিশ কনসালকেও ঐ সংগেই লিখেছিলাম, তিনি যেন দয়া করে আমার টাকাগুলি কাবুলে না পৌঁছা পর্যন্ত তার কাছে জমা রাখেন। সেই টাকার সংবাদ নেবার জন্যই কন‍্সাল আফিসে চলছিলাম।

 পর্যটক হয়ে নিজের দেশের গভর্নমেণ্টের কন‍্সাল্ অফিসে যাওয়াটা ভাল দেখায় না। সাধারণ লোক ভাবে, লোটা হয়ত পর্যটক নয়, একটা গুপ্তচর। যারা প্রকৃতই গোয়েন্দা তারা কন‍্সাল্ আফিসের সংগে সম্বন্ধ রাখে, কিন্তু বাইরে ভান করে তাদের সংগে কন‍্সালের কোন সম্পর্ক নেই। যে সরকারের পাসপোর্ট নিয়ে পথে বের হয়েছি সেই সরকারের বিরুদ্ধে যদি কিছু বলি, তাহলে অনেক সময় স্থানীয় লোক আমাকে গুপ্তচর বলেই মনে করবে। এসব কথা ভাল করেই জানতাম, কিন্তু নিজে খাঁটি থাকলে ভয়ের অথবা নতিস্বীকারের কোন কারণ থাকে না।

 কন‍্সাল্ অফিসে পৌছতে পাঁচটি চায়ের দোকানে চা খেয়ে শরীর গরম করতে হয়েছিল। কন‍্সালের বাড়ির কাছে একটা ফাঁকা মাঠ। সেটা পেরিয়ে কন‍্সালের দরজার সামনে এসেই দেখতে পেলাম দু’জন পাঞ্জাবী মুসলমান রৌদ্রে বসে আছে। এই ধরণে বসে থাকা রাজভক্ত প্রজার দ্বারাই সম্ভব। প্রচণ্ড শীতে আমার শরীরের রক্ত জমে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি করে দরজায় আঘাত করলাম। দরজা খোলামাত্রই সোজা কন‍্সালের ঘরে তাঁকে নমস্কার করলাম এবং কাছের প্রজ্জ্বলিত আগুনটার কাছে হাত দুটা বেড়িয়ে দিলাম। ভাবছিলাম ইনি কন‍্সাল্ হলে কি হবে, মানুষ তো, আমিও মানুষ। কিন্তু শীঘ্রই বুঝলাম তাঁর চক্ষে আমি মানুষ নই, এমন কি কুকুর-বিড়ালও নই, গরু-গাধাও নই, আমি একটি বনমানুষ,—যাকে হত্যা করলে ফাঁসিতে চড়তে হয় না, শুকিয়ে মারলে কেউ কিছু বলবার অধিকার রাখে না, গুলি করে মারলে চার পয়সা দামী বুলেটের জন্যই লোকে আপশোষ করে। কন‍্সাল্ মহাশয় আমাকে বললেন, “আপনার টাকা এসেছিল, ফেরত দেওয়া হয়েছে এবং এই প্রজ্জ্বলিত আগুনটি তাঁরই ব্যবহারের জন্য, গুড বাই, অর্থাৎ চলে যাও।” কি আর বলব। স্বাধীন দেশের মানুষতো নই, সেজন্য অবনতমস্তকে যখন কন‍্সলের ঘর হতে বের হয়ে আসছিলাম, তখন কয়েকজন পাঞ্জাবী মুসলমান, যারা কন‍্সালের বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল, তারা জিজ্ঞাসা করলে, কি হয়েছে, তোমাকে এত বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন? নির্বাক হয়ে পথ চলছিলাম, ফেরবার পথে কোথাও চা খেলাম না। প্রচণ্ড শীতের অনুভূতি পর্যন্ত হচ্ছিল না। একদম শীত,গ্রীষ্মবোধহীন হয়ে শহরের দিকে, মাথা নত করে পলাতক পশুর মত, কোথাও আশ্রয় পাবার জন্য এগিয়ে চলছিলাম। কাকে কি বলব? দেশ নাই, জাত নাই, আমার মাঝে মনুষ্যত্ব নাই—এই ঘৃণিত জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কি লাভ? সকাতরে পথকে বলছিলাম, “আমাকে আশ্রয় দাও, তোমার বুকের ওপর সবাই হাঁটে তাই আমিও হাঁটছি। তোমার মাঝেই আমার লয় হোক, তুমি জাতবিচার কর না, বাদামী এবং সাদাতে তুমি পার্থক্য দেখাও না। স্বাধীনে পরাধীনে তোমার কাছে কোনও তারতম্য নাই, তুমি সকলের জন্য উন্মুক্ত। তোমার বুকের ওপর দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মদগর্বে যেমন হাঁটছে, দরিদ্র পরাধীন জাতের লোকও তেমনি পদক্ষেপ করছে। তুমি পূঁজিবাদীরও নও, শাসক-জাতেরও নও। তুমি দাম্ভিক ভাড়াটে গুণ্ডারও নও, দীন মজুরেরও নও। তুমি সকলের। তুমি আমার একমাত্র ভরসা। তুমি ভরসা পরাধীনের, তুমি ভরসা নামগোত্রহীনের, তুমি আমার চরম আশ্রয়। তোমার ওপর দিয়ে চলতে চলতেই যেন আমার পরাধীন জীবনের শেষ হয়।”

 এই ধরণের চিন্তায় নিমজ্জিত হয়ে শহরে এলাম এবং একটি বড় চায়ের দোকানে চা খেতে বসলাম। অনেকেই আমার মুখাকৃতি দেখে দুঃখিত হ’ল এবং কেহ কেহ জিজ্ঞাসা করল আমার শরীর ভাল আছে কি না? সকলকেই এক কথায় জবাব দিলাম শরীর ভাল নাই। সেই সংগে মনে হয়েছিল আমানউল্লার কথা যিনি বুদ্ধি খাটিয়ে বৃটিশকে হটিয়ে দিয়ে নিজের দেশ স্বাধীন করেছিলেন।

 রাজার রাজ্য কি করে চলে প্রজা সে সংবাদ রাখত না। কয়েক বছর আগেও বাংলা দেশের বৃটিশ রাজ্য কি করে চলত, তার সংবাদ বাংগালী সর্বসাধারণ ক'জন রাখত? জমিদার, তালুকদার, মিরাশাদার, খুদে জোতদার— এবং জোতদারের পর হ’ল চাষার স্থান। চাষা জানে শুধু জোতদারকেই। বাংলা দেশের শিক্ষা এবং গণজাগরণের সংগে আফগানিস্থানের গণজাগরণের তুলনা হতে পারে না। গণজাগরণের হিসাবে বাংলা দেশ আফগানিস্থানের বহু উচ্চ স্থান দখল করে ছিল। আফগানিস্থান স্বাধীন আর ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন। বাংলা দেশ ভারতবর্ষের একটা অংশমাত্র। বাংগালী শিক্ষিত হয়েও বাংলা দেশের সংবাদ রাখে না। কিন্তু শিক্ষার হিসাবে কাবুলীরা আমাদের অনেক পেছনে থাকা সত্বেও এদের বৈশিষ্ট্য থাকায়, ভারতীয় কৃষকের মত পাঠান কৃষক জোতদারের হাতে কাবু হয়ে পড়ে নি। পাঠান বোঝে খাজনা দিতেই হবে; অতএব ন্যায্য খাজনা তুমি রাজা স্বয়ং এসে নাও কিংবা একটা বাঁদরের গলায় থলি বেঁধেই পাঠিয়ে দাও, খাজনা পেয়ে যাবে। কিন্তু পাঠান চাষা অন্যায়কে কখনও প্রশ্রয় দেয় না। নায়েববাবু, পেয়াদাবাবু, কেরানিবাবু,পুলিশবাবু—এসবের ধার ধারে না, অন্যায় করেছ কি মরেছি।—অটোমেটিক মেশিনগান চালিয়ে প্রতিকার করবে ঐ দরিদ্র চাষা। সে জীবনের ভয় করে না। আর্ম এক্ট কাকে বলে তা সে জানে না। আর্ম এক্ট আফগানিস্থানে চলে না। যেখানে আর্ম এক্ট নেই, সেখানে আর্ম-এর অপব্যবহারও হয় না।

 যেখানে লোকের চলতি পথে স্বাধীনতা আছে, সেখানে লোকে রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র-এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। পাঠানরা স্বাধীন, তাদের মাথা ঘামাতে হয় না, দুরানী বংশ রাজা হ’ল, কি খিলজাই বংশের লোক রাজা হ’ল। তারা কখনও ভাবে না সরকারী চাকুরি কে পেল আর কে না পেল। তাদের আত্মরক্ষা করার জন্য তলোয়ার, বন্দুক, পিস্তল, অটোমেটিক মেশিনগান রয়েছে, সেজন্যই সে কাউকে ভয় করে না। নিজের পরিবার, গ্রাম, এমন কি ছোট ছোট সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী পর্যন্ত নিজেরাই নিজেদের দেখাশুনা করে থাকে। রাজার পেয়াদা অথবা চাকর গ্রামের মালিকের কাছে হাজির হয়ে রাজকীয় আদেশ জানিয়ে আসে। গ্রামের মালিক সবাইকে ডেকে রাজার আদেশ শুনিয়ে দেয়। সর্বসাধারণ যদি সে আদেশ ভাল বোঝে। তবে মেনে নেয়, নতুবা অগ্রাহ করে। রাজার আদেশ সকল সময় চলে না, গ্রামের লোক স্ত্রীপুত্রপরিবার সমেত কবরস্থ হতে রাজী, তবুও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে রাজী নয়। সেজন্যই আফগান জাত নানাদিকে বাংগালীর পেছনে থেকেও বাংগালীর চেয়ে একদিকে উন্নত-জীবন কাটাচ্ছে। এখানে কথা ওঠে, যদি কোন গ্রামে পাঁচঘর হিন্দু, দশঘর শিয়া এবং পঁচিশ ঘর সুন্নি থাকে, তবে দুটি সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণীর লোক সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা শুনবে কেন? এখানে একটা মজার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আফগানিস্থানের শাসন-নীতি ভেদনীতির পক্ষপাতী নয়। আফগান জাতও ভেদনীতির সমর্থক নয়। আমার জমি আমি চাষ করছি। আমার বাড়িতে আমি বাস করছি। ঋণের দায়ে আমার কিছুই যাচ্ছে না, আমি ভেদবুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে কার সংগে বিবাদে প্রবৃত্ত হব? জমির জন্য আমাদের ঝগড়া হয় তার একমাত্র কারণ হ’ল, বুদ্ধিজীবীরা নানারূপ বদমতলব কার্যে পরিণত করার জন্য আইনের আশ্রয় নেবার পথ বাতলে দেয়। যারা আইনের আশ্রয় নেয়। তারা দরিদ্র এবং কাপুরুষ। আফগানরা কলহ ইত্যাদির মীমাংসা আইনজীবীর হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজেদের হাতেই রেখেছে। দুরভিসন্ধি যেখানে নেই সেখানে মেজরিটি মাইনরিটির কথা মোটেই ওঠে না। বন্দুক কামান, ছোরা তলোয়ার এ সবই হ’ল তাদের আত্মসম্মান বজায় রাখার পয়লা নম্বরের অস্ত্র। সেজন্য আফগানরা মানুষের অধিকার নিয়েই সসম্মানে সুখে আছে। শাসকদেরও ভেদনীতির আশ্রয় নেবার প্রয়োজন হয় না।

 রাষ্ট্র স্ত্রী-জাতির কোন স্বাধীন সত্তা স্বীকার না করলেও আফগানরা মায়ের জাতের যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণে কখনই শৈথিল্য দেখায় না। স্ত্রীলোকের অসন্মানকারীর প্রতি কড়া শাসনের ব্যবস্থা নিজেদের হাতেই রেখেছে, রাজকর্মচারীর ওপর ছেড়ে দেয় নি। ঘরে সাপ ঢুকলে যেমন গ্রামের লোক পরস্পরের শত্র‍‌ুতা ভুলে গিয়ে সাপকে হত্যা করে, তেমনি পাঠানরা স্ত্রীলোকের প্রতি অত্যাচারীকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না। হত্যা তিন রকমের হয়ে থাকে। গুলি করে মারা, পাহাড়ের ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া, এবং শরীরটার নীচের ভাগ মাটিতে পুঁতে ফেলে বাকি অর্ধেকটাতে ক্রমাগত ঢিল ছোঁড়া।

 পাঠানরা শুধু যে স্বদেশের স্ত্রীলোকেরই মান-ইজ্জত রক্ষায় সজাগ তা নয়, কোনও বিদেশী স্ত্রীলোকেরও আফগানিস্থানে অত্যাচারিত হবার আশংকা নেই। নারীর সম্মান রক্ষা সম্বন্ধে হিন্দুপ্রতিনিধি একটা ঘটনা বলেছিলেন।

 আমেদাবাদ শহরের কোনও এক হিন্দু রমণী স্বেচ্ছায় একটি পাঠানকে বিয়ে করে কাবুলে আসে। কাবুলের আবহাওয়া তার মোটেই পছন্দ হয় নি। বোরখা পরতেও তার ভাল লাগে নি। সেজন্যই বোধ হয় স্ত্রীলোকটি পাঠানকে বার বার আমেদাবাদে ফিরে যেতে অনুরোধ করে। পাঠান কিন্তু আমেদাবাদে ফিরে যেতে সম্মত হ’ল না। স্ত্রীলোকটি দেশে ফিরে আসার জন্য নানারূপ চেষ্টা করেও যখন কৃতকার্য হ’ল না, তখন একদিন পথে এসে চীৎকার করে জনসাধারণের কাছে তার দুঃখের কথা বলে। পথের লোক তৎক্ষণাৎ প্রতিকার করতে গিয়ে দেখে পাঠান গৃহ ছেড়ে পালিয়েছে। জনতার তখন কিছুই করার ছিল না। তারা তখন স্ত্রীলোকটিকে পুলিশের হাতে অর্পণ করে। পুলিশ রমণীটিকে হিন্দুপ্রতিনিধির বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তিন মাস পরে বৃটিশ সরকার হিন্দুরমণীটির দেশে ফিরে যাবার বন্দোবস্ত করেন।

 অন্তত মনের দুটি অবস্থায় আমোদ-প্রমোদ বিশেষ দরকার হয়ে পড়ে। প্রথমত, শরীর যখন সুস্থ থাকে, মনে যখন কোনরূপ উদ্বেগ থাকে না, তখন নিরুদ্বেগ প্রফুল্লতাকে আমোদ-আহলাদের ভেতর দিয়ে ব্যক্ত করতে মন তাই উৎসুক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, মন যখন অপমানে এবং ক্ষোভে একদম মুষড়ে পড়ে, তখন ভগ্নহৃদয়কে আমোদ-আহলাদের একটা সাময়িক উত্তেজনার মধ্যে আচ্ছন্ন করে রাখলে মনে বেশ শান্তি আসে। নানা কারণে আমার মন দমে গিয়েছিল। অপমানের বোঝা আর সইতে পারছিলাম না। সে জন্যই আমোদ-প্রমোদের সন্ধানে বের হয়েছিলাম। আফগানিস্থানে সিনেমা নেই যা দেখে মনে একটু শান্তি আনতে পারা যায়, অপেরা নেই যেখানে গিয়ে মনের বিষাদ লাঘব করতে পারা যায়। শীতের সময় নৃত্য অথবা হৈহল্লাও নেই যে তা দেখে সময় কাটানো যায়, অথচ আমার কাবুল শহরে আর থাকতে মোটেই ভাল লাগছিল না। মোটরে করে গজনি হয়ে কান্দাহার যাবার বন্দোবস্ত হয়েছিল, কিন্তু পথে প্রচুর বরফ জমে থাকায় গাড়ি চালানো মোটেই সম্ভব ছিল না। তখন বাধ্য হয়েই পুরা একটা মাস আমাকে কাবুল শহরে থাকতে হ'ল।

 কাবুলে পুরা এক মাস থাকতে বাধ্য হ'লেও অলসভাবে দিনগুলি কাটিয়ে যাই নি।

 কাবুলে একজন পার্শি ব্যবসায়ীর সংগে পরিচয় হয়। তিনি পর্যটকদের বড়ই ভালবাসেন। আমাকে একাকী সাইকেলে পৃথিবী পর্যটনে বহির্গত হতে দেখে তিনি খুব বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং আমাকে নানারূপ প্রশ্ন করেন। তাঁর প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে সক্ষম হওয়ায় তিনি খুশি হলেন বটে, কিন্তু আমি যে মতবাদ পোষণ করি তাতে তিনি দুঃখিত হন। এত সাধের স্বর্গরাজ্য কাবুল—যেখানে যাবার পর যা চাওয়া যায় সবই পাওয়া যায়—সেখানে আমি থাকতে চাই না, এমন কি সুখ বলে এখানে কিছু আছে তার অস্তিত্বও বিশ্বাস করি না, এতে দুঃখ হবার কথাই। কথায় কথায় তিনি প্রশ্ন করলেন, এ শহরে নানারূপ দ্রষ্টব্য জিনিস আছে, তা আমি দেখেছি কি না? জিজ্ঞাসা করে জানলাম এখানে অনেক পুরাতন বই আছে। হালে বোখারা হতে যারা এসেছে তারা সে সকল বই সংগে করে এনেছে।  সেই বইগুলির অনুসন্ধানে বের হলাম। কোথায় এবং কার কাছে বইগুলি আছে তা জানা ছিল না। পার্শি ব্যবসায়ীও তা বলে দেন নি। ফিরে এলাম সেই চায়ের দোকানে যেখান হতে আমি বার বার আঁধারের মাঝেও আলোর সন্ধান পেয়েছিলাম। চায়ের দোকানে ক্রমেই পুরাতন বয়ের দেখা পাওয়া গেল। এবার সেই বয় আমার সংগে কথা বলল। এই যুবকের সংগে আমার সাক্ষাৎ হয় পেশোয়ারে একটি বই-এর দোকানে। তখন তার পরনে ছিল পাজামা এবং পাঠানের পাগড়ী। এবার সে নূতন পোশাক পরেছে। দেখতে বেশ সুন্দর দেখায়। বইএর সন্ধান তারই কাছে জিজ্ঞাসা করলাম। বইএর সন্ধান কার কাছে গেলে পাব সে বলে দিল। সে সত্বরই রুশ দেশে যাবে তাও জানালে। রুশ দেশে যাবে সে এক নয়, আরও অনেকে। দুঃখের সহিত বললে তার দু’জন সংগীকে আফগান রাজ্যের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বাংগালী বাবু বয় সেজে রয়েছিলেন এতে আমার রাগ হয়েছিল, কিন্তু যখন শুনলাম তারই সাথী দু’জনকে হত্যা করা হয়েছিল তখন বড়ই দুঃখিত হয়েছিলাম এবং বয়কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, “মাতৃভূমিকে যদি মুক্ত করতে হয় তবে মরণকে বরণ করে নিতে হবেই।”

 চায়ের দোকান হতে বের হয়ে বয়-কথিত মিঃ আবদুল্লার আফিসের দিকে রওনা হলাম। আবদুল্লার সংগে পূর্বেই পরিচয় হয়েছিল। তিনি একজন পাঞ্জাবী মুসলমান। তাঁর অনেক বদনাম রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের কাছ থেকে শুনেছিলাম, এমনকি তিনি তাঁর ওয়াল‍র্ড ফেডারেশন নামক মাসিক পত্রে আবদুল্লাকে লক্ষ্য করে অনেক কথাই লিখেছিলেন। আমি সেই আবদুল্লার বাড়িতে গিয়েই বইএর সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন করলাম। আবদুল্লা শিল্প-বিভাগে মন্ত্রিত্ব করেন। তাঁর অধীনে অনেক মজুর অনেকগুলি কম্বল এবং দেশলাইএর কারখানাতে কাজ কয়ছিল। তাঁর কারখানা এবং মজুরদের কাজ দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলাম, কিন্তু বইএর কোন সন্ধান না পেয়ে দুঃখ হয়েছিল। অবশেষে তাঁরই কারখানার একটি হিন্দু মজুর বইএর সন্ধান দেয়।

 বই—যা দেখতে আমার খুব আগ্রহ ছিল না, তাই শেষটায় আমার মনকে গভীরভাবে টানছিল। প্রশ্ন হ’ল বইগুলো দেখে আমার কি লাভ হবে? কোনও ধর্মগ্রন্থ আমার মনে দাগ কাটতে পারবে না তা যে ধর্মেরই হোক না কেন? এই কথাটা ভাবতে ভাবতেই একজন বৃদ্ধ পুস্তক-ব্যবসায়ীর দোকানে প্রবেশ করলাম। দোকানী বেশ ভদ্র। দোকানে প্রবেশ করা মাত্রই লোকটি আমার সংগে কথা বললেন। দোকানীর কথা বলার ধরনটি বেশ ছিল।

 —আপনি ধর্মগ্রন্থ দেখতে চান না, তবে কি রকমের বই দেখাব বলুন? আচ্ছা, একটা বড় বই আছে যাতে ভাষা সম্বন্ধে নানা তথ্য লেখা রয়েছে। আপনি গুণী লোক, সে বইটাই দেখুন।

 আমি তাতে রাজী হলাম এবং পুস্তক প্রদর্শনের রুমে বসলাম। ঘরটি ছোট। দুটিমাত্র খিড়কি দরজা। খিড়কি দরজা দিয়ে যে আলো আসে তা প্রচুর ছিল না। পুস্তক-বিক্রেতা বইখানা আমার সামনে রেখে দিয়ে বললেন, “বইখানা গ্রীক ভাষায় লিখিত বলেই মনে হয় কিন্তু অনেক গ্রীক বলেছেন বইখানা গ্রীক ভাষাতে লিখিত নয়।”

 বইখানা হাতে নিয়ে তার কাগজ পরীক্ষা করছিলাম দেখে দোকানী হেসে বললেন, “এতে কোন লাভ হবে না—আপনি অক্ষর দেখুন তাতে লাভ হবে।”

 পৃথিবীতে নানারকমের অক্ষর আছে। অক্ষর শব্দ লেখবার সাংকেতিক চিহ্ন মাত্র। এই সাংকেতিক চিহ্নের মধ্যে কোন্ দেশীয় সাংকেতিক চিহ্ন সবচেয়ে পুরাতন বের করা কঠিন কাজ। বইখানার অক্ষরগুলি পরীক্ষা করে দেখলাম, অক্ষরগুলির কোনরূপ সংস্কৃতি নাই। যাকে সংস্কার করে নেওয়া হয়েছিল তাকে বলা হয় সংস্কৃত। তবে কি এরূপ অক্ষরকেই সংস্কার করে নেওয়া হয়েছিল? অক্ষরগুলির সংগে পুরাতন পাঞ্জাবী অক্ষরের বেশ সাদৃশ্য ছিল যাকে বর্তমানে বলা হয় “গুরুমুখী” অক্ষর।

 ইচ্ছা হ’ল বইখানা কিনে ফেলি। কিন্তু বইখানার দাম শুনে মনে হ’ল আমি কেন, অনেক ধনীও বইএর দাম শুনে ঘাবড়ে যাবেন। বইখানা দেখাই হ'ল, কিন্তু দুঃখের বিষয় তার কিছুই বোধগম্য হ’ল না। অনেকক্ষণ বইখানা দেখে শেষটায় ফিরে এলাম।

 পুরাতন বই ছিল, পুরাতন ভাষা ছিল। কিন্তু নতুন এসে এক এক ধাক্কা মেরেছে আর পুরাতনকে ভেংগে ফেলে দিয়ে নিজের স্থান করে নিয়েছে। আফগানিস্থান যদিও পুরাতন এবং নতুনের দ্বন্দ্বক্ষেত্র, তবুও এই দেশ আজও পুরাতনকেই আঁকড়ে ধরে আছে।

 স্থানীয় আর্যসমাজীরা নতুন নিয়মে আমাকে অভ্যর্থনা করবার জন্য চেষ্টা করছিল। সনাতনীরা বাধা দিতে গিয়ে বলছিল, তা কি হতে পারে? এতে হয়ত 'পক্ষপাতপূর্ণ’ রাজনীতি এসে যেতে পারে। এখানে পক্ষপাত শব্দটির ব্যবহার দেখে আমায় মনে হ’ল, সনাতনীরা শব্দের ব্যবহার করতে জানে, কিন্তু পক্ষপাত কাকে বলে তাও হয়তো ভাল করে জানে না। আর্যসমাজী এবং শিখরা সনাতনীদের কথায় কান না দিয়ে সভার বন্দোবস্ত করল।

 মহাভারত-রচয়িতা ব্যাসদেব দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করার পর যখন কোন রাজবাড়িতে যেতেন, তখন তাঁকে যেভাবে অভ্যর্থনা করা হত, আমাকেও ঠিক সেরূপভাবেই অভ্যর্থনা করার বন্দোবস্ত হ’ল। যথাসময়ে সভায় উপস্থিত হয়ে সমবেত জনমণ্ডলী কর্তৃক সংবর্ধিত হলাম। আমাকে একখানা বেদীতে বসতে হ’ল। তাতে বসে ঠিক পূর্বকালের কথকদের প্রথামত আমার ভ্রমণ-কথা বলতে আরম্ভ করলাম। সভায় সভাপতি কেউ ছিলেন না। শুধু একজন লোক আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েই ভিড়ের মধ্যে বসে পড়লেন।  যারা গঙ্গার ধারে বসে কথকতা শুনেছেন, তারা দেখে থাকবেন কথকেরা কেমন করে শ্রোতার মন আকর্ষণ করে থাকে। আমি ইচ্ছা করেই সে ভাবেই কথকতা শুরু করেছিলাম। আমার ভ্রমণকাহিনী একদিনে সমাপ্ত হয় নি। আমার ভ্রমণকাহিনী অনেকের ভাল লেগেছিল বলেই বোধ হয় প্রথমদিন কথকতা করে তিনশত কাবুলি মুদ্রা দক্ষিণা পেয়েছিলাম। পরদিনও আবার সভার আয়োজন হয়। দ্বিতীয় দিনও অনেক লোক হয়েছিল। প্রথম দিন যারা কথকতা শুনেছিলেন পরের দিনও তাঁরা সদলবলে উপস্থিত হন এবং দ্বিগুণ দক্ষিণা দিয়ে পূণ্য অর্জন করেন। আমি লক্ষ্য করছিলাম, দক্ষিণা দেবার সময় দাতা তাঁর নিজের সমস্ত শরীরটায় টাকার তোড়াটি বুলিয়ে তোড়া থালাতে ঢেলে দিচ্ছেন। একটি যুবককে এরূপ করে টাকা দেবার কারণ কি জিজ্ঞাসা করলাম। সে বললে, “এদের বিশ্বাস নিজের শরীর বুলিয়ে দেশভ্রমণকারীকে টাকা দিলে দাতার শরীরে কোন রোগ থাকে না এবং দেশভ্রমণকারী এই টাকার সাহায্যে যত দূরে যাবে দাতার বিপদ-আপদও ততদূরে চলে যাবে।” এদের ধারনা বিপদআপদও একধরণের শরীরধারী জীব। এদের কুসংস্কার ও অপরিণত বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে আমার খুব আমোদ হয়েছিল।

 এরা তাদের এই সংস্কারকে দৃঢ়ীভূত করার মত একটি হেতুও পেয়ে গেল। আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত বলার দ্বিতীয় দিনের আসর ভাংগার পর আসামাই মন্দিরের পূজারীর দ্বিতীয় পুত্র তার দোকান হতে সেদিনের বিক্রয়লব্ধ টাকা নিয়ে আসার সময় পথে দেখতে পায় একটি পাঠান বরফে জমে গেছে। লোকটি জ্বালানী কাঠ বিক্রি করতে এসেছিল। পরদিন সেই ঘটনাকে উপলক্ষ করে পূজারী রটিয়ে দিল, ভাগ্যে তার ছেলে দেশভ্রমণকারীকে শরীর বুলিয়ে দশ কাবুলি দিয়েছিল নতুবা পাঠানের ওপর যে ভূত চেপেছিল সেই ভূত তার ছেলের ওপরও চড়াও হয়ে নিশ্চয়ই তাকেও শীতে জমিয়ে মেরে ফেলত। এতে আমার বেশ লাভই হল। যারা আমাকে ইতিপূর্বে দান করে বিপদ মুক্ত হবার সুযোগ পায় নি তারা আমার আবাসস্থানে এসে দান করে যাচ্ছিল। প্রাপ্তির অংকটা বেশ মোটা রকমেই হয়েছিল। সনাতনীরা আমার পা ছুঁয়ে দান করতে আরম্ভ করল যাতে তাদের কোন লোক শীতে জমে না মরে।

 শীতে জমে লোক মরে সে কথা সবাই জানে। আমাকে দশ টাকা দান করার দরুণ পূজারীর ছেলে মরে নি, তার বদলে মরেছে একটি পাঠান যে দান করেনি। এর মানে হল পর্যটককে দান করার দরুণই শীতরূপ ভূত তার ঘাড়ে না চেপে হতভাগ্য পথচারী পাঠানের ঘাড় মটকিয়েছে। অথচ কতদিন পূর্বে শীতে আমার নিজেরই কিরূপ বিপদ হয়েছিল সে কথা অনেকেই আমার মুখে শুনেছিল।

 এরূপ কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু-সমাজ সম্বন্ধে কিছুই বলব না। তবে চিন্তা করছিলাম কাবুলের হিন্দুরা সত্যিকারের পাঠান কি পাঞ্জাব থেকে নূতন করে এসেছে। সেজন্য হিন্দুদের কাছে নানারূপ প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু তার কোনরূপ সদুত্তর পাওয়া অন্তত এদের কাছ থেকে সম্ভব ছিল না। আফগানসরকার কোনও আদেশ দেবার সময় গোষ্টির প্রধানের নামেই আদেশ জারি করেন, সর্বসাধারণের নামে কোনও আদেশ দেওয়া হয় না। এতে দেখা যায় হিন্দুপরিবারগুলিও সমাজপতিদের আওতার মাঝেই এসে পড়ে। এখানে ধর্মের কোন কথাই ওঠে না। তুমি যে গোষ্টির লোক সেই গোষ্টির সংগে তোমাকে কাজ করতে হবে। পাঞ্জাব থেকে নবাগত হিন্দুদের কথা অবশ্য পৃথক।

 বর্তমানে নবাগত ভারতবাসী আর আফগানিস্থানের নাগরিক হতে পারে না। তাদের প্রত্যেককে কুড়িদিন অন্তর পুলিশ স্টেশনে কাজকর্মের হিসাব দিয়ে আসতে হয়। আফগানিস্থানে নবাগত ভারতবাসী আর নাগরিক অধিকার না পেলেও পাঠানরা কিন্তু ভারতবর্ষে সে অধিকার হতে বঞ্চিত হয় নি। এটা মোটেই দুঃখের বিষয় নয়। একসময় আফগানিস্থান ভারতেরই অংশ ছিল। স্বাধীন আফগানদের বৃটিশ সরকার তাদের পূর্ব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নি। আইন-কানুনের মানে কি? স্বাধীন মানুষ ইসরাতেই সব বুঝতে সক্ষম হয়।

 নানারূপ সংবাদ জানিবার চেষ্টায় যখন আমি ব্যস্ত ছিলাম তখন একদিন হিন্দু-প্রতিনিধি আমাকে তাঁর বাড়ীতে চা পানের নিমন্ত্রণ করেন। তাঁর নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান না করে, বরং সাদরেই গ্রহণ করেছিলাম। জানতাম হিন্দু-প্রতিনিধি নিশ্চয়ই আমার কোন সাহায্য চাইবেন, অনিষ্ট করবার ক্ষমতা আর তাঁর নাই। তার বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম স্থানীয় চিফ জাষ্টিস্ও তথায় নিমন্বিত। আইনের সর্বময় কর্তাটি ধর্মে হিন্দু কিন্তু জাতিতে পাঠান। তাঁকে সনাতনী বলেই মনে হয়েছিল। কারণ তিনিও বিধবাবিবাহের সমর্থক ছিলেন না।

 কাবুল শহরে থাকার সময় ধর্ম সম্পর্কে কয়েক দিন আলোচনা করেই বুঝেছিলাম এটাও দ্বিতীয় নেপাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মের সপক্ষে কথা বলতে পার যত ইচ্ছা, কিন্তু ধর্মের বিপক্ষে বলবার, এমন কি ধর্মে যদি কোন গলদ থাকে তবে তাও নির্দেশ করবার অধিকার নাই। সরকারী আইন ধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে রাজি নয়। সেজন্য আমাকে শুধু শুনে যেতেই হ’ত। যখনই কিছু নিয়ে প্রতিবাদ করতে হ’ত তখনই বক্তব্য বিষয়ের সমর্থনের জন্য শাস্ত্র হতে শ্লোক উদ্ধত না করলে চলত না। শাস্ত্রে আমার পাণ্ডিত্য ছিল না, কাজেই আমার চুপ করে থাকা ছাড়া উপায়ও ছিল না।

 আইনের মালিক চিফ জাস্টিস এবং হিন্দুপ্রতিনিধি উভয়েই বৃদ্ধ এবং উভয়েই যুবতীভার্যার পাণিগ্রহণ করেছেন। চিফ জাস্টিস্ মহাশয় বাচ্চা-ই-সাত্তোর রাজত্বকালে দেশ হতে পালিয়ে যান এবং ইরান দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইরানীরা তাঁর প্রতি সদয় ব্যবহার করত যদি তিনি প্রথমেই হিন্দু বলে পরিচয় দিতেন, কিন্তু তিনি তা করেন নি। পরিচয় দান-প্রসংগে নিজের গোষ্টির কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তাঁর গোষ্টির লোক এককালে ইরানীদের শাসক ছিল। তারপর যখন দেখলেন ইরানীরা তাঁর প্রতি ভাল ব্যবহার করছে না, তখন তিনি নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। ইরান সরকার তাঁকে যতটুকু সাহায্য করেছিলেন তা ইণ্টার-নেশনেল আইন বজায় রাখবার জন্যই। ইরানে চিফ জাস্টিসের শরীর ভেংগে যায়। হিন্দুপ্রতিনিধি জিজ্ঞাসা করলেন “কি করে শরীর পুনরায় গঠন করা যায়।” সে প্রশ্নের উত্তর কি দেব আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। এদিকে ওদের কিছু বলাও দরকার। অগত্যা শরীর ভাল রাখার উপযুক্ত খাদ্য খেতে পরামর্শ দিলাম। কিন্তু বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরা চেয়েছিলেন কোনও মন্ত্রশক্তির সাহায্যে তাদের যৌবন কয়েক মিনিটের মাঝেই ফিরিয়ে পেতে। বাংলাদেশের লোক সকলেরই যাদুবিদ্যা অল্পবিস্তর জানে—এই ছিল তাঁদের ধারনা এবং বাংগালীর মন্ত্রশক্তির প্রভাবে মানুষকে ছাগলে এবং ছাগলকে মানুযে পরিণত করতে পারে এটাও তাদের ধারণা ছিল। বস্ত্রব্যবসায়ী পাঠানরা নাকি এসব তাজব ব্যাপার বাংলা মুলুকে স্বচক্ষে দেখে গেছে।

 আশ্চর্যের বিষয় উভয় ভদ্রলোকই শিক্ষিত, নানা দেশের রাষ্ট্রনীতির সংগে পরিচিত, অথচ তাঁরা এরূপ মনোভাব পোষণ করেন দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম। তাঁদের বললাম “যে সকল কথা আপনার সত্য বলে গ্রহণ করেছেন সেই কথা সত্য নয়, মন গড়া কথা মাত্র।” উভয় ভদ্রলোকই আমার কথায় দুঃখিত হলেন এবং আমাকে প্রসন্নমনে বিদায় দিতে পারেন নি।

 সেদিনই বিকালবেল মিঃ আবদুল্লার সংগে ফের দেখা করলাম এবং বাচ্চা-ই-সাক্কোর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি আমাকে বললেন “বাচ্চা-ই-সাক্কো যখন পালিয়ে যান। তখন তাঁরই চেষ্টায় বাচ্চ-ই-সাক্কো ধরা পড়েন এবং পরে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।”

 কাবুল শহর রাষ্ট্রনীতি আলোচনার একটি বিশেষ আড্ডা। কাবুলের একদিকে রুশদেশ এবং অন্যদিকে ইরান হতে তুর্কি পর্যন্ত মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অধ্যুষিত দেশগুলি থাকায় রাজনৈতিক চর্চা ভাল মতেই চলে। এখানে বসে হিন্দুদের হৃৎকম্প সৃষ্টি করার মত বাক্য উচ্চারণ করার সুযোগ এবং সুবিধাও পাওয়া যায়। এখানে বসেই অনেক রাষ্ট্রনৈতিক ভারতের ভবিষ্যত নিয়ে নানা রকম প্রবন্ধ রচনা করেন। পূর্বে এখানে বসেই অনেক বৈদেশিক ধনতান্ত্রিক চীনাতুর্কিস্থানের উপর চালাবাজি করতেন। কিন্তু সোভিয়েট রুশ সেই চালবাজিতে বাধা দিয়ে তুংগান সরদার মহম্মদকে খাসগার হতে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন তিনি শ্রীনগরে বাস করছেন। এই কাবুলে বসেই একদিন আনোয়ার পাশার বোখারা আক্রমণের মতলব রচনা করা হয়েছিল। কাবুলও পৃথিবীর চালবাজির একটি কেন্দ্রস্থল। কাবুলের রুশ রাষ্ট্রদূত যখন তার বাড়ী হতে বের হন। তখন লোক অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকায়। আবার যখন একজন খর্বকায় জাপানী লাঠি হাতে করে গম্ভীর মুখে পথে পথে বেড়ান। তখন হুঁশিয়ার লোক তানাকা মেমোরিয়েলের কথা স্মরণ করে কেঁপে ওঠে। ব্রিটিশ রাজদূত উদাসীর মত পৃথিবীর সকলকে উপেক্ষা করেন এবং কি ভাবেন কিন্তু তিনি যখন পথে বের হন। তখন অনেকেই তাঁকে চীন-সম্রাটের সংগে তুলনা করে।

 কে বলে কাবুলে প্রাণ নেই? ঢাক ঢোল বাজিয়ে আমোদ হয়। নীরব নিস্তব্ধতার মাঝেও ডিপ্লমেটিক চালবাজি দেখে আনন্দ পাওয়া যায়। ডিপ্লমেটিক চালবাজি দু রকমের। আভ্যন্তরিক এবং বাহ্যিক। বাহ্যিক চালবাজিই সাধারণ লোক দেখতে পায়, আভ্যন্তরিক চালবাজি বুঝবার জন্য সাধারণ লোক চেষ্টাও করে না। আমি বাইরের চালাবাজি দেখেই আনন্দিত হতাম।

 জীবনের ঈম্পিত দ্রষ্টব্য স্থানগুলির মধ্যে কাবুল শহরও একটি ছিল। কাবুল দেখা হয়ে গেলে একদিন ভাবলাম কাবুলের বৈদেশিক কনসালদের বাড়ী বেড়িয়ে আসলে ক্ষতি কি? এই বাড়ীগুলিও দ্রষ্টব্য স্থলসমূহের মধ্যে গণ্য করা যেতে পারে। কন‍্সালদের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কারো কাছে হাত পাততে ইচ্ছা হয় নি, সেজন্যই বোধহয় সকল কন‍্সালই সাদর সম্ভাষন করতে ত্র‍‌ুটি করেন নি। একজন কন‍্সাল শুধু উপদেশাচ্ছলে বলেছিলেন “আমি যদি রুশ দেশে যাই তবে খুবই ভাল হবে। আবার সংগে সংগেই বলেছিলেন রুশ দেশে গেলে অন্য কোনও দেশের ভিসা পাওয়া মুশকিল হবে, অতএব ভাবা উচিত একদিকে সমগ্র পৃধিবী আর অন্যদিকে কেবলমাত্র রুশিয়া এ দুএর কোন‍্টার আকর্ষণ বেশী। আমি জানতাম পারেয়ারী বলে এক ফরাসী ভূপর্যটক বাইসাইকেলে রুশ দেশের এক সীমান্ত হতে অন্য সীমান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর সংগে আমার দেখা হয়েছিল সাইগনে। তিনিই আমাকে বলেছিলেন রুশরা যেভাবে পর্যটকদের সাহায্য করে, পৃথিবীর আর কোন জাতই তেমনটি করে না। সাইগনে সর্বসাধারণের কাছে যখন তিনি তাঁর ভ্রমণ-কথা বলতেন তখন রুশদেশের কমিউনিজমের প্রশংসা করতেন। রুশ দেশের কমিউনিজমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করাও তখনকার দিনে পাপ বলে গণ্য হত, সেজন্য তাঁর মনের পরিবর্তনের ব্যবস্থা হয়েছিল। ফরাসী পর্যটক পারেয়ারী কোন মতেই নিজ মনোভাবের পরিবর্তন করতে সক্ষম হন নি। সেইজন্যই অন্তত আমি যতদিন সাইগনে ছিলাম ততদিন তিনি ফরাসী ইন্দোচীন পরিত্যাগ করতে সক্ষম হন নি। এতটুকু জেনে শুনে রুশ দেশে যাওয়াটা আমার কাছে খুব ভাল বলে মনে হল না। রুশিয়ায় যাওয়ার কথা উঠলেই বিষয়টাকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করতাম। এক্ষেত্রেও তাই করলাম।

 বৈদেশিক কন‍্সালগণ সকল সময়ই অপরের মনে কি আছে না আছে জানতে চেষ্টা করেন, জিজ্ঞাসু কন‍্সালদের সে ফুরসত দিলাম না। সমস্ত পৃথিবীতে সোভিয়েট রুশিয়াকে ধ্বংস করার মতলব আঁটা হচ্ছিল, আমি কেন তাতে যোগ দেব? কোন ভ্রমণকারীর পক্ষে অন্যের অনিষ্ট কামনা করাও অন্যায়। এই ধারনা পোষণ করেই সোভিয়েট রুশিয়া সম্বন্ধে নীরব থাকতাম।