আমার কথা (প্রথম খণ্ড)/স্টার থিয়েটার সম্বন্ধে নানা কথা

পত্র।

স্টার থিয়েটার সম্বন্ধে নানা কথা।

মহাশয়!

 এই সময় আমায় অতিশয় সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়িতে হইয়াছিল। আমাদের ন্যায় পতিতা ভাগ্যহীনা বারনারীদের টাল বেটাল তো সর্বদাই সহিতে হয় তবুও, তাহাদের সীমা আছে; কিন্তু আমার ভাগ্য চির দিনই বিরূপ ছিল। একে আমি জ্ঞনহীনা অধম স্ত্রীলোক, তাহাতে সুপথ কুপথ অপরিচিত। আমাদের গন্তব্য পথ সততই দোষনীয়, আমরা ভাল পথ দিয়া যাইতে চাহিলে, মন্দ আসিয়া পড়ে ইহা যেন আমাদের জীবনের সহিত গাঁথা। লোকে বলেন আত্মরক্ষা সতত উচিত, কিন্তু আমাদের আত্মরক্ষাও নিন্দনীয়! অথচ আমাদের প্রতি স্নেহ চক্ষে দেখিবার বা অসময় সাহায্য করিবার কেহ নাই! যাহা হউক; আমার মর্ম্ম ব্যথা শুনুন।

 আমিও এই সময় ৺প্রতাপ বাবু মহাশয়ের থিয়েটার ত্যাগ করিব মনে মনে করিয়াছিলাম। ইহার আগে আর একটী ঘটনার দ্বারা আমায় কতক ব্যথিত হইতে হইয়াছিল। আমি যে সম্ভ্রান্ত যুবকের আশ্রয়ে ছিলাম, তিনি তখন অবিবাহিত ছিলেন, ইহার কয়েক মাস আগে তিনি বিবাহ করেন ও ধনবান যুবকবৃন্দের চঞ্চলতা বশতঃ আমার প্রতি কতক অসৎ ব্যবহার করেন। তাহাতে আমাকে অতিশয় মনঃক্ষুন্ন হইতে হয়। সেই কারণে আমি মনে মনে করি যে ঈশ্বর তো আমার জীবিকা নির্ব্বাহের জন্য সামর্থ্য দিয়াছেন, এইরূপ শারীরিক মেহনত দ্বারা নিজের ও পরিবারবর্গের ভরণ পোষণ নির্ব্বাহ করিতে যদি সক্ষম হই, তবে আর দেহ বিক্রয় দ্বারা পাপ সঞ্চয় করিব না ও নিজেকেও উৎপীড়িত করিব না। আমা হইতে যদি একটী থিয়েটার ঘর প্রস্তুত হয় তাহা হইলে আমি চিরদিন অন্ন সংস্থান করিতে পারি। আমার মনের যখন এই রকম অবস্থা তখনই ঐ “ষ্টার থিয়েটার করিবার জন্য ৺গুর্ম্মুখ রায় ব্যস্ত। ইহা আমি আমাদের এক‍্টারদের নিকট শুনিলাম এবং ঘটনাচক্রে এই সময় আমার আশ্রয়দাতা সন্ত্রান্ত যুবকও কার্যানুরোধে দূরদেশে অবস্থিতি করিতে ছিলেন। এদিকে অভিনেতারা আমাকে অতিশয় জেদের সহিত অনুরো করিতে লাগিলেন যে, তুমি যে প্রকারে পার আর একটি থিয়েটার করিবার সাহায্য কর! থিয়েটার করিতে আমার অনিচ্ছা ছিল না, তবে একজনের আশ্রয় ত্যাগ করিয়া অন্যায়রূপে আর একজনের আশ্রয় গ্রহণ করিতে আমার প্রবৃত্তি বাধা দিতে লাগিল। এদিকে থিয়েটারের বন্ধুগণের কাতর অনুরোধ! আমি উভয় সঙ্কটে পড়িলাম। গিরিশবাবু বলিলেন থিয়েটারই আমার উন্নতির সোপান। তাঁহার শিক্ষা সাফল্য আমার দ্বারাই সম্ভব। থিয়েটার হইতে মান সম্রম জগদ্বিখ্যাত হয়। এইরূপ উত্তেজনায় আমার কল্পনা স্ফীত হইতে লাগিল। থিয়েটারের বন্ধুবর্গেরাও দিন দিন অনুরোধ করিতেছেন, আমি মনে করিলেই একটী নূতন থিয়েটার সৃষ্টি হয় তাহাও বুঝিলাম, কিন্তু যে যুবকের আশ্রয়ে ছিলাম, তাঁহাকেও স্মরণ হইতে লাগিল। ক্রমে সেই যুবা অনুপস্থিত, উপস্থিত বন্ধুবর্গের কাতরোক্তি, মন থিয়েটারের দিকেই টলিল। তখন ভাবিতে লাগিলাম। যিনি আশ্রয় দিয়াছেন, তিনি আমার সহিত যে সত্যে আবদ্ধ ছিলেন, তাহা ভঙ্গ করিয়াছেন, অপর পুরুষে যেরূপ প্রতারণা বাক্য প্রয়োগ করে, তাঁহারও সেইরূপ! তিনি পুনঃ পুনঃ ধর্ম্ম সাক্ষ্য করিয়া বলিয়া ছিলেন যে আমিই তাঁহার কেবল একমাত্র ভালবাসার বস্তু, আজীবন সে ভালবাসা থাকিবে। কিন্তু কই তাহা তো নয়! তিনি বিষয় কার্য্যের ছল করিয়া দেশে গিয়াছেন, কিন্তু সে বিষয় কার্য নয়, তিনি বিবাহ করিতে গিয়াছেন। তবে তাঁহার ভালবাসা কোথায়? এতো প্রতারণা! আমি কি নিমিত্ত বাধ্য থাকিব? এরূপ নানা যুক্তি হৃদয়ে উঠিতে লাগিল! কিন্তু মধ্যে মধ্যে আবার মনে হইতে লাগিল, যে সেই যুবার দোষ নাই, আত্মীয় স্বজনের অনুরোধে বিবাহ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। আমি তাঁহার একমাত্র ভালবাসার পাত্রী তবে এ কি করিতেছি! রাত্রে এ ভাব উদয় হইলে অনিদ্রায় যাইত, কিন্তু প্রাতে বন্ধুবর্গ আসিলে অনুরোধ তরঙ্গ ছুটিত ও রাত্রের মনোভাব একবারে ঠেলিয়া ফেলিত! থিয়েটার করিব সংকল্প করিলাম। কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমার মন আমার সহিত প্রতারণা করে নাই। ইহা যতদূর প্রমাণ পাওয়া সম্ভব তাহা পাইয়া ছিলাম। কিন্তু দিন ফিরিবার নয়, দিন ফিরিল না। এ প্রমাণের কথা মহাশয়কে সংক্ষেপে পশ্চাৎ জানাইব!

 থিয়েটার করিব সংকল্প করিলাম! কেন করিব না? যাহাদের সহিত চিরদিন ভাই ভগ্নীর ন্যায় একত্রে কাটাইয়াছি, যাহাদের আমি চিরবশীভূত, তাহারাও সত্য কথাই বলিতেছে। আমার দ্বারা থিয়েটার স্থাপিত হইলে চিরকাল একত্রে ভ্রাতা ভগ্নীর ন্যায় কাটিবে। সংকল্প দৃঢ় হইল, গুর্ম্মুখ রায়কে অবলম্বন করিয়া থিয়েটার করিলাম। একের আশ্রয় পরিত্যাগ করিয়া অপরের আশ্রয় গ্রহণ করা আমাদের চির প্রথা হইলেও এ অবস্থায় আমায় বড় চঞ্চল ও ব্যথিত করিয়াছিল। হয় তো লোকে শুনিয়া হাসিবেন যে আমাদেরও আবার ছলনায় প্রত্যবায়। বোধ বা বেদনা আছে। যদি স্থিরচিত্তে ভাবিতেন তাহা হইলে বুঝিতেন যে আমরাও রমণী। এ সংসারে যখন ঈশ্বর আমাদের পাঠাইয়া ছিলেন তখন নারী-হৃদয়ের সকল কোমলতায় তো বঞ্চিত করিয়া পাঠান নাই। সকলই দিয়াছিলেন, ভাগ্যদোষে সকলই হারাইয়াছি। কিন্তু ইহাতে কি সংসারের দায়িত্ব কিছুই নাই, যে কোমলতায় একদিন হৃদয়পূর্ণ ছিল তাহা একবারে নির্ম্মূল হয় না, তাহার প্রমাণ সন্তান পালন করা। পতি-প্রেম সাধ আমাদেরও আছে, কিন্তু কোথায় পাইব? কে আমাদের হৃদয়ের পরিবর্ত্তে হৃদয় দান করিবে? লালসায় আসিয়া প্রেমকথা কহিয়া মনোমুগ্ধ করিবার অভাব নাই, কিন্তু কে হৃদয় দিয়া পরীক্ষা করিতে চান যে আমাদের হৃদয় আছে? আমরা প্রথমে প্রতারণা করিয়াছি, কি প্রতারিত হইয়া প্রতারণা শিখিয়াছি, কেহ কি তাহার অনুসন্ধান করিয়াছেন? বিষ্ণু পরায়ণ প্রাতঃস্মরণীয় হরিদাসকে প্রতারিত করিবার জন্য আমাদেরই বারাঙ্গনা একজন প্রেরিত হয়, কিন্তু বৈষ্ণবের ব্যবহারে তিনি বৈষ্ণবী হন, এ কথা জগৎ ব্যাপ্ত। যদি হৃদয় না থাকিত, সম্পূর্ণ হৃদয় শূন্য হইলে কদাচ তিনি বিষ্ণুপরায়ণা হইতে পারিতেন না। অর্থ দিয়া কেই কাহারও ভালবাসা কেনেন নাই। আমরাও অর্থে ভালবাসা বেচি নাই। এই আমাদের সংসারে অপরাধ। নাট্যাচার্য গিরিশবাবু মহাশয়ের যে “বারাঙ্গনা” বলিয়া একটী কবিতা আছে, তাহা এই দুর্ভাগিনীদের প্রকৃত ছবি। “ছিল অন্য নারী সম হৃদয় কমল।” অনেক প্রদেশে জল জমিয়া পাষাণ হয়! আমাদেরও তাহাই! উৎপীড়িত অসহায় অবস্থায় পড়িয়া পড়িয়া হৃদয় কঠোর হইয়া উঠে। যাহা হউক, এখন ও কথা থাকুক। এই পূর্ব্ব বর্ণিত অবস্থান্তর গ্রহণ করিতে আমাকে ও থিয়েটারের লোকদিগকে অনেক বেগ পাইতে হইয়াছিল। কেননা যখন সেই সম্ভ্রান্ত যুবক শুনিলেন যে আমি অন্যের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া একটী থিয়েটারে চিরদিন সংলগ্ন হইবার সংকল্প করিয়াছি, তখন তিনি ক্রোধ বশতঃই হউক, কিম্বা নিজের জেদ বশতঃই হউক, নানারূপ বাধা দিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সে বাধা বড় সহজ বাধা নহে! তিনি নিজের জমিদারী হইতে লাঠিয়াল আনাইয়া বাড়ী ঘেরোয়া করিলেন; গুর্ম্মুখ বাবুও বড় বড় গুণ্ডা আনাইলেন, মারামারি পুলিশ হাঙ্গামা চলিতে লাগিল। এমন কি একদিন জীবন সংশয় হইয়াছিল! একদিন রিহারসালের পর আমি আমার ঘরে ঘুমাইতে ছিলাম, ভোর ছয়টা হইবে, ঝন্ ঝন্ মস্ মস্ শব্দে নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল! দেখি যে মিলিটারি পোষাক পরিয়া তরওয়াল বান্ধিয়া সেই যুবক একেবারে আমার ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া বলিতেছে, “যে মেনি এত ঘুম কেন?” আমি চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিতে, বলিল যে, “দেখ বিনোদ, তোমাকে উহাদের সঙ্গ ত্যাগ করিতে হইবে। তোমার জন্য যে টাকা খরচ হইয়াছে আমি সকলই দিব! এই দশ হাজার টাকা লও; যদি বেশি হয় তবে আরও দিব।” আমি চিরদিনই একগুঁয়ে ছিলাম, কেহ জেদ করিলে আমার এমন রাগ হইত যে, আমার দিক‍্বিদিক্ কার্য্যাকার্য্য জ্ঞান থাকিত না! যাই হোক করিতাম কিছুতেই তাহা টলাইতে পারিত না! মিষ্ট কথায় স্নেহের আদরে যাহা করিব স্থির করিতাম, কেহ জোর করিয়া নিষেধ করিলে, সে কাজ করিতাম না; জোরের সহিত কাজ করান আমার সহজ সাধ্য ছিলনা! তাহার ঐরূপ উদ্ধত ভাব দেখিয়া আমার বড় রাগ হইল, আমি বলিলাম, “না কখনই নহে, আমি উহাদের কথা দিয়াছি, এখন কিছুতেই ব্যতিক্রম করিতে পারিব না।” তিনি বলিলেন, “যদি টাকার জন্য হয়, তবে আমি তোমায় আরও দশ হাজার টাকা দিব।” তাহার কথায় আমার ব্রহ্মাণ্ড জ্বলিয়া গেল! দাঁড়াইয়া বলিলাম, যে রাখ তোমার টাকা! টাকা আমি উপার্জ্জন করিয়াছি বই টাকা আমায় উপার্জ্জন করে নাই! ভাগ্যে থাকে অমন দশ বিশ হাজার আমার কত আসিবে, তুমি এখন চলিয়া যাও! আমার এই কথা শুনিয়া তিনি আগুনের মতন জ্বলিয়া নিজের তরওয়ালে হাত দিয়া বলিলেন, “বটে!—ভেবেচ কি যে তোমায় সহজে ছাড়িয়া দিব, তোমায় কাটিয়া ফেলিব! যে বিশ হাজার টাকা তোমায় দিতে চাহিতে ছিলাম তাহা অন্য উপায়ে খরচ করিব, পরে যাহা হয় হইবে; বলিতে বলিতে ঝাঁ করিয়া কোষ হইতে তরবারি বাহির করিয়া, চক্ষের নিমিষে আমার মস্তক লক্ষ্য করিয়া এক আঘাত করিলেন। আমার দৃষ্টিও তাহার তরবারির দিকে ছিল, যেমন তরবারির আঘাত করিতে উদ্যত আমি অমনি একটী টেবিল হারমোনিয়ম ছিল তাহার পাশে বসিয়া পড়িলাম; আর সেই তরবারির চোট্ হারমোনিয়মের ডালার উপর পড়িয়া ডালার কাঠ তিন আঙ্গুল কাটিয়া গেল! নিমেষ মধ্যে পুনরায় তরওয়াল তুলিয়া লইয়া আবার আঘাত করিলেন, তাঁর অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন, আমারও মৃত্যু নাই, সে আঘাতও যে চৌকিতে বসিয়া বাজান হইত তাহাতে পড়িল, মুহূর্ত্ত মধ্যে আমি উঠিয়া তাহার পুনঃ উন্নত তরওয়াল শুদ্ধ হস্ত ধরিয়া বলিলাম কি করিতেছ, যদি কাটিতে হয় পরে কাটিও; কিন্তু তোমার পরিণাম? আমার কলঙ্কিত জীবন গেল আর রহিল তা’তে ক্ষতি কি! একবার তোমার পরিণাম ভাব, তোমার বংশের কথা ভাব, একটা ঘৃণিত বারাঙ্গনার জন্য এই কলঙ্কের বোঝা মাথায় করিয়া সংসার হইতে চলিয়া যাইবে, ছি! ছি! শুন! স্থির হও! কি করিতে হইবে বল? ঠাণ্ডা হও! শুনিয়া ছিলাম দুর্দ্দমনীয় ক্রোধের প্রথম বেগ শমিত হইলে লোকের প্রায় হিতাহিত ফিরিয়া আইসে! এ তাহাই হইল, হাতের তরওয়াল দূরে ফেলিয়া দিয়া মুখে হাত দিয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িলেন! তাহার সে সময়ের কাতরতা বড়ই কষ্টকর! আমার মনে হইল যে সব দূরে যাউক, আমি আবার ফিরিয়া আসি। কিন্তু চারিদিক হইতে তখন আমায় অষ্ট বজ্র দিয়া থিয়েটারের বন্ধুগণ ও গিরিশবাবু মহাশয় বাঁধিয়া ফেলিয়া ছিলেন; কোন দিকে ফিরিবার পথ ছিল না! যাহা হউক, সে হইতে তখন তো পার পাইলাম! তিনি কোন কথা না কহিয়া চলিয়া গেলেন! এদিকে আমরা যে কয়জন একত্র হইয়াছিলাম সকলে ৺প্রতাপবাবুর থিয়েটার ত্যাগ করিলাম। এখন ৺গুর্ম্মুখ বাবুও ধরিলেন যে আমি একান্ত তাঁর বশীভূত না হইলে তিনি থিয়েটারের জন্য কোন কার্য্য করিবেন না। কাজে কাজেই গোলযোগ মিটিবার জন্য পরামর্শ করিয়া আমাকে মাস কতক দূরে রাখিতে সকলে বাধ্য হইলেন। কখন রাণীগঞ্জে, কখন এখানে ওখানে আমায় থাকিতে হইল। ইহার ভিতর কেমন ও কিরূপ থিয়েটার হইবে এইরূপ কার্য্য চলিতে লাগিল। পরে যখন সব স্থির হইল, যে বিডন স্ত্রীটে প্রিয় মিত্রের যায়গা লিজ লইয়া এত দিন থিয়েটার হইবে, এত টাকা খরচ হইবে; তখন আমি কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম। আমি কলিকাতায় আসিবার কয়েক দিন পরে একদিন গুর্ম্মুখ বাবু বলিলেন, যে “দেখ বিনোদ! আর থিয়েটারের গোলযোগে কাজ নাই, তুমি পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার নিকট লও! আমি একেবারে তোমায় দিতেছি!” এই বলিয়া কতকগুলি নোট বাহির করিলেন। আমি থিয়েটার ভালবাসিতাম, সেই নিমিত্ত ঘৃণিত বারনারী হইয়াও অর্দ্ধ লক্ষ টাকার প্রলোভন তখনই ত্যাগ করিয়াছিলাম। যখন অমৃত মিত্র প্রভৃতি শুনিলেন, যে গুর্ম্মুখ রায় থিয়েটার না করিয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা আমায় দিতে চান, তখন তাঁহাদের চিন্তার সীমা রহিল না। যাহাতে আমি সে অর্থ গ্রহণ না করি, ইহার জন্য চেষ্টার ত্রুটী হইল না, কিন্তু এ সমস্ত চেষ্টা তখন নিষ্প্রয়োজন। আমি স্থির করিয়াছি থিয়েটার করিব। থিয়েটার ঘর প্রস্তুত না করিয়া দিলে আমি কোন মতে তাঁহার বাধ্য হইব না। তখন আমারই উদ্যমে বিডন স্ত্রীটে জমি লিজ্ লওয়া হইল, এবং থিয়েটার প্রস্তুতের জন্য গুর্ম্মুখ রায় অকাতরে অর্থ ব্যয় করিতে লাগিলেন। উক্ত বিডন স্ত্রীটেই বনমালী চক্রবর্তী মহাশয়ের বাটী ভাড়া লইয়া রিহারসাল আরম্ভ হল, তখন একে একে সব নৃতন পুরাতন এক‍্টার এক‍্ট্রেস্ আসিয়া যোগ দিতে লাগিলেন! গিরিশবাবু মহাশয় মাষ্টার ও ম্যানেজার হইলেন এবং বই লিখিতে আরম্ভ করিলেন। এই সময় এখনকার স্টার থিয়েটারের সুযোগ্য ম্যানেজার অমৃতলাল বসু আসিলেন। ইহার আগে ইনি বেঙ্গল থিয়েটার লিজ্ লন, তখন বোধ হয় আমরা ৺প্রতাপবাবুর থিয়েটারে; সেই সময় কোন কারণ বশতঃ জোড়া মন্দিরের পাশে ঐ সিমলাতে আমাদের একটী বাড়ী ভাড়া ছিল। সে বাড়ীতে ভুনীবাবুও প্রায়ই যাইতেন ও কার্য্যানুরোধে কয়েক দিন বাসও করিয়া ছিলেন। বেঙ্গল থিয়েটারের কর্ত্তৃপক্ষীয়দের সহিত বিবাদ থাকায় থিয়েটার হাউস্ দখল করিতে পারিতেছিলেন না। আমরাই দূরদেশ হইতে লাঠিয়াল আনাইয়া দিয়া ভুনীবাবুকে দখল দেওয়াইয়া দিই। পরে যখন আমাদের নূতন থিয়েটার হইল, তখন ভুনীবাবু আসিয়া আমাদের সহিত যোগ দেন! সেই সময় প্রফেসর জহরলাল ধর ষ্টেজ ম্যানেজার হন! দাসুবাবু যদিও ছেলে মানুষ কিন্তু কার্য্য শিখিবার জন্য গিরিশবাবু মহাশয় উঁহাকে সহকারী স্টেজ ম্যানেজার করেন এবং হিসাব পত্র সব ভাল থাকিবে ও বন্দোবস্ত সব সুশৃঙ্খলে হইবে বলিয়া তিনি এখনকার প্রোপ্রাইটার বাবু হরিপ্রসাদ বসু মহাশয়কে আনিয়া সকল ভার দেন। হরিবাবু মহাশয় চিরদিনই বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান! গিরিশবাবু মহাশয় নূতন থিয়েটারের বেশী উন্নতি করিবার জন্য শিক্ষা-কার্য্যে অনেক সময় অতিবাহিত করিতেন বলিয়া নিজে সকল কাজ দেখিতে পারিতেন না। সেজন্য সুযোগ্য লোক দেখিয়া দেখিয়া তাঁহাদের উপর এক এক কার্য্যের ভার দিয়া রাখিয়া ছিলেন। অতি উৎসাহের ও আনন্দের সহিত কার্য্য চলিতে লাগিল। এই সময় আমরা বেলা ২৷৩ টার সময় রিহারসালে গিয়া সেখানকার কার্য শেষ করিয়া থিয়েটারে আসিতাম; এবং অন্যান্য সকলে চলিয়া যাইলে আমি নিজে ঝুড়ি করিয়া করিয়া মাটী বহিয়া পিট, ব্যাক সিটের স্থান পূর্ণ করিতাম, কখন কখন মজুরদের উৎসাহের জন্য প্রত্যেক ঝুড়ি পিছু চারিকড়া করিয়া কড়ি ধার্য্য করিয়া দিতাম। শীঘ্র শীঘ্র প্রস্তুতের জন্য রাত্র পর্য্যন্ত কার্য্য হইত। সকলে চলিয়া যাইতেন, আমি গুর্ম্মুখবাবু আর ২৷১ জন রাত্র জাগিয়া কার্য্য করাইয়া লইতাম। আমার সেই সময়ের আনন্দ দেখে কে? অতি উৎসাহে অনেক পয়সা ব্যয়ে থিয়েটার প্রস্তুত হইল। বোধ হয় এক বৎসরের ভিতর হইয়া থাকিবে। কিন্তু ইহার সহিত আমি আর একটী কথা না বলিয়া থাকিতে পারিতেছি না, থিয়েটার যখন প্রস্তুত হয় তখন সকলে আমায় বলেন যে “এই যে থিয়েটার হাউস্ হইবে, ইহা তোমার নামের সহিত যোগ থাকিবে। তাহা হইলে তোমার মৃত্যুর পরও তোমার নামটী বজায় থাকিবে। অর্থাৎ এই থিয়েটারের নাম “বি” থিয়েটার হইবে।” এই আনন্দে আমি আরও উৎসাহিত হইয়াছিলাম। কিন্তু কার্য্যকালে উঁহারা সে কথা রাখেন নাই কেন—তাহা জানিনা! যেপর্যন্ত থিয়েটার প্রস্তুত হইয়া রেজেষ্টি না হইয়াছিল, সেপর্য্যন্ত আমি জানিতাম যে আমারই নামে “নাম” হইবে! কিন্তু যেদিন উহারা রেজেষ্ট্রি করিয়া আসিলেন— তখন সব হইয়া গিয়াছে, থিয়েটার খুলিবার সপ্তাহ কয়েক বাকী; আমি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলাম যে থিয়েটারের নূতন নাম কি হইল? দাসুবাবু প্রফুল্ল ভাবে বলিলেন “ষ্টার।” এই কথা শুনিয়া আমি হৃদয় মধ্যে অতিশয় আঘাত পাইয়া বসিয়া যাইলাম যে দুই মিনিট কাল কথা কহিতে পারিলাম না। কিছু পরে আত্মসংবরণ করিয়া বলিলাম “বেশ!” পরে মনে ভাবিলাম যে উঁহারা কি শুধু আমায় মুখে স্নেহ মমতা দেখাইয়া কার্য্য উদ্ধার করিলেন? কিন্তু কি করিব, আমার আর কোন উপায় নাই! আমি তখন একেবারে উঁহাদের হাতের ভিতরে! আর আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই যে উঁহারা ছলনা দ্বারা আমার সহিত এমন ভাবে অসৎ ব্যবহার করিবেন। কিন্তু এত টাকার স্বার্থ ত্যাগ করিতে আমার যে কষ্ট হইয়াছিল তাঁহাদের এই ব্যবহারে আমার অতিশয় মনোকষ্ট হইয়াছিল যদিও এ সম্বন্ধে আর কখন কাহাকেও কোন কথা বলি নাই, কিন্তু ইহা ভূলিতেও পারি নাই, ঐ ব্যবহার বরাবর মনে ছিল! বলা বৃথা বলিয়া আর কিছু বলি নাই। আর থিয়েটার আমার বড় প্রিয়, থিয়েটারকে বড়ই আপনার মনে করিতাম, যাহাতে তাহাতে আর একটী নূতন থিয়েটার তো হইল; সেই কারণে সেই সময় তাহা চাপাও পড়িয়া যাইত। কিন্তু থিয়েটার প্রস্তুত হইবার পরও সময়ে সময়ে বড় ভাল ব্যবহার পাই নাই! আমি যাহাতে উক্ত থিয়েটারে বেতনভোগী অভিনেতৃ হইয়াও না থাকিতে পারি তাহার জন্যও সকলে বিধিমতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এমন কি তাঁহাদের উদ্যোগ ও যত্নে আমাকে মাস দুই ঘরে বসিয়াও থাকিতে হইয়াছিল। তাহার পর আবার গিরিশবাবুর যত্নে ও স্বত্বাধিকারীর জেদে আমায় পুনরায় যোগ দিতে হইয়াছিল। লোক পরম্পরায় শুনিয়াছিলাম যে প্রোপ্রাইটার বলিয়াছিলেন “এতো বড় অন্যায়, যাহার দরুন থিয়েটার করিলাম তাহাকে বাদ দিয়া কার্য্য করিতে হইবে? এ কখন হইবে না।” তাহা সব পুড়াইয়া দিব। সে যাহাহউক, এক সঙ্গে থাকিতে হইলে ক্রটী অনেক হইয়া থাকে, আমারও শত সহস্র দোষ ছিল। কিন্তু অনেকেই আমায় বড় স্নেহ করিতেন, বিশেষতঃ মাননীয় গিরিশবাবুর স্নেহাধিক্যে আমার মান অভিমান একটু বেশী প্রভুত্ব করিত; সেইজন্য দোষ আমারই অধিক হইত। কিন্তু আমার অভিনয় কার্য্যের উৎসাহের জন্য সকলেই প্রশংসা করিতেন, এবং দোষ ভুলিয়া আমার প্রতি স্নেহের ভাগই অধিক বিকাশ পাইত। আমি তাঁহাদের সেই অকৃত্রিম স্নেহ কখন ভুলিতে পারিব না! এই থিয়েটারে কার্যকালীন কোন সুকার্য্য করিয়া থাকি আর না করিয়া থাকি প্রবৃত্তির দোষে বুদ্ধির বিপাকে অনেক অন্যায় করিয়াছি সত্য! কিন্তু এই কার্য্যের দরুন অনেক ঘাত প্রতিঘাতও সহিতে হইয়াছে! এইরূপ ননাবিধ টাল বেটালের পর যখন নূতন “ষ্টারে’ নূতন পুস্তক “দক্ষযজ্ঞ” অভিনয় আরম্ভ হইল, তখন সকলেরই মনোমালিন্য এক রকম দূরে গিয়াছিল। সকলেই জানিত যে এই থিয়েটারটী আমাদের নিজের। আমরা ইহাকে যেমন বাহ্যিক চাক‍্চিক্যময় করিয়াছি তেমনিই গুণময় করিয়া ইহার সৌন্দর্য্য আরও অধিক করিব। সেই কারণ সকলে আনন্দে, উৎসাহে এক মনে অভিনয়ের গৌরব বৃদ্ধির জন্য যত্ন করিতেন।

 এখানকার প্রথম অভিনয় “দক্ষযজ্ঞ”। ইহাতে গিরিশবাবু মহাশয় “দক্ষ”, অমৃত মিত্র “মহাদেব”, ভুনীবাবু “দধীচি”। আমি “সতী”, কাদম্বিনী “প্রসূতি” এবং অন্যান্য সুযোগ্য লোক সকল নানাবিধ অংশ অভিনয় করিয়াছিলেন। প্রথম দিনের সে লোকারণ্য, সেই খড়খড়ি দেওয়ালে লোক সব ঝুলিয়া ঝুলিয়া বসে থাকা দেখিয়া আমাদের বুকের ভিতর দুর্ দুর্ করিয়া কম্পন— বর্ণনাতীত! আমাদেরই সব “দক্ষযজ্ঞ” ব্যাপার! কিন্তু যখন অভিনয় আরম্ভ হইল, তখন দেবতার বরে যেন সত্যই দক্ষালয়ের কার্য্য আরম্ভ হইল। বঙ্গের গ্যারিক গিরিশবাবুর সেই গুরুগম্ভীর তেজপূর্ণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুর্ত্তি যখন ষ্টেজে উপস্থিত হইল তখন সকলেই চুপ। তাহার পর অভিনয় উৎসাহ, সে কথা লিখিয়া বলা যায় না। গিরিশবাবুর “দক্ষ”, অমৃত মিত্রের “মহাদেব” যে একবার দেখিয়াছে, সে বোধ হয় কখনই তাহা ভুলিতে পারিবে না। “কে—রে, দে—রে, সতী দে আমার” বলিয়া যখন অমৃত মিত্র ষ্টেজে বাহির হইতেন, তখন বোধহয় সকলেরই বুকের ভিতর কাঁপিয়া উঠিত। দক্ষের মুখে পতি-নিন্দা শুনিয়া যখন সতী প্রাণ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইয়া অভিনয় করিত তখন সে বোধহয় নিজেকেই ভুলিয়া যাইত। অভিনয়কালীন স্টেজের উপর যেন অগ্নি উত্তাপ বাহির হইত। যাহাহউক, এই থিয়েটার হইবার পর গিরিশবাবু মহাশয়ের যত্নে ও অভিনেতা ও অভিনেত্রীবর্গের আগ্রহ উৎসাহে দিন দিন উজ্জ্বলতর উন্নতির পথে চলিতে লাগিল। এই থিয়েটারেই কার্য্যকালীন নানাবিধ গুণী, জ্ঞানী, পণ্ডিত, সন্ত্রান্ত লোকের নিকট উৎসাহ পাইয়া আমার কার্য্যের গুরুত্ব আমি অনুভব করিতে পারিলাম। অভিনয়কার্য্য যে রঙ্গালয়ের রঙ্গ নহে, তাহা যে শিক্ষা করিবার ও দীক্ষা দিবার বিষয়। অভিনয়-কার্য্য যে হৃদয়ের সহিত মিশাইয়া লইয়া সে কার্য্য মন ও হৃদয় এক করিয়া লইতে হয়; তাহাতে কতকটা আপনাকে ঢালিয়া মিলাইয়া—লইতে হয় তাহা বুঝিতে সক্ষম হইলাম, এবং আমার ন্যায় ক্ষুদ্র-বুদ্ধি চরিত্রহীনা স্ত্রীলোকদিগের যে কতদূর উচ্চ কার্য্য সমাধার জন্য প্রস্তুত হইতে হয় তাহাও বুঝিতে সক্ষম হইলাম। সেই কারণ সতত যত্নের সহিত হৃদয়কে সংযম রাখিতে চেষ্টা করিতাম। ভাবিতাম যে ইহাই আমার কার্য্য ও ইহাই আমার জীবন। আমি প্রাণপণ যত্নে মহামহিমান্বিত চরিত্র সকলের সম্মান রক্ষা করিতে হৃদয়ের সহিত চেষ্টা করিব। ইহার পর গিরিশবাবুর লিখিত সব উচ্চ অঙ্গের পুস্তক অভিনয় হইতে লাগিল। মধ্যস্থানে সমাজ পীড়নে বা অন্য কারণে হউক গুর্ম্মুখবাবু থিয়েটারের স্বত্ব ত্যাগ করিলেন। সেই সময় হরিবাবু, অমৃত মিত্র, দাশুবাবু কিছু কিছু টাকা দিয়া ও কতক টাকা স্বর্গাগত মাননীয় হরিধন দত্ত মহাশয়ের নিকট হইতে কর্জ্জ করিয়া ও তখন এক‍্জিবিসনের সময়, প্রত্যহ অভিনয় চালাইয়া সেই টাকার দ্বারা “স্টার থিয়েটার” নিজেরা ক্রয় করিলেন। শ্রীযুক্ত বাবু অমৃতলাল বসুও একজন প্রোপ্রাইটার হইলেন। এই সময় নানা কারণে ও অসুস্থ হইয়া গুর্ম্মুখবাবু থিয়েটারের স্বত্ব ত্যাগ করিতে উদ্যত হইলেন ও বলিলেন যে, এই থিয়েটার যাহার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, আমি তাহাকেই ইহার স্বত্ত্ব দিব, অন্ততঃ ইহার অর্দ্ধেক স্বত্ব তাহার থাকিবে, নচেৎ আমি হস্তান্তর করিব না।

 সেই সময় গুর্ম্মুখবাবুর ইচ্ছায় আমারও সমান অংশ লইবার কথা উঠিল। লোক পরম্পরায় শুনিলাম যে গুর্ম্মুখবাবু বলিয়াছিলেন যে ইহাতে বিনোদের অংশ না থাকিলে আমি কখন উহাদিগকে দিবনা। এদিকে কিন্তু গিরিশবাবু মহাশয় তাহাতে রাজি হইলেন না, তিনি আমার মাকে বলিলেন যে “বিনোদের মা ও সব ঝঞ্ঝাটে তোমাদের কাজ নাই, তোমরা স্ত্রীলোক অত ঝঞ্জাট বহিতে পারিবে না”। আমরা “আদার ব্যাপারি আমাদের জাহাজের খবরে কাজ নাই।” তোমার মেয়েকে ফেলিয়া তো আমি কখন অন্যত্র কার্য্য করিব না; আর থিয়েটার করিতে হইলে বিনোদ যে একজন অতি প্রয়োজনীয়, কেহই অস্বীকার করিতে পারিবে না। আমরা কার্য্য করিব; বোঝ। বহিবার প্রয়োজন নাই! গাধার পিঠে বোঝা দিয়া কার্য্য করিব। গিরিশবাবুর এই সকল কথা শুনিয়া মা আমার কোন মতেই রাজি হইলেন না। যেহেতু আমার মাতাঠাকুরাণীও গিরিশবাবু মহাশয়কে অতিশয় ভক্তি শ্রদ্ধা করিতেন। তাঁহার কথা অবহেলা করিতে তাহাদের কিছুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। এই রকম নানাবিধ ঘটনায় ও রটনায় বহু দিবসাবধি লোকের মনে ধারণা ছিল যে “স্টারে” আমার অংশ আছে! এমন কি অনেকবার লোকে আমায় স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করিয়াছে “তোমার কত অংশ”? সে যাহাহউক, এই থিয়েটার ইঁহাদের নিজের হতে আসিবার পর দ্বিগুণ উৎসাহে কার্য্য আরম্ভ হইল। পূর্ব্বে এক‍্জিবিসনের কথা উল্লেখ করিয়াছি, তখনও - এক‍্জিবিসন চলিতেছে, কত দেশ দেশান্তরের লোক কলিকাতায়! আমাদের উদ্যোগ, উৎসাহ, আনন্দ দেখে কে? এই সময় আবার আমরা সব ঐক্য হইলাম। যে যাহার কার্য্য করিতে লাগিল, তাহা যেন তা’রই নিজের কার্য্য! এই সময় সুবিখ্যাত “নল-দময়ন্তী”, “ধ্রুবচরিত্র”, “শ্রীবৎস-চিন্তা” ও প্রহলাদচরিত্র নাটক প্রস্তুত হয়।

 এই থিয়েটারের যতই সুনাম প্রচার হইতে লাগিল, গিরিশবাবু মহাশয় ততই যত্নে আমায় নানাবিধ সৎশিক্ষা দিয়া কার্য্যক্ষম করিবার যত্ন করিতে লাগিলেন। এই বার “চৈতন্যলীলা” নাটক লিখিত হইল এবং ইহার শিক্ষাকার্যও আরম্ভ হইল। এই “চৈতন্যলীলা”র রিহার্সালের সময় “অমৃতবাজার পত্রিকার” এডিটার বৈষ্ণচূড়ামণি পূজনীয় শ্রীযুক্ত শিশিরবাবু মহাশয় মাঝে মাঝে যাইতেন এবং আমার ন্যায় হীনার দ্বারা সেই দেব-চরিত্র যতদূর সম্ভব সুরুচি সংযুক্ত হইয়া অভিনয় হইতে পারে তাহার উপদেশ দিতেন, এবং বার বার বলিতেন যে, “আমি যেন সতত গৌর পাদপদ্ম হৃদয়ে চিন্তা করি। তিনি অধমতারণ, পতিতপাবন, পতিতের উপর তাঁর অসীম দয়া।” তাঁর কথামত আমিও সতত ভয়ে ভয়ে মহাপ্রভুর পাদপদ্ম চিন্তা করিতাম। আমার মনে বড়ই আশঙ্কা হইত যে কেমন করিয়া এ অকূল পাথারে কূল পাইব। মনে মনে সদাই ডাকিতাম “হে পতিতপাবন গৌরহরি, এই পতিতা অধমাকে দয়া করুন।” যেদিন প্রথম চৈতন্যলীলা অভিনয় করি তাহার আগের রাত্রে প্রায় সারা রাত্রি নিদ্রা যাই নাই; প্রাণের মধ্যে একটা আকুল উদ্বেগ হইয়াছিল। প্রাতে উঠিয়া গঙ্গাস্নানে যাইলাম; পরে ১০৮ দুর্গানাম লিখিয়া তাঁহার চরণে ভিক্ষা করিলাম যে, “মহাপ্রভু যেন আমায় এই মহা সঙ্কটে কূল দেন। আমি যেন তাঁর কৃপালাভ করিতে পারি”; কিন্তু সারা দিন ভয়ে ভাবনায় অস্থির হইয়া রহিলাম। পরে জানিলাম, আমি যে তাঁর অভয় পদে স্মরণ লইয়াছিলাম অহা বোধহয় ব্যর্থ হয় নাই। কেননা তাঁর যে দয়ার পাত্রী হইয়াছিলাম তাহা বহু সংখ্যক সুধীবৃন্দের মুখেই ব্যক্ত হইতে লাগিল। আমিও মনে মনে বুঝিতে পারিলাম যে ভগবান আমায় কৃপা করিতেছেন। কেননা সেই বাল্যলীলার সময় “রাধা বই আর নাইক আমার, রাধা বলে বাজাই বাঁশী” বলিয়া গীত ধরিয়া যতই অগ্রসর হইতে লাগিলাম, ততই যেন একটা শক্তিময় আলোক আমার হৃদয়কে পূর্ণ করিয়া তুলিতে লাগিল। যখন মালিনীর নিকট হইতে মালা পরিয়া তাহাকে বলিতাম “কি দেখ মালিনী?” সেই সময় আমার চক্ষু বহির্দৃষ্টি হইতে অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করিত। আমি বাহিরের কিছুই দেখিতে পাইতাম না। আমি হৃদয় মধ্যে সেই অপরূপ গৌর পাদপদ্ম যেন দেখিতাম, আমার মনে হইত “ঐ যে গৌরহরি, ঐ যে গৌরাঙ্গ” উঁনিই তো বলিতেছেন, আমি মন দিয়া শুনিতেছি ও মুখ দিয়া তাঁহারই কথা প্রতিধ্বনি করিতেছি! আমার দেহ রোমাঞ্চিত হইত, সমস্ত শরীর পুলকে পূর্ণ হইয়া। যাইত। চারিদিকে যেন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হইয়া যাইত। আমি যখন অধ্যাপকের সহিত তর্ক করিয়া বলিতাম “প্রভু কেবা কার! সকলই সেই কৃষ্ণ” তখন সত্যই মনে হইত যে “কেবা কার!” পরে যখন উৎসাহ উৎফুল্ল হইয়া বলিতাম যে,—

“গয়াধামে হেরিলাম বিদ্যমান,
বিষ্ণুপদ পঙ্কজে করিতেছে মধুপান,
কত শত কোটী অশরীরি প্রাণী!”

 তখন মনে হইত বুঝি আমার বুকের ভিতর হইতে এই সকল কথা আর কে বলিতেছে! আমি তো কেহই নহি! আমাতে আমি-জ্ঞানই থাকিত না। সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া মাতা শচীদেবীর নিকট বিদায় লইবার সময় যখন বলিতাম যে —

“কৃষ্ণ বলে কাঁদ মা জননী,
কেঁদনা নিমাই বলে,
কৃষ্ণ বলে কাঁদিলে সকল পাবে,
কাঁদিলে নিমাই বলে,
নিমাই হারাবে কৃষ্ণে নাহি পাবে।”

 তখন স্ত্রীলোক দর্শকদিগের মধ্যে কেহ কেহ এমন উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতেন যে আমার বুকের ভিতর গুর‍্গুর্ করিত। আবার আমার শচীমাতার সেই হৃদয়ভেদী মর্ম্ম-বিদারণ শোক ধ্বনি, নিজের মনের উত্তেজনা, দর্শকবৃন্দের ব্যগ্রতা আমায় এত অধীর করিত যে আমার নিজের দুই চক্ষের জলে নিজে আকুল হইয়া উঠিতম। শেষে সন্ন্যাসী হইয়া সঙ্কীর্ত্তন কালে “হরি মন মজায়ে লুকালে কোথায়। আমি ভবে একা দাওহে দেখা প্রাণ সখা রাখ পায়॥” এই গানটী গাহিবার সময়ের মনের ভাব আমি লিখিয়া জানাইতে পারিব না। আমার সত্যই তখন মনে হইত যে আমি তো ভবে একা, কেই তো আমার আপনার নাই। আমার প্রাণ যেন ছুটিয়া গিয়া হরি পাদপদ্মে আপনার আশ্রয় স্থান খুঁজিত! উন্মত্ত ভাবে সঙ্কীর্ত্তনে নাচিতাম। এক একদিন এমন হইত যে অভিনয়ের গুরুভার বহিতে না পারিয়া মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়িতাম।

 একদিন অভিনয় করিতে করিতে মধ্যস্থানেই অচৈতন্য হইয়া পড়ি, সেদিন অতিশয় লোকারণ্য হইয়াছিল। “চৈতন্যলীলার” অভিনয়ে প্রায় অধিক লোক হইত। তবে যখন কোন কার্য্য উপলক্ষে বিদেশী লোক সকল আসিতেন তখন আরও রঙ্গালয় পূর্ণ হইত এবং প্রায় অনেক গুণী লোকই আসিতেন। মাননীয় ফাদার লাফোঁ সাহেব সেদিন উপস্থিত ছিলেন, ড্রপসিনের পরেই স্টেজের ভিতর গিয়াছিলেন; আমার ঐ রকম অবস্থা শুনিয়া গিরিশবাবু মহাশয়কে বলেন যে “চল আমি একবার দেখিব।” গিরিশবাবু তাঁহাকে আমার গ্রিনরুমে লইয়া যাইলেন; পরে যখন আমার চৈতন্য হইল, আমি দেখিতে পাইলাম একজন মস্ত বড় দাড়িওয়ালী সাহেব ঢিলা ইজের জামা পরা আমার মাথার উপর হইতে পা পর্যন্ত হস্ত চালনা করিতেছেন। আমি উঠিয়া বসিতে গিরিশবাবু বলিলেন, ইঁহাকে নমস্কার কর। ইঁনি মহামান্বিত পণ্ডিত “ফাদার লাফোঁ।” আমি তাঁর নাম শুনিতাম, কখনও তাঁহাকে দেখি নাই! আমি হাত জোড় করিয়া তাঁহাকে নমস্কার করিলাম, তিনি আমার মাথায় খানিক হাত দিয়া এক গ্লাস জল খাইতে বলিলেন! আমি এক গ্লাস জল পান করিয়া বেশ সুস্থ হইয়া আপন কার্যে ব্রতী হইলাম। অন্য সময় মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িলে যেমন নিস্তেজ হইয়া পড়িতাম, এবার তাহা হয় নাই; কেন তাহা বলিতে পারিনা! এই চৈতন্যলীলা অভিনয় জন্য আমি যে কত মহামহোপাধ্যায় মহাশয়গণের আশীর্ব্বাদ লাভ করিয়াছিলাম তাহা বলিতে পারিনা। পরম পূজনীয় নবদ্বীপের বিষ্ণু প্রেমিক পণ্ডিত মথুরানাথ পদরত্ন মহাশয় ষ্টেজের মধ্যে আসিয়া দুই হস্তে তাঁহার পবিত্র পদ ধূলিতে আমার মস্তক পূর্ণ করিয়া কত আশীর্ব্বাদ করিয়াছিলেন। আমি মহাপ্রভুর দয়ায় কত ভক্তি-ভাজন সুধীগণের কৃপার পাত্রী হইয়াছিলাম। এই চৈতন্যলীলার অভিনয়ে—শুধু চৈতন্য লীলার অভিনয়ে নহে আমার জীবনের মধ্যে চৈতন্যলীলা অভিনয় আমার সকল অপেক্ষা শ্লাঘার বিষয় এই যে আমি পতিতপাবন ৺পরমহংস দেব রামকৃষ্ণ মহাশয়ের দয়া পাইয়াছিলাম। কেননা সেই পরম পূজনীয় দেবতা, চৈতন্যলীলা অভিনয় দর্শন করিয়া আমায় তাঁর শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় দিয়াছিলেন! অভিনয় কার্য্য শেষ হইলে আমি শ্রীচরণ দর্শন জন্য যখন আপিস ঘরে তাঁহার চরণ সমীপে উপস্থিত হইতাম, তিনি প্রসন্ন বদনে উঠিয়া নাচিতে নাচিতে বলিতেন; “হরি গুরু, গুরু হরি”, বল মা “হরি গুরু, গুরু হরি”, তাহার পর উভয় হস্ত আমার মাথার উপর দিয়া আমার পাপ দেহকে পবিত্র করিয়া বলিতেন যে, “মা তোমার চৈতন্য হউক।” তাঁর সেই সুন্দর প্রসন্ন ক্ষমাময় মূর্ত্তি আমার ন্যায় অধম জনের প্রতি কি করুণাময় দৃষ্টি! পাতকীতারণ পতিতপবন যেন আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমায় অভয় দিয়াছিলেন। হায়! আমি বড়ই ভাগ্যহীনা অভাগিনী! আমি তবুও তাহাকে চিনিতে পারি নাই। আবার মোহ জড়িত হইয়া জীবনকে নরক সদৃশ করিয়াছি।

 আর একদিন যখন তিনি অসুস্থ হইয়া শ্যামপুকুরের বাটীতে বাস করিতেছিলেন, আমি শ্রীচরণ দর্শন করিতে যাই তখনও সেই রোগক্লান্ত প্রসন্ন বদনে আমায় বলিলেন, “আয় মা বোস”, আহা কি স্নেহপূর্ণ ভাব! এ নরকের কীটকে যেন ক্ষমার জন্য সতত আগুয়ান? কতদিন তাঁহার প্রধান শিষ্য নরেন্দ্রনাথের (পরে যিনি বিবেকানন্দ স্বামী বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন) “সত্যং শিবং” মঙ্গলগীতি মধুর কণ্ঠে থিয়েটারে বসিয়া শ্রবণ করিয়াছি। আমার থিয়েটার কার্য্যকরী দেহকে এইজন্য ধন্য মনে করিয়াছি। জগৎ যদি আমায় ঘৃণার চক্ষে দেখেন, তাহাতেও আমি ক্ষতি বিবেচনা করিনা। কেননা আমি জানি যে “পরমারাধ্য পরম পূজনীয় ৺রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব” আমায় কৃপা করিয়াছিলেন। তাঁর সেই পিযুষ পূরিত আশাময়ী বাণী— “হরি গুরু, গুরু হরি” আমায় আজও আশ্বাস দিতেছে। যখন অসহনীয় হৃদয়-ভারে অবনত হইয়া পড়ি; তখনই যেন সেই ক্ষমাময় প্রসন্ন মূর্ত্তি আমার হৃদয়ে উদয় হইয়া বলেন যে, বল—“হরি গুরু, গুরু হরি।” এই চৈতন্যলীলা দেখার পর তিনি কতবার থিয়েটারে আসিয়াছেন মনে নাই। তবে “বক্সে যেন তার সেই প্রসন্ন প্রফুল্লময় মুর্ত্তি আমি বহুবার দর্শন করিয়াছি।

 ইহার পর “দ্বিতীয় ভাগ চৈতন্যলীলা” অভিনয় হয়! এই দ্বিতীয় ভাগ চৈতন্যলীলা প্রথমভাগ হইতে কঠিন ও অতিশয় বড় বড় স্পীচ দ্বারা পূর্ণ! আর ইহাতে চৈতন্যের ভূমিকাই অধিক। এই দ্বিতীয় ভাগ চৈতন্যলীলার অংশ মুখস্থ করিয়া আমায় প্রায় একমাস মাথার যন্ত্রণা অনুভব করিতে হইয়াছিল। ইহার সকল স্থান কঠিন ও উন্মাদ
বিবাহ-বিভ্রাট প্রহসনে “বিলাসিনী কারফর্‌মার ভূমিকায়

শ্রীমতী বিনােদিনী।

কারী; কিন্তু যখন সার্ব্বভৌম ঠাকুরের সহিত সাকার ও নিরাকার বাদ লইয়া যুক্তি প্রদর্শন করিতে করিতে মহাপ্রভুর ষড়ভুজমূর্ত্তি ধারণ, সেই স্থান অভিনয় যে কতদূর উন্মাদকারী আত্মবিস্মৃত ভাবপূর্ণ, তাহা যাঁহারা দ্বিতীয় ভাগ চৈতন্যলীলার অভিনয় না দেখিয়াছেন, তাঁহার বুঝিতেই পারিবেন না। সেই সকল স্থান অভিনয়কালীন মনের আগ্রহ যতদূর প্রয়োজন; আবার দেহের শক্তিও ততদূর দরকার। কেননা সেই লঘু হইতে উচ্চ, উচ্চ হইতে উচ্চতর স্বর সংযোগে একভাবে মনের আবেগে মনে হইত যে আমি বুঝি এখনি পড়িয়া যাইব। আর সেই ৺জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশকালীন “ঐ ঐ আমার কালাচাঁদ” বলিয়া আত্মহারা! ইহা বলিতে যত সহজ কার্য্যে যে কতদূর কঠিন ভাবিতেও ভয় হয়! এখনকার এই জড়, অপদার্থ দেহে যখন সেই সকল কথা ভাবি, তখন মনে হয়, যে কেমন করিয়া আমি ইহা সম্পূর্ণ করিতাম। তাই মনে মনে হয় যে, সেই মহাপ্রভুর দয়া ব্যতীত আমার সাধ্য কি? আমি রঙ্গালয় ত্যাগ করিবার পর এই “দ্বিতীয় ভাগ চৈতন্যলীলা” আর অভিনয় হয়। নাই! এই সময় অমৃতলাল বসু মহাশয়ের সর্ব্ব শ্রেষ্ঠ প্রহসন “বিবাহ বিভ্রাট” প্রস্তুত হয়। ইহাতে আমি “বিলাসিনী কারফরমার” অংশ অভিনয় করি! কি বিষম বৈষম্য! কোথায় জগতপূজ্য দেবতা মহাপ্রভু চৈতন্য চরিত্র; আর কোথায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত হিন্দু সমাজ বিরোধী সভ্য স্ত্রী বিলাসিনী কারফরমা চরিত্র! আমি তো ছয় সাত মাস ধরিয়া এক সঙ্গে “চৈতন্য” ও “বিলাসিনীর” অংশ অভিনয় করিতে সাহস করি নাই। যদিও পরে অভিনয় করিতে হইয়াছিল, কিন্তু অনেক দিন পরে তবে সাহস হইয়াছিল। অভিনয়কালীন কত যে বাধা বিপত্তি সহিতে হইত, এখন মনে হইলে ভাবি যে কেমন করিয়া এত কষ্ট সহিতাম। সময়ে সময়ে এত অসুস্থ হইয়া পড়িতাম যে স্বাস্থ্যের সম্বন্ধে প্রায় আমার অনিষ্ট হইত। মাঝে মাঝে গঙ্গার তীরের নিকট কোন স্থানে বাসা লইয়া বাস করিতাম এবং শনি ও রবিবারে আসিয়া অভিনয় করিয়া যাইতাম। আমার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যাহা প্রয়োজন হইত, তাহার ব্যয় ভার থিয়েটারের অধ্যক্ষের যত্নের সহিত বহন করিতেন।

 এই সময়ের মধ্যে আর একটা পরিবর্ত্তন ঘটে। অসুখে ও নানারূপ বাধা বিপত্তিতে আমার মনের ভাব হঠাৎ অন্য প্রকার হয়। মনে করি যে আমি আর কাহার অধীন হইব না। ঈশ্বর আমায় যে স্বকৃত উপার্জ্জনের ক্ষমতা দিয়াছেন তাহাই অবলম্বন করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিব। আমার এই মনের ভাব প্রায় দেড়বৎসর ছিল এবং সেই সময় আমি বড় শান্তিতে দিন কাটাইতাম। সন্ধ্যার সময় কার্য্য স্থানে যাইতাম, আপনার কার্য্য সমাধা হইলে, ভুনীবাবু ও গিরিশবাবু মহাশয়ের নিকট নানা দেশ বিদেশের গল্প বা থিয়েটারের কথা সব শুনিতাম, এবং কি করিলে কোনখানে উন্নতি হইবে, কোন্ কার্য্যের কোথায় কি ক্রটী আছে, এই নানারূপ পরামর্শ হইত। পরে বাটীতে আসিলে স্নেহময়ী জননী কত যত্নে আহার দিতেন। সেই তত রাত্রে উঠিয়া নিকটে বসিয়া আহার করাইতেন। আহারান্তে ভগবানের ঐ চরণ স্মরণ করিয়া সুখে নিদ্রা যাইতাম। কিন্তু, পরিশেষে নানারূপ মনভঙ্গ দ্বারা থিয়েটারে কার্য্য করা দুরূহ হইয়া উঠিল। যাহারা এক সঙ্গে কার্য্য করিবার কালীন সমসাময়িক স্নেহময় ভ্রাতা, বন্ধু আত্মীয়, সখা ও সঙ্গী ছিলেন। তাঁহারা ধনবান উন্নতিশীল অধ্যক্ষ হইলেন। বোধ হয়, সেই কারণে অথবা আমারই অপরাধে দোষ হইতে লাগিল। কাজেই আমায় থিয়েটার হইতে অবসর লইতে হইল।