বার

 কৈশোর ও যৌবনের সে দিনগুলি ছিল বড় মিঠে ও সুখদ। দেওঘরে অবাধ প্রকৃতির স্নেহ-কোল, স্নিগ্ধ রঙীন প্রাণকাড়া ঊষা, রহস্য-নিবিড় ঘোরাল গোলাপী সন্ধ্যা, সরল আমুদে বাল্য বন্ধুগুলি, অনর্গল কবিতা চর্চ্চা, উচ্চ আশার কত স্বপ্ন, মিঠে বিরহের ও অমিলনের বেদনা-মাখা ভালবাসার খেলা—একটি ছোট গৌরী কিশোরীকে ঘিরে—এত উপকরণেও যদি জীবনটা না ভরে ওঠে তা’ হলে ভরবে আর কিসে! তা’ ছাড়া কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে মানুষের মন হৃদয় প্রাণ সবই থাকে সহজ, নমনীয় ও আশায় আশায় রঙীন; ব্যর্থতা, বেদনা, নৈরাশ্য, বাধা এসে এসে তখনও ঘাত প্রতিঘাতে মন-প্রাণে কড়া পড়িয়ে কঠিন করে দেয় নি, জীবনে নিরস cynicism এসে বৈরাগ্য ও উদাস নিরাশার কালো মেঘ জমায় নি।

 এত সুখ আরও জমাট বাঁধতো যখন পূজোর ছুটিতে সে আসতো কাছে। তখন প্রতি সন্ধ্যায় আমুদে সুরসিক বড় মামাকে সভাপতি করে বসতো আমাদের nonsense-clubএর বৈঠক। এই বৈঠকের কড়া নিয়ম ছিল—প্রতি রাত্রের অধিবেশনে প্রত্যেক সভ্যকে একটা অন্ততঃ বেশ মজাদার রসিকতা করতে হবে, তা’ না করতে পারলে সে রাত্রের মত তার নাম কাটা যাবে। এই ক্লাবে আমি ও বড় মামাই ছিলুম সব চেয়ে বড় গোপাল ভাঁড়, রামায়ণ মহাভারতের যুদ্ধে যেমন বর্ষার জলের মত আকাশ ছেয়ে বান পড়তো, আমাদের দু’জনকে তেমনি অবিরাম চালিয়ে যেতে হতো রসিকতার শরবর্ষণের ঝড়। এই নৈশ অধিবেশনে আমার ছিল সব চেয়ে বড় সুখ তার কাছটি ঘেঁসে বসা ও তার সুন্দর রক্তাধর প্রান্তে ও আকর্ণ দুটি চোখে কেবলি হাসি ফোটান। কখন কখনও সদ্য ওঠা চাঁদের আলোর নেশায় বিভোর হয়ে সে র‍্যাপারের তলায় লুকিয়ে হাত খানি দিত আমার কোলের ওপর, চোখে নিবিড় করে চোখ রেখে বুকের মাঝে তুলতো সুখের ঢেউ আর দেহে জাগাত আনন্দের অপূর্ব্ব শিহরণ।

 আর একটা আনন্দের ব্যাপার ছিল সকাল ও সন্ধ্যায় বেড়াতে যাওয়া। তার সঙ্গে গাছে গাছে পাথরের গায়ে মন্দিরের দেয়ালে তারই নামের পাশটিতে ছুরি দিয়ে নিজের নামটি খুদে রাখা, তাকে পাশে নিয়ে পাথরের মাথায় বসে গান শোনা, ছবি তোলা, গল্প করা, নানা ছুতোয় ও অছিলায় অতৃপ্ত চোখে চেয়ে চেয়ে তার রূপ-সুধা বুক ভরে পান করা—এতে আমার সকাল সন্ধ্যাগুলি রঙিয়ে কতই না উজ্জ্বল হয়ে থাকতো। দেওঘর থেকে ছুটির অবসানে সে চলে গেলে এই সবের স্মৃতি নিয়ে দেওঘরের পথ ঘাট পাহাড় পর্ব্বত নদী নালা ঘর দুয়ার আমার কাছে হয়ে থাকতো ভক্তের তীর্থস্থল; দিন কাটতো সুখ-স্মৃতিতে কেঁদে আর কবিতা লিখে। তাকে চিঠি লেখাও ছিল এক মহোচ্ছব ব্যাপার, যে দিন চিঠি দিতুম আর যে দিন তার ছোট্ট দু’দশ লাইনের উত্তরটি পেতুম সে দিন কাটতো আধজাগা স্বপ্নের ঘোরে।

 বাল্য সঙ্গীদের নিয়েও সান্ধা ভ্রমণ ছিল কতই না সুখকর। যে দিন সখারাম বাবু, সঙ্গে আসতেন সে দিন আর আমাদের পায় কে? থার্ড টিচার বকু বাবুও মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যেতেন। মাঝে মাঝে দল বেঁধে ত্রিকুট দিঘড়িয়া ও ও নন্দন পাহাড়ে excursion বেরোন হ’তো। আমাদের সব চেয়ে টেনেছিল শিবাজীর জীবন, কারণ সখারাম বাবু পুরাণো পুঁথিপত্র ঘেঁটে খুঁজে রাশি রাশি উপকরণ সংগ্রহ করছিলেন শিবাজীর এক বিরাট জীবনী লেখবার জন্যে, এইটিই ছিল তাঁর জীবনের সব চেয়ে বড় লক্ষ্য। তখন পর্য্যন্ত তিনি “এটা কোন্ যুগ?” বলে সামান্য একখানা চটি বই ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করেন নি। মহারাষ্ট্র বীর শিবাজীর এত বড় গুণগ্রাহী ভক্ত আমি আর দেখি নি, সারা জীবন তিনি উপকরণই সংগ্রহ করে গেলেন, সে বৃহৎ জীবনী লিখে ওঠা আর হলো না। সংবাদপত্রে এস্ ডি ও’র বিরুদ্ধে খবর লেখায় কি একটা গণ্ডগোলে তাঁকে দেওঘর স্কুলের কাজ ছেড়ে আসতে হয়, তারপর থেকেই তিনি হিতবাদীর সহ-সম্পাদক।

 আমার কৈশোর ও যৌবনের উদ্বেল আশারঙীন প্রাণের অলিতে গলিতে ঘুরতো তাঁর সশস্ত্র অর্দ্ধ উলঙ্গ মাউলী সেনা নিয়ে এই দুব্বার পার্ব্বত্য বীর শিবাজী। আমিও এই পতিত পরাধীন বাঙলার রাজমহল গিরিমালায় একদিন বাঙলার রাণা প্রতাপ হয়ে ঘুরবো এই সপ্ন ছিল আমার সব চেয়ে বড় স্বপ্ন। কবিতায় শিবাজী শীলা মহাকাব্য লেখাও ছিল আর একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এই সময়ে আমি ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারে একটি গল্প লিখে পাঁচ টাকা পুরস্কার পাই, গল্পটি পুরস্কার বইএ ছাপা হয়ে বেরোয়। ‘সখা ও সাথী’তে ধাঁধার উত্তর দিয়ে নাম ছাপানর চেষ্টা তখন একটা বাতিকের মত আমাদের পেয়ে বসে থাকতো।

 যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন হরিচরণ সেন দেওঘরের ছিলেন সরকারী ডাক্তার! তাঁর ছেলে সুরেন সেন, শচীন সেন এম্ এ ও বি এ পড়তেন, ছুটিতে দেওঘরে আসতেন। শৈলেন পড়তো আমার নীচের ক্লাসে, তার সঙ্গে হয় আমার রোমাণ্টিক বন্ধুত্ব। একজন আর একজনকে ছেড়ে দুদণ্ড চোখের আড় করে থাকতে পারতুম না। তার মধ্যে আমার ভালবাসাই ছিল খুব কবিত্ব ভরা ও নিঃস্বার্থ, কারণ শৈলেন ছিল বয়সে আমার অনেক ছোট ও অপরিপক্ক। কত যে চিঠি তাকে এই দু’বছর ধরে লিখেছি! বোমার মামলায় আমি ধরা পড়ার পর তার বাবা পুলিশের উৎপাতের ভয়ে সব চিঠি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন, শৈলেন তখন বোধ হয় বিলেতে।

 আমার জীবনের সেই সব স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভাগ শৈলেন নিতো না, সে ছিল নিতান্তই সাদামাঠা ছেলে, যাকে বলে ক্লাসের গুড বয়—আমুদে আপমৎলবী টাইপের ছেলে। তবু তাকে যে কি মোহের চোখে দেখেছিলুম, তার মুখ দেখে আমি আমার সব স্বদেশ হিতের ও মানব কল্যাণের ব্রত ভুলে যেতুম, মনে হ’তো একে বন্ধুরূপে আর সেই তাকে জীবন সঙ্গিনীরূপে পেলে মানুষের আর কি সুখের উপকরণ দরকার হতে পারে? জগতে বোধ হয় এই রকমটিই হয়; আমাদের মন খোঁজে এক উচ্চলোকের বৈকুণ্ঠ আর হৃদয় এবং প্রাণ খোঁজে নিতান্তই সাদামাঠা মাটির পুতুল। ফুল বিল্বপত্রে দূর থেকে পূজা করার সামগ্রী—দেবী ও অমরাবতীর সুরনর্ত্তকীতে তার পেট ভরে না, তার প্রেমক্ষুধা মেটাবার পদ্মটি ফোটা চাই তারই কামনার পাঁকে, তারই পঙ্কময় বুকের তলাটি আঁকড়ে। এ ব্যাপার আমি আরও বহু বড় বড় মনীষী ও বিরাট পুরুষের জীবনে দেখেছি। নারীত্বের মহান্ ও অপূর্ব্ব আদর্শ নিয়ে জীবনের সঙ্গিনী খুঁজতে খুঁজতে যাকে তাঁরা বরণ করে নিলেন সে মেয়ে হয়তো হাবা, সরল ও নিতান্তই সাধারণ মানুষের থাকে!

 আসলে cupid is blind —একথা খুবই ঘাঁটি। আমাদের হৃদয় ও প্রাণের খেলা অন্ধ, সে হচ্ছে অন্ধ ক্ষুধার রাজ্য, মনের যুক্তি-বুদ্ধির আলো তাকে আলো দিতে বা সব সময় চালাতে পারে না। আমাদের প্রাণ ভোগের বস্তু রূপে চায় ঠিক আমাদেরই মত মাটির মানুষ—দোষে গুণে অপূর্ণতায় মহত্ত্বে সুন্দর human মানুষ; খুঁৎগুলিই তার যেন আমাদের প্রেমের অন্ধ চোখে সব চেয়ে হয় টানের জিনিস। শিশুর টলমলে চলার মত, আধ আধ ভাষার মত, অর্থহীন হাত পা নাড়ার মত প্রেমাস্পদের ভ্রম ত্রুটিই তাকে সযত্ন সাদরে বুকে তুলে নেবার প্রেরণা দেয়। দেবতা নিয়ে মন আদর্শের রঙীন ফানুস ওড়ায়, প্রাণ তাকে শুধু পূজা করেই সুখ পায় না, ভরে ওঠে না। সে যে চায় আত্মসাৎ করতে, আপন করতে, একেবারে একাঙ্গ ও একাত্ম হতে!

 ছেলে বেলায় দেওঘরের এই স্কুল জীবনে আমার মধ্যে প্রথম নৈতিক পঙ্কিলতা ঢোকে। কুসঙ্গে মিশে অস্বাভাবিক ভাবে শক্তি ক্ষয় করার অভ্যাস আমার হয়েছিল। এই সময়টা আমার জীবনে পাশাপাশি বইছিল পঙ্কিল ও নির্ম্মল জল। অশ্বিনীবাবুর ভক্তিযোগ পড়ে আমি এত উৎকট নীতিবাগীশ হয়েছিলুম যে মেয়ে লোকের পা ছাড়া মুখের দিকে চোখ তুলে দেখতুম না। কাম চেষ্টা দমন করবার জন্যে নাম জপ, সংখ্যা গণনা, জোরে জোরে হাত পা নাড়া, এমনি কত কাণ্ডই করতুম। কিছুতেই কাম বৃত্তি ঘুচতো না। কবিতার উচ্চ ভাব, প্রেম ভগবদ্ভক্তি এবং অধোলোকের কামবৃত্তি পাশাপাশি ঘেঁষাঘেষি পরম আত্মীয়ের মত চলতো। মানুষের জীবনে তাই-ই হয়,—দুধের, নির্ম্মল জলের ও পাঁকের ত্রিবেণী ধারাই সারাটা জীবন জুড়ে কোন্ এক সাগরসঙ্গমে অবাধে পাশাপাশি বয়ে চলে; সেখানে পাঁকের মানুষ, স্বর্গের দেবতা ও ভাবের কবি একসঙ্গে ঘরকরণা চালায় কেমন করে তা’ তারাই জানে।

 আমার মাস্তুত ভাই হুপোদা’ বা অবিনাশ এত উৎকট ভাবে নিত্য কামচেষ্টা করতো যে তার albumeneria ব্যাধির সূত্রপাত হলো। শয্যাশায়ী হবার আগে পর্য্যন্ত তাকে দেখেছি সেই করাল ব্যাধির গ্রাসেও বীর্য্য নষ্ট করতে। তার অকাল মৃত্যুতে পরিণাম ভয়ে আমার পঙ্কবাহিনী একটু ক্ষীণস্রোতা হলেন বটে কিন্তু ঐ পর্য্যন্ত। অনেক বার দেখেছি প্রেমের চিন্তা ও গাঢ় উচ্চ অনুভূতির বা আনন্দের ফল রাত্রে নিদ্রায় দাঁড়িয়েছে স্বপ্নদোষে; যে দিন ভগবদ্ভক্তিতে চোখে জল এসেছে সেই দিন রাত্রেই কুস্বপ্নে সমস্ত সত্তা মলিন করে তুলেছে। জীব-ধর্ম্মই এই, ঊর্দ্ধস্তরে যা নিষ্কাম নিরপেক্ষ প্রেম প্রাণস্তরে তাই রূপান্তরিত হয় সময়সাপেক্ষ আসঙ্গলিপ্সায় ও দেহে এসে সেই রসই নিছক দৈহিক কামক্ষুধায় পরিণত হয়!

 নীতিবাগীশতার তাড়নায় আমরা যতই কাম থেকে সরে থাকতে চাই ততই সে মানুষকে তেড়ে ধরে। ভয় এক রকম ধ্যান বা এক প্রত্যয়ধারা; যাকে ভয় করি—এড়িয়ে চলি তাকে সর্ব্বদা স্মৃতিতে জাগিয়ে রাখি, আকর্ষণ ও ত্যাগ—কামনা ও ত্যাগেচ্ছা একই বস্তুর দুটো দিক। যে সহজ হতে পারে কাউকে টানে না বা ছাড়ে না সেই জয় করতে পারে এই সব মানবী বৃত্তিকে; সমতাই আত্ম জয়ের পথ। যখন আমি আলিপুর জেলে বন্দী তখন শ্রীঅরবিন্দ প্রথম আমায় এই সাম্যের কথা বোঝান, তখন থেকে আজ অবধি কিন্তু এই সাম্যে আমার সিদ্ধি এলো না। যোগীর কাছে সবই একই আনন্দের খেলা— এই বৃহৎ শান্ত সমতার চোখে কামকে আজও ঠিক দেখতে পারি নি, তাই সেও আজও একেবারে আমার পিছু ছাড়েনি। এই ঐশী শক্তি জীব-জগতের সর্ব্বত্র মানুষ থেকে কীট পতঙ্গের অবধি কেশাকর্ষণ করে ভোগ করাচ্ছে, নইলে জীব জগৎ চলে না, সব species গুলি ধ্বংস হয়ে যায়। তাই ভাগবত কৃপা বিনা মহামায়ার এই দুর্ব্বার শক্তির হাত থেকে মুক্তি কারুর নেই।