পনর

 ১৭ই জুলাই। মস্কৌ থেকে সকাল ৮টায় বিমান ছাড়ল। খারখোভ রস্টভ ছেড়ে বিমান চলেছে; নীচে কৃষ্ণসাগরের নীলজল। সোকোনিতে বিমান থামল। চা পানের পর ককেসাস পর্বতমালার ওপর দিয়ে অপরাহ্ণ ৭টায় বিমান জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসি বিমান ঘাঁটিতে নামল। স্থানীয় লেখকসঙ্ঘ যথারীতি অভ্যর্থনা করলেন।

 চারিদিকে পর্বতমালা বেষ্টিত উপত্যকায় অসমতল তিবলিসি শহর, মাঝখান দিয়ে খরস্রোতা কুরা নদী এঁকে বেঁকে চলেছে; তার দু’পাশে ফার পপলার চেনার পাইন গাছের সার, মাঝে মাঝে বাগান, নানা রংয়ের অজস্র ফুল। এ কোন স্বপন পুরীতে প্রবেশ করলাম। চওড়া পরিচ্ছন্ন রাস্তা, উজ্জ্বল স্নিগ্ধ-ভাতি বিদ্যুতালোকে চারিদিক প্রসন্ন। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি, যদি সুউচ্চ সৌধমালা চারিদিকে না থাকতো তা হ’লে দার্জিলিং বলে ভ্রম হত। পুনা ও হায়দ্রাবাদ হাত ধরে মিলে মিশে দাঁড়িয়েছে, একথা বললেও এ সুন্দরী নগরীর তুলনা হয় না। সম্মুখে পাহাড়ের চূড়ায় প্রমোদভবন আলোয় আলোময় হয়ে শোভা পাচ্ছে।

 ধ্যান ভেঙ্গে গেল, কমরেড অকসানা দেবী ডাকছেন, পাশ্‌লি পাশ্‌লি, অর্থাৎ ত্বরা করো।  হোটেলের একতালায় একটি ভোজন কক্ষ। সুসজ্জিত টেবিলে নানাবিধ খাদ্য ও মদ্যের সমাবেশ। জর্জিয়ার প্রাচীন প্রথা অনুসারে ভোজসভার একজন নেতা নির্বাচন করতে হয়। জর্জিয়ার লেখকসঙ্ঘের সভাপতি কবি গেয়রগি লিওনিট্‌সে (Georgi Leonitze) ভোজসভার সভাপতি অর্থাৎ “তামাদা” নির্বাচিত হলেন। এ দেশের নিয়ম খাদ্য পানীয় সম্পর্কে তামাদার নির্দেশ যথাসাধ্য পালন করতে হবে। লিওনিট্‌সে ‘শালপ্রাংশু মহাভূজ পুরুষ’ প্রশস্ত ললাটের নীচে উজ্জ্বল নীলচক্ষু, সুগঠিত দেহে যৌবনের প্রাচুর্য। জর্জিয়া আঙ্গুর ও অন্যান্য ফলের উৎকৃষ্ট সুরার জন্য প্রসিদ্ধ। জর্জিয়ার ‘স্যাম্পেন’, ফ্রান্সের পৃথিবী বিখ্যাত স্যাম্পেনের চেয়ে কোন অংশে নিকৃষ্ট নয়। ভোজন আরম্ভ হ’ল। বারম্বার ‘স্বাস্থ্যপান’ এবং পানপাত্র এক চুমুকে নিঃশেষ করতে হবে। এখানে ভোজসভা এক বিরাট ব্যাপার, সন্ধ্যায় আরম্ভ হয়ে শেষরাত্রি পর্যন্ত পান ভোজন নৃত্য গীত বিরামহীন ভাবে চলে। গল্প শুনলাম, কোন গ্রামে এক ‘তামাদা’ তিন দিন তিন রাত সমানে ভোজসভায় নৃত্য গীত চালিয়েছিলেন। আমাদের ‘তামাদা’ এতটা নিষ্ঠুর না হলেও সহজে রেহাই দিলেন না; রাত্রি এগারটায় নিয়ে গেলেন পর্বতচূড়ার ওপরে এক সুরম্য প্রমোদ নিকেতনে। আবার ভোজসভা বসল, নিস্তেজ সুরভিত সুমিষ্ট সুরা। তবুও সুরা তো বটে! আমাদের ‘তামাদা’ এবং জর্জিয়ান লেখকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ‘স্বাস্থ্যপান’ আমাদের সাধ্যাতীত। আমরা কৌশলে সুরার পরিবর্তে গ্লাসে লিমোনেড ঢেলে ওঁদের ‘স্বাস্থ্যপানে’ আহ্বান করতে লাগলাম। ‘তামাদা’ মিটমিট করে চাইলেন, কিন্তু হটবার পাত্র তিনি নন। আমাদের লিমোনেডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি ‘স্যাম্পেন’ দিয়ে পানপাত্র পূর্ণ করতে লাগলেন। রাত্রি একটায় সভা ভাঙ্গলো, চরাচর পরিব্যাপ্ত চন্দ্রালোক আকাশে মোহ রচনা করেছে, নিম্নে আলোকমালামণ্ডিত তিবলিসি নগরী।

 তিবলিসি প্রায় হাজার বছরের পুরাতন সহর। সহরতলীতে সূতা কাপড় ইস্পাত ও জলবিদ্যুতের কারখানা গড়ে ওঠায় লোক সংখ্যা বেড়ে প্রায় তিন চার লাখ হয়েছে। সহরে জর্জিয়ান ছাড়াও রুশ আর্মেনিয়ান তাজিক তুর্কী কাজাক প্রভৃতি মধ্যএশিয়ার নানা জাতির লোক দেখতে পাওয়া যায়। গির্জা মসজিদ এবং প্রাচীন প্রাসাদ-দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া পুরাতন নিদর্শন কম। এখন বাড়ী ঘর রাস্তা সবই আধুনিক। এর কারুকার্য, দেয়ালচিত্র আসবাবপত্রে জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ছাপ আছে। জর্জিয়ানরা জাতীয় সাহিত্য ও শিল্পের অনুরাগী, সুপ্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী বলে গর্ববোধ করে থাকে।

 উত্তর পশ্চিম এশিয়ায় জর্জিয়া একটি ক্ষুদ্র দেশ। ১৮ হাজার ফুট উঁচু ককেসাস পর্বতমালার তরঙ্গায়িত কোলে কোলে অপূর্ব শোভাময় উপত্যকায় ভরা জর্জিয়ার উর্বর ভূমি কৃষ্ণসাগরের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানেই বাকুর বিখ্যাত তেলের খনি, এ ছাড়া নানাস্থানে ম্যাঙ্গানিজ তামা ও লোহার খনি আছে। সোবিয়েত আমলে তিবলিসিতে প্রকাণ্ড ইস্পাতের কারখানা গড়ে উঠেছে।

 সাহসী অতিথিবৎসল পরিশ্রমী বুদ্ধিমান সুগঠিত দেহ আর্য বংশীয় জর্জিয়ান জাতির দু’হাজার বছরের ইতিহাস—রাজ্য ও সাম্রাজ্য ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাস। সম্রাট আলেকজেণ্ডার, বাইজানটাইন, চেঙ্গিস খাঁ, তিমুর প্রভৃতি দিগ্বিজয়ীদের চতুরঙ্গবাহিনী এদেশে প্রবেশ করেছে, তাদের ধ্বংসলীলার কাহিনী এরা ভোলেনি। যুগে যুগে এরা স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছে। এদের লোক-সঙ্গীত, ও গাঁথার মধ্যে পূর্বপুরুষের সেইসব বীরত্ব কাহিনী ছড়িয়ে আছে। দশম শতাব্দীর কবি রুস্তাভেলীর কাব্যে গল্প আছে এক ভারতীয় রাজকন্যা জর্জিয়ার রাণী ছিলেন। গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে জর্জিয়াকে রুশ সাম্রাজ্য গ্রাস করে। শতাব্দীর শেষভাগে ক্রাইমিয়ার যুদ্ধের সময় জর্জিয়ানরা বিদ্রোহ করেছিল। জার গভর্নমেণ্ট নিষ্ঠুর অত্যাচারে সে বিদ্রোহ দমন করে ফেলেন। প্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী এই নিপীড়িত পরাধীন জাতির মধ্যেই মানবমুক্তির পুরোধা স্তালিনের আবির্ভাব।

 তিবলিসিতে প্রথমেই চোখে পড়লো, পুরুষেরা বসন ভূষণে একদম ইয়োরোপীয়, তবে সাধারণতঃ ‘টাই’ পরে না। মেয়েদের বসনে সাজসজ্জায় প্রাচ্যের অলঙ্কার প্রিয়তা আছে। প্রসাধনে মস্কৌএর নারীদের চেয়ে এরা বেশী সজাগ। খাদ্যের বেলায় এরা প্রাচ্যই আছে, আমাদেরই মত মশলা ব্যবহার করে, কাঁচা লঙ্কা ও কচি পেঁয়াজ খাবারের টেবিলের শোভাবর্ধন করে। রান্নায় ইরানী প্রভাব আছে, পোলাও ও কাবাব (শাসলিক) যথেষ্ট। এদের বাড়ীঘর আসবাবপত্র শিল্পকলায় ইরানী-সংস্কৃতির ছাপ সুস্পষ্ট। পরাধীনতা এবং তার ফলে দারিদ্র্য অশিক্ষা কুসংস্কার এবং সামন্তযুগের দাসত্বের পাঁক থেকে এরা মাত্র পঁচিশ বছর হলো উদ্ধার পেয়েছে, এবং আজ এদের দেহে মনে পুরাতন গরিবী ও ভীরুতার কোন ছাপ নেই।

 সর্বত্র যেমন এখানেও তেমনি শিশুপালনাগার কিণ্ডারগার্টেন হাসপাতাল সংস্কৃতিভবন সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিচালিত। জর্জিয়ার লোক সংখ্যা ৩৩ লক্ষের মত, অথচ এদের বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস আকারে আয়তনে সাজসজ্জায় ভারতের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা বড়। জর্জিয়ার শিক্ষামন্ত্রী বললেন, এঁদের রাজস্বের অর্ধেক শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। আমাদের বৃহৎ কারখানার আয় থেকে স্বাস্থ্য ও লোকহিতকর কাজ করা হয়, কাজেই শিক্ষার জন্য এত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। পুলিশের ব্যয় রাজস্বের শতকরা সাত ভাগ মাত্র!

 প্রথমরাত্রে যে পাহাড়ের চূড়ায় প্রমোদভবনে আমরা মোটরে গিয়েছিলাম, সেই পাহাড়ে স্বতন্ত্র পথ দিয়ে ইলেকট্রিক রেলে (Finicular Railway) ওঠা গেল। সোজা খাড়া ওপরে উঠে যায়, গা শির শির করে। ট্রেন থেকে নেমে ডান দিকে অগ্রসর হলাম। ষষ্ঠ শতাব্দীর পুরাতন গীর্জা। অনেক মূর্তি ও দেয়ালচিত্র আছে। এর প্রাঙ্গণে কবি ও লেখকদের সমাধি। এক পাশে আচ্ছাদনহীন কৃষ্ণমর্মর পাথরে রচিত স্তালিন জননীর সমাধি। ইনি অত্যন্ত সাদাসিধে ভাবে তিবলিসিতেই বাস করতেন। ১৯৩৭ সালে অতি বৃদ্ধা হয়ে ইনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 এই তিবলিসি সহরেই খৃস্টান পাদ্রীদের বিদ্যালয়ের ছাত্র স্তালিন মার্কসবাদে দীক্ষা লাভ করেন। শ্রমিকদের বৈপ্লবিক সংস্থা গঠন করবার ভার নিয়ে তিনি ১৮৯৪ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত শ্রমিকদের মধ্যে কাটিয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, জেল থেকে পালিয়ে পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে বলশেভিক মতবাদ প্রচার করেছেন। ১৯০৩ সালে জেল থেকে পালিয়ে এসে স্তালিন এক গুপ্ত ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে নিষিদ্ধ পুস্তক, সাময়িক পত্র, ইস্তাহার প্রভৃতি প্রকাশ করা হ’ত। পুলিশ দু’বছর পাগলের মত ছাপাখানাটি খুঁজেছে। রাশিয়ান জর্জিয়ান আর্মেনিয়ান আজার বাইজান নানা ভাষায় এখান থেকে বই, সাময়িক পত্র প্রকাশিত হ’ত। আমরা এই গুপ্ত ছাপাখানাটি দেখলাম। একটি সত্তর ফুট গভীর কূপের মাঝামাঝি সুরঙ্গ কেটে বাড়ীর তলায় গর্ভগৃহ রচনা করা হয়েছিল। দড়ীর পুলী মৈ-এর সাহায্যে কর্মীরা যাতায়াত করতেন। হাতে চালানো ছাপাখানা এবং বিভিন্ন ভাষার হরপ ছিল। ১৯০৬ সালের ১৫ই এপ্রিল জারের পুলিশ ছাপাখানা আবিষ্কার করে। এ বাড়ীটা এখন ম্যুজিয়ম।

 তিবলিসি সহর যন্ত্রশিল্পের এক প্রধান কেন্দ্র । আমরা একটা সূতো ও মোজা গেঞ্জীর কারখানা দেখলাম। দেখলাম শ্রমিকদের আবাস বিশ্রাম ভবন শিশুপালনাগার । সমস্ত দিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, একটা বৃহৎ বাগানে গেলাম বিশ্রাম করতে। বেলা পড়ে এসেছে, দলে দলে নরনারী আসছে, সঙ্গে ছেলেমেয়েরা। নানাস্থানে ছেলেদের খেলার জায়গা, কোথাও নাচগান হচ্ছে। এ যেন একটা আনন্দমেলা— জীবনের পরিপূর্ণ প্রাচুর্য চারিদিকে ঝরণার জলের মত ছড়িয়ে পড়ছে।

 এই বাগানে ছোটদের দু’মাইল লম্বা একটা রেলপথ আছে। ১৯৩৫ সালে এটি তৈরী হয়। দু’তিন জন বয়স্ক পরিদর্শক আছেন, কিন্তু টিকিট বিক্রেতা স্টেশন মাস্টার গার্ড কনডাকটার ইঞ্জিনচালক সকলেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। গাড়ী ও ইঞ্জিন আকারে প্রায় শিলিগুড়ী দার্জিলিং লাইনের গাড়ীর মত। জমকালো ইউনিফর্ম পরা ছোটদের ভারিক্কীচালে কাজকর্ম দেখে আমরা কৌতুকবোধ করলাম। এক রুবল ভাড়ায় যাতায়াত হয়, মাঝে চারটি স্টেশন। আমরা গাড়ীতে উঠে বস্‌লাম, যাত্রীর মধ্যে ছেলেমেয়ে বেশী হলেও বয়স্ক নরনারীর অভাব নেই। বাঁশী বাজিয়ে গাড়ী ছাড়লো, একটি কিশোরী কনডাকটার গম্ভীর মুখে টিকিট পরীক্ষা করল। রেলওয়ে পরিচালনা ছেলেবেলায়ই হাতে কলমে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু ভারী মজার খেলা বলে মনে হ’ল।