আমার কথা (প্রথম খণ্ড)/রঙ্গালয়ে প্রবেশের সূচনা

১ম কথা (পল্লব) রঙ্গালয়ে প্রবেশের সূচনা।

(বাল্য-জীবন)

 আমার জন্ম এই কলিকাতা মহানগরীর মধ্যে সহায় সম্পত্তিহীন বংশে। তবে দীন দুঃখী বলা যায় না, কেননা কষ্টে-শ্রেষ্টে এক রকম দিন গুজরান হইত। তবে বড় সুশৃঙ্খলা ছিল না, অভাব যথেষ্টই ছিল। আমার মাতামহীর একখানি নিজ বাটী ছিল। তাহাতে খোলার ঘর অনেকগুলি ছিল। সেই কর্ণওয়ালিস ষ্টীটের ১৪৫ নম্বর বাটী এখন আমার অধিকারে আছে। সেই সকল খোলর ঘরে কতকগুলি দরিদ্র ভাড়াটিয়া বাস করিত। সেই আয় পলক্ষ করিয়াই আমাদের সংসার নির্ব্বাহ হইত। আর তখন দ্রব্যাদি সকল সুলভ ছিল; আমরাও অল্প পরিবার। আমার মাতামহী, মাতা আর আমরা দুটী ভ্রাতা ভগ্নী। কিন্তু আমাদের জ্ঞানের সহিত আমাদের দারিদ্র্য দুঃখ বাড়িতে লাগিল, তখন আমার মাতামহী একটী মাতৃহীনা আড়াই বৎসর বয়সের বালিকার সহিত আমার পঞ্চমবর্ষীয় শিশু ভ্রাতার বিবাহ দিয়া তাহার মাতার যৎকিঞ্চিৎ অলঙ্কারাদি ঘরে আনিলেন। তখন অলঙ্কার বিক্রয়ে আমাদের জীবিকা চলিতে লাগিল। কারণ ইহার অগ্রেই মাতামহীর ও মাতাঠাকুরাণীর যাহা কিছু ছিল, তাহা সকলই নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল।

 আমার মাতামহী ও মাতাঠাকুরাণী বড়ই স্নেহময়ী। ছিলেন। তাঁহারা স্বর্ণকারের দোকানে এক একখানি করিয়া অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া নানাবিধ খাদ্য-সামগ্রী আনিয়া আমাদের হাতে দিতেন, অলঙ্কার বিক্রয় জন্য কখন দুঃখ করিতেন না।

 আমার সেই সময়ের একটা কথা মনে পড়ে; আমার যখন বয়স বছর সাতেক তখন আমার মাতা কাহাদিগের কর্ম্ম-বাড়ী গিয়া আমাদের জন্য কয়েকটী সন্দেশ চাহিয়া আনিয়াছিলেন। অনুগ্রহের দান কিনা, তাহাতেই দশপনের দিন তুলিয়া রাখিয়া, মায়া কাটাইয়া আমার মাতার হাতে দিয়াছিলেন; এখন হইলে সে সন্দেশ দেখিলে অবশ্য নাকে কাপড় উঠিত! আমার মাতা তাহা বাটীতে আনিয়া আমাদের তিনজনকে আনন্দের সহিত খাইতে দেন। পাছে সেই দুর্গন্ধ সংযুক্ত সন্দেশ শীঘ্র ফুরাইয়া যায়, এইজন্য অতি অল্প করিয়া খাইতে প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা হইয়াছিল। এই আমার সুখের বাল্য কালের ছবি।

 আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা অতি অল্প বয়সেই আমার মাতাকে চিরদুঃখিনী করিয়া এ নারকীদের সঙ্গ ত্যাগ। করিয়া গিয়াছিলেন। আমার ভ্রাতার মৃত্যুতে আমার মাতামহী ও মাতাঠাকুরাণী একেবারে অবসন্ন হইয়া। পড়েন। আমার ভ্রাতা অসুস্থ হইলে অর্থের অভাবে তাহাকে দাতব্য চিকিৎসালয়ে লইয়া যাইতে হয়। আমরা দুটী ক্ষুদ্র বালিকা বাটীতে থাকিতাম। আমাদের একটী দয়াবতী প্রতিবেশিনীর জন্য আমাদের আহারাদির কোন কষ্ট হইত না। তিনি আমাদের সঙ্গে করিয়া আমার মাতার ও মাতামহীর আহার লইয়া ডাক্তারখানায় আমার ভ্রাতাকে দেখিতে যাইতেন। কোন কোন দিন তাঁহাদের আহার করিবার জন্য বাড়ী পাঠাইয়া দিয়া তিনি নিজে আমার ভ্রাতার নিকট বসিয়া থাকিতেন। পরে আবার তাহারা আহার সমাপন করিয়া সেইখানে যাইলে আমাদের সঙ্গে করিয়া বাটী আসিতেন, কেবল আমাদের বলিয়া নহে, তিনি স্বভাবতই পরোপকারিণী ছিলেন। যদি রাত্র দ্বি-প্রহরের সময় কেহ আসিয়া তাঁহাকে বিপদ জানাইত; তখনি আমনি কিঞ্চিৎ অর্থ সঙ্গে তাহাদের বাটী যাইতেন। পরে নিজের শরীর দ্বারাই হউক আর পয়সার দ্বারাই হউক লোকের উপকার সাধন করিতেন। তাঁহার মতন পরোপকারিণী এখনকার দিনে প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহার নিজের কিছু সম্পত্তি ছিল, সংসারে তাঁহার আর কেহ ছিল না। পরোপকারই তাঁহার ব্রত ছিল।

 উক্ত দাতব্য চিকিৎসালয়েই আমার ভ্রাতার মৃত্যু হয়। সে দিন আমার স্মৃতি-পটে জাজ্জ্বল্যমান আছে। তখন ভাবিতে লাগিলাম, আবার আমার ভাই আসিবেনা কি? যমে নিলে যে আর ফিরাইয়া দেয়না, দৃঢ়রূপে তখন হৃদয়ঙ্গম হয় নাই। আমার মাতামহী আমার ভ্রাতাকে অতিশয় স্নেহ করিতেন কিন্তু অতিশয় ধৈর্যশালিনীও ছিলেন। তাঁহার শুনা ছিল, ডাক্তারখানায় মরিলে মড়া কাটে, গতি করিতে দেয়না! যেমন আমার ভ্রাতা প্রাণত্যাগ করিল, তিনি অমনি সেই মৃতদেহ বুকে করিয়া তিন তলার উপর হইতে তড়্ তড়্ করিয়া নামিয়া গঙ্গার ঘাটের দিকে যেন ছুটিলেন। আমরা আমার মাতার হাত ধরিয়া কঁদিতে কাদিতে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে যাইতে লাগিলাম। আমার মাতাঠাকুরাণী কেমন বিকৃত হৃদয় হইয়াছিলেন, তিনি হাঃ হাঃ করিয়া মাঝে মাঝে হাসিতে লাগিলেন। আমাদের অবস্থা দেখিয়া ডাক্তারখানার বড় ডাক্তার বলিতে লাগিলেন; “ব্যস্ত হইওনা, আমরা ধরে রাখিব না!” কিন্তু দিদিমাতা শুনেন নাই, তিনি একেবারে কোলে করিয়া লইয়া গঙ্গার তীরে মৃত দেহ শয়ন করাইয়া দেন। গঙ্গার উপর সেই ডাক্তারখানা। তখন একজন ডাক্তার সেইখান পর্যন্ত দয়া করিয়া আসিয়া বলিয়াছিলেন, যে “এখনই সৎকার করিও না, অতিশয় বিষাক্ত ঔষধ দেওয়া হইয়াছে, আমি আবার আসিতেছি।” পরে তাঁহারা ঘণ্টা খানেক সেই গঙ্গাতীরে সেই মৃতদেহ কোলে লইয়া বাসিয়াছিলেন। সেই ডাক্তারবাবু আসিয়া আবার অনুমতি দিলে তবে কাশী মিত্রের ঘাটে এনে তাকে চিতায় শয়ন করান হয়। ইতিমধ্যে আমাদের সেই দয়াবতী প্রতিবেশিনী তথায় উপস্থিত হন। তিনি বাটী হইতে কিছু অর্থ আনিতে গিয়াছিলেন। ভ্রাতার অবস্থা খারাপ। দেখিয়া তার আগের রাত্রে আমি ও ভ্রাতৃবধূ সেইখানেই ছিলাম। এর ভিতর আর একটা দুর্ঘটনা ঘটিতে ঘটিতে রক্ষা হয়। ভ্রাতার সৎকারের জন্য আমার মাতামহী ও সেই প্রতিবেশিনী যখন ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় মা আমার আস্তে আস্তে গঙ্গার জলে কোমর পর্যন্ত নামিয়া। গিয়াছিলেন। আমি মা’র কাপড় ধরিয়া খুব চিৎকার করিয়া কাঁদিতে থাকায় আমার দিদিমাতা দৌড়াইয়া আসিয়া মাতাকে ধরিয়া লইয়া যান। ইহার পর মা আমার অনেক দিন অর্দ্ধ উন্মাদ অবস্থায় ছিলেন। মোটে কাঁদিতেন না, বরং মাঝে মাঝে হাসিয়া উঠিতেন। সে কারণ আমার দিদিমাতা বড়ই সাবধান ছিলেন। মায়ের সম্মুখে কাহাকেও আমার ভাতার কথা কহিতে দিতেন না। যদিও আমার দিদিমাতা আমাদের সকলের অপেক্ষা আমার ভ্রাতাকেই অধিক স্নেহ করিতেন, কেন না আমাদের বংশে পুত্র সন্তান কখন হয় নাই; মেয়ের মেয়ে, তাহার মেয়ে নিয়েই সব ঘর। কিন্তু নিজ কন্যার অবস্থা দেখিয়া একেবারে চুপ করিয়া গিয়াছিলেন। এক দিন রাত্রে আমরা সকলে শুইয়া আছি, আমার মা “ওরে। বাবারে কোথা গেলিরে” বলিয়া উচৈঃস্বরে চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। আমার দিদিমাতা বলিলেন, “আঃ বাঁচলেম।” আমি ‘মা মা’ করিয়া উঠিতে দিদিমাতা বলিলেন, যে “চুপ—চুপ উহাকে কাঁদিতে দে,” আমি ভয়ে চুপ করিয়া রহিলাম। কিন্তু আমারও বড় কান্না আসিতে লাগিল।

 শুনিয়াছি আমারও বিবাহ হইয়াছিল এবং এ কথাও যেন মনে পড়ে যে আমার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বড় একটা সুন্দর বালক ও আমার ভ্রাতা, বালিকা ভ্রাতৃবধূ আর আর প্রতিবেশিনী বালিকা মিলিয়া আমরা একত্রে খেলা করিতাম। সকলে বলিত ঐ সুন্দর বালকটী আমার বর। কিন্তু কিছুদিন পরে আর তাঁহাকে দেখিতে পাই নাই। শুনিয়াছি যে আমার একজন মাস্-শ্বাশুড়ী ছিলেন; তিনিই আমার স্বামীকে লইয়া গিয়াছিলেন, আর আসিতে দেন নাই। সেই অবধি আর তাঁহাকে দেখিতে পাই নাই। লোক পরম্পরায় শুনিতাম যে তিনি বিবাহাদি করিয়া সংসার করিতেছেন, এক্ষণে তিনিও আর সংসারে নাই। আমার ভ্রাতার জীবদ্দশায় আমার স্বামীকে আনিবার জন্য কয়েকবার বিশেষ চেষ্টা হইয়াছিল। আমি একটা মাত্র কন্যা বলিয়া মাতামহীর ও মাতার ইচ্ছা ছিল যে তিনি আমাদের বাড়ীতেই থাকেন। কেননা তিনিও আমাদের ন্যায় দরিদ্র ঘরের সন্তান। কিন্তু তাঁহার মাসী আর আসিতে দেন নাই।

 এই তো গেল আমার বালিকা কালের কথা; পরে যখন আমার নয় বৎসর বয়ঃক্রম, সেই সময় আমাদের বাটীতে একটী গায়িকা আসিয়া বাস করেন। আমাদের বাটীতে একখানি পাকা একতলা ঘর ছিল, সেই ঘরে তিনি থাকিতেন। তাঁহার পিতা মাতা কেহ ছিল না, আমার মাতা ও মাতামহী তাঁহাকে কন্যা সদৃশ স্নেহ করিতেন। তাঁহার নাম গঙ্গা বাইজী। অবশেষে উক্ত গঙ্গা বাইজী স্টার থিয়েটারে একজন প্রসিদ্ধ গায়িকা হইয়াছিলেন। তখনকার বালিকা-সুলভ-স্বভাব বশতঃ তাঁহার সহিত আমার “গোলাপ ফুল” পাতান ছিল; আমরা উভয়ে উভয়কে “গোলাপ” বলিয়া ডাকিতাম এবং তিনিও নিঃসহায় অবস্থায় আমাদের বাটীতে আসিয়া আমার মাতার নিকট কন্যা স্নেহে আদৃত হইয়া পরমানন্দে একসঙ্গে অতিবাহিত করিয়াছিলেন, সে কথা তিনি সমভাবে তাঁহার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হৃদয়ে স্মরণ রাখিয়াছিলেন। সময়ের গতিকে এবং অবস্থা ভেদে পরে যদিও আমাদের দূরে দূরে থাকিতে হইত, তথাপি সেই বাল্য-স্মৃতি তাঁহার হৃদয়ে সমভাবে ছিল। এবং তাহার অন্তঃকরণ অতিশয় উন্নত ও উদার ছিল বলিয়া আমার মাতামহী ও মাতাকে বড়ই সম্মান করিতেন। এখনকার দিনে অনেক লোক বিশেষ উপকৃত হইয়া ভুলিয়া যায় ও স্বীকার করিতে লজ্জা এবং মানের হানি মনে করে, কিন্তু “গঙ্গামণি”—ষ্টারে গায়িকা ও অভিনেত্রীর উচ্চস্থান অধিকার করিয়াও অহঙ্কার শূন্য ছিলেন। সেই উন্নত হৃদয়া বাল্য-সখী স্বর্গাগতা গঙ্গামণি আমার বিশেষ সম্মান ও ভক্তির পাত্রী ছিলেন।

 আমাদের আর কোন উপায় না দেখিয়া আমার মাতামহী উক্ত বাইজীর নিকটেই আমায় গান শিখিবার জন্য নিযুক্ত করিলেন। তখন আমার বয়ঃক্রম ৭ বা ৮ বৎসর এমনই হইবে। আমার তখন গীত বাদ্য যত শিক্ষা করা হউক বা না হউক তাঁহার নিকট যে সকল বন্ধুবান্ধব আসিতেন, তাঁহাদের গল্প শুনা একটী বিশেষ কাজ ছিল। আর আমি একট চালাক চতুর ছিলাম বলিয়া আমাকে সকলে আদর করিতেন। তখন বালিকা-সুলভ-চপলতা বশতঃ তাঁহাদের আদর আমার ভাল লাগিত। কি করিতাম, কি করিতেছি, ভাল কি মন্দ কিছুই বুঝিতে পারিতাম না। কিন্তু খুব বেশী মিশিতাম না; কেমন একটা লজ্জা বা ভয় হইত। দূরে দূরে থাকিতাম, কেননা আমি বাল্যকাল হইতে আমাদের বাড়ীর ভাড়াটিয়াদের রকম সকমের প্রতি কেমন একটা বিতৃষ্ণা ছিলাম, যাহারা আমাদের খোলার ঘরে ভাড়াটিয়া ছিল; তাহারা যদিও বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষ নহে, তবুও স্ত্রী-পুরুষের ন্যায় ঘর সংলার করিত; দিন আনিত দিন খাইত এবং সময়ে সময়ে এমন মারামারি করিত যে দেখিলে বোধ হইত বুঝি আর তাহাদের কখনও বাক্যালাপ হইবে না। কিন্তু দেখিতাম যে পরক্ষণেই পুনরায় উঠিয়া আহারাদি হাস্য পরিহাস করিত। আমি যদিও তখন অতিশয় বালিকা ছিলাম, কিন্তু তাঁহাদের ব্যবহার দেখিয়া ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া যাইতাম! মনে হইত, আমি তো কখনও এরূপ ঘৃণিত হইব না। তখন জানি নাই যে আমার ভাগ্যদেবতা আমার মাথার উপর কাল্ মেঘ সঞ্চার করিয়া রাখিয়াছেন। তখন মনে করিতাম বুঝি এমনি মাতৃকোলে সরল সুখময় হৃদয় লইয়া চিরদিন কাটিয়া যাইবে। সেই মনোভাব লইয়া আমার বাল্যসখীর বন্ধুদের সহিত বাহিরে বাহিরে আনন্দ করিয়া খেলা করিয়া, রাত্র হইলে স্নেহময়ী জননীর কোলে শুইয়া আনন্দ লাভ করিতাম। আমার ভ্রাতার মৃত্যুর কিছুদিন পরে, গঙ্গামণির ঘরে বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও ব্রজনাথ শেঠ বলিয়া দুইটী ভদ্রলোক তাহার গান শুনিবার জন্য প্রায়ই আসিতেন; শুনিতাম তাঁহারা নাকি কোনখানে “সীতার বিবাহ” নামে গীতিনাট্য অভিনয় করিবার মানস করিয়া ছিলেন। তিনি একদিন আমার মাতামহীকে ডাকিয়া বলিলেন যে “তোমাদেরও বড় কষ্ট দেখিতেছি তা তোমার এই নাতনীটিকে থিয়েটারে দিবে? এক্ষণে জলপানি-স্বরূপ কিছু কিছু পাইবে, তারপর কার্য্য শিক্ষা করিলে অধিক বেতন হইতে পারিবে।” তখন সবে মাত্র দুইটী থিয়েটার ছিল, একটী শ্রীযুক্ত ভুবনমোহন নিয়োগীর “ন্যাশন্যাল থিয়েটার” দ্বিতীয় স্বর্গীয় শরৎচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের “বেঙ্গল থিয়েটার”। আমার দিদিমাতা দুই চারিটী লোকের সহিত পরামর্শ করিলেন, অবশেষে পূর্ণবাবুর মতে থিয়েটারে দেওয়াই স্থির হইল। তখন পূর্ণবাবু আমাকে সুবিখ্যাত “ন্যাশন্যাল থিয়েটারে” দশ টাকা মাহিনাতে ভর্তি করিয়া দিলেন। গঙ্গাবাইজী যদিও একজন সুদক্ষ গায়িকা ছিলেন, কিন্তু লেখাপড়া কিছুমাত্র জানিতেন না; সেইজন্য আমার থিয়েটারে প্রবেশের বহুদিন পরে তিনি সামান্য মাত্র লেখাপড়া শিখিয়া কার্যে প্রবৃত্ত হন, পরে উত্তরোত্তর উন্নতি করিয়া শেষ জীবন পর্যন্ত অভিনেত্রীর কার্য্যে ব্রতী ছিলেন।

 এই সময় হইতে আমার নূতন জীবন গঠিত হইতে লাগিল। সেই বালিকা বয়সে, সেই সকল বিলাস বিভূষিত লোক সমাজে সেই নূতন শিক্ষা, নূতন কার্য্য, সকলই আমার নূতন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। কিছুই বুঝিতাম না, কিছুই জানিতাম না, তবে যেরূপ শিক্ষা পাইতাম, প্রাণপণ যত্নে সেইরূপ শিক্ষা করিতাম। সাংসারিক কষ্ট মনে করিয়া আরও আগ্রহ হইত। মাতার শোক দুঃখপূর্ণ মুখখানি মনে করিয়া আরও উৎসাহ বাড়িত। ভাবিতাম যে মায়ের এই দুঃখের সময় যদি কিছু উপার্জ্জন করিতে পারি, তবে সাংসারিক কষ্টও লাঘব হইবে।

 যদিও রঙ্গালয়ে শিক্ষামত কার্য্য করিতাম বটে, কিন্তু আমার মনের ভিতর কেমন একটা আগ্রহ আকাঙ্ক্ষা সতত ঘুরিয়া বেড়াইত। মনে ভাবিতাম, যে আমি কেমন করিয়া “শীঘ্র শীঘ্র এই সকল বড় বড় অভিনেত্রীদের মত কার্য্য শিখিব! আমার মন সকল সময়েই সেই সকল বড় বড় অভিনেত্রীদের কার্য্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়াইত। তখন সবে মাত্র চারিজন অভিনেত্রী ন্যাশন্যাল থিয়েটারে ছিলেন। রাজা, ক্ষেত্রমণি, লক্ষী ও নারায়ণী। ক্ষেত্রমণি আর ইহলোকে নাই। সে একজন প্রসিদ্ধা অভিনেত্রী ছিল। তাহার অভিনয় কার্য্য এত স্বাভাবিক ছিল যে লোকে আশ্চর্য্য হইত, তাহার স্থান আর কখন পূর্ণ হইবে কিনা সন্দেহ! “বিবাহ-বিভ্রাটে” ঝীর অংশ অভিনয় দেখিয়া স্বয়ং “ছোট লাট টমসন” বলিয়াছিলেন যে এ রকম অভিনেত্রী আমাদের বিলাতেও অভাব আছে। চৌরঙ্গীর কোন সম্ভ্রান্ত লোকের বাটীতে এক সময় অনেক বড় বড় সাহেব ও বাঙ্গালীর অধিবেশন হইয়াছিল, সেইখানেই আমাদের থিয়েটারে বিবাহ-বিভ্রাট অভিনয় হয়, তাহার অভিনয় ছোট লাট সাহেব দেখিয়া ছিলেন। যাহা হউক, মহাশয় অধিক আর বলিতে সাহস হইতেছে না। যেহেতু সেই গতজীবনের নীরস ও বাজে কথা শুনিতে হয় তো আপনার বিরক্তি জন্মিতে পারে, সেইজন্য এইখানে বন্ধ করিলাম। তবে এই পর্য্যন্ত বলিয়া রাখি যে যত্ন ও চেষ্টা দ্বারা আমি অতি অল্প সময় মধ্যেই তাঁহাদের ন্যায় সমান অংশ অভিনয়। করিতে পারিতাম।