আমার কথা (প্রথম খণ্ড)/বেঙ্গল থিয়েটারে

বেঙ্গল থিয়েটারে।

 কৈশােরে পদার্পণ করিয়া বেঙ্গল থিয়েটারের অধ্যক্ষ পূজনীয় ৺শরৎচন্দ্র ঘােষ মহাশয়ের অধীনে কার্য্যে নিযুক্ত হই। ঠিক মনে পড়েনা, কি কারণ বশতঃ আমি “গ্রেট ন্যাশন্যাল” থিয়েটার ত্যাগ করি। এই বেঙ্গল থিয়েটারই আমার কার্য্যের উন্নতির মূল; এই স্থানে ৺শরৎচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের কর্ত্তৃত্বাধীনে অতি অল্প দিনের মধ্যে প্রধান প্রধান ভূমিকা অভিনয় করিতে আরম্ভ করি। মাননীয় শরৎবাবু আমায় কন্যার ন্যায় স্নেহ করিতেন, তাঁহার অসীম স্নেহ ও গুণের কথা আমি একমুখে বলিতে পারিনা। প্রসিদ্ধা গায়িকা বনবিহারিণী (ভুনি), সুকুমারী দত্ত (গোলাপী) ও এলােকেশী সেই সময় “বেঙ্গলে” অভিনেত্রী ছিলেন। তখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদ বধ” কাব্য নাটককারে পরিবর্ত্তিত হইয়া অভিনয়ার্থে প্রস্তুত হইতে ছিল। আমি উক্ত “মেঘনাদ বধ” কাব্যে সাতটী পার্ট একসঙ্গে অভিনয় করিয়া ছিলাম। ১ম চিত্রাঙ্গদা, ২য় প্রমিলা, ৩য় বারুণী, ৪র্থ রতি, ৫ম মায়া, ৬ষ্ঠ মহামায়া, ৭ম সীতা। বঙ্কিমবাবুর “মৃণালিনীতে” মনোরমা অভিনয়ই করিতাম এবং “দুর্গেশনন্দিনীতে” আয়েষা ও তিলোত্তমা এই দুইটী ভূমিকা প্রয়োজন হইলে দুইটীই একরাত্রি একসঙ্গে অভিনয় করিয়াছি। কারাগারের ভিতর ব্যতীত আয়েষা ও তিলোত্তমার দেখা নাই! কারাগারে তিলোত্তমার কথাও ছিলনা, অন্য একজন তিলোত্তমার কাপড় পরিয়া কারাগারে গিয়া “কেও—বীরেন্দ্র সিংহের কন্যা? জগৎসিংহের মুখে এইমাত্র কথা শুনিয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িত।” আর সেই সময়েই আয়েষার ভূমিকার শ্রেষ্ঠ অংশ ওস‍্মানের সহিত অভিনয়! এই অতি সঙ্কুচিতা ভীরু স্বভাবা রাজকন্যা তিলোত্তমা, তখনি আবার উন্নত-হৃদয়া-গর্ব্বিণী। অপরিসীম হৃদয়-বলশালিনী প্রেমপরিপূর্ণা নবাব পুত্রী আয়েষা! এইরূপ দুই ভাগে নিজেকে বিভক্ত করিতে কত যে উদ্যম প্রয়োজন তাহা বলিবার নহে। ইহা যে প্রত্যহ ঘটিত তাহা নহে, কার্য্যকালীন আকস্মিক অভাবে এইরূপে কয়েকবার অভিনয় করিতে হইয়া ছিল।

 একদিন অভিনয় রাত্রিতে আয়েষা সাজিবার জন্য গৃহ ইইতে সুন্দর পোষাক পরিচ্ছদ পরিয়া অভিনয় স্থানে উপস্থিত হইয়া শুনিলাম, যিনি “আসমানির” ভূমিকা অভিনয় করিবেন তিনি উপস্থিত নাই। রঙ্গালয় জনপূর্ণ। কর্ত্তৃপক্ষগণের ভিতর চুপি চুপি কথা হইতেছে—“কে বিনোদকে ‘আসমানির’ পার্ট অভিনয় করিতে বলিবে? উপস্থিত বিনোদ ব্যতীত অন্য কেহই পারিবে না!” আমি বাটী হইতে একবারে আয়েষার পোষাকে সজ্জিত হইয়া আসিআছি বলিয়া ভরসা করিয়া কেহই বলিতেছেন না। এমন সময় বাবু অমৃতলাল বসু আসিয়া অতি আদর করিয়া বলিলেন, “বিনোদ! লক্ষ্মী ভগ্নিটী আমার! আসমানি যে সাজিবে তাহার অসুখ করিয়াছে, তোমায় আজ চালাইয়া দিতে হইবে, নতুবা বড়ই মুস্কিল দেখিতেছি”। যদিও মুখে অনেকবার “না—পারিব না” বলিয়াছিলাম বটে, আর বাস্তবিক সেই নবাব পুত্রীর সাজ ছাড়িয়া তখন দাসীর পোষাক পরিতে হইবে, আবার “আয়েষা সাজিতে অনেক খুঁত হইবে বলিয়া মনে মনে বড় রাগও হইয়াছিল, কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন বুঝিয়া তাঁহাদের কথামত কার্য্য করিতে বাধ্য হইলাম। বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনয় করিবার সময় “ইংলিসম্যান”, “স্টেটসম্যান” ইত্যাদি কাগজে আমায় কেহ “সাইনোরা”, কেহ কেহ বা “ফাওয়ার অব দি নেটিভ ষ্টেজ” বলিয়া উল্লেখ করিতেন। এখনও আমার পূর্বব বন্ধুদের সহিত সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা বলেন, যে “সাইনোরা” ভাল আছ তো!

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি এই থিয়েটারে বঙ্কিমবাবুর “মৃণালিনী” অভিনীত হইত। তাহার অভিনয় যেরূপ হইয়াছিল তাহা বর্ণনাতীত। তখনকার বা এখনকার কোন রঙ্গালয়ে এ পুস্তকের এরূপ অভিনয় বোধহয় কোথাও হয় নাই। এই মৃণালিনীতে হরি বৈষ্ণব—হেমচন্দ্র, কিরণ বাঁড়ুর্য্যে— পশুপতি, গোলাপ (সুকুমারী দত্ত)—গিরিজায়া, ভুনী—মৃণালিনী এবং আমি—মনোরমা!

 আর গোটাকয়েক কথা বলিয়া বেঙ্গল থিয়েটার সম্বন্ধে কথা শেষ করিব। একবার আমরা সদলবলে চুয়াডাঙ্গা যাই, আমাদের জন্য একখানি গাড়ী রিজার্ভ করা হইয়াছিল। সকলে একত্র যাইতেছি! মাস—স্মরণ নাই, মাঝখানে কোন্ ষ্টেশনে তাও মনে নাই, তবে সে যে একটী বড় স্টেশন সন্দেহ নাই। সেইস্থানে নামিয়া “উমিচাঁদ” বালিয়া ছোটবাবু মহাশয়ের একজন আত্মীয় (আমরা মাননীয় শরৎচন্দ্র ঘোষ মহাশয়কে ছোটবাবু বলিয়া ডাকিতাম) ও আর দুই চারিজন এক‍্টার আমাদের কোম্পানীর জন্য খাবার আনিতে গেলেন। জলখাবার, পাতা ইত্যাদি লইয়া সকলে ফিরিয়া আসিলেন, উমিচাঁদ বাবুর আসিতে দেরী হইতে লাগিল। এমন সময় গাড়ী ছাড়ে ছাড়ে, ছোটবাবু মহাশয় গাড়ী হইতে মুখ বাড়াইয়া “ওহে উমিচাঁদ শীঘ্র এস—শীঘ্র এস—গাড়ী যে ছাড়িল” বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। এমন সময় গাড়ীও একটু একটু চলিতে লাগিল, ইত্যবসরে দৌড়িয়া উমিচাঁদবাবু গাড়ীতে উঠিলেন, গাড়ীও জোরে চলিল। এমন সময় উমিচাঁদ বাবু অবসন্ন হইয়া শুইয়া পড়িলেন। ছোটবাবু মহাশয় ও অন্যান্য সকলে “সর্দ্দিগরমি হইয়াছে, জল দাও জল দাও” করিতে লাগিলেন; চারুচন্দ্রবাবু ব্যস্ত হইয়া বাতাস করিতে লাগিলেন। কিন্তু এমন দুদৈব যে সমস্ত গাড়ীখানার ভিতর একটী লোকের কাছে, এমন কি এক গণ্ডুষ জল ছিল না, যে সেই আসন্ন-মৃত্যুমুখে পতিত লোকটীর তৃষ্ণার জন্য তাহা দেয়। “ভুনি” তখন সবে মাত্র বেঙ্গল থিয়েটারে কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছে। তাহার কোলে ছোট মেয়ে। সে সময় অন্য কোনও উপায় না দেখিয়া আপনার স্তন্য দুগ্ধ একটী ঝিনুকে করিয়া লইয়া উমিচাঁদের মুখে দিল। কিন্তু তাহার প্রাণ তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া গেল। বোধহয় ১০৷১৫ মিনিটের মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটিল। গাড়ী শুদ্ধ লোক একবারে ভয়ে ভাবনায় মুহ্যমান হইয়া পড়িল। ছোটবাবু মহাশয় উমিচাঁদের বুকে মুখ রাখিয়া বালকের ন্যায় কাঁদিয়া উঠিলেন। আমি একে বালিকা, তাহাতে ওরকম মৃত্যু কখন দেখি নাই, ভয়ে মাতার কোলের উপর শুইয়া পড়িলাম। উমিচাঁদবাবুর মৃত্যুকালীন সেই মুখভঙ্গী আমার মনোক্ষেত্রে পুনঃ পুনঃ অভিনীত হইতে লাগিল। আমার। অবস্থা দেখিয়া চারুবাবু মহাশয় ছোটবাবুকে বলিলেন, “শরৎ থাম, যাহা হইবার হইয়াছে। এখন যদি রেলের লোক এ ঘটনা জানিতে পারে, গাড়ী কাটিয়া দিবে, এত লোকজন লইয়া রাস্তার মাঝে আর এক বিপদ হইবে।” ছোটবাবু কঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “আমি উমির মা’কে গিয়া কি বলিব? সে আসিবার কালীন উমিচাঁদ সম্বন্ধে কত কথা যে আমাকে বলিয়া দিয়াছিল।” (উমিচাঁদবাবু মাতার একমাত্র পুত্র ছিলেন)। যাক্ এই রকম ভয়ানক বিপদ ঘাড়ে করিয়া আমরা সন্ধ্যার সময় চুয়াডাঙ্গায় নামিলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা, সেখানের ষ্টেশন মাষ্টারকে বলা হইল যে এই আগের ষ্টেশনে এই ঘটনা ঘটিয়াছে। তারপর আমরা বাসায় গিয়া যে যেখানে পাইলাম, অবসন্ন হইয়া সে রাত্রে শুইয়া পড়ি পাম। ছোটবাবু ও দুই চারিজন অভিনেতা শব দাহ করিতে যাইলেন। সেখানে তিন দিন থাকিয়া অভিনয় কার্য্য সারিয়া সকলে অতি বিষন্নভাবে কলিকাতায় ফিরিলাম। এই শোকপূর্ণ ঘটনাটী কোন যোগ্য লেখকের দ্বারা বর্ণিত হইলে সে ভীষণ ছবি কতক পরিমাণে পরিস্ফুট হইত।

 আর একবার একটী ঘোর বিপদে পড়ি। সেও বেঙ্গল থিয়েটারের সহিত সাহেবগঞ্জ না কোথায় একটী জঙ্গলাদেশে যাইতে। নির্দিষ্ট স্থানে যাইতে কতকটা জঙ্গলের মধ্য দিয়া হাতী ও গোরুর গাড়ীতে যাইতে হয়। ৪টী হাতী ও কয়েকখানি গোরুর গাড়ী আমাদের জন্য প্রেরিত হয়। যাহারা যাহারা গোরুর গাড়ীতে যাইবে, তাহারা তিনটার সময় চলিয়া গেল। আমি ছেলে মান‍্ষির ঝোঁকে বলিলাম, যে “আমি হাতীর উপর যাইব।” ছোটবাবু মহাশয় কত বারণ করিলেন। কিন্তু আমি হাতী কখন দেখি নাই! চড়া তো দূরের কথা! ভারি আমোদ হইল, আমি গোলাপকে বলিলাম, “দিদি, আমি। তোমার সঙ্গে হাতীতে যাইব।” গোলাপ বলিল, “আচ্ছা, যাস্!” সে আমায় তার সঙ্গে রাখিল। মা বকিতে বকিতে আগে চলিয়া গেলেন। আমরা সন্ধ্যা হয় এমন সময় হাতীতে উঠিলাম। আমি, গোলাপ ও আর দুইজন পুরুষ মানুষ একটাতে, আর চারিজন করিয়া অপর তিনটাতে। কিছু দূর গিয়া দেখি, এমন রাস্তা তো কখন দেখি নাই! মোটে এক হাত চওড়া রাস্তা! আর দুই ধারে বুক পর্যন্ত বন! ধান গাছ কি অন্য গাছ বলিতে পারিনা— আর জল! ক্রমে যতই রাত্রি হইতে লাগিল ততই বৃষ্টি চাপিয়া আসিল, আর সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ও আরম্ভ হইল। হাতী তো ফর ফর করিতে লাগিল। শেষে সকলকে বেত বনের মধ্যে লইয়া ফেলিল। তার উপর শিলা বৃষ্টি! হাতীর উপর ছাউনী নাই, সেই জল, ঝড়, মেঘ গর্জ্জন, তার উপর শিলাবর্ষণ, আমি কেঁদেই অস্থির! গোলাপও কঁদিতে লাগিল। শেষে হাতী আর এগোয় না। শুড় মাথার উপর তুলিয়া আগের পা বাড়াইয়া ঠায় দাঁড়াইয়া রহিল। আবার তখন মাহুত বলিল, যে “বাঘ বেরিয়েছে তাই হাতী যাইতেছে না।” মাহুত চারি জন হৈ হৈ করিয়া চেঁচাইতে লাগিল। আমি তো আড়ষ্ট, আমার হাতী চড়ার আমোদ মাথায় উঠিয়াছে। ভয়ে কেঁদে কাঁপিতে লাগিলাম; পাছে হাতীর উপর হইতে পড়িয়া যাই বলিয়া একজন পুরুষ মানুষ আমায় ধরিয়া রহিল। তাহার পর কত কষ্টে প্রায় আধমরা হইয়া আমরা কোন রকমে বাসায় পৌঁছিলাম। জলে শীতে আমরা এমনি অসাড় হইয়া গিয়াছিলাম, যে হাতী হইতে নামিবারও ক্ষমতা ছিল না। ছোটবাবু নিজে ধরিয়া নামাইয়া নিয়া আগুন করিয়া আমার সমস্ত গা সেঁকিতে লাগিলেন। মা তো বকিতে বকিতে কান্না জুড়িলেন। নার বুলিই ছিল “হতচ্ছাড়া মেয়ে কোন কথা শোনে না।” সেই দিনই আমাদের অভিনয়ের কথা ছিল, কিন্তু দুর্যোগের অন্য ও আমাদের শারীরিক অবস্থার জন্য সেদিন বন্ধ রহিল।

 আর একবার নৌকাতে বিপদে পড়িয়া ছিলাম—আর একবার পাহাড়ে বেড়াইতে গিয়া ঝড়ের মাঝে পড়িয়া পথ হারাইয়া পাহাড়ীদের কুটীরে আশ্রয় লইয়া জীবন রক্ষা করি! সেই পাহাড়ীই আবার রাস্তা দেখাইয়া দিয়া বাসায় রাখিয়া যায়।

 একবার কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীতে ঘোড়ায় চড়িয়া অভিনয় করিতে পড়িয়া গিয়া বড়ই আঘাত লাগিয়া ছিল। “প্রমীলা”র পার্ট ঘোটকের উপর বসিয়া অভিনয় করিতে হইত। সেখানে মাটীর প্লাটফরম্ প্রস্তুত হইয়াছিল, যেমন আমি ষ্টেজ হইতে বাহিরে আসিব, অমনি মাটীর - ধাপ ভাঙ্গিয়া ঘোড়া হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া গেল। আমিও ঘোড়ার উপর হইতে প্রায় দুই হস্ত দূরে পতিত হইয়া অতিশয় আঘাত পাইলাম। উঠিয়া দাঁড়াইবার শক্তি রহিল না। তখন আমার অভিনয়ের অনেক বাকী আছে কি হইবে! চারুবাবু আমায় ঔষধ সেবন করাইয়া বেশ করিয়া আমার হাঁটু হইতে পেট পর্যন্ত ব্যাণ্ডেজ বাঁধিয়া দিলেন। ছোটবাবু মহাশয় কত স্নেহ করিয়া বলিলেন, যে “লক্ষ্মীটী! আজিকার কার্যটী কষ্ট করিয়া উদ্ধার করিয়া দাও।” তাঁহার সেই স্নেহময় সান্ত্বনাপূর্ণ বাক্যে আমার বেদনা অর্দ্ধেক দূর হইল। কোনরূপে কার্য্য সম্পন্ন করিয়া পরদিন কলিকাতায় ফিরিলাম। ইহার পর আমি এক মাস শয্যাশায়ী ছিলাম। যাহা হউক, বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনয়কালে আমি একরূপ সন্তোষে কাটাইয়া ছিলাম। কেননা তখন বেশী উচ্চ আশা হয় নাই। যাহা পাইতাম তাহাতেই সুখী হইতাম। যেটুকু উন্নতি করিতে পারিতাম, সেইটুকুও যথেষ্ট মনে করিতাম। বেশী আশাও ছিল না, অতৃপ্তিও ছিল না। সকলে বড় ভালবাসিত। হেসে খেলে নেচে কুঁদে দিন কাটাইতাম।

 এই সময় মাননীয় ৺কেদারনাথ চৌধুরী ও শ্রীযুত বাবু গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয় প্রায়ই বেঙ্গল থিয়েটারে যাইতেন। স্বর্গীয় কেদারবাবু আমার “কপালকুণ্ডলা”র অভিনয় দেখিয়া বলিয়া ছিলেন, যে “এই মেয়েটী যেন প্রকৃত “কপালকুণ্ডলা” ইহার অভিনয়ে বন্য সরলতা উৎকৃষ্টরূপে প্রদর্শিত হইয়াছে।

 পরে শুনিয়াছিলাম এই সময়ে গিরিশবাবু মহাশয় ছোটবাবুকে বলেন, যে “আমরা একটী থিয়েটার করিব মনে করিতেছি। আপনি যদ্যপি বিনোদকে আমাদের থিয়েটারে দেন তবে বড়ই ভাল হয়।” ছোটবাবু মহাশয় অতি উচ্চ-হৃদয়-সম্পন্ন মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন, তিনি বলিলেন, “বিনোদকে আমি বড়ই স্নেহ করি; উহাকে হাড়তে হইলে আমার বড়ই ক্ষতি হইবে। তথাপি আপনার অনুরোধ আমি এড়াইতে পারি না, বিনোদকে আপনি লউন।”

 তারপর ছোটবাবু মহাশয় একদিন আমায় বলিলেন, “কিরে বিনোদ এখান হইতে যাইলে তোর মন কেমন করিবে না?” আমি চুপ করিয়া রহিলাম। এ বিষয় লইয়া সেদিন শ্রীযুক্ত অমৃতলাল বসু মহাশয়ও বলিলেন, “ওসব কথা আমারও বেশ মনে আছে। তোমাকে বেঙ্গল থিয়েটার হইতে আনিবার পরও শরৎবাবু মহাশয় আমাদের বলিয়া ৺মাইকেল মধুসূদন দত্তের বেনিফিট নাইটের “দুর্গেশনন্দিনীর আয়েষার” ভূমিকা অভিনয় করিবার জন্য লইয়া যান; আরও কয়েকবার লইয়া গিয়াছিলেন। যাহা হউক, সেই সময় হইতে আমি মাননীয় গিরিশবাবু মহাশয়ের সহিত কার্য্য করিতে আরম্ভ করি। তাঁহার শিক্ষায় আমার যৌবনের প্রথম হইতে জীবনের সার ভাগ অতিবাহিত হইয়াছে।