আমার কথা (প্রথম খণ্ড)/ন্যাশন্যাল থিয়েটারে
ন্যাশন্যাল থিয়েটারে।
যৌবনারম্ভে।
আমি বেঙ্গল থিয়েটার ত্যাগ করিয়া স্বর্গীয় কেদারনাথ চৌধুরী মহাশয়ের ন্যাশন্যাল থিয়েটারে কার্য্য করিবার জন্য নিযুক্ত হই। মাস কয়েক “মেঘনাদ বধ”, “মৃণালিনী” ইত্যাদি পুরাতন নাটকে এবং “আগমনী”, “দোললীলা” প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গীতিনাট্যে ও অনেক প্রহসন ও প্যাণ্টোমাইমে প্রধান প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করি। সকলগুলিই প্রায় গিরিশবাবুর রচিত। ইহার পর গিরিশবাবুর ও আমার থিয়েটারের সহিত সংশ্রব শিথিল হইয়া আসে। ঐ সময় ন্যাশন্যাল থিয়েটারের দুর্দ্দশা! অল্পদিনের মধ্যেই থিয়েটার নীলামে বিক্রয় হওয়ায় প্রতাপচাঁদ জহুরী নামক জনৈক মাড়োয়ারী অধিকারী হইলেন। প্রতাপচাঁদবাবুর অধীনে থিয়েটারের নাম ন্যাশন্যাল থিয়েটারই রহিল। গিরিশবাবু পুনর্ব্বার ম্যানেজার হইলেন। এই থিয়েটারের প্রথম অভিনয়, স্বর্গীয় কবিবর সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার বিরচিত “হামীর”! ইহার নায়িকার ভূমিকা আমার ছিল, কিন্তু তখন ন্যাশন্যালের দুর্নাম রটিয়াছে; অতি ধূমধামের সহিত সাজ সরঞ্জাম প্রস্তুত হইয়া অভিনয় হইলেও অধিক দর্শক আকর্ষিত হইল না। ভাল ভাল নাটক যাহা ছিল, সব পুরাতন হইয়া গিয়াছে, নূতন ভাল নাটকও পাওয়া যায় না। “মায়াতরু” নামে একখানি ক্ষুদ্র গীতিনাট্য গিরিশবাবু রচনা করিলেন। “পলাশীর যুদ্ধের” সহিত একত্রিত হইয়া এই গীতিনাট্য প্রথম অভিনীত হয়। দুই তিন রাত্রি অভিনয়ের পরেই এই ক্ষুদ্র নাটিকার যশে দর্শক আকর্ষিত হইয়া বাড়ী ভরিয়া যাইতে লাগিল। এই গীতিনাট্যে আমার “ফুলহাসির” ভূমিকা দেখিয়া “রিজ্ এণ্ড রায়তের” সম্পাদক স্বর্গীয় শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় লেখেন, “বিনোদিনী was simply charming” ক্রমে গিরিশবাবুর “মোহিনী প্রতিমা”, “আনন্দ রহো” দর্শক আকর্ষণ করিতে লাগিল। তারপর “রাবণ বধের” পর হইতে থিয়েটারে লোকের স্থান সঙ্কুলান হইত না। উপরের আসন সকল প্রতিবারই পূর্ণ হইয়া যাইত, যে সকল ধনবান ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা ঘৃণা করিয়া থিয়েটারে আসিতেন না তাঁহাদের দ্বারাই দুই একদিন পূর্ব্বে টিকিট ক্রীত হইয়া অধিকৃত হইত। দিন দিন থিয়েটারের অদ্ভুত উন্নতি দেখিয়া একদিন সত্ত্বাধিকারী প্রতাপচাঁদ বলেন, “বিনোদ তিল সমাত করন্তি।” তিল সমাত অর্থে যাদু! ক্রমে “সীতার বনবাস” প্রভৃতি নাটক চলিল। থিয়েটারের যশ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে অধিনীর খ্যাতিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।
গিরিশবাবুর সহিত থিয়েটার করিতে আরম্ভ করিয়া বিডন স্ট্রীটের “স্টার থিয়েটার” শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি তাঁহার সঙ্গে বরাবর কার্য্য করিয়া আসিয়াছি। কার্য্যক্ষেত্রে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন এবং আমি তাঁহার প্রথমা ও প্রধানা শিষ্যা ছিলাম। তাহার নাটকের প্রধান প্রধান স্ত্রী চরিত্র আমিই অভিনয় করিতাম। তিনিও অতি যত্নে আমায় শিক্ষা দিয়া তাঁহার কার্যোপযোগী করিয়া লইতেন।
যে সময় কেদারবাবু থিয়েটার করেন, সেই সময়। সুপ্রসিদ্ধ অভিনেতা স্বর্গীয় অমৃতলাল মিত্র মহাশয় আসিয়া অভিনয় কার্যে যোগ দেন। গিরিশবাবুর মুখে শুনিয়া ছিলাম, যে অমৃত মিত্র আগে যাত্রার দলে এক্ট করিতেন। তাঁহার গলার সুন্দর সুর শুনিয়া তিনি প্রথমে থিয়েটারে লইয়া আসেন। উপরে উল্লেখ করিয়াছি, ইতিপূর্বে “মেঘনাদ বধ”, “বিষবৃক্ষ”, “সধবার একাদশী”, “মৃণালিনী”, “পলাশীর যুদ্ধ” ও নানা রকম বড় অথরের বই নাটকাকারে অভিনীত হইয়াছিল। “মেঘনাদ বধে” অমৃতলাল রাবণ সাজেন এবং আমি এখানেওমােহিনী প্রতিমা গীতিনাট্যে “সাহানা”র ভূমিকায়
শ্রীমতী বিনােদিনী।
৺কেদার বাবু প্রায় বৎসরেক থিয়েটার করেন; ইহার পর কৃষ্ণধন ও হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়া দুই ভাই কয়েক মাস থিয়েটারের কর্ত্তৃত্ব করেন। তাহার পর কাশীপুরের প্রাণনাথ চৌধুরীর বাটীর শ্রীযুক্ত শিবেন্দ্রনাথ চৌধুরী বলিয়া একব্যক্তি ছয় মাস কি আট মাস এই থিয়েটারের প্রোপ্রাইটার হন। এই সকল থিয়েটারেই গিরিশবাবু মহাশয় ম্যানেজার ও মোশান মাষ্টার ছিলেন। কিন্তু সকল প্রোপ্রাইটারই স্ব স্ব প্রধান, গিরিশ বাবুও আফিসের কার্য্য করিয়া থিয়েটারে অধিক সময় দিতে পারিতেন না। ইহাতে এত বিশৃঙ্খল হইত যে ব্যবসা বুদ্ধিহীন আমোদপ্রিয় প্রোপ্রাইটারেরা শেষে থলি ঝাড়া হইয়া শূন্য হস্তে ইন্সল্ভেণ্টের আসামী হইয়া থিয়েটার হইতে বিদায় গ্রহণ করিতেন। তত্রাচ আমার বেশ মনে পড়ে যে সে সময় প্রতি রাত্রেই খুব বেশী লোক হইত ও এমন সুন্দররূপ অভিনয় হইত যে লোকে অভিনয় দর্শনে মোহিত হইয়া একবাক্যে বলিত যে আমরা অভিনয় দর্শন করিতেছি কি প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, তাহা বোধ করিতে পারিতেছি না। এত বিক্রয় সত্বেও যে কেন সব ধনী সন্তানেরা সর্ব্বস্বান্ত হইতেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। লোকে বলিত যে এই যায়গাটা হানা যায়গা। এই স্থানের ভূমিখণ্ড কাহাকেও অনুকূল নহে।
গিরিশ বাবু মহাশয়ের শিক্ষা ও সতত নানারূপ সৎ উপদেশ গুণে আমি যখন ষ্টেজে অভিনয়ের জন্য দাঁড়াইতাম, তখন আমার মনে হইত না যে আমি অন্য কেহ! আমি যে চরিত্র লইয়াছি আমি যেন নিজেই সেই চরিত্র। কার্য্য শেষ হইয়া যাইলে আমার চমক ভাঙ্গিত। আমার এইরূপ কার্যে উৎসাহ ও যত্ন দেখিয়া রঙ্গালয়ের কর্ত্তৃপক্ষীয়েরা আমায় বড়ই ভালবাসিতেন ও অতিশয় স্নেহ মমতা করিতেন। কেহবা কন্যার ন্যায় কেহবা ভগ্নীর ন্যায়, কেহবা সখীর ন্যায় ব্যবহার করিতেন। আমিও তাঁহাদের যত্নে ও আদরে তাঁহাদের উপর প্রবল স্নেহের অত্যাচার করিতাম। যেমন মা বাপের কাছে আদরের পুত্র কন্যারা বিনা কারণে আদর আবদারের হাঙ্গামা করিয়া তাঁহাদের উৎকণ্ঠিত করে, ভ্রাতা ও ভগ্নীদের নিকট যেমন তাহাদের কোলের ছোট ছোট ভাই ভগ্নীগুলি মিছামিছি ঝগড়া আবদার করে, আমারও সেই রকম স্বভাব হইয়া গিয়াছিল।
এই সময়ে নানা রকমের উচ্চ চরিত্র অভিনয় দ্বারা আমার মন যেমন উচ্চদিকে উঠিতে লাগিল, আবার নানারূপ প্রলোভনের আকাঙক্ষাতে আকৃষ্ট হইয়া সময়ে সময়ে আত্মহারা হইবার উপক্রম হইত।
আমি ক্ষুদ্র দীন দরিদ্রের কন্যা, আমার বল বুদ্ধি অতি ক্ষুদ্র। এদিকে আমার উচ্চ বাসনা আমার আত্মবলিদানের জন্য বাধা দেয়, অন্য দিকে অসংখ্য প্রলোভনের জীবন্ত চাক্চিক্য মূর্ত্তি আমায় আহবান করে। এইরূপ অসংখ্য ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে আমার ন্যায় ক্ষুদ্রহৃদয়-বল কতক্ষণ থাকে? তবুও সাধ্যমত আত্মদমন করিতাম। বুদ্ধির দোষে ও অদৃষ্টের ফেরে আত্মরক্ষা না করিতে পারিলেও কখনও অভিনয় কার্য্যে অমনোেযোগ হই নাই। অমনোযোগী হইবার ক্ষমতাও ছিল না। অভিনয়ই আমার জীবনের সার সম্পদ ছিল। পার্ট অভ্যাস, পার্ট অনুযায়ী চিত্রকে মনোমধ্যে অঙ্কিত করিয়া বৃহৎ দর্পণের সম্মুখে সেই সকল প্রকৃতির আকৃতি মনোমধ্যে স্থাপিত করিয়া তন্ময় ভাবে সেই মনাঙ্কিত ছবিগুলিকে আপনার মধ্যে মিলাইয়া মিশাইয়া দেখা, এমন কি সেই ভাবে চলা, ফেরা, শয়ন, উপবেশন, যেন আমার স্বভাবে জড়াইয়া গিয়াছিল।
আমার অন্য কথা বা অন্য গল্প ভাল লাগিত না। গিরিশবাবু মহাশয় যে সকল বিলাতের বড় বড় অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের গল্প করিতেন, যে সকল বই পড়িয়া শুনাইতেন, আমার তাহাই ভাল লাগিত। মিসেস সিড্নিস্ যখন থিয়েটারের কার্য্য ত্যাগ করিয়া, দশ বৎসর বিবাহিতা অবস্থায় অতিবাহিত করিবার পর পুনরায় যখন রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন, তখন তাঁহার অভিনয়ে কোন সমালোচক কোন স্থানে কিরূপ দোষ ধরিয়াছিল, কোন অংশে তাঁহার উৎকর্ষ বা ত্রুটী ইত্যাদি পুস্তক হইতে পড়িয়া বুঝাইয়া দিতেন। কোন্ এক্টেস বিলাতে বনের মধ্যে পাখীর আওয়াজের সহিত নিজের স্বর সাধিত, তাহাও বলিতেন। এলেণ্টারি কিরূপ সাজ-সজ্জা করিত, ব্যাণ্ডম্যান কেমন হ্যামলেট সাজিত, ওফেলিয়া কেমন ফুলের পোষাক পরিত, বঙ্কিম বাবুর ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ কোন্ পুস্তকের ছায়াবলম্বনে লিখিত, ‘রজনী’ কোন্ ইংরাজী পুস্তকের ভাব সংগ্রহে রচিত, এই রকম কত বলিব গিরিশবাবু মহাশয়ের ও অন্যান্য স্নেহশীল বন্ধুগণের যত্নে ইংরাজি, গ্রীক, ফেঞ্চ, জার্ম্মানি প্রভৃতি বড় বড় অথরের কত গল্প যে আমি শুনিয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। শুধু শুনিতাম না, তাহা হইতে ভাব সংগ্রহ করিয়া সতত সেই সকল চিন্তা করিতাম। এই কারণে আমার স্বভাব এমন হইয়া গিয়াছিল যে যদি কখন কোন উদ্যান ভ্রমণ করিতে যাইতাম, সেখানকার ঘর বাড়ী আমার ভাল লাগিত না, আমি কোথায় বন-পুষ্প শোভিত নির্জ্জন স্থান তাহাই খুঁজিতাম। আমার মনে হইত যে আমি বুঝি এই বনের মধ্যে থাকিতাম, আমি ইহাদের চিরপালিত! প্রত্যেক লতা পাতায় সৌন্দর্য্যের মাখামাখি দেখিয়া আমার হৃদয় লুটাইয়া পড়িত! আমার প্রাণ যেন আনন্দে নাচিয়া উঠিত! কখন কোন নদীতীরে যাইলে আমার হৃদয় যেন তরঙ্গে তরঙ্গে ভরিয়া যাইত, আমার মনে হইত আমি বুঝি এই নদীর তরঙ্গে তরঙ্গেই চিরদিন খেলা করিয়া বেড়াইতাম। এখন আমার হৃদয় ছাড়িয়া এই তরঙ্গগুলি আপনা আপনি লুটোপুটি করিয়া বেড়াইতেছে। কুচবিহারের নদীর বালিগুলি অভ্র মিশান, অতি সুন্দর, আমি প্রায় বাসা হইতে দূরে, নদীর ধারে একলাটী যাইয়া সেই বালির উপর শুইয়া নদীর তরঙ্গ দেখিতাম। আমার মনে হইত উহারা বুঝি আমার সহিত কথা কহিতেছে।
নানাবিধ ভাব সংগ্রহের জন্য সদা সর্বক্ষণ মনকে লিপ্ত রাখায় আমি কল্পনার মধ্যেই বাস করিতাম, কল্পনার ভিতর আত্ম বিসর্জ্জন করিতে পারিতাম, সেইজন্য বোধ হয় আমি যখন যে পার্ট অভিনয় করিতাম, তাহার চরিত্রগত ভাবের অভাব হইত না। যাহা অভিনয় করিতাম, তাহা যে অপরের মনোমুগ্ধ করিবার জন্য বা বেতনভোগী অভিনেত্রী বলিয়া কার্য্য করিতেছি ইহা আমার কখন মনেই হইত না। আমি নিজেকে নিজে ভুলিয়া যাইতাম। চরিত্রগত সুখ দুঃখ নিজেই অনুভব করিতাম, ইহা যে অভিনয় করিতেছি তাহা একেবারে বিস্মৃত হইয়া যাইতাম। সেই কারণে সকলেই আমায় স্নেহের চক্ষে দেখিতেন।
একদিন বঙ্কিম বাবু তাঁহার ‘মৃণালিনী’ অভিনয় দেখিতে আসিয়াছিলেন, সেই সময় আমি ‘মৃণালিনী’তে ‘মনোরমা’র অংশ অভিনয় করিতেছিলাম। মনোরমার অংশ অভিনয় দর্শন করিয়া বঙ্কিম বাবু বলিয়া ছিলেন যে “আমি মনোরমার চরিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখন যে ইহা প্রত্যক্ষ দেখিব তাহা মনে ছিল না, আজ মনোরমাকে দেখিয়া আমার মনে হইল যে আমার মনোরমাকে সামনে দেখিতেছি।” কয়েক মাস হইল এখনকার স্টার থিয়েটারের ম্যানেজার অমৃতলাল বসু মহাশয় এই কথা বলিয়াছিলেন যে “বিনোদ, তুমি কি সেই বিনোদ,—যাহাকে দেখিয়া বঙ্কিম বাবুও বলিয়াছিলেন যে আমার মনোরমাকে প্রত্যক্ষ দেখিতেছি?” যেহেতু এক্ষণে রোগে, শোকে প্রায়ই শয্যাগত।
আমি অতি শৈশবকাল হইতে অভিনয় কার্যে ব্রতী হইয়া, বুদ্ধি বৃত্তির প্রথম বিকাশ হইতেই, গিরিশবাবু মহাশয়ের শিক্ষাগুণে আমায় কেমন উচ্ছ্বাসময়ী করিয়া তুলিয়াছিল, কেহ কিছুমাত্র কঠিন ব্যবহার করিলেই বড়ই দুঃখ হইত। আমি সততই আদর ও সোহাগ চাহিতাম। আমার থিয়েটারের বন্ধু-বান্ধবেরাও আমায় অত্যধিক আদর করিতেন। যাহা হউক এই সময় হইতে আমি আত্ম নির্ভর করিবার ভরসা হৃদয়ে সঞ্চয় করিয়াছিলাম।
এই সময়ের আর একটা ঘটনা বলি:—প্রতাপ বাবুর থিয়েটারে আসিবার ঠিক আগেই হউক আর প্রথম সময়েই হউক, আমাদের অবস্থা গতিকে আমাকে একটা সম্রান্ত যুবকের আশ্রয়ে থাকিতে হইত। তিনি অতিশয় সজ্জন ছিলেন; তাঁহার স্বভাব অতিশয় সুন্দর ছিল, এবং আমাকে অন্তরের সহিত স্নেহ করিতেন। তাঁহার অকৃত্রিম স্নেহগুণে আমায় তাঁহার কতক অধীন হইতে হইয়াছিল। প্রথম তাঁর ইচ্ছা ছিল, যে আমি থিয়েটারে কার্য্য না করি, কিন্তু যখন ইহাতে কোন মতে রাজী হইলাম না, তখন তিনি বলিলেন, তবে তুমি অবৈতনিক ভাবে (এ্যামেচার) হইয়া কার্য্য কর, আমার গাড়ী ঘোড়া তোমায় থিয়েটারে লইয়া যাইবে ও লইয়া আসিবে। আমি মহাবিপদে পড়িলাম, চিরকাল মাহিনা লইয়া কার্য্য করিয়াছি। আমার মায়ের ধারণা যে থিয়েটারের পয়সা হইতে আমাদের দারিদ্র্যদশা ঘুচিয়াছে, অতএব ইহাই আমাদের লক্ষ্মী। আর এমন অবস্থা হইয়াছিল যে, সখের মত কাজ করা হইয়া উঠিত না। হাড়ভাঙ্গা মেহনত করিতে হইত, সেইজন্য সখেও বড় ইচ্ছা ছিল না। আমি একথা গিরিশ বাবু মহাশয়কে বলিলাম, তিনি বলিলেন যে তাহাতে আর কি হইবে, তুমি “অমুককে” বলিও যে— আমি মাহিনা লই না। তোমার মাহিনার টাকাটা আমি তোমার মা’র হাতে দিয়া আসিব। যদিও প্রতারণা আমাদের চির সহচরী, এই পতিত জীবনের প্রতারণা আমাদের ব্যবসা বলিয়াই প্রতিপন্ন, তবুও আমি বড় দুঃখিত হইলাম। আর আমি ঘৃণিতা বারনারী হইলেও অনেক উচ্চ শিক্ষা পাইয়াছিলাম, প্রতারণা বা মিথ্যা ব্যবহারকে অন্তরের সহিত ঘৃণা করিতাম। অবিশ্বাস আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র হইলেও আমি সকলকেই বিশ্বাস করিতাম ও ভাল ব্যবহার পাইতাম। লুকোচুরি ভাঁড়াভাঁড়ি আমার ভাল লাগিত না। কি করিব দায়ে পড়িয়া আমায় গিরিশ বাবু মহাশয়ের কথায় সম্মত হইতে হইল। উক্ত ব্যক্তির সহিত গিরিশ বাবুর বিশেষ সৌহৃদ্য ছিল, তিনি গিরিশ বাবুকে বড় সম্মান করিতেন। তিনি এত সজ্জন ছিলেন যে পাছে উঁহারা কিছু মনে সন্দেহ করেন বলিয়া কাজের আগে আমায় থিয়েটারে পৌছাইয়া দিতেন। সে যাহা হউক প্রতাপ জহুরীর থিয়েটার, বেশ সুশৃঙ্খলায় চলিতে ছিল; তিনিও অতিশয় মিষ্টভাষী ও সুদক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। এইস্থানে যে যে ব্যক্তি কার্য্য করিয়াছেন, কেবল প্রতাপ বাবুই ঋণগ্রস্ত হন নাই। লাভ হইয়াছিল কিনা জানি না অবশ্য তাহা বলিতেন না, তবে যে লোকসান হইত না, তাহা জানা যাইত। কেন না প্রতি রাত্রে অজচ্ছল। বিক্রয় হইত, আর চারিদিকে সুনিয়ম ছিল। তাঁর বন্দোবস্তও নিয়মমত ছিল। সকল রকমে তিনি যে একজন ব্যবসায়ী লোক তাহা সকলেই জানিত ও জানেন। এক্ষণে আমার উক্ত থিয়েটার ছাড়িবার কারণ ও “স্টার থিয়েটার” সৃষ্টির সূচনার কথা বলিয়া এ অধ্যায় শেষ করি। গিরিশ বাবুর নূতন নূতন বই ও নূতন নূতন প্যাণ্টমাইমে আমাদের বড়ই বেশী রকম খাটিতে হইত। প্রতিদিন অতিশয় মেহনতে আমার শরীরও অসুস্থ হইতে লাগিল, আমি এক মাসের জন্য ছুটী চাহিলাম, তিনি অনেক জেদাজেদির পর ১৫ দিনের ছুটী দিলেন! আমি সেই ছুটীতে শরীর সুস্থ করিবার জন্য ৺কাশীধামে চলিয়া যাইলাম। কিন্তু সেখানে আমার অসুখ বাড়িল। সেই কারণ আমার ফিরিয়া আসিতে প্রায় এক মাস হইল। এখানে আসিয়া পুনরায় থিয়েটারে যোগ দিলাম, কিন্তু শুনিলাম যে প্রতাপ বাবু আমার ছুটীর সময়ের মাহিনা দিতে চাহেন না। গিরিশবাবু বলিলেন এ ‘ছুটীর মাহিনা না দিলে বিনোদ কাজ করিবে না, তখন বড় মুস্কিল হইবে। যদিও স্পষ্ট শুনি নাই, তবু এই রকম শুনিয়া আমার সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল, বড় রাগ হইল। আমার একটুতে যেন মনের ভিতর আগুন লাগিয়া যাইত, আমি চোখে কিছু দেখিতে পাইতাম না। সেই দিনই প্রতাপ বাবু ভিতরে আসিলে আমি আমার মাহিনা চাহিলাম তিনি হাসিয়া বলিলেন, “মাহিন কেয়া? তোম তো কাম নেহি—কিয়া!” আর কোথা আছে;—“বটে মাহিনা দিবেন না” বলিয়া চলিয়া আসিলাম। আর গেলাম না! তারপর গিরিশ বাবু, অমৃত মিত্র আমাদের বাটীতে আসিলেন। আমি তখন গিরিশ বাবুকে বলিলাম যে “মহাশয়, আমার বেশী মাহিনা চাহি, আর যে টাকা বাকী পড়িয়াছে তাহা চুক্তি করিয়া চাহি, নচেৎ কাজ করিব না। তখন অমৃত মিত্র বলিলেন, “দেখ বিনোদ এখন গোল করিও না, একজন মাড়োয়ারীর সন্তান, একটী নূতন থিয়েটার করিতে চাহে; যত টাকা খরচ হয় সে করিবে। এখন কিছুদিন চুপ করিয়া থাক, দেখি কতদূর কি হয়!”
এইখান হইতেই “স্টার থিয়েটার” হইবার সূত্রপাত আরম্ভ হইল। আমিও গিরিশবাবুর কথা অনুযায়ী আর প্রতাপ বাবুকে কিছু বলিলাম না। তবে ভিতরে ভিতরে সংবাদ লইতে লাগিলাম কে লোক নূতন থিয়েটার করিতে চাহে?