আমার কথা (প্রথম খণ্ড)/অঙ্কুর
আমার কথা!
বাল্য-জীবন।
অঙ্কুর।
মহাশয়!
বহু দিবস গত হইল, সে বহুদিনের কথা, তখন মহাশয়ের নিকট হইতে এরূপ অজ্ঞাতভাবে জীবন লুক্কায়িত ছিল না। সে সময় মহাশয়, বার বার কত বার আমাকে বলিয়াছেন যে, “ঈশ্বর বিনা কারণে জীবের সৃষ্টি করেন না, সকলেই ঈশ্বরের কার্য্য করিতে এ সংসারে আসে, সকলেই তাঁহার কার্য্য করে; আবার কার্য্য শেষ হইলে, দেহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়।” আপনার এই কথাগুলি আমি কতবার আলোচনা করিয়াছি; কিন্তু আমি তো আমার জীবন দিয়া বুঝিতে পারিলাম না যে আমার ন্যায় হীন ব্যক্তির দ্বারা ঈশ্বরের কি কার্য হইয়াছে, আমি তাঁর কি কার্য্য করিয়াছি, এবং কি কার্যই বা করিতেছি; আর যদি তাহাই হয় তবে এতদিন কার্য্য করিয়াও কি কার্য্যের অবসান হইল না? আজীবন যাহা করিলাম, ইহাই কি ঈশ্বরের কার্য্য? এরূপ হীন কার্য্য কি ঈশ্বরের?
বার বার আমার অশান্ত হৃদয় জিজ্ঞাসা করে, “কৈ সংসারে আমার কার্য্য কৈ?” এইতো সংসারের পান্থশালা হইতে বিদায় লইবার সময় নিকটবর্ত্তী হইয়া আসিল। তবে এতদিন আমি কি করিলাম? কি সান্ত্বনা বুকে লইয়া এ সংসার হইতে বিদায় লইব! আমি কি সম্বল লইয়া মহাপথের পথিক হইব! মহাশয় অনেক বিষয়ে আমাকে উপদেশ প্রদান করিয়াছেন, আমায় বুঝাইয়া দিন, যে ঈশ্বরের কোন্ কার্যে আমি ছিলাম ও আছি এবং থাকিব।
মহাশয়!
মরুভূমে পতিত পথিকের তৃষ্ণায় আকুল প্রাণ যেমন দূরে সুশীতল সরোবর দর্শনে তৃপ্তি পায়; সেইরূপ মহাশয়ের আশা-বাক্যে আমার প্রাণের কোণে আবার আশার আলোক দেখা দিতেছে। কিন্তু যে, ঈশ্বরের জগতপূর্ণ নাম, কোথায় সে ঈশ্বর? কোথায় সে দয়াময়? যিনি আমার মত পাপী তাপীকে দয়া করেন? আপনি লিখিয়াছেন, “কি কার্য্যে সংসারে আছি, তাহা জানিবার আমাদের অধিকার নাই। যিনি সমস্ত কার্য্যের কর্ত্তা তিনিই জানেন।” অবশ্যই জানেন! তিনি সর্ব্বান্তর্যামী। তিনি তো জানিবেনই। কিন্তু আমার কি হইল? আমার যে জ্বালা সেই জ্বালাই আছে, যে শূন্যতা সেই শূন্যতাই! আমার কি হইল? আমার সান্ত্বনার জন্য কি রাখিলেন? শেষ অবলম্বন একটী মধুময়ী কন্যা দিয়াছিলেন আমি তো তাহা চাহি নাই, তিনিই দিয়াছিলেন তবে কেন কাড়িয়া লইলেন? শুনেছিলাম দেবতার দান ফুরায় না! তার কি এই প্রমাণ? না অভাগিনীর ভাগ্য? হায়! ভাগ্যই যদি এত বলবান, তবে তিনি পতিতপাবন নাম ধরিয়াছেন কেন? দুর্ভাগা না হইলে কেন আকিঞ্চন করিব, কেন এত কাঁদিব! যে জন ভক্তি ও সাধনের অধিকারী সে তো জোর করিয়া লয়! প্রহলাদ, ধ্রুব প্রভৃতি আর আর সাধু ভক্তগণ তো জোর করিয়া লইয়াছেন। আমায়। মতন অধম, যদি চির-যাতনার বোঝা বহিয়া অনন্ত নরকে গেল, তবে তাঁহার পতিতপাবন নাম কোথায় রহিল?
আপনি লিখিয়াছেন—“তোমার জীবনে অনেক কার্য্য হইয়াছে, তুমি রঙ্গালয় হইতে শত শত ব্যক্তির হৃদয়ে আনন্দ প্রদান করিয়াছ। অভিনয় স্থলে তোমার অদ্ভুত শক্তি দ্বারা যেরূপ বহু নাটকের চরিত্র প্রস্ফুটিত করিয়াছ, তাহা সামান্য কার্য্য নয়। আমার ‘চৈতন্যলীলায়’ চৈতন্য সাজিয়া বহু লোকের হৃদয়ে ভক্তির উচ্ছাস তুলিয়াছ ও অনেক বৈষ্ণবের আশীর্ব্বাদ লাভ করিয়াছ। সামান্য ভাগ্যে কেহ এরূপ কার্য্যের অধিকারী হয় না। যে সকল চরিত্র অভিনয় করিয়া তুমি প্রস্ফুটিত করিয়াছিলে, সে সকল চরিত্র গভীর ধ্যান ব্যতীত উপলব্ধি করা যায় না। যদিচ তাহার ফল অদ্যাবধি দেখিতে পাও নাই, সে তোমার দোষে নয় অবস্থায় পড়িয়া, এবং তোমার অনুতাপের দ্বারা প্রকাশ পাইতেছে যে অচিরে, সেই ফলের অধিকারী হইবে।”
মহাশয় বলিতেছেন—দর্শকের মনোরঞ্জন করিয়াছি। দর্শক কি আমার অন্তর দেখিতে পাইতেন! কৃষ্ণ নাম করিবার সুবিধা পাইয়া কার্য্যকালে, অন্তরে বাহিরে কত আকুল প্রাণে ডাকিয়াছিলাম! দর্শক কি তাহা দেখিয়াছেন! তবে কেন একমাত্র আশার প্রদীপ নিবিয়া যাইল? আর অনুতাপ! সমস্ত জীবনই তো তানুতাপে গেল। পদে পদে তো অনুতপ্ত হইয়াছি, জীবন যদি সংশোধন করিবার উপায় থাকিত, তাহা হইলে অনুতাপের ফল হইত বুঝিতে পারিতাম। কিন্তু অনুতাপের কি ফল ফলিয়াছে? এখনও তো স্রোতে মগ্ন তৃণ প্রায় ভাসিয়া যাইতেছি। তবে আপনি কাহাকে অনুতাপ বলেন জানিনা। এই যে হৃদয় জোড়া যাতনার বোঝা লইয়া তাঁর বিশ্বব্যাপী দরজায় পড়িয়া আছি, কেন দয়া পাইনা। আর ডাকিব না, আর কাঁদিব না বলেও যে “হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ” করিয়া হৃদয়ের নিভৃত কোণ হইতে যাহাকে ডাকিতেছি, কোথায় সে হরি?
বাল্যকাল হইতে কত সাধ, কত বাসনা, কত সরল সৎপ্রবৃত্তি কালের কোলে ডুবিয়া গিয়াছে, কেমন করিয়া বলিব? কৃষ্ণ নাম স্মরণ করিয়া, জগৎ-সুন্দর জগদীশ্বরের দিকে যে বাসনা সৎপথে ছুটিতে চাহিত, তখনি মোহজালে জড়িত মন তাহাকে চোরাবালির মোহে ডুবাইয়া দিয়াছে। যখন জোর করিয়া উঠিতে আগ্রহ হইত, কিন্তু চোরাবালিতে পড়িয়া ডুবিয়া গিয়া, জোর করিয়া উঠিতে গেলে যেমন বালির বোঝা সব চারিদিক হইতে আরও উপরে আসিয়া পড়িয়া তাহাকে পাতালে ডুবাইয়া দেয়, আমার দুর্ব্বল বাসনাকেও তেমনি মোহ-ঘোর আসিয়া চাপিয়া ধরিয়াছে। বলহীন বাসনা আশ্রয় পায় নাই, ডুবিয়া গিয়াছে। চোরাবালিতে পড়িয়া পুতে যাওয়ার ন্যায় ছট্ফট্ করিতে করিতে ডুবিয়াছে! কিন্তু এখন তাই আমার ক্ষুত্র বুঝিতে পারিতেছি যে বাসনা প্রবৃত্তি উপরে ছুটিতে চায়। কে যেন ঘাড় ধরিয়া ডুবাইয়া দেয়, তাহাতো বুঝিতে পারিনা। তখন কত কাতরে কাঁদি, তবু ডুবি! শক্তিহীন দুর্ব্বল বলিয়াই ডুবি। বলিতে গেলে অনেক বলিতে হয়। মহাশয় মনের আবেগে কত কথা আসিয়া পড়িতেছে। যাহার দিকে চাহিয়া, যাহাকে বড় আপনার করিয়া, বড়ই অনাথ হইয়া চরণ ধরিয়া আপনার করিতে যাই, তবু দূরে বহু দূরে পড়িয়া থাকি! অধিক বলিয়া বিরক্ত করিব না, এক্ষণে বিদায় হই!
৩য় পত্র।
মহাশয়!
পূর্ব্বের অবস্থা যাহাই থাকুক, উপস্থিত অবস্থায় কি কার্য্যে আছি! রুগ্ন, অথর্ব্ব, ভবিষ্যৎ আশা শূন্য, দিন যামিনী এক ভাবেই যাইতেছে, কোনরূপ উৎসাহ নাই। রোগ-শোকের তীব্র কশাঘাত, নিরুৎসাহের জড়তায় আচ্ছন্ন হইয়া অপরিবর্ত্তিত স্রোত চলিতেছে। আহার, নিদ্রা ও দুশ্চিন্তা, প্রতিদিনের ছবি একদিনে পাওয়া যায়, আজ একরূপ কাল অন্যরূপ কোনই পরিবর্ত্তন নাই! কেবলমাত্র প্রভেদ এই কখন কখন রোগের যন্ত্রণা বৃদ্ধি সদা সর্ব্বক্ষণ অস্বস্তি! কেহ যত্ন করিয়া উপশমের চেষ্টা করিলে, সান্ত্বনা বাক্যে আশ্বস্ত হইতে বলিলে মনে মনে হাসি পায়! কারণ তাঁহারা এই বলিয়া আশ্বাস দেন, বলেন “সুস্থ হইয়া থাক কোনরূপ চিন্তা করিওনা।” আমি ভাবি তাঁহারা আমার অবস্থা বোঝেন না। তাঁহারা বোঝেন না যে যদি চেষ্টা করিয়া সুস্থ থাকা সম্ভব হইত; সে চেষ্টা শত সহস্ররূপে হইয়াছে, এবং তাঁহাদের বলার অপেক্ষা থাকিত না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যে তাঁহারা আমার মতন ভাগ্যহীনা লোকের স্বরূপ অবস্থা না বোঝেন। কারণ এরূপ অবস্থায় না ঠেকিয়া কেহ বুঝিতে পারে না। সততই মনে হয় যে এই আশাশূন্য দুশ্চিন্তায় সদাসর্ব্বদা মগ্ন থাকাই কি ঈশ্বরের কার্য্য? সর্ব্বদাই বলি ভগবান আর কতকাল! দুঃখের অবসান না হউক অন্ততঃ স্মৃতির, জ্বলন্ত যাতনা হইতে নিস্তার পাইয়া শান্তিলাভ করি। সে যন্ত্রণা অতি তীব্র। বিনীত ভাবে আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি যে, এইরূপ জরাজীর্ণ দেহ লইয়া অবসন্ন ভাবে সংসারের এক কোণে পড়িয়া থাকিয়া কি আপনার মতে ঈশ্বরের কার্য্য হইতেছে?
৪র্থ পত্র।
মহাশয়!
আপনাকে যখন দুঃখের কথা জানাইয়া পত্র লিখি, পত্রের উত্তরে— আপনার সান্ত্বনা বাক্যে আশার ক্ষীণ আলোক হৃদয়ে দেখা দেয়! কিন্তু সে ক্ষণিক—মেঘাচ্ছন্ন রজনীতে বিদ্যুৎ ঝলকের ন্যায়। আপনি তো জানেন আমার তমোময় হৃদয়ের আলোক স্বরূপ একটী কন্যা অযাচিত রূপে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, সে কন্যাটী নাই। এক্ষণে আমার গাঢ় তমাচ্ছন্ন হৃদয় গাঢ়তর তিমিরে ডুবিয়াছে। যত প্রকারে সান্ত্বনা আনিবার চেষ্টা পাই, সকলই বিফল। “ঈশ্বর দয়া কর” “হরি দয়া কর”— বারবার বলি সত্য, কিন্তু হৃদয়ের অভ্যন্তরে দেখিতে পাই যে আমার সেই প্রাণ- প্রতিমার জন্য আমি লালায়িত। যেমন দিক্ নির্ণয় যন্ত্রের সূচিকা উত্তরাভিমুখে থাকে, আমারও মন সেইরূপ সেই হারানিধিকে লক্ষ্য করিয়া। আছে। যিনি মাতার বেদনা জানেন না, তিনি আমার বেদনা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিতে পারিবেন না। কন্যার জন্ম হইতে মরণ পর্যন্ত প্রত্যেক ঘটনা আমার মানস দর্পণে প্রতিফলিত হইয়া আছে। এ অবস্থায় শান্তি কোথায়? সততই মনে হয়, আমি কি এই দারুণ যন্ত্রণা ভোগের জন্য সৃষ্ট হইয়াছি! আপনার নীতিগর্ভ-বাক্যে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিলে হয়তো বা শান্তিলাভ করতে পারিতাম। কিন্তু সে বিশ্বাস আমার কোথায়? বাল্যকাল হইতে সংসারচক্রে পড়িয়া অবিশ্বাস করিতে শিখিয়াছি, এই অবিশ্বাসের জন্য আমার অভিভাবক, সাংসারিক অবস্থা ও আমি নিজে দায়ী। কিন্তু দায়িত্ব অর্পণ করিয়া ফল কি? অবিশ্বাস অবিশ্বাসই আছে। অবস্থায় পড়িয়া যে দিকে মনের গতি, তাহার বিপরীত দিকে চিরদিনই চালিত হইয়াছি। এই বিপরীত যুদ্ধে শরীর-মন জর্জ্জরীভূত। বলিয়াছি আমার হৃদয় সেই স্নেহ-প্রতিমার দিকে দিবারাত্র রহিয়াছে। তাহার আলোচনা দুঃখময়, কিন্তু সেই আলোচনাই আমার সুখ! হতাশ্বাসপূর্ণ সন্তান-হারা হৃদয়ে আর অপর সুখ নাই। অবিশ্বাসের মুল কিরূপ দৃঢ় হইয়া অন্তরে বসিয়াছে, তাহা আমার জীবনের ঘটনাবলি শুনিলে বুঝিতে পারিবেন। আপনি বলেন, আমার আজীবন বৃত্তান্ত শুনিলে, আমি যে ঈশ্বরের কার্যে সৃষ্ট হইয়াছি, তাহা বুঝাইয়া দিবেন। আমিও আমার আদ্যোপান্ত ঘটনাগুলি বিবৃত করিব। যদি কৃপা করিয়া শুনেন, বুঝিতে পারিবেন অবিশ্বাস কিরূপে দৃঢ়ীভূত হইয়াছে। এবং তাহার উচ্ছেদ অসম্ভব! শান্তির মূল বিশ্বাস, হয়তো বুঝিতে পারি, কিন্তু সেই বিশ্বাস কোথায়? আমার প্রতি আপনার অশেষ স্নেহ, এই নিমিত্ত সাহস করিয়া আদ্যোপান্ত বলিতেছি। কৃপা করিয়া শুনুন! শুনিতে শুনিতে যদি বিরক্তি জন্মায় পত্র ছিঁড়িয়া ফেলিবেন। শুনিবেন কি?
মহাশয় আপনি যে আমার ক্ষুদ্র জীবনী শুনিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। ইহা আমার পক্ষে সামান্য শ্লাঘার বিষয় নয়। আদ্যোপান্ত বর্ণনা করিতেছি দয়া করিয়া শুনিলে কৃতার্থ হইব এবং আপনার ন্যায় মহৎ লোকের নিকট হৃদয়ের বোঝা নামাইয়া এ দুর্ব্বিসহ হৃদয়ভার কতকটা লাঘব করিব।