চৌদ্দ

 মস্কৌর উপকণ্ঠে লেনিন পর্বতের ওপর নির্মীয়মাণ নূতন বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৯-এর ফেব্রুয়ারী মাসে কাজ আরম্ভ হয়েছে, ১৯৫২-এর ডিসেম্বর মাসে কাজ শেষ হবে। এত দ্রুত একটা গোটা নগর শুদ্ধ সুবিশাল অট্টালিকা তৈরী, সোবিয়েত ইঞ্জিনিয়র ও শ্রমিকদের প্রশংসনীয় কৃতিত্ব। আমরা দেখলাম, মোটামুটি কাজ শেষ হয়ে এসেছে। প্রধান স্থপতি তাঁর কার্যালয়ে আমাদের পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে দিলেন। কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ষোল শ’ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠছে। কেন্দ্রীয় বিভাগটি ৩৬ তলা উঁচু। মস্কৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো বাড়ী থেকে বিজ্ঞানের ছয়টি বিভাগ এখানে সরিয়ে আনা হবে। কেন্দ্রে থাকবে খনিবিজ্ঞান ভূ-বিজ্ঞান যন্ত্র-বিজ্ঞান গণিত ও ভূগোল বিভাগ, পাশের বাড়ীগুলোতে পদার্থবিদ্যা রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। একটা বিশেষ বাড়ী তৈরী হচ্ছে যেটা মানমন্দির বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণাগার। বিজ্ঞানের গবেষণা ও অগ্রগতির জন্য এই বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠায় প্রথম কিস্তীতে সোবিয়েত সরকার তিন কোটি রুবল ব্যয় করেছেন। এই আবাসিক বিদ্যালয়ে ছয় হাজার ছাত্র ও দু’শ’ অধ্যাপক থাকবেন। আমরা এর নমুনা দেখলাম। ছাত্রদের কক্ষগুলিতে পড়াশোনা বিশ্রাম ও সংলগ্ন স্নানাগারের ব্যবস্থা; আর অধ্যাপকদের জন্য সুদৃশ্য আসবাবে সজ্জিত তিনখানি ঘর স্নানাগার, রন্ধনশালা বৈদ্যুতিক চুল্লী প্রভৃতি।

 এ ছাড়া বার লক্ষ খণ্ড পুস্তক সমন্বিত লাইব্রেরী, যন্ত্রচালিত টিউবের মধ্য দিয়ে কোন বই চাইবার দশ মিনিটের মধ্যে ছাত্র ও অধ্যাপকদের টেবিলে এসে পৌঁছবে। দু’শো নব্বই বিঘে জমির ওপর তৈরী হচ্ছে বোটানিকেল গার্ডেন। দেশদেশান্তরের তরুলতার সমাবেশ ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষণার ব্যবস্থা। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের সাজ সরঞ্জামের বিবরণ শুনতে শুনতে প্রধান স্থপতিকে বললাম, ‘আপনাদের প্রত্যেক পরিকল্পনাই বৃহৎ।’ তিনি হেসে বললেন, ‘রাশিয়া বৃহত্তর।’

 শুনলাম আগামী বছরেই কাজ আরম্ভ হবে। কোরিয়া ও চীন থেকে ছয় শত ছাত্র ছাত্রী যোগদান করবে। ভারতীয় ছাত্ররা এখানে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর তিনি হেসে বললেন, নিশ্চয়ই পারে। আমরা তো সব দেশের ছাত্র গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু বাধা আছে। প্রথম বাধা তোমাদের দেশে এক জন গ্রাজুয়েট যে পরিমাণ ইংরেজী শেখে, ততটা রুশ ভাষা শেখা দরকার। আমাদের অধ্যাপকরা ইংরেজী জানেন না। দ্বিতীয় বাধা, তোমাদের গভর্নমেণ্ট জোয়ান ছেলেমেয়েদের কি এদেশে আসতে দেবে? শেষের বাধার উত্তর দেওয়া কঠিন। প্রথম বাধার কথা শুনে আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিতরা উচ্চ হাস্য করবেন। ইংরেজী জানে না; তা হলে অধ্যাপক হতেই পারে না। এমন কথা বললে এদেশের শতকরা ৯৯ জন সায় দেবে। মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা হতে পারে, এ কথা বলতে সাহস হয় না। পাঠশালায় ওটা চলতে পারে কিন্তু কলেজে অচল। পরের ভাষায় জ্ঞানলাভের সাধনা পৃথিবীর কোন স্বাধীন দেশে নেই। মাতৃভাষা এদেশে এতই অবজ্ঞেয় যে, ইংরেজী জানি না একথা বলা অপরাধ। রাশিয়ার নামজাদা সাহিত্যিকদের দেখলাম, ইংরেজী জানেন না একথা বলতে আমাদের মত লজ্জায় তাদের কর্ণমূল আরক্তিম হয়ে ওঠে না। সম্প্রতি আমাদের দেশে উত্তর ভারতের গ্রাম্য কথ্যভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বলে চালাবার উৎসাহ দেখছি। পণ্ডিত ব্যক্তিরা হায় হায় করছেন, স্কুল কলেজে ইংরেজী শিক্ষা না দিলে শিক্ষাই লোপ পাবে। এদের কুযুক্তির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ইংরেজী হোটেলওয়ালার দোকান ছাড়া আর কোথাও দেশের লোকের পুষ্টিকর অন্ন মিলবেই না এমন কথা বলাও যা আর ইংরেজী ভাষা ছাড়া মাতৃভাষার যোগে জ্ঞানের সম্যক সাধনা হতেই পারবে না এও বলা তাই।’

 হিন্দী বা হিন্দুস্থানীকে নিখিল ভারতীয় রাষ্ট্রভাষারূপে মেনে নেয়া হয়েছে এতে আপত্তি করিনে, কিন্তু প্রাদেশিক প্রাচীন ও বেগবান ভাষাগুলিকে কোণঠাসা করে হিন্দী চালাবার উদ্যম দেখে দুঃখ পাই। অন্ততঃ আমাদের প্রতিবেশী বিহার প্রদেশে এই চেষ্টা চলছে। বঙ্গ ভাষাভাষীদের বিদ্যালয়গুলির ওপর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, হিন্দীর মাধ্যমে ইতিহাস বিজ্ঞান গণিত ভূগোল প্রভৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে সরকারী সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। পুরুলিয়ায় একটি পুরাতন মেয়েদের ম্যাটিক স্কুলের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতার মোহ এতই প্রবল! মাতৃস্তন্য যেমন শিশুর পক্ষে তেমনি মাতৃভাষা জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশ ও পুষ্টির জন্য আবশ্যক। বহু ভাষাভাষী ভারত এ ব্যাপারে রাশিয়ার দৃষ্টান্ত গ্রহণ করবে। আমি এখনও এই আশা পোষণ করি।

 রুশ ভাষা সকলেই শেখে; কিন্তু বিদ্যালয় থেকে কলেজ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষাতেই এখানে শিক্ষার ব্যবস্থা। জর্জিয়ার তিবলিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখলাম উচ্চশিক্ষা জর্জিয়ান ভাষাতেই দেওয়া হয়। জর্জিয়ানদের মাতৃভাষা প্রীতি এত প্রবল যে তারা নিজেদের মধ্যে জর্জিয়ান ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলে না। রুশদের সঙ্গে এরা রুশভাষায় কথা বলে; কিন্তু বিদেশীদের সঙ্গে কথা বলতে মাতৃভাষায় কথা বলে, তা ইংরেজীতে অনুবাদ করে আমাদের দোভাষীকে বোঝাতে হয়েছে। উজবেকিস্তানেও এই দেখলাম। উজবেকদের লেখ্য ভাষার বয়স মাত্র পঁচিশ বৎসর এখানেও পঠন পাঠন উজবেক ভাষায় হয়, বহু রুশ জার্মান ফরাসী সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শনের বই উজবেক ভাষায় অনুদিত হয়েছে।