আমার দেখা রাশিয়া/সতর
সতর
রাত্রি দশটায় গোরী থেকে ট্রেন ছাড়লো, আমরা চলেছি কৃষ্ণ সাগরের তীরে বন্দর ও স্বাস্থ্যনিবাস সুকুমীতে। চাঁদের আলোয় পাহাড় পাইন বন ও আলোকিত গ্রামগুলির এক অপরূপ শোভা। সমতল ভূমির অধিবাসী বাঙ্গালীর সমুদ্র পর্বতের ওপর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। রূপের পূজারী বাঙ্গালী এই টানেই পুরীতে যায়, দার্জিলিং শিলং পাহাড়ে যায়। সারাদিনের শ্রমের ক্লান্তিতে চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন পূর্বাকাশ রাঙ্গা হয়ে উঠেছে। পথের দু’ধারে ভুট্টার ক্ষেত, এরা বলে “ভারতীয় শস্য।” ভারত থেকেই হয় তো ভুট্টা এ দেশে এসেছিল। একদিন এখানে দরিদ্রদের ভুট্টাই ছিল প্রধান আহার যেমন আমাদের দেশের বিহার অঞ্চলে। এখন মানুষ হয়তো সখ করে খায়, আসলে পশুর খাদ্যরূপেই প্রধানত এর ব্যবহার।
কৃষ্ণসাগরের তীর দিয়ে ট্রেন চলেছে। নিস্তরঙ্গ নীল জলের বিস্তারে সাদা পাল তোলা নৌকা ভাসছে, ছোট স্টীমারের চাকার আবর্তে ফেনিল জলের তরঙ্গ। উপল আস্তীর্ণ তটভূমিতে সমুদ্রস্নানে ক্লান্ত নরনারীরা রোদ পোহাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে স্নান করছে। মাঝে মাঝে সরবত কুলপী বরফ আর ফলের দোকান। সমুদ্রের ধারে যেন মেলা বসে গেছে। রাশিয়ার নানা প্রান্ত থেকে শ্রমিকেরা সপরিবারে স্বাস্থ্যনিবাসে এসেছে।
বেলা দশটায় সুকুমী স্টেশনে ট্রেন থামলো। জর্জিয়ান সুন্দরীরা অজস্র পুষ্পগুচ্ছ দিয়ে অভ্যর্থনা করলো, শত শত কণ্ঠে ভারতের জয়ধ্বনি। “স্বাধীন ভারত শান্তি আন্দোলনের অগ্রদূত হোক।” সুদূর বিদেশে আমরা জননী জন্মভূমির স্বাধীনতার গৌরব ঘোষণা করে বললাম, আমাদের জনসাধারণ ও নেতারা যুদ্ধের বিরোধী। শান্তিকামী স্বাধীন ভারত কোনো শক্তিশিবিরের লেজুড় হয়ে হিংসা ও হত্যার অভিযানে যাবে না।
সমুদ্রের ধারেই একটা বড় হোটেলে এসে উঠলাম। বারান্দা থেকে দেখি দু’দিকে যত দূর দৃষ্টি যায় সমুদ্র তীর বাঁধানো, পায়ে চলার রাস্তা এবং বাগান। তারপর বড় রাস্তা। বারিধির বিস্তারে ঘন অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের নীলাঞ্জন ছায়া গাঢ়তর। তীরে শুভ্র সমুন্নত সৌধমালা। সৌন্দর্যবোধ ও সুরুচি মিলিতভাবে প্রকাশ পাচ্ছে চারিদিকে।
এখানকার ‘বোটানিক্যাল গার্ডেন’ দেখবার মত। ১৮৮০ সালে এর পত্তন হয়, নানাদেশের গাছপালা ফল ও ফুলগাছের সমাবেশ। আমাদের শিবপুর বাগানের অন্ততঃ তিনগুণ, সংগ্রহও অনেক বেশী। উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী এবং তাঁদের ছাত্রদের একটি বৃহৎ গবেষণাগার রয়েছে। উদ্যানে প্রবেশ পথের পরেই কলাগাছের ঝাড়, ফিকে সবুজ রংএর দীর্ঘপাতাগুলি বাতাসে দুলছে। শুনলাম এখানে কলাগাছ যত্ন করলে হয়, কিন্তু তাতে ফল ধরে না, কেবল পাতারই বাহার। বহু সুমিষ্ট ফলের দেশে কলাগাছ কেন নিষ্ফলা হ’ল, বুঝে উঠতে পারলাম না।
একটা পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে আমরা চূড়ায় উঠে গেলাম। শঙ্খধবল বিশ্রামাগার, চারদিকে কেয়ারী করা বাগান। ধনী ও অভিজাতদের বিলাসভবন নয়, নবজাগ্রত জনসাধারণের আনন্দ নিকেতন। এখান থেকে সমুদ্র-মেখলা সুকুমী নগরী দেখায় সবুজ ফ্রেমে আঁটা ছবির মত।
সকালে প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। পঞ্চাশ মাইল রাস্তা, পাহাড়ের ওপর উঠছি যেন দেরাদুন থেকে মুসৌরী অথবা কাঠগুদাম থেকে নাইনীতাল। পাহাড়ের গায়ে পাইন বন খাড়া উঠে গেছে, ঝরণা গলে গড়িয়ে পড়ছে কলহাস্যে। দেখতে দেখতে পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে উঠে গেলাম। পর্বত শৃঙ্গবেষ্টিত রিৎসা হ্রদ, অতলস্পর্শ নীল জল থৈ থৈ করছে। লরী ও বাসে এসেছে সমবায় কৃষিক্ষেত্র থেকে কারখানা থেকে তরুণ তরুণীরা। মোটর বোটে হ্রদে বেড়াচ্ছে অথবা দাঁড়টানা নৌকা নিয়ে বাইচ খেলছে। হ্রদের তীরে মদ্য ও খাদ্যের দোকান। লক্ষ্য করে দেখেছি এরা কড়া মদ খায় না। আঙ্গুরের রসে তৈরী রক্তিম সুরভি সুরাই এদের প্রিয়। প্রাচীন আর্যরা যে ঘরে তৈরী আসব পান করতেন, সে ধারা এরা বজায় রেখেছে।
সুকুমীর চারপাশে অনেকগুলি ছোট বড় স্বাস্থ্যনিবাস ও আরোগ্যশালা দেখলাম। এগুলি বিভিন্ন রিপাবলিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের তৈরী। এর মধ্যে গাগরীর স্বাস্থ্যনিবাসটাই বৃহৎ। সর্বত্রই স্বাস্থ্যনিবাস ও আরোগ্যশালা পাশাপাশি রয়েছে। স্বাস্থ্যনিবাসে শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবীরা বিশ্রাম ও ভ্রমণের আনন্দে চিত্তবিনোদন করে আর আরোগ্যশালায় থাকে রোগীরা, বিনাব্যয়ে আহার শুশ্রূষা চিকিৎসার ব্যবস্থা। জলচিকিৎসার নানা রকম ধারাযন্ত্র প্রত্যেকটিতে আছে। এগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। গ্রীষ্মকালে নানা প্রান্ত থেকে শত শত নরনারী এসেছে স্বাস্থ্যনিবাসে। এর আরাম যত্ন আসবাবপত্র, আমাদের দেশের মধ্যবিত্তরা চিন্তাই করতে পারে না, ধনীদের পক্ষেও দুর্লভ।
যারা উদয়াস্ত খেটে উদরান্ন সংগ্রহ করে বা কারখানায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খেটে কায়ক্লেশে বাঁচবার মত মজুরী পায়, তাদের বিশ্রাম শিক্ষা ও স্বাস্থ্যলাভের অধিকার আছে, আমাদের দেশে এ কল্পনা করাই কঠিন। এদের শিক্ষাবিধির মত স্বাস্থ্য ও আরোগ্যের ব্যবস্থাও সর্বব্যাপী। অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে অচিকিৎসায় কেউ মারা না যায়, এ সম্বন্ধে সোবিয়েত সরকার সতর্ক ও সজাগ। আমাদের রাজধানীর হাসপাতালের দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয়া রুগ্ন নরনারীর হতাশা-মলিন মুখগুলো মনে পড়লো, মনে পড়লো হতদরিদ্র দেশের চৌষট্টি টাকা দাবী করা ডাক্তারদের প্রসন্ন মুখচ্ছবি। লোকাকীর্ণ বস্তীর বদ্ধ ঘরে যক্ষ্মায় ভুগে কত লোক মরছে, আর দশ জনের মরবার ব্যবস্থা রেখে যাচ্ছে, কে তার হিসেব নেয়। আমাদের দেশে বিরল সংখ্যক দাতব্যচিকিৎসালয় অবশ্য আছে, গভর্নমেণ্ট এবং দয়ালু ধনীদের খয়রাতি পাইকারী মিক্চার না খেয়ে কেউ যাতে না মরে, সে ব্যবস্থা আমরা করেছি বই কি। এখানে সর্বত্র লোকসাধারণ বিনামূল্যে ওষুধ আর বিনা-ভিজিটে ডাক্তার পায়, আর পেয়েছে এই সব রাজপ্রাসাদ তুল্য আরোগ্যশালা। এগুলি কি কেবল আরোগ্যশালা? এ যে মানুষের বৃহৎ মিলনের আনন্দ সম্মেলন। জার সাম্রাজ্যে যারা ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন পরিচয়হীন, বিচিত্র জাতের মানুষের পরস্পরের মেলামেশার কোন সুযোগ ছিল না। আজ উক্রেনের খনি মজুরের পাশের ঘরে বাস করছে, মোঙ্গলিয়ার ইস্কুল-মাস্টার।
বৃটিশ সাম্রাজ্যতন্ত্র অক্টোপাসের মত আমাদের যেমন ভাবে পিষে হাড়গোড় ভেঙ্গে পঙ্গু করে ফেলে রেখে গেছে, জারের আমলে এদেরও ছিল সেই দশা। কিন্তু এরা প্রাচীন ব্যবস্থা জড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পেরেছিল বলেই আত্মকর্তৃত্বের জাদুমন্ত্রে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। আর আমরা প্রাচীন শাসনযন্ত্রের ওপর ত্রিসিংহ মূর্তির ছাপ দিয়ে, সেই আমলা-শ্রেণীর ওপর চালাবার ভার দিয়েছি, যারা আত্মসম্মান খুইয়ে বিদেশীর দাসত্ব করেছে। যে নিজেই অশ্রদ্ধেয়, সে স্বজাতিকে শ্রদ্ধা করার মত চরিত্রবল কোথায় পাবে! এখানে সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ইংরাজ আমলের ‘ল’ এণ্ড ওর্ডারের’ মানুষ পেষা জাঁতাকলটা ভারত সমুদ্রে বিসর্জন না দিতে পারলে, বহুকাল ধরে অপমানিত অবজ্ঞাত জনসাধারণের কল্যাণ নেই। খুবই দুঃসাধ্য, অন্য কোন পথও দেখিনে।