আমার কথা (প্রথম খণ্ড)/রঙ্গালয়ে

দ্বিতীয় পল্লব।

রঙ্গালয়ে।

মহাশয়!

 আপনার যে এখনও আমার জীবনের দুঃখময় কাহিনী শুনিতে ধৈর্য্য আছে, ইহা কেবল আমার উপর মহাশয়ের অপরিমিত স্নেহের পরিচয়।

 আপনি ছত্রে ছত্রে বলিতেছেন যে, প্রতি চরিত্র অভিনয়ে আমি মানুষের মনে দেবভাব অঙ্কিত করিয়াছি। দর্শক অভিনয় দর্শনে আনন্দ করিয়াছেন ও মনঃসংযোগে দেখিয়াছেন বটে, কিন্তু কিরূপে তাঁহাদের হৃদয়ে দেব-ছবি অঙ্কিত করিয়াছি, তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। যদি অবকাশ হয় তবে বুঝাইয়া দিবেন। এক্ষণে যদি ধৈর্য্য থাকে তবে আমার নাটকীয় জীবন শুনুন!

 আমি যখন প্রথম থিয়েটারে যাই, তখন রসিক নিয়োেগীর গঙ্গার ঘাটের উপর যে বাড়ী ছিল, তাহাতে থিয়েটারের রিহার্সাল হইত। সে স্থান যদিও আমার বিশেষ স্মরণ নাই, তবুও অল্প অল্প মনে পড়ে। বড়ই রমণীয় স্থান ছিল, একেবারে গঙ্গার উপরে বাড়ী ও বারান্দা, নীচে গঙ্গার বড় বাঁধান ঘাট; দুইধারে অন্তিমপথ-যাত্রীদিগের বিশ্রাম-ঘর। সেই বালিকা কালের সেই রমণীয় ছবি দূর স্মৃতির ন্যায় এখনও আমার মনোমধ্যে জাগিয়া আছে, কেমন গঙ্গা কুল কুল করিয়া বহিয়া যাইত। আমি সেই টানা-বারান্দায় ছুটাছুটি করিয়া খেলিয়া বেড়াইতাম। আমার মনে কত আনন্দ, কত সুখ-স্বপ্ন ফুটিয়া উঠিত। বালিকা বলিয়াই হউক, কিম্বা শিক্ষাকার্য্যে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়াই হউক, সকলে আমাকে বিশেষ স্নেহ ও যত্ন করিতেন। আমরা যে তখন বড় গরীব ছিলাম, তাহা পূর্ব্বেই বলিয়াছি; ঐ নিজের একটী বসত বাটী ছাড়া ভাল কাপড় জামা বা অন্য দ্রব্যাদি কিছুই ছিল না। সেই সময়ে “রাজা” বলিয়া যে প্রধানা অভিনেত্রী ছিলেন, তিনি আমায় ছোট হাত-কাটা দুটী ছিটের জামা তৈয়ারী করাইয়া দেন। তাহা পাইয়া আমার কত যে আনন্দ হইয়াছিল, তাহা। বলিতে পারি না। সেই জামা দুইটাই আমার শীতের সম্বল ছিল। সকলে বলিত যে এই মেয়েটাকে ভাল করিয়া শিক্ষা দিলে বোধ হয় খুব কাজের লোক হইবে। তখন স্বর্গীয় ধর্ম্মদাস সুর মহাশয় ম্যানেজার ছিলেন, ৺অবিনাশচন্দ্র কর মহাশয় আসিষ্টাণ্ট ম্যানেজার ছিলেন।
শরৎ-সরােজিনী নাটকে “সরােজিনী” (পুরুষবেশী )র ভূমিকায়

শ্রীমতী বিনােদিনী।

আর বোধহয় বাবু মহেন্দ্রনাথ বসু শিক্ষা দিতেন। আমার সব মনে পড়েনা। তবে তখন বেলবাবু, মহেন্দ্রবাবু, অর্দ্ধেন্দুবাবু ও গোপালবাবু, ইঁহারাই বুঝি সব শিক্ষা দিতেন। তখন বাবু রাধামাধব করও উক্ত থিয়েটারে অভিনয় কার্য্য করিতেন এবং বর্ত্তমান সময়ে সম্মানিত সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ কর মহাশয়ও উক্ত “ন্যাশন্যাল থিয়েটারে অবৈতনিক অভিনেতা ছিলেন। ইঁহারা সকলে পরামর্শ করিয়া আমায় “বেণীসংহার” পুস্তকে একটা ছোট পার্ট দিলেন, সেটী দ্রৌপদীর একটী সখীর পার্ট, অতি অল্প কথা। তখন বই প্রস্তুত হইলে, নাট্যমন্দিরে গিয়া ড্রেস-রিহার্সাল দিতে হইত। যে দিন উক্ত বই এর ড্রেস-রিহার্সাল হয়, সে দিন আমার তত ভয় হয় নাই, কেননা রিহার্সাল বাড়ীতেও যাহারা দেখিত, সেখানেও প্রায় তাহারাই সকলে এবং দুই চারিজন অন্য লোকও থাকিত।

 কিন্তু যে দিন পার্ট লইয়া জন সাধারণের সম্মুখে ষ্টেজে বাহির হইতে হইল, সে দিনের হৃদয়ভাব ও মনের ব্যাকুলতা কেমন করিয়া বলিব। সেই সকল উজ্জ্বল আলোকমালা, সহস্র সহস্র লোকের উৎসাহপূর্ণ দৃষ্টি, এই সব দেখিয়া শুনিয়া আমার সমস্ত শরীর ঘর্ম্মাক্ত হইয়া উঠিল, বুকের ভিতর গুর্ গুর্ করিতে লাগিল, পাদুটীও থর্ থর্ করিয়া কাঁপিয়া উঠিল, আর চক্ষের উপর সেই সকল উজ্জ্বল দৃশ্য যেন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হইয়া গেল বলিয়া মনে হইতে লাগিল। ভিতর হইতে অধ্যক্ষেরা আমায় আশ্বাস দিতে লাগিলেন। ভয়, ভাবনা ও মনের চঞ্চলতার সহিত কেমন একটা কিসের আগ্রহও যেন মনের মধ্যে উথলিয়া উঠিতে লাগিল। তাহা কেমন করিয়া বলিব? একে আমি অতিশয় বালিকা, তাহাতে গরীবের কন্যা, কখনও এরূপ সমারোহ স্থানে যাইতে বা কার্য্য করিতে পাই নাই। বাল্যকালে কতবার মাতার মুখে শুনিতাম ভয় পাইলে হরিকে ডাকিও, আমিও ভয়ে ভয়ে ভগবানকে স্মরণ করিয়া, যে কয়টী কথা বলিবার জন্য প্রেরিত হইয়া ছিলাম, প্রাণপণ যত্নে তাঁহাদের শিক্ষানুযায়ী সুচারুরূপে ও সেইরূপ ভাবভঙ্গীর সহিত বলিয়া চলিয়া আসিলাম। আসিবার সময় সমস্ত দর্শক আনন্দধ্বনি করিয়া করতালি দিতে লাগিলেন। ভয়েই হউক, আর উত্তেজনাতেই হউক, আমার তখনও গা কাঁপিতেছিল। ভিতরে আসিতে অধ্যক্ষেরা কত আদর করিলেন। কিন্তু তখন করতালির কি মর্ম্ম তাহা জানিতাম না। পরে সকলে বুঝাইয়া দিয়াছিলেন, যে কার্য্যে সফলতা লাভ করিলে আনন্দে করতালি দিয়া থাকেন। ইহার কিছুদিন পরেই সকলে পরামর্শ করিয়া আমায় হরলাল রায়ের “হেমলতা” নাটকে হেমলতার ভূমিকা অভিনয় করিবার জন্য শিক্ষা দিতে লাগিলেন। আমার পার্ট শিখিবার আগ্রহ দেখিয়া সকলে বলিত যে এই মেয়েটী হেমলতার পার্ট ভাল করিয়া অভিনয় করিতে পারবে। এই সময় আর একজন অভিনেত্রী আসিলেন ও সেই সঙ্গে মদনমোহন বর্ম্মণ অপেরা মাষ্টার হইয়া থিয়েটারে যোগ দিলেন। উক্ত অভিনেত্রীর নাম কাদম্বিনী দাসী। বহুদিন যাবৎ বিশেষ সুখ্যাতির সহিত কাদম্বিনী অভিনয় কার্য্য করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি অবসর প্রাপ্তা এই “হেমলতা” অভিনয় শিক্ষা দিবার সময় আমার হৃদয় যেন উৎসাহ ও আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। আমি যখন কার্য্য স্থান হইতে বাড়ীতে আসিতাম, সেই সকল কার্য্য আমার মনে আঁকা থাকিত। তাঁহারা যেমন করিয়া বলিয়া দিতেন, যেমন করিয়া ভাব ভঙ্গি সকল দেখাইয়া দিতেন, সেই সকল যেন আমার খেলার সঙ্গিনীদের ন্যায় চারিকে ঘেরিয়া থাকিত। আমি যখন বাড়ীতে খেলা করিতাম তখনও যেন একটা অব্যক্তশক্তি দ্বারা সেইদিকেই আচ্ছন্ন থাকিতাম। বাড়ীতে থাকিতে মন সরিত না, কখন আবার গাড়ী আসিবে, কখন আমায় লইয়া যাইবে, তেমনি করিয়া নূতন নূতন সকল শিখিব, এই সকল সদাই মনে হইত। যদিও তখন আমি ছোট ছিলাম, তবুও মনের ভিতর কেমন একটা উৎসাহপূর্ণ মধুর ভাব ঘুরিয়া বেড়াইত। ইহার পর যখন আমার শিক্ষা শেষ হইয়া অভিনয়ের দিন আসিল, তখন আর প্রথমবারের মত ভয় হইল না বটে, কিন্তু বুকের ভিতর কেমন করিতে লাগিল। সে দিন আমি রাজকন্যার অভিনয় করিব কিনা—তক‍্তকে ঝক‍্ঝকে উজ্জ্বল পোষাক দেখিয়া ভারি আমোদ হইল। তেমন পোষাক পরা দূরে থাক্, কখন চক্ষেও দেখি নাই। যাহা হউক, ঈশ্বরের দয়াতে আমি “হেমলতা”র পার্ট সুচারুরূপে অভিনয় করিলাম। তখন হইতে লোকে বলিত যে “ইহার উপর ঈশ্বরের দয়া আছে।” আর আমারও এখন বেশ মনে হয়, যে আমার ন্যায় এমন ক্ষুদ্র দুর্ব্বল বালিকা ঈশ্বর অনুগ্রহ ব্যতীত কেমন করিয়া সেরূপ দুরূহ কার্য্য সমাপন করিয়াছিল। কেননা আমার কোন গুণ ছিল না, তখন ভাল লেখাপড়াও জানিতাম না, গান ভাল জানিতাম না। তবে শিখিবার বড়ই আগ্রহ ছিল।

 সেই সময় হইতে আমি প্রায় প্রধান প্রধান পার্ট অভিনয় করিতে বাধ্য হইতাম। আমার অগ্রবর্ত্তী অভিনেত্রীগণ যদিও আমার অপেক্ষা অধিক বয়স্কা ছিলেন, কিন্তু আমি তাঁহাদের বয়সে সমান না হইলেও অল্পদিনে কাজে তাঁহাদের সমান হইয়া ছিলাম। ইহার কয়েক মাস পরেই “গ্রেট ন্যাশন্যাল” থিয়েটার কোম্পানী পশ্চিম অঞ্চলে থিয়েটার করিতে বাহির হন, এবং আমায় আর পাঁচ টাকা মাহিনা বৃদ্ধি করিয়া আমাকে ও আমার মাতাকে সঙ্গে লইয়া যান। তাঁহারা নানা দেশ ভ্রমণ করেন পশ্চিমে থিয়েটার করিবার সময় দু’একটী ঘটনা শুনুন,— যদিও সে ঘটনা শুধু আমার সম্বন্ধে নয় তবুও তাহা। কৌতুহলকর।

 একরাত্রি লক্ষ্ণৌনগরে ছত্রমণ্ডিতে আমাদের“নীলদর্পণ” অভিনয় হইতেছিল, সেই দিন লক্ষ্ণৌ নগরের প্রায় সকল সাহেব থিয়েটার দেখিতে আসিয়া ছিলেন। যে স্থানে রোগ সাহেব ক্ষেত্রমণির উপর অবৈধ অত্যাচার করিতে উদ্যত হইল, তোরাপ দরজা ভাঙ্গিয়া রোগ সাহেবকে মারে, সেই সময় নবীনমাধর ক্ষেত্রমণিকে লইয়া চলিয়া যায়। একে তো “নীলদর্পণ” পুস্তকই অতি উৎকৃষ্ট অভিনয় হইতে ছিল; তাহাতে বাবু মতিলাল সুর—তোরাপ, অবিনাশ কর মহাশয়—মিষ্টার রোগ সাহেবের অংশ অতিশয় দক্ষতার সহিত অভিনয় করিতে ছিলেন। ইহা দেখিয়া সাহেবেরা বড়ই উত্তেজিত হইয়া উঠিল। একটা গোলযোগ হইয়া পড়িল এবং একজন সাহেব দৌড়িয়া একবারে ষ্টেজের উপর উঠিয়া তোরাপকে মারিতে উদ্যত! এইরূপ কারণে আমাদের কান্না, অধ্যক্ষদিগের ভয়, আর ম্যানেজার ধর্মদাস সুর মহাশয়ের কাঁপুনি!! তারপর অভিনয় বন্ধ করিয়া, পোষাক আসবাব বাঁধিয়া ছাঁদিয়া বাসায় এক রকম পলায়ন!! পরদিন প্রাতেই লক্ষৌনগর পরিত্যাগ করিয়া হাপ ছাড়ন!!!

 ইহার পরে আমরা যদিও অনেক স্থানে গিয়াছিলাম কিন্তু সব কথা আমার মনে নাই, তবে দিল্লীতে মাছির ঘর, বিছানা ব্যতীত কিছুই দেখা যাইত না। এবং সেই প্রথম ভিস্তির | জলে স্নান করিতে আমার আপত্তি, মাতার ক্রমাগত রোদন দেখিয়া, আমার মাকে একটী ইঁদারার জল নিজ হাতে তুলিয়া স্নান আহার করিবার সুবিধা করিয়া দেওয়ায় সন্তুষ্ট হইলেন। আর আমাদের ভিস্তির জলই বন্দোবস্ত। দিল্লীতে আর একটা ঘটনা হয় তাহা ক্ষুদ্র হইলেও আমার বেশ মনে আছে। দিল্লীর বাড়ীর খোলা ছাদে আমি একদিন ছুটাছুটী করিয়া খেলা করিতে ছিলাম। কি কারণে মনে নাই, কাদম্বিনীর তাহা অসহ্য হওয়ায় আমার হাত ধরিয়া আমার গালে দুই চড় মারেন, সেই দিন আমরা মায়ে ঝীয়ে সারা দিন কাঁদিয়া ছিলাম। মা আমার মনের দুঃখে কিছু খান নাই, আমিও মায়ের কাছে সমস্ত দিন বসিয়া ছিলাম, শেষে বৈকালে থিয়েটারের বাবুরা আমায় জোর করাইয়া আহার করান। আমার মা কিন্তু সে দিন কিছুই আহার করিলেন না। একে তো দিল্লীসহরে মুসলমানের বাড়াবাড়ি দেখিয়া মা আমার ক্রমাগতই কাঁদিতেন, কি করিবেন, একে আমরা গরীব তাহাতে আমি বালিকা, যদিও কর্তৃপক্ষেরা যত্ন করিতেন, তবুও বড় অভিনেত্রীরা নিজের গণ্ডা নিজে বুঝিয়া লইতেন, আমার দয়ার উপর নির্ভর ছিল। আর কি কারণে—জানিনা, সকলের অপেক্ষা কাদম্বিনী যেন কিছু অহঙ্কৃতা ছিলেন, আমার উপর কেমন তাঁর দ্বেষ ছিল, প্রায়ই দূর ছাই করিতেন। তারপর বোধ হয় আমাদের লাহোরে যাইতে হয়। লাহোরে আমাদের বেশী দিন থাকিতে হয়; সেখানে অনেকগুলি বই অভিনয় হইয়া ছিল। আমি নানা রকম পার্ট অভিনয় করিয়া ছিলাম। “সতী কি কলঙ্কিনী”তে রাধিকা, “নবীন তপস্বিনী”তে কামিনী, “সধবার একাদশী”তে কাঞ্চন, “বিয়ে পাগলা বুড়ো” তে ফতি—কত বলিব। তবে বলিয়া রাখি যে, সে সময় আমার এত অল্প বয়স ছিল যে বেশ করিবার সময় বেশকারীদের বড় ঝঞ্ঝটে পড়িতে হইত। আমার মত একটী বালিকাকে কিশোর বয়স্কা বা সময় সময় প্রায় যুবতীর বেশে সজ্জিত করিতে তাহারা সময়ে সময়ে বিরক্ত হইত—তাহা বুঝিতাম। আবার কখন কখন সকলে তামাসা করিয়া বলিত “যে তাকে কামার দোকানে পাঠাইয়া দিয়া পিটিয়া একটু বড় করিয়া আনাইব।” লাহোরে যখন আমরা অভিনয় করি, তখন আমার সম্বন্ধে একটী অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। সেখানে গোলাপ সিংহ বলিয়া একজন বড় জমীদার মহাশয়ের খেয়াল উঠিল, যে তিনি আমায় বিবাহ করিবেন এবং যত টাকা লইয়া আমার মাতা সন্তুষ্ট হন তাহা দিবেন। পূর্ব্বোক্ত জমীদার মহাশয় অর্ধেন্দুবাবু ও ধর্ম্মদাস বাবুকে বড়ই পিড়াপীড়ি করিয়া ধরিলেন। তখন উঁহারা বড়ই মুস্কিলে পড়িলেন। তিনি নাকি সেখানকার একটা বিশেষ বড় লোক। একে বিদেশ—উপরান্ত এই সকল কথা শুনিয়া আমার মা তো কাঁদিয়াই আকুল। আমিও ভয়ে একবারে কাঁটা। এই উপলক্ষে আমাদের শীঘ্রই লাহোর ছাড়িতে হয়। ফিরিবার সময় আমরা ৺শ্রীশ্রীবৃন্দাবন ধাম দিয়া আসিয়া ছিলাম। ৺শ্রীবৃন্দাবন ধামে আবার আমি একটী বিশেষ ছেলে মান‍্ষি করিয়া ছিলাম। তাহা এই:—

 থিয়েটার কোম্পানী সেই দিন ৺শ্রীধামে পৌঁছিয়া চল্লিশ জন লোকের জলখাবার ইত্যাদি প্রস্তুত করিয়া রাখিয়া তাঁহারা ৺শ্রীজীউদিগের দর্শন করিতে গেলেন এবং আমাকে বলিয়া যান যে “তুমি ছেলে মানুষ, এখনই এই গাড়ীতে আসিলে, এখন জল খাইয়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া থাক। আমরা দেবতা দর্শন করিয়া আসি।” আমি বাসায় দরজা বন্ধ করিয়া রহিলাম। তাঁহারা সকলে ৺শ্রীশ্রীগোবিন্দজীউর দর্শন জন্য চলিয়া গেলেন। আমার একটু রাগ ও দুঃখ হইল বটে, কিন্তু কি করিব? মনের ক্ষোভ মনেই চাপিয়া রহিলাম। ঘরের দরজা দিয়া বসিয়া আছি, এমন সময় একটা বাঁদর আসিয়া জানালার কাঠ ধরিয়া বসিল। আমি বালিকা-সুলভ-চপলতা বশতঃ তাহাকে একটী কাঁকড়ি খাইতে দিলাম, সে খাইতেছে এমন সময় আর দুইটা আসিল, আমি তাহাদেরও কিছু খাবার দিলাম, আবার গোটা দুই আসিল, আমি মনে ভাবিলাম যে ইহাদের কিছু কিছু খাবার দিলে সকলে চলিয়া যাইবে। সেই ঘরের চার পাঁচটা জানালা ছিল, আমি যত আহার দিই, ততই জানালায়, ছাদে, বারান্দায় বাঁদরে বাঁদরে ভরিয়া যাইতে লাগিল। তখন আমার বড় ভয় হইল, আমি কঁদিতে কাদিতে যত খাবার ছিল প্রায় তার সকলই তাহাদের দিতে লাগিলাম। আর মনে করিতে লাগিলাম যে এইবারেই তারা চলিয়া যাইবে। কিন্তু যত খাবার পাইতে লাগিল, বানরের দল তত বাড়িতে লাগিল। আর আমি কঁদিতে কাদিতে তাদের ক্রমাগত আহার দিতে লাগিলাম। ইতিমধ্যে কোম্পানীর লোক ফিরিয়া আসিয়া দেখিল—ছাদ, বারান্দা, জানালা সব বানরে ভরিয়া গিয়াছে। তাঁহারা লাঠি ইত্যাদি লইয়া তাহাদের তাড়াইয়া দিয়া আমায় দরজা খুলিতে বলিলেন। আমি কঁদিতে কাঁদিতে দরজা খুলিয়া দিলাম। তাঁহারা আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি সকল কথা তাঁহাদের বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া আমার মা আমায় দুটী চড় মারিলেন ও কত বকিতে লাগিলেন। কিন্তু আমি যে অত ক্ষতি করিয়া ছিলাম, তবু কোম্পানীর সকলে হাসিয়া মাকে মারিতে নিষেধ করিলেন; বলিলেন যে “মারিও না, ছেলে মানুষ ও কি জানে? আমাদের দোষ, সঙ্গে করিয়া হইয়া গেলেই হইত!” অর্ধেন্দুবাবু বলিলেন “বোকা মেয়ে আমাদের সকল খাবার বিলাইয়া ব্রজবাসীদিগের ভোজন করাইলি, এখন আমরা কি খাই বল দেখি?” আবার জলখাবার খরিদ করিয়া আনা হইল, তবে তাঁহারা জল খাইলেন। ঐ কথা লইয়া নীলমাধববাবু আমায় দেখা হইলেই এখনও তামাসা করিয়া বলিতেন, যে “৺বৃন্দাবনে গিয়া বাঁদর ভোজন করাবি বিনোদ!” নীলমাধব চক্রবর্তী বঙ্গীয় নাট্যজগতে বিশেষ সুপরিচিত! সকলেই তাঁহার নাম জানেন। তিনিও আমাদের সঙ্গে পঞ্চিমে ছিলেন, তিনি আমায় অতিশয় যত্ন করিতেন। দিল্লীতে যখন সব এক‍্ট্রেসরা চাদর, জামা, কাপড় নিজ নিজ পয়সায় খরিদ করেন। আমার পয়সা ছিল না বলিয়া কিনিতে না পারায় তিনি আমায় একখানি ফুল দেওয়া চাদর ও কাপড় কিনিয়া দেন। সেই তখনকার স্মৃতিচিহ্ন তাঁহার স্নেহের জিনিষ আমার কতদিন ছিল। আর একটী প্রথম উপহার, একটী অকৃত্রিম স্নেহময় বন্ধুর প্রদত্ত আমার বড় আদরের হইয়াছিল। মাননীয় শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ কর ডাক্তার মহাশয় তিনি একটী ঢাকার গঠিত রূপার ফুল ও খেলিবার একটী কাঁচের ফুলের খেলনা আমায় দিয়া ছিলেন। তাঁহার সেই স্নেহময় উপহার আমার সেই বালিকাকালে বড়ই আনন্দপ্রদ হইয়াছিল। নিঃস্বার্থ স্নেহে বশীভূত হইয়া আমি এখনও তাঁ’র দয়া অনুগ্রহ দ্বারা ও দায় বিদায়ে রোগে শোকে সান্ত্বনা পাইয়া থাকি। তাঁহার অকৃত্রিম অনুগ্রহে আমি তাঁহার নিকট চিরঋণী। এই বহু সম্মানিত ডাক্তার বাবু মহাশয় এই অভাগিনীর চির ভক্তির পাত্র! এই রূপেই আমার বাল্যকালের নাট্যজীবন!

 ইহার পর আমরা কলিকাতা চলিয়া আসি। তারপর বোধহয় পাঁচ ছয় মাস পরে “গ্রেট ন্যাশন্যাল” থিয়েটার বন্ধ হইয়া যায়। তৎপরে আমি মাননীয় ৺শরৎচন্দ্র ঘোেষ মহাশয়ের বেঙ্গল থিয়েটারে প্রথমে ২৫৲ পঁচিশ টাকা বেতনে নিযুক্ত হই। তখনও যদিচ আমি বালিকা কিন্তু পূর্ব্বাপেক্ষা অনেক কার্য্যতৎপরা এবং চালাক চটপটে হয়া ছিলাম। স্বর্গীয় শরৎচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের নিকট আমি চিরঋণে আবদ্ধ। এইখান হইতেই আমার অভিনয় কার্যে শ্রীবৃদ্ধি এবং উন্নতির প্রথম সোপান। সকলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাননীয় স্বর্গগত শরৎচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের অতুলনীয় স্নেহ মমতা। তিনি আমায় এত অধিক যত্ন করিতেন, বোধহয় নিজকন্যা থাকিলেও এর অধিক স্নেহ পাইত না।

 মহাশয়ের আমার উপর অসীম করুণা ছিল, সেই কারণে বলিতে সাহস করিতেছি। যদি অনুমতি করেন। তবে বেঙ্গল থিয়েটারে যে কয়েক বৎসর অভিনয় কার্য্য করিয়া ছিলাম, সেই সময়ের ঘটনাগুলি বিবৃত করি।