জুগদিদি। এরা বলে গ্রাম, কিন্তু এসে দেখি সহরেরও বাড়া। সুকুমী থেকে ট্রেনে আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। বৃষ্টি মাথায় করে পান্থশালায় এলাম; প্রশস্ত রাস্তা বিদ্যুতালোকে উদ্ভাসিত। সকালে দেখি, সম্মুখে বাগান অন্যপাশে বড় বড় দোকান— দলে দলে কৃষকরমণী এসেছে সওদা করতে এবং বেচবে বলে কেউ কাঁকালে করে এনেছে শুকর—ছানা। দেখে ভ্রম হয়, যেন কলকাতার চৌরঙ্গীপাড়ার সৌখিন দোকানে মেম-সাহেবেরা বাজার করতে বেরিয়েছেন। আমার সঙ্গীরা তখনও ঘুমুচ্ছেন; একাই বেরিয়ে পড়লাম। এখানকার মেয়েরা মস্কৌএর মত নয়, পোষাক ও প্রসাধনে পারিপাট্য আছে, অলঙ্কারও প্রচুর। সম্মুখে ভীড় দেখে এগিয়ে গেলাম। ঘড়ীর দোকান, ঘড়ী মেরামতের খদ্দেরদের ভীড়। হাত ঘড়ীর চল এখন বিশ্বব্যাপী। এখানেও তরুণ তরুণীদের হাতে সোনার বক্‌লস দেয়া হাতঘড়ীর ছড়াছড়ি। পথে অনেকে হেসে অভিবাদন করে, আমিও হেসে নমস্কার করি, কথা বলবার উপায় নেই। বাগানের বেঞ্চে এসে বসেছি, পাশে একজন আরাম করে পাইপ টানছেন। ঘনিষ্ঠ হয়ে আলাপ সুরু করলেন। আমি যত বলি, ইণ্ডিস্কী, হিন্দী, তিনি তা কানেই তোলেন না। নিজের বক্তব্য অনর্গল বলে যাচ্ছেন। এমন সময় আমাদের সঙ্গী আনাতোলি এসে হাজির, নিষ্কৃতি পেলাম। শুনলাম, কমরেড তাঁদের গ্রামের সমৃদ্ধি কি ভাবে চা-বাগানের দৌলতে বেড়ে গেছে, তারই গল্প শোনাচ্ছিলেন।

 দুটো চা-বাগান ও একটা চা তৈরীর কারখানা দেখলাম । আমাদের দেশের তরাই-এর চা-বাগানগুলোর মতই। কারখানা অর্থাৎ কাঁচা চায়ের পাতা নানারকম প্রণালীর মধ্য দিয়ে শুকিয়ে যে ভাবে চা হয়, তাও আমাদের দেখান হ’ল। এমন কারখানা আমাদের দেশেও আছে, কেবল নেই কুলী ও কুলীবস্তী । চা-বাগানের কারখানার চারদিকে প্রাসাদতুল্য অট্টালিকায় কর্মীরা বাস করে। ছোট ছোট ব্যক্তিগত পারিবারিক বাড়ীও আছে। এছাড়া ক্লাব নাচঘর থিয়েটার শিশু পালনাগার কিণ্ডারগার্টেন রয়েছে। চায়ের পাতা মেয়েরাই তোলে। একটি কারখানায় থান ইটের মত চা তৈরী হয়, এগুলি মঙ্গোলিয়া কাজাকস্তান ও সাইবেরিয়ায় চালান যায়।

 জুগদিদির চারদিকে সমবায় কৃষিক্ষেত্র। এই কৃষির দৌলতেই গ্রাম শহর হয়েছে। এদের গ্রাম্য ম্যুজিয়ম দেখে বিস্মিত হলাম । প্রস্তরযুগ থেকে আধুনিক যুগের কত ঐতিহাসিক নিদর্শন এরা সংগ্রহ করেছে। জর্জিয়ান কুটির শিল্প ও চিত্রকলার সংগ্রহ প্রচুর। একটা কক্ষে স্থানীয় সামন্তরাজার সংগৃহীত বিলাসসামগ্রী ও তৈজসপত্র। ইনি প্যারিসে নেপোলিয়নের ব্যবহৃত চেয়ার টেবিল কিনেছিলেন, তাও দেখলাম এরা যত্ন করেই রেখেছে। এখানে লোকে দেশের শিল্প খনিজসম্পদ সংস্কৃতি ও চারুকলার সঙ্গে পরিচয় লাভ করে। একজায়গায় প্রাচীন আমলের অভিজাতদের মূল্যবান চীনে মাটির বাসন, স্ফটিক পানপাত্র থরে থরে সাজানো তার পাশেই কৃষকদের পোড়া মাটির মলিন পাত্রগুলি। লোকে এক নজরেই পুরনো দিন আর হাল আমলের তফাৎটা বুঝতে পারে ।

 ম্যুজিয়মের পাশেই খেলার মাঠ। একধারে তিনতলা স্টাডিয়াম, প্রায় ১৫/২০ হাজার লোক বসতে পারে। গ্রামেও এমনটা সম্ভব হয়েছে! এখানে ফুটবল খেলা হ’ল। তারপর শুরু হ’ল ককেসিয়ানদের জাতীয় ক্রীড়া ঘোড় দৌড়। জাতীয় পোষাকে সজ্জিত পুরুষ নারী ও কিশোর বালকরা ঘোড়া ছুটিয়ে অনেক রকম দুঃসাহসিক খেলা দেখালো। শত্রুর ব্যূহে প্রবেশ করে ভল্ল নিক্ষেপ এবং পলায়মান শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন; দর্শকগণ করতালি দিয়ে উৎসাহিত করতে লাগলো। প্রায় পঞ্চাশটি দ্রুত ধাবমান অশ্বারোহীর পুরোভাগে পতাকাবাহী নব্বুই বৎসরের বৃদ্ধ, শুভ্র কেশ ও শ্মশ্রু বাতাসে উড়ছে। দেখে অবাক হলাম। এ দেশের নরনারী দীর্ঘজীবী হয়, আশী নব্বুই বছরেও এরা যুবার মত কর্মক্ষম।

 বেলা পড়ে আসছে, আমরা একটা বৃহৎ সমবায় কৃষিক্ষেত্রে গেলাম, নাম ‘বেরিয়া খোলকোজ’। বেরিয়া বলশেভিক আন্দোলনে স্তালিনের দক্ষিণহস্ত ছিলেন। ইনি জর্জিয়ার একজন মুখ্য নেতা, বর্তমানে সোবিয়েত রাশিয়ার অন্যতম মন্ত্রী।

 ডিরেক্টর কৃষিক্ষেত্রের যে পরিচয় দিলেন, তা মোটামুটি এই — ১৯৩০ সালে ৫৭টি পরিবার এবং ১৬৯ হাজার রুবল সম্পত্তি নিয়ে এই কৃষিক্ষেত্রের পত্তন হয়। ১৯৫১ সালে ২৭০টি পরিবার এবং মোট সম্পত্তির মূল্য ১১০ লক্ষ ৬ হাজার রুবল। পূর্বে এ অঞ্চলে কেবল ভুট্টার চাষ হত। সোবিয়েত কৃষি-বিজ্ঞানীদের সহায়তায় চা ও ফলের চাষ সুরু হয়। মোট জমি ১৫৮০ হেক্টর (১ হেক্টর ২.৪৭ একর)। চা আঙ্গুর ফল তরিতরকারী এবং ভুট্টার চাষ হয়। এ ছাড়া সমবায়ের এবং ব্যক্তিগত পশু পাখী পালন আছে । সমবায়ের দুগ্ধবতী গাভীর সংখ্যা ৮৭৪।

 ১৯৫০ সালে মোট আয় হয়েছে নয় হাজার লক্ষ রুবল। দৈনিক মাথাপিছু মজুরী ৪২ রুবল। বেতন বোনাস নিয়ে কৃষকেরা পেয়েছে ৫ হাজার লক্ষ ৭৯ হাজার রুবল। সরকারী ট্যাক্স ২ লক্ষ ৫০ হাজার রুবল দিয়ে বাকী অর্থ হাসপাতাল স্কুল ক্লাবের জন্য ব্যয় হচ্ছে। সমবায়ের বিশটি ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তাদের খরচ দেয়া হয়। বেতন ভাতার নগদ অর্থ ছাড়া প্রত্যেক পরিবার বছরে দু’টন শস্য পায়। গৃহপালিত পশু ও ফল তরিতরকারীর বাগান থেকেও বাড়তি আয় আছে। এই কৃষিক্ষেত্রে ৪০ জন ‘স্যোসালিস্ট হিরো’ এবং ২১ জন সম্মানিত পদকধারী রয়েছে।

 আমরা চারদিক ঘুরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং কৃষকদের বাড়ীঘর আসবাবপত্র দেখলাম। স্বচ্ছলতা ও সাফল্যের ছাপ সর্বত্র। একজন বৃদ্ধ কৃষক বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে, আগের দিনের গল্প বললেন। বলশেভিকরা যখন প্রস্তাব করলো, এ ভাবে চলবে না, সমবায় কৃষি ক্ষেত্র গঠন করতে হবে, উত্তেজিত আলোচনায় গ্রাম ভরে উঠলো। নিজের জমি না হলে কি কেউ মন দিয়ে চাষ করবে, সব পয়মাল হয়ে যাবে। সকলে মিলে সব জমির মালিক হবে, এমন অসম্ভব কথা কে কবে শুনেছে? যাদের জমি নেই, ভাগচাষী, মালিক হওয়ার লোভে তারা তো রাজী হয়ে গেল, ছোট ছোট কৃষকরাও নিম রাজী, কিন্তু কুলাকরা (জোতদার) কিছুতেই রাজী হয় না।

 সভা ডাকা হ’ল। তরুণ বলশেভিকরা সমবায় কৃষিক্ষেত্র ও যন্ত্রের সাহায্যে বৈজ্ঞানিক চাষের ভাবী সমৃদ্ধি বর্ণনা করলো। কলে চাষ ফসল কাটা ফসল ঝাড়াই হবে, এমন আজগুবী কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। বক্তৃতা শেষ হবার পর একজন প্রবীণ কৃষক বলতে লাগলেন, তোমরা সহুরে কেতাব পড়া, আমাদের মনের ভাব ও অবস্থা বোঝ না। আমি এখনও মরিনি, এর মধ্যেই দু’ছেলে জমি ভাগ বাটোয়ার সলা পরামর্শ করছে; আমার দুই বেটার বউ আরো উৎসাহী। গরু ঘোড়া হাঁস মুরগী তারা ভাগ করে ফেলেছে, ভেড়া হ’ল তিনটি। কি ভাবে ভাগ করা যায়! ছোট বউ বলে একটা ভেড়া কশাই-এর দোকানে বেচে দিয়ে টাকাটা ভাগ করে নিলেই হবে। যেখানে এক মায়ের পেটের দু’ভাই একত্র মিলে মিশে চাষ করতে চায় না, সেখানে তোমরা গ্রামশুদ্ধ লোককে একসঙ্গে চাষ করাতে চাও!

 কিন্তু তাও হ’ল ধীরে ধীরে। অল্প জমি আর কয়েক ঘর কৃষক নিয়ে কাজ আরম্ভ হ’ল। এলো কলের লাঙ্গল, চাষের নূতন পদ্ধতি ও ফলন দেখে ক্রমে লোকের বিশ্বাস হ’ল বলশেভিকরা ভাল কথাই বলেছে। কৃষিকাজে আদিম ব্যবস্থা, অতিক্রম করে আমরা যন্ত্রযুগে এসেছি অনেক অবুদ্ধির খেসারত দিয়ে। আজ আমার বাড়ী দেখছো, এখানে ছিল আমার বাপদাদার মাটির কুঁড়ে, সেই অন্ধকূপে ভেড়া-ছাগলের সঙ্গে শুয়ে আমার শৈশব কেটেছে। এখন ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ে, ক্লাবে গান গায়, রঙ্গীন পোষাক পরে নাচে, আমার নাতনী তিবলিসিতে কৃষি বিজ্ঞান কলেজে পড়ছে। প্রাচীন কালের দুঃখ দারিদ্র্য ও আধুনিক স্বাচ্ছল্যের কথা বলতে বলতে তিনি মুখর হয়ে উঠলেন।

 আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কি আপনাদের মধ্যে কলহ হয় না? কেউ যদি কাজ ফাঁকী দেয় তার কি ব্যবস্থা?

 বৃদ্ধ বললেন, মতভেদ ঘটে বৈকি। কাজ নিয়ে নয়, কাজের পদ্ধতি নিয়ে। ওগুলো নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে নেয়া হয়, না মিটলে ডিরেক্টর মধ্যস্থ হয়ে যে মীমাংসা করেন তাই আমরা মেনে নেই। ফাঁকী দেওয়ার কথা ওঠে না, কেননা আমাদের কাজ একঘেঁয়ে নয়। যে অপারগ তার খাটুনী কমিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।

 পাইন গাছ ঘেরা সবুজ ঘাসে ঢাকা উন্মুক্ত মাঠে বিরাট বিদায় ভোজ। চক্রাকারে আমাদের নিয়ে দেড়শ’ নরনারী বসলেন, পাঁচশ’ লোক খেতে পারে এমন মাছ মাংস রুটি পনীর ও বিবিধ পিষ্টক। সুমিষ্ট সুরার ছড়াছড়ি। গরুর শিংএর বৃহৎ শিঙ্গায় মদ্যপান। ভোজন সভার কর্তা ‘তামাদা’ তিন বোতল মদ শিঙ্গায় ঢেলে এক চুমুকে পানপাত্র নিঃশেষ করলেন। আমি তো দেখে শিবনেত্র। অতিথিদের জন্যও ঐ ব্যবস্থা। অপারগতা জানিয়ে নিষ্কৃতি পেলাম। জর্জিয়ান যুবকযুবতীরা সুসজ্জিত হয়ে নৃত্যগীত সুরু করলো। বাদ্যযন্ত্র তাল সুর ও সঙ্গীতের মুর্চ্ছনায় ভারতীয় আভাস আছে। প্রেয়সী নারীর চিত্তজয় করতে তরবারী আস্ফালন করে নৃত্যের বলিষ্ঠ সুষমা ভাল লাগলো। দীর্ঘাঙ্গী গৌরবর্ণা সুগঠিত দেহ শুভ্রবসনা তরুণীদের সমবেত সঙ্গীত ও লোকনৃত্য নয়নময় হয়ে দেখলাম। জীবন্ত জাতির প্রাণের প্রাচুর্য এদের সারা অঙ্গে উচ্ছলিত, পদক্ষেপের দৃঢ়ভঙ্গিতে সচল শক্তির গতিচ্ছন্দ লীলায়িত হয়ে উঠছে। সেই অপরূপ সন্ধ্যায় হাসি, আনন্দে তন্ময় হয়ে আছি, এমন সময় কমরেড অকসানা দেবীর পরিচিত আহ্বান, পাশলি পাশলি, বিদায় নেবার সময় হয়েছে।