আমার আত্মকথা/পরিশিষ্ট
পরিশিষ্ট
দেশে এলুম অপূর্ব্ব এক স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নিয়ে; এইখানে “আমার আত্মকথা”র প্রসঙ্গের পরিসমাপ্তি আর “বোমার কথা”র আরম্ভ। যাঁরা এই দুই শ’ পৃষ্ঠাব্যাপী আত্মকাহিনী মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা এই মানুষকে তার রক্তরাঙা বিপ্লব প্রচেষ্টার মাঝে চিনতে পারবেন কিনা সন্দেহ। যে ভাবুক খেয়ালী মানুষ বাবরী চুল রাখে, অতি সযত্নে ঢেউ খেলানো টেরি কাটে, নাগরা জুতা পায়ে দেয়, দেওঘরের পাহাড়ে বসে রবিয়ালী ভাষায় ও ভাবে প্রেমের কবিতা লেখে, বাঁকিপুরে গিয়ে মনোহারী দোকান ও চায়ের ষ্টল খোলে, আবার এক কথায় সেই দোকান তুলে দিয়ে বার শ’ মাইল দূরে গুর্জ্জর দেশে পাড়ী জমায়, সে মানুষ হঠাৎ কেন এমন একটা বীভৎস গুণ্ডামীর কাজে হাত দিল? রবীন্দ্রনাথ যদি কাল শান্তিনিকেতন ও কবির মধুমাখা কলম ছেড়ে রাতারাতি বিশে ডাকাতে পরিণত হন আর গালপাট্টা রেখে মালকোচা মেরে ঠ্যাঙ্গা হাতে অন্ধকার গলির মুখে মেছো বাজারে মানুষ ঠ্যাঙ্গাতে নামেন তা’ হলে সেটা একটা বিপরীত কাণ্ড হয় না কি? শুধু আমিই নই আমার মত হাজার হাজার নির্ব্বিরোধ নারীর অধিক কোমল প্রকৃতির মানুষ রাজনীতির পাল্লায় পড়ে ঠ্যাঙাড়েয় পরিণত হয়েছে। এই অদ্ভুত কাণ্ড কেন ঘটলো তার কারণ আমি যথাসাধ্য বিশদ করে “বোমার কথা”র মুখবন্ধে বলেছি।
প্রাণ দিয়ে দেশকে বড় করবো, এ স্বপ্ন আমার আজও প্রাণ মনকে মাতিয়ে তোলে, কিন্তু রক্তপাত আমার কাছে কোন কালেই রুচিকর নয়। মানুষের দুঃখে রোগে ব্যথায় বিপদে এত শীঘ্র কেঁদে ওঠে যার হৃদয় ও প্রাণ তার পক্ষে নিরপরাধ মানুষকে তার স্বজাতির অপরাধে প্রাণে মারতে যাওয়া কি কখন আনন্দদায়ক হতে পারে? আমি ছিলুম আনন্দের পোকা, জগৎ ছিল আমার চোখে রসের ধনি, কি স্বদেশী কি বিদেশী প্রত্যেক মানুষ ছিল তারুণ্যে উন্মুখ আমার কাছে আরব্য উপন্যাসের নায়ক নায়িকা। কবিতা লেখা আর প্রকৃতির হরিত কোলে কৃষি উদ্যান রচনা করার ঘোরাল স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমার এই ভাবে একটা খুনাখুনির মাঝে নামাটা আপাত চোখে বিসদৃশ ও ছন্দপতন মনে হলেও হয়তো পরাধীনতার ব্যথায় আতুর দেশে ঐ রকমই হয়। কত নিপীড়িত পর-পদদলিত দেশে কত কবি শিল্পী ভাবুক প্রেমিক নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে দেশের দরদে, এই মুক্তির পাগল করা স্বপ্নে। ভারতের এই দুর্দ্দিন কেটে গিয়ে জগতে মানুষের মুক্তির যুগ এলে ইংরেজও একদিন বাংলা দেশের এই পাগলামিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। আজ রাজনীতির অন্ধ ঝঞ্ঝায় ইংরাজ ও বাঙ্গালী সমান অন্ধ, আপন পর জ্ঞান তাদের হারিয়ে গেছে, এক মানবতার উদার প্রেম সে তো বহু দুরের কথা। তাই আমাদের সুকৃতি দুষ্কৃতির প্রকৃত হিসাব করবার দিন এখনও হয়তো আসে নি।
কিছু দিন বাঙলা দেশে ব্যর্থ বিপ্লব প্রচেষ্টা করবার পর যতীনদার সঙ্গে গৃহ বিবাদে আমাদের কেন্দ্রটী ভেঙে যাওয়ায় আবার সেই বরোদায় আমি সেজদা’র সঙ্গে ফিরে যাই। সেখানে আবার কিছু কালের জন্যে আরম্ভ হ’লো সেই শান্ত সুখ-নিবিড় নিরালা জীবন, সেই শিকার, কবিতা চর্চ্চা ও সব্জীবাগ। তখন আমি বোধ হয় ‘মিলনের পথে’ লিখছি। আবার আমাদের প্লাঞ্চেট নিয়ে ভূতের রিসার্চ্চ আরম্ভ হলো। এবার কে একজন অনৈসর্গিক জীব রামমোহন না বিবেকানন্দ অমনি একজনের নামে এসে আমাদের ক্রমাগত উত্তেজিত করতে লাগলো দুর্গম বনে পর্ব্বতে ‘ভবানী মন্দির’ গড়বার জন্য। এই মন্দিরে দীক্ষাপ্রাপ্ত সমর্পিতপ্রাণ কর্ম্মী সব বাঙলা দেশে গড়বে অনুপম এক মুক্তির পীঠস্থান।
আমার প্রাণ ও হৃদয় সত্তার মাঝে আছে কে এক কবি, অতি বালক কাল থেকে যার খেলাই নানা ঘোরাল রসাল স্বপ্ন নিয়ে। খুব ছোট বেলা ১৪।১৫ বছর বয়সেও আমার মনে আছে প্রাণের মাঝে জাগতো একটা প্রবল বেগ, একটা আকুল উর্দ্ধ দৃষ্টি, বড় কিছু হবার অদম্য স্পৃহা। দিন যেন আমার বৃথা বয়ে যাচ্ছে, কি যেন একটা বৃহৎ ও সার্থক আয়োজন করতে হবে, এক দিনের বা পাঁচ দিনের বিলম্বে যার বিমল শুভ্র সৌধ নীল আকাশ ছুঁয়ে বুঝি আর উঠবে না। এই চঞ্চল উচ্চাকাঙ্ক্ষার বেগে আমি আমার চার পাশের মানুষকে চিরদিন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি; আমি চলেছি আপন স্বপ্নে নিজের বেগে আর তারা আমাকে ঘিরে জটলা করে চলেছে আমার তাড়ায়। তাদের মধ্যে হয়তে। সবাই চায় নি কিছু, কিন্তু তবু আমার ডাকের টানে আমার আশার ছোঁয়াচ লেগে তারাও না চেয়ে পারেনি।
ছেলে বেলায় দরিদ্রের সেবার স্বপ্ন, নিষ্কলঙ্ক নৈতিক জীবন গঠনের স্বপ্ন, তারপর সাহিত্যের রসের আয়োজন, দেশপ্রেমে বিশ্বজয়ী বীর হবার কামনা; তার পরে কৃষি, দোকানদারী, বরোদার জীবন; অবশেষে রাজনীতির ঘূর্ণিপাক, বিপ্লবের রক্তচুল্লী, সব শেষে ধর্ম্মের নেশা—দিব্য কোন্ পরম জ্যোতির্লোকের অভিমুখে জয়যাত্রার অভিযান। সব গিয়ে এখনও আছে ঐ সবেরই কিছু কিছু ভগ্নাংশ, বুঝি সব কয়টি মিলে হয়েছে জগতে মানব সমাজে এক উজ্জ্বল সুসমঞ্জস সত্যলোকের আবির্ভাবের স্বপ্ন। আমার তো বোধ হয় চেষ্টা করলে সত্যই এটা হয়, এই ভাঙা-চোরা বিসদৃশ অর্দ্ধোন্মাদ জগতের দিকে চাইলে অবশ্য এই উপাদান নিয়ে সেটা যে খুব সম্ভব ও খুব সহজে কার্য্যকরী তা’ মনে হয় না বটে কিন্তু অন্তরের সেই ধ্যানস্তিমিত স্বপ্ন পুরুষের দিকে চাইলে সমস্ত সত্তা গর্জ্জে ওঠে, “এযে অনিবার্য্য, ওরে মন হবেই হবে।”
জগতে প্রচুর অন্ন বস্ত্র, প্রচুর ভোগোপকরণ ও অনন্দ সম্ভার থাকতে মানুষ কি চিরদিনই করবে কোটীপতি আর চিরকন্থাধারী ভিখারীর অভিনয়? সাম্নে অন্নকুট সাজিয়ে চিরদিনই এমনি করে তারা হাজারে হাজারে লাখে লাখে মরবে মর্ম্মান্তিক ক্ষুধার তাড়নায়? সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর মানুষের শতকরা নব্বই জন হয় গৃহহারা আর নয়তো পর্ণকুটীরবাসী। ভগবান যাকে চারদিকের বাঁধন খুলে মুক্ত করে দিয়েছেন জন্ম, সে কি এমনিই সারাটা জীবন জুড়ে করবে রাশি রাশি শৃঙ্খল রচনা আর নিজের চারপাশে তুলবে সমাজ ধর্ম্ম রাষ্ট্র ও বিধির কারা প্রাচীর? একি বিসদৃশ ব্যাপার বল দেখি? মানুষ কি সর্ব্ব সংস্কার বিমুক্তির পরম নিশ্চিন্ততায় আবার ফিরে যেতে পারে না? দশজনকে নিয়ে সে কি সুখী হতে ভুলে গেল? মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের নিরুপম ছন্দটি কি এমনি করে একেবারে হারিয়ে গেছে! আজও তাই মনে হয় আর একবার বের হই সর্ব্ব বিমুক্তির বাণী নিয়ে, প্রেমের—মহামানবতার আদর্শের—মশাল হাতে আর একবার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে করি অভিযান—মানুষকে মানুষ করবার জন্যে মানুষেরই বিরুদ্ধে অভিযান।