আমার আত্মকথা/আট
আট
আমাদের উচ্চ-চিন্তা, আদর্শ বা নীতিবাগীশতা এ সবই পোষাকী বস্ত্র, সমাজে বাহির হবার সময় নিজেকে লোক চক্ষে জাহির করবার বা তুলে ধরবার সময় এগুলি আমরা পরে দাঁড়াই। জীবনের ঘরোয়া কাজে—প্রাণের ভোগের আটপৌরে ব্যাপারে কিন্তু এ সাজ-পোষাক খসে পড়ে বাসনাকামনার ঘূর্ণিপাকে, তখন কোন ছদ্মবেশই আর রাখা চলে না, পশু-স্তরের ক্ষুধার্ত্ত জীবটি তার কদাকার অঙ্গ নিয়ে পুরো নগ্ন বীভৎসতায় বেরিয়ে পড়ে। আজ আমার এই পঞ্চাশ বছর বয়সে এই ঘটনা আমি কত না ক্ষেত্রেই কতবার দেখেছি। মুখে আমরা সতী, জনসমাজে লজ্জাশীলা দীঘল-ঘোমটা নারী— সতীর ও ভদ্রতার জ্বলজ্বলে বিজ্ঞাপন। খুব বড় ধর্ম্মপ্রাণ নীতিবাগীশকে দেখে হয়তো ভেবেছি, এ মানুষের বুঝি কখনও পদস্খলন হবে না। ও হরি হরি! একটু পরদা তুলে তার জীবনের অন্তঃপুরে তাকে দেখে অবাক্! তার নিজের বা মেয়ের কেলেঙ্কারী চাপা দেবার জন্যে সেই সাধু পুরুষের কি আকুলি ব্যাকুলি, কি ছেলেমানুষের মত ব্যবহার! এরকমটা কেন হয়? আমার লেখায় নানা জায়গায় মনুষ্য-চরিত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এর হেতু আমি বিশদ করে অনেকবারই বলেছি। মানুষের মন ঊর্দ্ধ-লোকের জীব— সে হচ্ছে আধ আঁধার আধ আলোকের রাজ্যের বাসিন্দা—এক কথায় সাজা ভদ্রলোক বা জেণ্টলম্যান; কিন্তু মানুষের প্রাণ হচ্ছে কাদার জন্তু, পাঁকে তার বাস এবং পাঁক তার আহার্য্য! এই মন আর প্রাণ দুইয়ে মিলে জুলে ঘরকন্না, তাই মনের আকাশ-কুসুম মনেই ফুটে চিন্তায়ই মিলিয়ে যায়; জীবনে রূপ নিতে পারে না; সেখানে পাঁকের কুমীর প্রাণই হচ্ছে রাজা, কদাকার তার লেজের ঘায়ে ঘায়ে কাদা ঘুলিয়ে অহরহ সে শিকার ধরছেই সেখানে, নির্ম্মল জীবন-জল নিত্যই রক্তে রাঙিয়ে উঠছে।
বাবা মারা যাবার পর যখন কৌঁসুলী মনোমোহন ঘোষের বাড়ীতে উইল পড়া হয়ে রাঙা মা হলেন বিষয়-আশয়ের সর্ব্বময়ী কর্ত্রী, তখন এই ব্যাপারটাকে রদ করবার জন্যে আমার ব্রাহ্ম আত্মীয়দের মধ্যে পড়ে গেল একটা আপ্রাণ চেষ্টা। যেমন নগ্ন তেমনি বীভৎস! কি করে এই অপাঙক্তেয় স্ত্রীলোকটিকে ধোপদন্ত সামাজিক আত্মীয় মহলে চালানো যায়! ছেলে মেয়ে ওর হাতে থাকলে যে উচ্ছন্নে যাবে! এই সব দুশ্চিন্তায় পরম পিতার সন্তানদের যখন প্রায় আহার নিদ্রা ত্যাগ হবার দাখিল হয়েছে তখন আমার একজন আত্মীয় (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের একজন চূড়া) এসে মায়ের সঙ্গে কথায় বার্ত্তায় উইলখানি একবার দেখতে চাইলেন। সরল মেয়ে মা আমার উইলখানা তাঁর হাতে এনে দেবামাত্র তিনি পকেটস্থ করে বললেন, “তুমি ছেলে মেয়ে পাবে না আর টাকা কড়ির দাবী যদি কর এই উইল জাল ও তোমাকে বাজারের বেশ্যা বলে কোর্টে প্রমাণ করা হবে।” এই বলে ধর্ম্মপ্রাণ মানুষটি দিব্য গজেন্দ্র গমনে প্রস্থান করলেন।
মা আমার তো কেঁদেই আকুল। অনেক কান্নাকাটি ধমক চমকের পর একটা সালিসী হয়ে স্থির হ’লো উইল মত কাজ হতে পারে যদি মা রীতিমত দীক্ষা নিয়ে ব্রাহ্ম হন। ছেলে মেয়ে হারাবার ভয়ে আকুল মা প্রথমটা রাজী হলেন, হিন্দুধর্ম্মের আচার-নিষ্ঠায় নিষ্ঠাবতী তাঁর তখন উভয় সঙ্কট উপস্থিত, বাপ পিতামহের ধর্ম্ম ছাড়াও কষ্টকর আবার ছেলে হারানোও তাঁর পক্ষে একটা নিদারুণ দুর্ব্বিষহ ব্যাপার। একদিন ব্রাহ্মসমাজে আচার্য্য আদি সব সেজে গুজে পুলকিত প্রাণে সমবেত হয়েছেন—সেই দিনই রাঙা মায়ের ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিত হবার দিন। মা কিন্তু যথা সময়ে হুজুরে হাজির হলেন না, ধর্ম্ম ত্যাগ করা থেকে মন তাঁর শেষ মুহূর্ত্তে বেঁকে বসলো। ব্রাহ্ম আত্মীয়টি রুদ্র মূর্ত্তিতে এসে অনেক ধমক চমক করলেন, শেষে ব্যাপারটা কোর্টে যায় যায়। কিন্তু খোলা আদালতে স্বামীর নামে একটা কেলেঙ্কারী করাও পতিপ্রাণা হিন্দু মেয়ের পক্ষে কতদূর কঠিন তা সহজেই বোঝা যায়। বাবার এই দ্বিতীয় বিবাহ বিবাহই নয়, আইনের চোখে এক্ট তিন অনুযায়ী প্রথম বিবাহের পর এ বিবাহ বেআইনী অপরাধ। তাঁদের দুজনের ছিল প্রেমের মিলন, অন্তরের বিবাহ—‘যদিদং হৃদয়ং মম তদিদং হৃদয়ং তব’—এই শাস্ত্রবাক্যের অনুসরণে দু’জনের হয়েছিল সহজ স্বাভাবিক হৃদয়-বিনিময়। কিন্তু ধর্ম্মপ্রাণ কি হিন্দু আর কি ব্রাহ্ম সমাজে হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত্ত মিলন তো বিবাহের পক্ষে একটা অবান্তর ব্যাপার, আসল হচ্ছে প্রাণহীন অনুষ্ঠানগুলো। আদালতের বিজ্ঞ জজদের চোখেও তাই, তাঁরা দেখবেন আইন, আর দেখবেন কেতাব মাফিক সম্প্রদান হয়েছিল কিনা, বাপ মা গুরুজন দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ে এই জবাই কার্য্যটি সমাধান করেছিলেন কিনা।
অনেক বাক বিতণ্ডা ঘোরাঘুরির পর রফা হল রাঙা মা খোর পোষ বাবদ পাঁচ হাজার টাকা মাত্র পারেন, ছেলে মেয়ে থাকবে মাতুলালয়ে দেওঘরে, তিন চার মাস অন্তর তিনি তাদের দেখতে পাবেন। ঠিক কি সর্ত্তটা এসম্বন্ধে হয়েছিল তা’ আমার আজ আর মনে নেই কিন্তু তিনি যে ছেলে মেয়েকে প্রায়ই কাছে পাবেন এটা তার মধ্যে ছিল, কতদিন পরে পরে সেটা আমি ভুলে গেছি। একটা দিন স্থির হলো আমাদের ছাড়াছাড়ির, মা আকুল কান্না বুকে চেপে সেই ভীষণ দিনের প্রতীক্ষায় রইলেন। সামনে যদি মৃত্যুদও আসন্ন হ’য়ে থাকে তা’ হলে পরমায়ুর গোণা দিনগুলি হুহু করে চলে যায়। সে কয় দিনের করুণ ব্যাপার আর আমি বর্ণনা করবো না। একদিন আমাকে ও দিদিকে নিয়ে গাড়ী করে মা চললেন সেই আত্মীয়টির বাড়ীতে, জীবন্ত দু’টি তাঁর প্রাণপুত্তলীকে বিসর্জ্জন দিতে—এই বৃথা আশা বুকে পুষে যে তবু যা হোক মাঝে মাঝে তাদের দেখে চোখ জুড়াতে পাবেন। সেখানে বাড়ীর দরজায় পৌঁছে মা আর নামলেন না, দিদিকে প্রথমে নামিয়ে নেওয়া হ’লো। আমি কিছুতেই রাঙা মাকে ছাড়বো না, তাঁকে আঁকড়ে ধরে কান্না জুড়ে দিলুম। সেই আত্মীয়টি তখন টেনে হিঁচড়ে আমায় সেই অপবিত্র কোল থেকে তাঁর পবিত্র সংসারে ছিনিয়ে নিলেন। মা মুখ চেপে চোখ বুদ্ধে অর্দ্ধ অজ্ঞান অবস্থায় গাড়ীতে পড়ে রইলেন, তাঁকে নিয়ে গাড়ী শূন্য-পুরী গোমস্ লেনে ফিরে গেল। এইভাবে সীতা হরণ করে আমায় দু’ দু’বার ছিনিয়ে নিতে হয়েছে, একবার পাগল মায়ের কাছ থেকে আর একবার এই রাঙা মায়ের কাছ থেকে। আরও একবার রাজশক্তি আমাকে সীতা হরণ করে নিয়ে প্রথমে ঘাতকের Death cell-এ এবং তার পর আন্দামানের অশোক বনে রেখেছিলেন! না জানি এখনও দগ্ধ অদৃষ্টে আরও কি আছে; তবে আশা এই যে ৫০-এর কোটা পেরিয়েছি, এখন ‘বনং ব্রজেৎ’-এর পালা বলে যদি রেহাই পাই, আর অদৃষ্টে যত কিছু হতে পারে সে দশ দশাই তো ইতিমধ্যেই হয়ে চুকেছে। বৃদ্ধ বয়সে এখন দারিদ্র্য-দুঃখও এসেছে, এখন—ভোজনং যত্র তত্র শয়নং হট্টমন্দিরে, বাকি শুধু মরণং গোমতী তীরে; সুতরাং অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি?
আত্মীয়টি আমার গুরু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, অবান্তর হাসি তাঁর শ্মশ্রুল মুখে কদাচিৎ উদয় হতো, বাজে কথা তিনি প্রাণান্তে বলতেন না। যেখানে তিনি বসতেন তার চারি ধারে বিশ হাত বেড়ে জায়গাটা গাম্ভীর্য্যে থম থম করতো, সেখানকার মানুষরা মনের ও প্রাণের গুমোটে দম আটকে পেট ফুলে মারা যাবার দাখিল হতো। তাঁর স্ত্রী ছিলেন জীর্ণা শীর্ণা রুক্ষ মেজাজের মানুষ, বাঁকা দৃষ্টি তাঁর খুঁজতো মানুষের ছিদ্র, অতি মাত্রায় মরাল মন তাঁর হিন্দু সমাজের সব কিছুকে দেখতো অসহিষ্ণু ঘৃণায়। পৌত্তলিক মানুষ ছিল এঁদের চোখে নিতান্ত কৃপার পাত্র, অন্ধকার থেকে আলোকে আনবার অভিশপ্ত আত্মা। এ বাড়ীর দুই মেয়ে ও এক ছেলে তখন নিতান্ত ছেলে মানুষ, তারাই ছিল আমাদের একমাত্র আনন্দের সাথী, তখনও দুনিয়ার ভাল মন্দের হিসাব-বুদ্ধি তাদের সরলতা নষ্ট করে নি। সে রাত্রে শুতে যাওয়া অবধি আমি অবিরাম কেঁদেছিলুম, রাঙা মাকে ছেড়ে আসবার ব্যথা আমার সারতে দশ পনর দিন লেগেছিল। তারপর পুজোর ছুটিতে আমরা গেলুম বৈদ্যনাথে—আমার মাতুলালয়ে, দিদিমা নিস্তারিণী দেবীর সংসারে দাদাবাবু ঋষি রাজ নারায়ণ তখন বেঁচে; বড় মামা, ছোট মামা, পাগল মেজ মামা, মা ও মাসী সবাই আছেন; মা রোহিণীতে আর বাদ বাকি সবাই পুরন্দাহার বাড়ীতে।
বৈদ্যনাথ আমার শৈশবের কৈশোরের ও প্রথম যৌবনের সুখ দুঃখের স্মৃতিতে জড়ানো স্বপ্নপুরী বৈদ্যনাথ। সে যে চেতনার কতখানি জুড়ে আজও জেগে আছে তা বলে বোঝান শক্ত। পূবে নীল আকাশের গায়ে গাঢ়তর সুনীল রেখার তিনটী চূড়ায় আঁকা ত্রিকূট পাহাড়, পশ্চিমে ডুবন্ত সূর্য্যের রাঙা আভা গায়ে কুব্জপৃষ্ঠ কচ্ছপের মত প্রকাণ্ড দিগড়িয়া, রাঙা মাটির ঢেউ খেলানো মাঠের মাঝে সবুজ ধান ক্ষেতের কোলে ক্ষীণ রজত রেখায় আঁকা বাঁকা দাড়োয়া নদী। উত্তর-পশ্চিম কোণে নন্দন পাহাড়ের মাথায় ভাঙা মন্দিরের গাছ গজানো দেওয়াল। চার দিকে কত শোভা, কত বনের ঘন রেখা, ধানের সবুজ আঁচল, মুক্ত দিকচক্রবাল, খোলা মাঠের ঝিরঝিরে হাওয়া, উদাস সন্ধ্যা, স্নিগ্ধ ঊষা, কাক জোৎস্না ঢালা কত না সুখ নিশি! সে বৈদ্যনাথ কি আমার ভোলবার জিনিস?
এই বৈদ্যনাথে ১৮৯৩ সাল থেকে আমার জীবনে পাঁচটি বছর কেটেছে। এই কয়টি বছরের সব ঘটনা খুঁটিয়ে লিখতে গেলে একটি অর্দ্ধেক মহাভারতের নয় পর্ব্বের অবতারণা হতে পারে। কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে পড়বার পথে এইখানে স্কুল জীবনে আমার মন প্রাণের খুব দ্রুত বিকাশ হয়েছিল। তারই গল্প এবারে বলবো। মামার বাড়ীটি ঠিক ডাক বাঙালার পাশে, পূবে ও পশ্চিমে তার উধাও সুদূর ঢেউ খেলানো মাঠ; উত্তরে মিস এডামসের মিশন-বাড়ী। এই মিস এডামস্ অতি ভক্তিমতী ও নিষ্ঠাবতী খৃশ্চান ছিলেন, তিনি অতি অকপটে ঐকান্তিকতায় বিশ্বাস করতেন প্রেমাবতার যীশুকে যে না ভজেছে তার অনন্ত নরক। আমি যখন তাঁকে দেখি তখন তিনি অতি বৃদ্ধা, একটি কাঠের গাড়ীতে তিনি বাস করতেন, ঘরের মত পরিসর সেই গাড়ীর মধ্যে ছিল তাঁর শোবার ঘর, রন্ধনশালা, লাইব্রেরী সবই। তাঁরই হাতে দীক্ষিত সাঁওতাল খৃশ্চান একজন তাঁকে ঐ গাড়ীতে করে টেনে নিয়ে বেড়াত; প্রকাও বাড়ী ও গির্জ্জার কাছে গাড়ীখানি সচরাচর দাঁড়িয়ে থাকতো। তিনি আমার দাদাবাবু রাজনারায়ণ বসুকে খৃষ্টধর্ম্মে দীক্ষিত করবার জন্যে আট দশ বছর চেষ্টা করেছিলেন, যখনই আসতেন তাঁকে ধর্ম্মোপদেশ দিতেন এবং যীশু প্রেম থেকে তাঁর বঞ্চিত দশা মনে করে সত্যি সত্যি ইনি অঝোরে কাঁদতেন। প্রায় ৭৫ কিম্বা ৮০ বছর অবধি তিনি বেঁচে ছিলেন; কোন এক সাঁওতালের কাছ থেকে কুষ্ঠ রোগের অদ্ভুত ওষুধ পেয়েছিলেন, খৃশ্চান হবার প্রতিশ্রুতি পেলেই রোগীকে নিজের নন্দন পাহাড়ের কাছে কুষ্ঠাশ্রমে রেখে সারিয়ে দিতেন, তারাও তখন তাঁর গাড়ীখানি দূর থেকে আসছে দেখে নিজেদের গ্রামের দিকে সরে পড়তো, কারণ রোগ তখন সেরে গেছে, আর বৃথা খৃষ্টান হয়ে কি লাভ। বার বার ঠকেও আবার তিনি নতুন নতুন মানুষকে ঐ সর্ত্তে ওষুধ দিতেন, ‘খৃশ্চান হবো’ বলে তাঁর কাছে না পাওয়া যেত এমন দুর্লভ বস্তু কিছুই ছিল না।
দেওঘরে এসে রাঙা মায়ের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ হলো, কলকেতায় যে এক মাস ছিলুম সেখানেও দেখা হয় নি। মানুষের মন প্রাণ হচ্ছে আনন্দের পোকা, শোক দুঃখ তার প্রকৃতির ব্যতিক্রম, তাই শোকের বা দুঃখের পুঁটলি আঁকড়ে সে বেশীদিন থাকতে পারে না। দিন গেলে সে আবার হাসে, আবার ঘরকন্না পাতে, আবার নতুন নতুন মানুষকে হৃদয় প্রাণ নতুন করে দিয়ে ফেলে। আনন্দ হাসি সুখ শান্তিই মানুষের রসঘন সত্তার আসল খোরাক; দুঃখ তার প্রকৃতির এতই বিরোধী যে বেশী দিন শোক দুঃখকে ধরে থাকলে তার মন স্বাভাবিক গতি হারিয়ে পাগল হয়ে যায়, দেহ ভেঙ্গে পড়ে। আমাদের সত্তার আঁধার পুরীতে কিন্তু (sub conscious) এমন বিকৃতি আছে এবং এমন morbid দিকও আছে যার মাঝে রয়েছে শোক দুঃখ ও বিপদ আপদের আগুনের দিকে টান। মা যখন বহু আগে মরা ছেলের জন্যে নিজ কাজকর্ম্মের অবসরে পা ছড়িয়ে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে তখন তার এই বিকৃত morbid মন সেই দুঃখের ঝাল আচারটুকু জীবে রেখে নেড়ে নেড়ে চাখে, ভোগ করে। ‘আমি বড় দুঃখী গো, আমার সর্ব্বনাশ হয়েছে গো’ এই কথা দশ জনকে ডেকে বলায় সুখ আছে, আগুনের প্রতি পতঙ্গের টানের মত মরণ বা অকল্যাণের দিকেও মানুষের একটা লোভ ও টান আছে। মৃত্যুর দুয়ারের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াবার নেশায়ই শিকারী বাঘের গুহায় যায়, যোদ্ধা যুদ্ধ করে, পরোপকারী বিপন্নকে উদ্ধার করতে আগুনে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু শোকের আঁধার ছায়া মানুষের সহজ আনন্দঘন রসস্বরূপ যে সত্তা তার বিরোধী।
মায়ের কাছ ছাড়া হবার দুঃখও আমাকে বেশি দিন বেঁধে নি। রাঙা মা আমাকে অতখানি আত্ম-বিস্তৃত হয়ে ভাল বাসতেন বলেই বোধ হয় একটা ভাসা ভাসা টান তাঁর ওপর আমারও হয়েছিল, কারণ ভালবাসায় আত্মতৃপ্তি আছে, সুখ আছে, পরম আরাম আছে। মানুষের আত্মম্ভরিতা ওতে সুখ পায়। শেষের জীবনে দেখেছি মায়ের প্রতি ভালবাসা আমার আদৌ গভীর নয়, একটা কর্ত্তব্য বুদ্ধি আমাকে তাঁর দিকে সজাগ রাখতো মাত্র। একবার খুব পীড়িত হয়ে পড়ে তাঁর শেষ দিন এসেছে ভেবে বাবা আমাকে তাঁর মৃত্যু শিয়রে ডেকে বললেন, “দেখো, আমি মলে সবাই তোমার মাকে ত্যাগ করবে, তুমি কিন্তু ওকে ত্যাগ করো না, আমাকে কথা দাও।” তাঁর মাথা ছুঁয়ে আমি কথা দিয়েছিলুম। দেওঘরে এসে বড় মামা যোগীন্দ্রনাথ বসুকে ও মাতামহ রাজনারায়ণ বাবুকে আমার অভিভাবক রূপে পেয়ে আমি বেঁচে গেলুম। কারণ এঁরা দুজনেই আমুদে রসিক লোক, আমার এঁরা হলেন বন্ধু, অভিভাবক—সে কেবল নামে মাত্র।
দেওঘরের বাড়ী এখনও জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ভেঙে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সে যুগে ঋষি রাজনারায়ণ একটি কম মানুষ ছিলেন না, তাঁর “হিন্দু ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠত।” নামে বক্তৃতায় বাংলা দেশের মনের ধারা ফিরে গিয়েছিল, ইংরাজি শিক্ষিতদের সাহেবী ধরণ ধারণের লোভ আর খৃশ্চান হবার হিড়িক থেমে গেছিল যে কজন দেশনেতা ও সুলেখকের কলমের জোরে, রাজনারায়ণ বসু তাঁদের একজন। এ জাতি যে বাঁচবে, নিজের অপূর্ব্ব সাহিত্য কলা ও স্বতন্ত্র জীবন গড়ে তুলবে তার আয়োজনের জন্যে শঙ্খ হাতে জাতির প্রাণগঙ্গার অবতরণ ঘটাবার সামর্থ্য নিয়ে কত ভগীরথ তুল্য মানুষই না এসেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র, বঙ্কিম, ভূদেবচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ—সবাই এসে বাঙালীর জীবনতরীর হাল ও দাঁড় ধরেছিলেন একে একে অর্দ্ধ শতাব্দী জুড়ে। এমন মানুষের বাড়ীখানি আজ দেনার দায়ে বিকিয়ে যাচ্ছে, দেশের ধনীদের পক্ষে এ কম লজ্জার কথা নয়। কিন্তু বলা বৃথা—দেশ আমাদের এমনই। নিজের সুসন্তানকে এ অকৃতজ্ঞ দেশ চেনে না।