ষোল

 ১৯শে জুলাই প্রভাতে তিবলিসি থেকে গোরী যাত্রা করা গেল । কুরা নদীর তীর দিয়ে মোটর চলেছে এঁকে বেঁকে। পাহাড়ের কোলে গ্রাম, নদীর ওপারে ছোট ছোট ধানক্ষেত দেখলাম, আমাদের দেশের মতই আল দেওয়া। ধানের জমিতে জল আটকে রাখতে আলের দরকার হয়। ত্রিশ মাইল দূরে কুরা নদীর দু’পারে সহর প্রাচীন রাজধানী। নদীর ওপর রোমানদের তৈরী সেতু এখনও রয়েছে। প্রাচীন দুর্গের প্রাচীর খাড়া রয়েছে— গঠনভঙ্গী ভারতের মুঘল যুগের দুর্গ-প্রাচীরের মত। ভিতরে একটা বৃহৎ গীর্জা ছাড়া কিছুই নেই। পঞ্চম শতাব্দীতে তৈরী এই গীর্জা হাজার বছর পর তিমুর লঙ্গ লুট করেন, তারপর অনেকদিন সংস্কার হয় নি। গত শতাব্দীতে সংস্কার করা হয়েছে। এই গীর্জায় যীশু খৃষ্টের একখানা ছোট আগ্রীবা ছবি আছে। একদৃষ্টে চাইলে মনে হয় ছবির চোখ ধীরে ধীরে বুঁজে যাচ্ছে এবং খুলছে। চিত্রকরের বাহাদুরী আছে।

 চেনার ও ওক গাছের ছায়ায় ঢাকা এক গ্রামে এসে আমাদের মোটর থামলো। দলে দলে নরনারী আমাদের দেখতে এসেছে। ভোজসভা বসলো গাছতলায়, ভোজ্য পানীয়ের বিপুল আয়োজন। জর্জিয়ান আতিথেয়তার উদার অজস্রতা। আমাদের তাড়া আছে, তাই মাত্র দু’ঘণ্টা পরে তাঁরা দুঃখের সঙ্গে বিদায় দিলেন। গাড়ী ছুটলো। পাহাড়ের চূড়া তরঙ্গায়িত; সুদৃশ্য গ্রাম, দিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র, শ্যামল বনভূমি, মাঝে মাঝে দুরন্ত নদীকে বশ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র দেখতে দেখতে আমরা স্তালিনের জন্মভূমি গোরীতে এসে উপস্থিত হলাম।

 সেকালে গোরী ছিল ছোট গঞ্জের মত সহর, এখন তার পুরনো দিনের চেহারা একদম বদলে গেছে। কেবল পূর্ব দিকে প্রাচীন দিনের স্মৃতি নিয়ে পাহাড়ের ওপর পরিত্যক্ত বাইজানটাইন দুর্গ দাঁড়িয়ে আছে, গ্রীক্ রোমক তুর্কী মুঘল ইরানী রাশিয়ানদের অভিযানে কতবার হাত বদল হয়ে, এখন নিস্তব্ধ। এ ছাড়া বাড়ী ঘর দোর ট্রাম বাস সবই আধুনিক; সামন্ততান্ত্রিক যুগের চিহ্ন বিলুপ্ত হয়েছে । প্রকাণ্ড হোটেল ও পান্থনিবাস হয়েছে ভ্রমণকারী ও তীর্থযাত্রীদের জন্য। স্তালিনের জন্মভূমি বিশ্বমানবের মুক্তিকামীদের তীর্থক্ষেত্র ছাড়া আর কি?

 ছোট উদ্যান, লাল ও সাদা গোলাপ চারদিকে ফুটে আছে, একদিকে নীল পাইনের গাছগুলি অস্তসূর্যের আলোয় পুঞ্জ পুঞ্জ নীলমেঘের মত স্থির হয়ে আছে। তারি সম্মুখে চতুষ্কোণ মর্মরবেদী, মর্মর স্তম্ভের ওপর কাঁচের ছাদের নীচে পাশাপাশি দুটো জাফরী ইটের তৈরী ছোটঘর। একটাতে থাক্‌তেন ভাড়াটে রূপে ভিসারিয়ান-দম্পতি। একজন চর্মকার, অপর কৃষক-দুহিতা। অপর ঘরটি ছিল বাড়ীওয়ালার। দরিদ্র শ্রমিকের এই কুটিরে জননী ক‍্যাথারিনা ১৮৭৯ সালের ২১শে ডিসেম্বর চতুর্থ সন্তান স্তালিনকে প্রসব করেন। পর পর তিনটি সন্তান সুতিকাগারেই মারা যায়। এটি বাঁচলো। পিতার ইচ্ছা পুত্রকে একজন উত্তম চর্মকার রূপে গড়ে তোলা, মার ইচ্ছা তাঁর পুত্র লেখা পড়া শিখে পাদ্রী হবে। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ বিধান অন্যরূপ। বহুনিন্দিত বহুবন্দিত স্তালিন আজ বিশকোটি বন্ধন মুক্ত নরনারীর নেতা গুরু উপদেষ্টা, সর্বদেশের মানবমুক্তিকামীদের শ্রদ্ধেয় দিশারী!

 সেই তক্তপোষ মলিন বিছানা কাঠের তোরঙ্গ টেবিলের ওপর কিছু সাধারণ ভোজ্য পাত্র জলের জগ আর কেরোসিনের বাতি। নরকেশরী স্তালিনের জন্মস্থান, সম্ভ্রমে মাথা নত হ’ল, যুক্তকর অজ্ঞাতসারেই করল ললাট স্পর্শ। বাঙ্গলা ভাষায় স্তালিনের জীবন-চরিত লেখকরূপে এ আমার জীবনে এক দুর্লভ সৌভাগ্য। বহুবর্ষ পূর্বে গোরক্ষপুর থেকে শালবন ঘেরা লুম্বনীতে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান দেখে যে ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, তেমনি ভাবাবেগে হৃদয় কানায় কানায় ভরে উঠ্‌লো । আড়াই হাজার বৎসর ব্যবধানে দুই পৃথক মতবাদ ও আদর্শ নিয়ে মানব মুক্তিকামী দুই মহাপুরুষের অভ্যুদয়। বুদ্ধদেবের মহিমা কীর্তন করে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল গেয়েছিলেন “আজিও জুড়িয়া অর্ধ জগত ভকতি প্রণত চরণে যার।” আমি যদি এ কথা বলি বিংশ শতাব্দীতে অর্ধজগত জীবিত স্তালিনকে বন্দনা করে তবে তা নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না। প্রভাতের ভানু আর মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডে প্রভেদ থাক্‌লেও যোগ আছে ।

 বুদ্ধদেব ও স্তালিনের নাম এক সঙ্গে উচ্চারণ করলে আমাদের দেশে অনেকের কানে তা, বেসুরো শোনাবে এ আশঙ্কা আমার মনে আছে। সে সময়ে আমার মনে যে ভাবের উদয় হয়েছিল তা অসঙ্কোচে খুলেই বলি। মানব-সভ্যতার শৈশব থেকে সমাজ স্থিতির কতকগুলো ‘আইডিয়া’ (ধারণা?) সভ্যতার গতিপথের নিয়ামক । এর বিকাশ ও বিস্তারের ধারায় যতই বৈচিত্র্য থাকুক, স্ব-স্বরূপে অনিত্য সংসারে এটা নিত্যবস্তু। বৈষ্ণব পদকর্তা বলেছেন, “স্বরূপ বিহনে রূপের জনম কখনো নাহিক হয়।” সমাজের বিবর্তনে রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থ নৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের মূলে একটা ‘আইডিয়া’ কাজ করছে। আইডিয়া মানসলোক থেকে বাস্তব ক্ষেত্রে মূর্তি নেয়, বিলম্বে ও ক্লেশকর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অধিকার ভেদের বিরুদ্ধে, মানুষের লোভ ও দুর্বুদ্ধির বিরুদ্ধে নৈতিক সংগ্রাম যুগে যুগে রূপ থেকে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রাচীন যুগে যা ছিল আধ্যাত্মিক হৃদয়াবেগ, বর্তমান যুগে তাই বস্তুতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রবাদ। বেদের ভাষায়, “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।”

 বাগানের বেঞ্চে বসে দেখছি, নানাদেশের নরনারী এসেছে স্তালিনের জন্মভূমি দেখতে। তীর্থদর্শনের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যাবার জন্য ফটো তোলাচ্ছে; তিন জন ফটোগ্রাফার বেশ দু’পয়সা রোজগার করছে। আমাদের দেশে এবং সব দেশেই এমন আগ্রহ লোকের আছে । রোমে সেণ্ট পিটার্স চার্চেও দেখেছি তীর্থযাত্রীরা চার্চের পরিপ্রেক্ষিতে ফটো তোলাচ্ছে। আমরাও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। মানব প্রকৃতি সর্বত্রই একরকম। আমরা যে ভাব নিয়ে পুরী কাশী বৃন্দাবন যাই সেই ভাব নিয়ে এরাও এসেছে সুবৃহ সোবিয়েত ইউনিয়নের নানা প্রান্ত থেকে।

 পাশেই স্তালিন ম্যুজিয়ম। স্তালিনের ছাত্রজীবন ও পরিণত বয়সের অনেক নিদর্শন সাজিয়ে রাখা হয়েছে, ফটো ও ছবি প্রচুর। কিশোর বয়সে স্তালিন কবিতা লিখ্‌তেন এটা জানা ছিল না। প্রেমের কবিতা নয়, দেশপ্রেমের কবিতা। পরাধীনতার বেদনা ও জর্জিয়ান জাতীয়তাবাদ তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।

 স্থানীয় হোটেলে ভোজের আয়োজন। গোরীর লেখক ও কবিরা এসেছেন, শ্রমিকসঙ্ঘের নেতারাও আছেন। রকমারী সুস্বাদু সুরা এবং প্রচুর অন্ন-ব্যঞ্জনের সমাবেশ। তার চেয়েও বেশী উচ্ছ্বসিত বক্তৃতা। ভারত ও সোবিয়েতের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করলেন একাধিক বক্তা। আমরাও কম গেলাম না। বহুদিন পর গৃহাগত প্রিয়জনকে দেখে যে আনন্দ হয়, এরা যেন সেই আনন্দে আত্মহারা। জর্জিয়া ও ভারত, হাজার হাজার বছর আগে আমাদের পিতৃপরিচয় একই ছিল, সে নাড়ীর যোগ এখনো রয়েছে।