পাঁচ

 —গলির বাড়ীখানায় আমার কলকেতা আসার পর অল্প দিনই আমরা ছিলুম। সে বাড়ী ছিল ভূতের বাড়ী। রাত্রে একটি মেয়ে মল বাজিয়ে নাকি ঝমর ঝমর করে সারা বাড়ীখানায় বেড়াতো। একদিন আমার বেশ মনে আছে রাত্রে সোরগোল করে সবাই জেগে উঠলো, শোনা গেল চঞ্চলা সে মেয়ে নীচের চৌবাচ্চা থেকে বালতি বালতি জল তুলে তেতলার ছাদে সিঁড়ি অবধি ভিজিয়ে দিয়েছে। মানুষ ছুটোছুটি করে ওপরে গেলে নীচে ঝমর ঝমর করে মল বাজে, নীচে এলে মাঝের তলায় বাজে, মাঝে এলে ছাদে গিয়ে রুণু ঝুণু করে শব্দ কোথায় হারিয়ে যায়। এই বাড়ীতে ঘুমের ঘোরে আমার মনে হতে লাগল কে যেন আমার ডাকছে, সে ডাক যেন না শুনে উপায় নেই, যেতেই হবে আমায় সেই অজানা অচেনা ডাকের অনুসরণ করে। রাত্রে ঘুমের ঘোরে আমি উঠে জাগা মানুষের মত ঘুরতুম somnambulismএর মোহে, দশ বার জন লোক মিলে আমাকে এনে খাটে শোয়াতে পারতো না, এত জোর আসতো আমার মত জীর্ণ শীর্ণ কৃশকায় বালকের শরীরে। একদিন একেবারে নীচে নেমে বাবুর্চ্চিখানার উঁচু চুলোর গন্‌গনে আগুনের কাছে চলে গেছিলুম।

 বোধ হয় এই সব কারণে ও-বাড়ী ছেড়ে দিয়ে গোমস্ লেনের বড় বাঙলো প্যাটার্ণের একতলা বাড়ীতে আমাদের আসা হয়েছিল। এমনি আমাদের অদৃষ্ট—দেখা গেল সে বাড়ীতেও আছে ভূতের বাথান। সে অপূর্ব্ব ইতিহাস পরে বলছি।

 আমাকে বাবার যে বন্ধুটি রোহিণী থেকে নিয়ে এলেন তাঁর নাম ছিল চিন্তামণি ভঞ্জ চৌধুরী; খুলনার তিনি ছিলেন এক দুঃস্থ ক্ষুদে জমিদার,—বাবার এক গ্লাসের ইয়ার। গাঢ় শ্যামবর্ণ মোটা সোটা গোলগাল ভুঁড়েল মানুষটি, গোল নাক—bottle nose যাকে বলে; চিন্তামণি ছিলেন বড় রসিক লোক, তাঁর সঙের মত হাবভাবে সবাই হেসে কুটিপাটি হ’তো। রহস্য করে তিনি দিদিকে বলতেন ‘মাসী’, দিদিও রেগে কাঁই হতেন তাঁর পায়ে-পড়া রসিকতায়, দু’জনের কাণ্ড দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি দিত। আমি কলকেতায় আসবার এক মাস আন্দাজ পরে একদিন ভোর চারটের সময় ঝাঁকড়া চুল বেচো কুকুরটা ডাকাডাকি ঝাঁপাঝাপি জুড়ে দিল। সবাই বুঝলো খুলনা থেকে বাবা এসেছেন, বাবার সাড়া পেলেই কুকুরটা ঐ রকম লম্ফ ঝম্ফ শুরু করে দিত। এমন কি, তিনি যখন তার দৃষ্টির বাইরে আছেন—দারোয়ান গেটও খোলে নি, তখনই সে টের পেত যে তার মনিব এসেছে।

 আমার সজ্ঞানে এই প্রথম বাবার কলকেতার বাড়ীতে আসা—সে এক মহোচ্ছব ব্যাপার। তাঁর হারানো সন্তানকে ফিরে পাবার আনন্দে আমাকে সে কি আদরের ঘটা! বাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ী ভরে গেল বিস্কুট পনির মাখম ফল মূল তরি তরকারী আদি সুখাদ্যের প্লাবনে। দেখলুম বাবার কাছে দিদির ও আমার সমান আদর, সে ভালবাসা মায়ের স্নেহের মত একচোখো নয়, কোন প্রতিদানের প্রত্যাশা রাখে না বলেই বাবার সে ভালবাসা প্রতিদানে বঞ্চিত হলেও কারু ওপর বিরূপ হয় না। তারপর থেকে অনেক পরিবারে অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি ভালবাসার এই কাঙাল ভিখারীর রূপ, কবিস্তুতি ও কিম্বদন্তির দ্বারা আকাশে তুলে ধরা মাতৃস্নেহ—তাও যে কতখানি স্বার্থপর হতে পারে তা’ বেশ বোঝা যায় যখন দেখি মা সেই সম্ভানটিকে হৃদয়ের সব তত্ত্বগুলি দিয়ে জড়িয়ে বুকে রাখছেন যে তাঁকে অসহায়ের মত আশ্রয় করছে, অহরহ মন জুগিয়ে ভালবাসার সাংসারিক প্রতিদান দিচ্ছে। যে ছেলে বা মেয়েটী একটু রাগী বা একবগ্‌গা তাকে মা বাপের কাছে সইতে হচ্ছে তাড়না গঞ্জনা আর অবহেলা। তবু বাধ্য মমতাময় সন্তানকে ফেলে অবাধ্য চরিত্রহীন সন্তানকেই মা যে কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ হচ্ছে চিরটা কাল ভালবেসেই চলে, সে হচ্ছে একান্তই প্রকৃতির বশে। ঠিক দৈহিক ক্ষুধা তৃষ্ণার মত আমাদের বুভুক্ষু হৃদয় ও প্রাণের আছে দুর্দ্দম বেগ যা’ অনুপযুক্ত নির্ম্মম মানুষের কাছেও আমাদের কেশাকর্ষণ করে আত্মসমর্পণ করায়,—তা সে স্বামী হোক, পুত্র হোক, বন্ধু হোক, প্রণয়ী হোক, সামাজিক হিসাবে প্রণয়ের যত বড়ই অপাত্র হোক না কেন—প্রণয় বা স্নেহ ভালবাসা পাত্রাপাত্র বাছে না—cupid is blind, অন্ধ লতার মত কাটা গাছকেও সে অবাধে আশ্রয় করায়। তারপর এদিক দিয়ে আরও অনেক জটিল তত্ত্ব আছে উদ্ঘাটন করবার। এ জগতে কে যে কাকে ভালবাসে, কার সত্তার কোন্ স্তর থেকে দুর্দ্দম টান এসে আর একজনের কোন্ দিকটা বিহ্বল করে তোলে তার ওপর সমস্ত ব্যাপারটা নির্ভর করে। সে কথা প্রসঙ্গান্তরে বলবো।

 মাসের মধ্যে দু’একবার বাবা আসতেন আর ২।৪ দিন থেকে চলে যেতেন। কলকেতায় থাকার সময়ে তাঁর সঙ্গে আমরা যেতুম গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে খোলা ফিটনে বসে, এই সময়টির জন্যে সাহেব আমার tip-top বাবার পাশে মা বসতেন বুক-খোলা গাউন পরে নানা ফুল-ফলে ডরা লেডিজ হ্যাট মাথায় দিয়ে রুমাল হাতে। সে বেশেও রূপসী ম আমার গড়ের মাঠ ও ইডেন গার্ডেন আলো করে চলতেন তাঁর সম্রাজ্ঞীর বাড়া লাবণ্যে ও শ্রী গরিমায়। এই মা যে কে, কোথা থেকে এসে কবে আমার বাবার শূন্য জীবন সুখের প্লাবনে ভরে দিয়ে তাঁর ভাঙা সংসার আবার গড়ে তুলেছিলেন
পিতা স্বর্গীয় কৃষ্ণধন ঘোষ
তা’ অনেকদিন আমি জানতুম না। মায়ের কুলজী সন্তানের কাছে কি অমন করে খোঁজবার জিনিস? তা খোঁজে কেবল মরালিটির হিষ্টীরিয়া-গ্রস্ত এই সমাজ, আর তার ফিটফাট ধোপদস্ত স্তম্ভগুলি। মা কি জানিস তা আমি আমার শৈশব ভরে কখনও জানি নি। এই অজানা রাঙা-মা আমার সে আস্বাদ আমায় প্রথম দেন। আমি সত্যি সত্যিই হয়েছিলুম তাঁর চোখের মণি।

 দু’ তিন মাস পরে পরে একবার করে আমরাও যেতুম খুলনায় বাবার কর্ম্মস্থলে। সে খড়ের ছাওয়া বাড়ীখানি ছবির মত এখনও আমার চোখের সাম্‌নে ভাসছে। সামনে বাগান, বাড়ীতে উঠতেই একটুখানি বারাণ্ডা; তার একপাশে বাবার বসবার ঘর। ভিতরে বড় হল ঘর, তাতে ডিনার টেবিল। হলের দু’ পাশে দু’খানি করে ঘর, ভিতর দিকেও একফালি বারাণ্ডা। প্রকাণ্ড কম্পাউণ্ডের মধ্যে এই বাড়ীখানি। দূরে বাবুর্চ্চিখানা, ঘোড়ার আস্তাবল, মুরগী-হাঁসের ঘর, গোশালা। কম্পাউণ্ডে ঢুকতে বাঁশের জাফরী ঘেরা লতায় ঢাকা একটি বসবার কুঞ্জ। এই ছিল খুলনার প্রবল প্রতাপ মুকুটহীন রাজা ডাক্তার কে ডি ঘোষের আস্তানা। বাবা আমাকে পাশে বসিয়ে টমটম্ হাঁকিয়ে কাজে বের হতেন আর দেখতুম দু’ধারে মানুষ শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ছে, সমস্ত পথ তিনি যেতেন মাথার টুপি তুলতে তুলতে সেই মুহুর্মুহু নমস্কার, সেলাম ও প্রণামের প্রত্যভিবাদন দিতে দিতে। এজলাসে বসে মাজিষ্ট্রেট যখন বিচার করতেন তখনও বাবা থাকতেন চেয়ার নিয়ে তাঁর ডান পাশে বসে—পরামর্শ দাতা রূপে। জেলে সিভিল সার্জ্জনরূপে বাবাই ছিলেন হর্ত্তা কর্ত্তা বিধাতা, জেলার সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট আদি কর্ম্মচারীরা ছিল নামকাওয়াস্তে। পি ডবলিউ ডি, স্কুল, ডিস্পেন্সারী যা’ কিছু খুলনার ছিল সর্ব্বই সর্ব্বঘটেই এই মুকুটহীন রাজার ছিল দোর্দ্দণ্ড প্রতাপ—অদ্ভুত একাধিপত্য।

 কলকেতার বাড়ীতে একদিন বাবা এসেছেন। গভীর রাত্রে একটা সোরগোল শুনে আমি জেগে উঠে শুনলুম ভূত বেরিয়েছে, আমাদের দারোয়ান তেওয়ারীজীর পায়ের বুড়ো আঙ্গুল চেপে ধরেছিল। কলকেতার গোমস্ লেনের বাড়ীখানি ছিল বাঙলো প্যাটার্ণের। সামনে গেট, একটু উঠান পার হয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি, তারপর বারাণ্ডা; সামনে একটি বড় হল ঘর, তার পরে পাশাপাশি দু’খানি এবং তারও পরে ঠিক অমনি দু’খানি মোট চারখানি ঘর। বারাণ্ডাটি চলে গেছে ঘুরে এই হল ঘর ও দু’খানি ঘর বেড়ে পিছনে বাবুর্চ্চিখানার দিকে। এই দিকে ছাদ, কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে প্রথমে নীচু রান্নাঘর ও দাসদাসীদের ঘরের (out houseএর) ওপর এবং পরে আসল বাড়ীটির ওপর আর এক প্রস্ত ঘুরে উঠেছে প্রকাণ্ড ছাদে। গেট দিয়ে ঢুকে দুই দিকের বারাণ্ডা বেয়ে রান্নাঘরের নীচু উঠানে নেমে আাবার একটি সরু রাস্তা বেয়ে সমস্ত বাড়ীখানিকে পাক দিয়ে আসা যায় পুনশ্চ সদর গেটের কাছে। ভূতটি নাকি কুলি ভূত, এই বাড়ী হবার সময় সেই যে অসম্পূর্ণ ছাদ থেকে পড়ে তার অস্থি দিয়ে এই বাড়ীখানি গড়বার সাহায্য করে গেছে সে মায়া আজও সে কাটিয়ে উঠতে পারে নি। রাত বারটা একটার সময় সবাই দেখে সে তার বাবরী চুল নিয়ে খাটো হাতকাটা কুর্ত্তা পরে কালো মুস্কো জোয়ান বলিষ্ঠ শরীরটির রূপে দশ দিক আঁধার করে এসে গেট দিয়ে বাড়ীতে ঢোকে এবং বাড়ীটি একবার প্রদক্ষিণ করে বেরিয়ে যায়, কখনও বা ছাদে উঠে ছোট ছাদের গায়ে গয়লাদের বাড়ীর দেওয়াল বেয়ে গজানো যজ্ঞী ডুমুর গাছটীর কাছে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। আশ্চর্য্য এই জাতের গণ্ডী,—এই আভিজাত্য ও দারিদ্র্যের সীমা; ভূতের দেশেও এটা অক্ষুণ্ণ ভাবে টিঁকে আছে। এখানকার রাজা মরে সেখানেও মুকুট মাথায় দণ্ড হাতে বেড়ায়, এখানকার শ্রমজীবীরা সেখানেও বোধ হয় গতর খাটিয়ে যায়। আমাদের দারোয়ান রামরাজ তেওয়ারী খুব ওস্তাদ লাঠিখেলোয়াড় ছিল, সাহসীও কম ছিল না, তার কাছে কে নাকি এই ভূতের গল্প করায় সে জিদ করে সেই দিন তার খাটিয়াটিকে বারাণ্ডায় আড়াআড়ি ভাবে রেখে ভূতের পথ রুখে শুয়েছিল। রাত্রে যথা সময়ে ভূতপ্রবর এসে এই অনধিকার চর্চ্চা ও tresspassএ চটে তেওয়ারীজীর পায়ের বুড়ো আঙুলটা শুধু চেপে ধরা এবং তাতেই তেওয়ারীজীর জেগে পৈতা হাতে রামনাম জপ। সোরগোলে তো আমরা সব উঠে পড়লুম; ততক্ষণ ভূতটি ছাদে উঠে ঐ ডুমুর গাছে মিলিয়ে গেছে।

 আমাদের এক মুসলমানী ঝি ছিল, সে একরোখা মেয়ে, কথাটা শুনে নথ নেড়ে তেওয়ারীকে ঠাট্টা করে দু’শ কথা শুনিয়ে দিলে। তেওয়ারীজী ঐ ছাদে ডুমুর গাছের কাছে যাবার জন্যে তাকে challenge করায় রাগী মেয়েটাও রাগ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে সরাসর চলে গেল অকুস্থানে এবং তখনি আবার যথাশাস্ত্র ফিরে এসে ঘাড় মুড় ভেঙে পড়লো ফিট হয়ে। তার জ্ঞান করাতে আধঘণ্টাটাক লেগেছিল। তারপর থেকে দু এক দিন রাত্রে উঠে দেখতুম দরজার খড়খড়ি খুলে বাবা মাঝে মাঝে বারাণ্ডার দিকে দেখছেন আর গুলিভরা পিস্তল হাতে ঘরের মধ্যে ঘুরছেন। ভূত কি স্বদেশী বিপ্লবী, যে, গুলি করলেই ‘বন্দেমাতরম্’ বলে ধরায় লুটিয়ে পড়বে আর একটা পিলে চমকানি গোছের confession করে বুভুক্ষু সংবাদ পত্রগুলির লম্বা চওড়া (flaring headlines) স্তম্ভের খোরাক যুগিয়ে যথাশাস্ত্র মরে যাবে?

 এই গোমস্ লেনের বাড়ীতে এক বুড়ী গয়লানী দুধ যোগাতো, তার নাকে ছিল এক প্রকাণ্ড ফাঁদী নথ।অতবড় নথ আর আজকাল কোথাও বড় একটা দেখা যায় না। মা ও সবাই আমায় ক্ষেপাতো ঐ বুড়ী গয়লানীকে আমার বৌ বলে আর গয়লানীও আমাকে চুমো খাবার জন্যে ধরতে আসতো তার শিরাকীর্ণ হাত দুটো মেলে। আমি চিল চীৎকার করে চেঁচিয়ে দিতুম কান্না জুড়ে। ঐ ডুমুর গাছটার ওধারে ছিল বুড়ীর বাড়ী, সেইখানে থাকতো তার এক গোয়াল গাই আর বুড়ো অথর্ব্ব কেসো রুগী গয়লা। আমাদের বাড়ীর আর এক দিকে থাকতো আর এক বুড়ী, তার ছিল ৪০ টা বেরাল; সে বুড়ী ছাদে বড়ী বা আমসত্ত্ব দিলে সেই চল্লিশটা বেরাল ঘিরে বসে কাক তাড়াতো এবং পাহারা দিত। এই গোমস্ লেনের বাড়ী থেকে সেজেগুজে আমরা সাহেবী চালে ফিটন গাড়ীতে চড়ে যেতুম মিউনিসিপ্যাল মার্কেটে বাজার করতে আর ময়দানে হাওয়া খেতে। তখন ট্যাক্‌সী মটর লরী বাস প্রভৃতি গর্দ্দভরাগিণীওয়ালা পদার্থ ছিল কল্পলোকে, কলকেতা সহর ছিল ছ্যাকরা গাড়ীর ছ্যাড়-ছ্যাড়-ছ্যাড় রবমুখর স্থান।

 আমাদের গোমস্ লেনের বাড়ীর সংসারে যে ক’জন ছিল অন্তরঙ্গ তাদের ৩।৪ জনকে আমার মনে আছে। বাবা একটী দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তানকে লেখাপড়ায় সাহায্য করতেন, সে আমাদের সংসারে আমাদেরই একজন হয়ে থাকতো। বড় লোকেরা যেমন গরীর ছেলে পোষে আর তাকে বাজার সরকারের মত খাটায় তেমন নয়,—তাকে ঘরের ছেলের মত এক অন্নে সেণ্ট জেভিয়ার কলেজে পড়ানো হতো। তার নাম ছিল যদুগোপাল চট্টোপাধ্যায়। এই ছেলে পরে শুনেছি জয়পুর কলেজের অধ্যাপক হন। এখনও তিনি জীবিত, মাঝে মাঝে তাঁর খবর পাই কিন্তু কোথায় যে কি করেন যদুদা’ এখন তা’ এতবার শুনেও কিছুতেই আমার মনে থাকে না। যদুগোপাল ছিল রোগা, শান্ত শিষ্ট, কোমল স্বভাবের স্বল্পভাষী ছেলে, মুখে থাকতো তার সর্ব্বদা হাসিটি লেগে।

 মায়ের তাসের আড্ডায় একজন ইহুদী ছেলে আসতো যেতো, জিনের ইজের কোট পরা, মাথায় জরিদার ইহুদী টুপী, মুখে দিবারাত্র সিগারেট, শিস আর গান; চঞ্চল, সর্ব্বদা হাসি-খুসী আমোদ ইয়ারকীতে মশগুল; এ ছেলেটি এসেই দুপুরে তাসের আড্ডা জমে উঠতো খুব। ছেলেটা ভবঘুরে, কোথায় ব্যাণ্ডের দলে ঢুকে ক্ল্যারিয়নেট বাজাতো, আর একটি ধনী ইহুদীর পরমা সুন্দরী মেয়ের প্রেমে হাসি খুসির ফাঁকে ফাঁকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। একদিন তার মায়ের সঙ্গে মেয়েটি আমাদের বাড়ীতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল, আমাদের সঙ্গে হুটোপাটি করে লুকোচুরি খেলেছিল। লম্বা ছিপছিপে, রসে ঢলঢল লতার মত, গৌরাঙ্গী, কালো নিবিড় চোখ, প্রবালের ঠোঁট, একমাথা ঘনকৃষ্ণ চুল,—এই ছিল ইহুদী ছোকরার উপাস্য দেবী—তার জীবনের সুদূর দিগন্তের চাঁদ। তারা বড়লোক আর এ বেচারী গরীব, তার ওপর সে জীবনের জলের ওপরে ভাসমান বোহেমিয়ান শ্যাওলা,—ব্যাণ্ড-বাজিয়ে বওয়াটে ছেলে। সামাজিক মানুষের কাছে প্রেম ভালবাসা জাতীয় আকাশ কুসুমের চেয়ে মোটা মাহিনার চাকরীর দর অনেক বেশি। মেয়ের জীবনের সুখ মানেই সোণা দানা পোলাও পরমান্ন দাস দাসী বাড়ী গাড়ী, ছেলেটি হয়তো বড় ঘরের পাঁঠা—মদে ও আনুষঙ্গিকে ডুবে আছে; তা হোক, তবু কত বড় ঘর! তাই বলি মানুষের চেয়ে শিক্ষিত মর্কট আর আছে?

 তার ট্যারা ব্যাঁকা বাঙলা উচ্চারণ দিয়ে এই ইহুদী যুবক যখন গান ছাড়তো,

ও আমার সাধের বকুল ফুল!
স্নানের ঘাটে নাইতে গিয়ে
হারালেম দুকুল।

তখন আড্ডায় আমাদের হাসির দমকা হাওয়া বয়ে যেত। বাইরের ঘরে একটা ক্যাম্প খাটে মাঝে মাঝে রাত্রে এসে শুয়ে থাকতো, কখনও বা ড্রইংরুমে বা পাশের ঘরে সেই খাটটা টেনে নিয়ে রাত কাটিয়ে দিত। তাসখেলায় সে প্রায়ই হারতো আর হারলেই বুক চাপড়ে নেচে কুঁদে পাছা থাবড়ে নানা রকম দুঃখের সং দিয়ে আমাদের হাসাতো। আমার দিদির ও মায়ের এই আমুদে ছেলেটি ছিল ব্যাঙখোঁচানী করে আনন্দ পাবার জিনিস। কলকেতার সহর ছিল তার নখদর্পণে, তাই গোমস্ লেনের সংসারে কোন দুর্ল্লভ দুষ্প্রাপ্য বস্তুর দরকার হলে সে কলকেতা সহর ঘুটে তা’ নিয়ে আসতো।

 আগেই বলেছি দারোয়ান রামরাজ তেওয়ারী ছিল খুব পাকা লাঠি খেলোয়াড়। একদিন গোমস্ লেনের পাড়ার মুসলমান ছেলেদের একটা বল এসে বাড়ীর মধ্যে পড়ে, আমি সেটা কুড়িয়ে নিই। সেই নিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে ছোঁড়াদের বচসা হওয়ার পর প্রায় দু’ তিন শ’ মুসলমান এসে আমাদের বাড়ী ঘেরাও করে। রামরাজ দেখি হঠাৎ ফটক একেবারে হাঁ করে খুলে দিয়ে তার পাকা বাঁশের তারের গাঁটবাধা তেল চকচকে লম্বা লাঠি গাছটা নিয়ে সাম্‌নে দাঁড়াল আর হেঁকে দিল—কোন বাপের ব্যাটা যদি ভিড়ের মধ্যে থাকে একবার এগিয়ে আসুক। সেই ভরা দুপুরের রোদে তেওয়ারীজীর লাঠি ঝক্ ঝক্ করে ঘুরতে লাগল পাঁচ সাত হাত জমি বেড়ে, লাঠি বড় দেখা যাচ্ছিল না, দেখা যাচ্ছিল একটা রৌদ্র প্রতিফলিত চক্র মাত্র। বলা বাহুল্য কেউ এগিয়ে এলো না, লাঠিখেলার তারিফ শতমুখে করতে করতে জনতা গেল ভেঙে। জনতা ভেঙে যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল এই যে, পুলিশে খবর গেছিল, লাল পাগড়ী আসার আগেই অকুস্থান ত্যাগ করে নির্ব্বিঘ্ন নীড় আশ্রয় করাই ফুর্ত্তিবাজ জনতার তখন উচিৎ মনে হয়েছিল। বাবা মারা যাবার পরে এই দারোয়ানজীর ইতিহাস খুব সুন্দর, তা’ যথাস্থানে পরে বল্‌বো। সে রাঙা মাকে নিজের মায়ের যতই শ্রদ্ধা করতো।