তের

 ১৫ই জুলাই বেলা এগারটায় স্তালিনগ্রাদ থেকে বিদায়। অনায়াস নৈপুণ্যে বিমান ঊর্ধ্বলোকে উঠে গেল, বায়ুমণ্ডল নিথর, পৃথিবী মেঘে ঢাকা। আমরা শীতার্ত হয়ে উঠ্‌লাম। ধুতি পিরাণের ওপর কম্বল চাপিয়ে বসে রইলাম। চার-ঘণ্টার মধ্যে মস্কৌ এসে গেলাম। এখানে এসে দেখি বেজায় গরম পড়েছে। অর্দ্ধশতাব্দীর মধ্যে আজ উষ্ণতম দিন। এক জন হেসে বললেন, তোমরা ভারতীয় গরম নিয়ে এসেছ।

 বেতার কেন্দ্রে গিয়ে স্তালিনগ্রাদের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটা বাঙ্গলা বক্তৃতা দিয়ে হোটেলে ফিরেই শুনলাম, টাস এজেন্সীর কয়েকজন সাংবাদিক আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। তাঁদের প্রশ্নের উত্তরে আমরা স্ব স্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম। এই প্রসঙ্গে আমি বল্‌লাম, ‘সবই দেখলাম, কেবল বহুল প্রচারিত “লৌহযবনিকার” সাক্ষাৎ মিললো না। মনে হয় ও-বস্তুটি রাশিয়ায় নেই, আছে রুশবিদ্বেষীদের মগজে।’ পরদিন প্রাবদায় ঐ বিবরণ প্রকাশিত হয়, ‘রয়েটার’ এটা লণ্ডন থেকে ভারতেও প্রচার করেন। দেশে ফিরে শুনলাম, এ নিয়ে কোন কোন সংবাদপত্রে আমাকে বিদ্রুপ ও আক্রমণ করা হয়েছে। একটু রং চড়িয়ে কেউ লিখেছেন, মস্কৌএ পৌঁছেই আমি নাকি ঐ বিবৃতি দিয়েছি। সত্যের প্রতি কিছুটা নিষ্ঠা থাকলে তাঁরা দেখতেন আমাদের মস্কৌ আসার অন্ততঃ তিন সপ্তাহ পরে আমি ঐ মন্তব্য করি, এবং দেশে ফিরে বহু জনসভায় এ কথা বলেছি।

 ‘লৌহ-যবনিকা’ কথাটি নানা উদ্দেশ্যে এবং নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়।

 প্রথম অভিযোগ— ওরা কতকগুলি পূর্ব-নির্দিষ্ট স্থান ও প্রতিষ্ঠান দেখায়। স্বাধীনভাবে কিছুই দেখবার উপায় নেই। আমন্ত্রিত প্রতিনিধিদের ‘কনডাক্‌টেড টুর’ ব্যবস্থায় সত্যিকার রাশিয়ার জনজীবন আড়ালেই থেকে যায়।

 উত্তর— অল্প সময়ের মধ্যে দলবেঁধে বেশী দেখতে হলে, সর্বত্রই এমনি ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হয়। এক নিশ্বাসে যারা ইয়োরোপ বা ভারত ভ্রমণ করেন, তাঁরাও টমাস কুক বা ঐ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বাঁধা-ধরা স্থানগুলি দেখেন। রোমে আমার এ-অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু এখানে ব্যবস্থা স্বতন্ত্র। পূর্বদিন রাত্রে আমরা আলোচনা করে দ্রষ্টব্য স্থান বা প্রতিষ্ঠান ঠিক করে নিতাম। সেই অনুযায়ী এঁরা যানবাহনের ব্যবস্থা করতেন, সঙ্গে দোভাষী দিতেন। চোখকান খোলা থাক্‌লে সহর ও পল্লীর জনজীবন বোঝা বিশেষ কিছু শক্ত নয়। রূপকথার গল্পের মত এরা চোখবেঁধে আমাদের রহস্যময় পুরী দেখাতে নিয়ে যায়নি। সমাজতান্ত্রিক সভ্যতার নবসৃষ্টিকে এরা গর্বের সঙ্গে বিদেশী অতিথিদের দেখাবার জন্যই আমাদের আমন্ত্রণ করেছিল। এরা রেখে ঢেকে দেখাচ্ছে বা সাজিয়ে-গুছিয়ে দেখাচ্ছে, এমন সন্দেহ করবার কোন কারণ আমি খুঁজে পাইনি। আলাপ করে দেখেছি, বৃটিশ কোয়েকার, নরউইজীয়ান ও আমেরিকান শ্রমিক প্রতিনিধিরাও এ বিষয় একমত। তারাও দেশে ফিরে লৌহযবনিকার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন।

 দ্বিতীয় অভিযোগ— বিদেশীদের রাশিয়ায় প্রবেশ সম্বন্ধে ওদের কড়াকড়ি ও সন্দেহ অত্যন্ত প্রবল।

 উত্তর— এ অভিযোগটা ওরাও অস্বীকার করে না। মনে রাখতে হবে ধনতান্ত্রিক জগতের বৈরিতা ও বয়কট সোবিয়েত ভূমিষ্ট হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত সমান প্রবল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানীর শক্ত পাল্লায় পড়ে ততোধিক শক্তিমান সোবিয়েত রাশিয়ার প্রেমে যাঁরা ডগমগ হয়ে উঠেছিলেন, ফাঁড়া কেটে যাবার পর তাঁরাই সুর ঘুরিয়ে ফেলেছেন। সমগ্র ইয়োরোপ ‘লাল’ হয়ে গেল বলে ধনতন্ত্রীদের আর্তনাদ ও সোবিয়েত বিদ্বেষ ১৯৪৭ থেকেই শুরু হয়েছে। এতে রুশদের চিত্ত প্রীতি প্রসন্ন ঔদার্যে ভরে উঠ্‌বার কথা নয়। ধনতন্ত্রীদের গুপ্তচর ও স্পাই ইনফরমার সম্বন্ধে এরা সজাগ এবং ধ্বংসাত্মক কাজ সম্বন্ধে সতর্ক। সাংবাদিকের ছদ্মবেশে গুপ্তচরবৃত্তির অনেক প্রমাণ এরা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক হৃদ্যতার আদান-প্রদান পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে জানবার ও বুঝবার ওপর নির্ভর করে। বর্তমান জগতে তা দুর্লভ।

 তৃতীয় অভিযোগ— লৌহ-যবনিকার অন্তরালে এরা কোটি কোটি লোককে বন্দীশিবিরে রেখে কৃতদাসের মত খাটায়, উরাল অঞ্চলে বা সাইবেরিয়ার জঙ্গলে এমন অমানুষিক ব্যবস্থা আছে।

 উত্তর— রাশিয়ার শ্রমিক সাধারণের স্বচ্ছলতা, সম্মান ও মর্যাদা যা চোখে দেখেছি, তাতে এমন ব্যাপার অসম্ভব। যা মিথ্যা নিন্দা, যুক্তি দিয়ে তা খণ্ডন করা যায় না।

 চতুর্থ অভিযোগ— ওরা ‘লৌহ-যবনিকার’ আড়ালে বিশ্বজয়ের দুরাশা নিয়ে বিপুল সামরিক বল গড়ে তুলছে।

 উত্তর— এটা ঈসপের গল্পের মেষশাবককে হত্যা করার নেকড়ে বাঘের যুক্তি। শত বর্ষ পূর্বে কবি হেমচন্দ্র লিখেছিলেন, “হোথা আমেরিকা নব অভ্যূদয়, পৃথিবী গ্রাসিতে করিছে আশয়।” তার প্রকট মূর্তি আজ তো প্রত্যক্ষ। নবীন ইয়োয়োপ, পুরাতন ইয়োরোপের সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারী হবার আশায় ইয়োরোপ এশিয়াময় দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছেন, তার একটা যুক্তি আবিষ্কার করবার জন্য ‘লৌহ-যবনিকাটা’ পাকাপোক্ত করা দরকার। আপাদমস্তক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে এরা সব দেশেই ঢুকেছেন। প্রশ্ন করলে ডান হাতের রাইফেল উঁচু করে, বা’হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা পিঠের পেছনে উঁচিয়ে ধরে বলেন, ঐ যে! ঐ যে কি? বোঝ না, লাল জুজু আসছে। তোমাকে তো বাঁচাতে হবে! আমি নিজেই বাঁচবো, তুমি সরে পড়! বল্লেই হ’ল, যেখানে স্বাধীন জগত বিপন্ন, সেখানে তুমি একা কি করবে? নিজেও মরবে আমাদেরও মারবে। লৌহ-যবনিকার খাঁচায় লাল জুজুকে আটকে রাখতে হলে, ‘প্যাক্ট-যবনিকা’ দরকার।

 আমার স্বদেশে এ সব বালাই ছিল না। আমাদের সদর দরজা হাজার বছর ধরে উন্মুক্ত। গ্রীক যবন, শক হুন তুর্কী পাঠান মুঘল, ইংরাজ ফরাসী পর্তুগীজ, দিনেমার, ওলন্দাজ সকলেই এসেছে। স্বাধীন হবার পরও পশ্চিমাদের প্রবেশদ্বার সর্বদাই উন্মুক্ত। আমাদের পক্ষেও স্বাধীন ভাবে ইয়োরোপ আমেরিকায় যেতে বিশেষ কোন হাঙ্গামা নেই। কিন্তু চীন ও রাশিয়ায় যেতে চাইলেই ‘খাদি যবনিকা’য় ধাক্কা খেতে হয়। আমেরিকা ইংলণ্ডেও সেই দশা। বিশেষ শ্রেণীর লোকের ছাড়পত্র নিয়ে প্রবেশ ও নির্গমন দুইই দুরূহ । সম্প্রতি বার্লিন যুব উৎসবে যোগদানে তরুণ তরুণীদের ছাড়পত্র না দেওয়ার কড়াকড়ি ভারতে বৃটেনে আমেরিকায় আমরা দেখলাম। কাজেই কাঁচের ঘরে বাস করে অপরের প্রতি ঢিল ছোড়া খুব নিরাপদ খেলা নয়। আন্তর্জাতিক রেষারেষিতে নিরপেক্ষ ভারত কোন শক্তি শিবিরে যোগ দেবে না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ জহরলালের ভারতে আসবার জন্য রাশিয়ান প্রতিনিধি দল অনুমতি পায় নি; ভারতীয়দের অনেকেই রাশিয়ায় যাবার অনুমতি পায় না, কিন্তু আমেরিকার বেলায় এমনটি হয় না । যবনিকার পর যবনিকা আছে। তা লোহারই হোক আর যাই হোক।