বার

 স্তালিনগ্রাদে দুটো কারখানা দেখলাম। একটি “রেড অক্টোবর ফ্যাক্টরী” ইস্পাতের কারখানা; আর একটি “ঝেরঝিনস্কী ট্রাকটর ফ্যাক্টরী।” এ দুটোই ধ্বংস হয়েছিল আবার নূতন করে কলকব্জা বসান হয়েছে। ইস্পাতের কারখানাটি খুব বড় নয়, সম্মুখে বাগান রাস্তা, শ্রমিকদের আবাসভবন দেখে, ভল্গার তীরে এদের ‘প্যালেস অফ টেকনিক’ দেখলাম। এক কোটি রুবল ব্যয় হয়েছে এটি তৈরী করতে। এর নাচঘর ভোজনশালা লাইব্রেরী কারিগরী বিদ্যা শিক্ষার কেন্দ্র এবং ৬০০ আসন সমন্বিত নাট্যশালা দেখলাম। শ্রমিকদের সাংস্কৃতিক উন্নতি ও চিত্তবিনোদনের সব রকম ব্যবস্থা। এ ছাড়া কিণ্ডারগার্টেন হাসপাতাল শিশুপালনাগার রয়েছে।

 সহরের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে ট্রাকটর ফ্যাক্টরী। এটিকে কেন্দ্র করে একটা নূতন সহর গড়ে উঠেছে। পথের দুধারে গাছের সার ও বাগান। স্কুলগৃহ আবাসভবন ক্লাব বিপণী ছাড়িয়ে আমরা কারখানার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলাম। আপিস-বাড়ীর দোতালার হলঘরে ডিরেক্টার ও ইঞ্জিনিয়ররা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। জানালা দিয়ে দেখলাম পুরনো কারখানার ধ্বংসাবশেষ। কতকটা অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। নূতন কারখানা ২।৩ বছর হ’ল চালু হয়েছে। ত্রিশ হাজার নরনারী এই কারখানায় কাজ করে। প্রতি পাঁচ মিনিটে এক একখানি নূতন ট্রাকটর বা মোটর চালিত অতিকায় কলের লাঙ্গল কারখানা থেকে বেরিয়ে আসছে। দেখলাম হাজার খানেক নূতন ট্রাকটর দেশের বিভিন্ন কৃষিকেন্দ্রে চালান হবার জন্য প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করছে। রেলের খোলা মালগাড়ীতে এগুলি ক্রেনে করে তোলা হচ্ছে।

 কারখানার ভেতরে প্রবেশ করলাম। এ যেন বিশ্বকর্মার কর্মশালা। বিভিন্ন বিভাগে ঘুর্ণিত বৈদ্যুতিক যন্ত্রে বিভিন্ন অংশ তৈরী হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে জোড়া দেওয়ার কাজও চলেছে; যন্ত্রচালিত ট্রলিতে এগুলি এক বিভাগ থেকে আর এক বিভাগে চলে যাচ্ছে। অবশেষে পুর্ণাঙ্গ ট্রাকটর হয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে আসছে। একটি কলের সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম। ডিরেক্টর বললেন, পূর্বে এটা চালাতে ২৪ জন শ্রমিকের দরকার হত। সোভিয়েত ইঞ্জিনিয়ররা এর এত উন্নতি করেছেন যে, এখন দু’জন শ্রমিকই এটা চালাতে পারে। এই দু’জনের একজন নারী শ্রমিক, তার বুকে দুটো সোনার মেডেল। ইনি সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক হিরোইন। এঁকে প্রশ্ন করলাম, যন্ত্রের উন্নতির ফলে ২২ জন শ্রমিক ছাঁটাই হল; তা হলে যন্ত্রের উন্নতি কি শ্রমিকদের স্বার্থের বিরোধি নয়? উনি বললেন, তা কেন হবে? কায়িক শ্রম লাঘব করা এবং খাটবার সময় কমিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা ২২ জন কমরেডকে নূতন গঠন কাজে যোগ দেবার জন্য মুক্তি দিয়েছি। আমাদের এখানে কাউকে বেকার বসে থাকতে হয় না।

 এখানে শ্রমিক নরনারীরা হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ দেহ, হাড়ভাঙ্গা খাটুনির কোনো লক্ষণ নেই। প্রত্যহ ৮ ঘণ্টার বেশী খাটা আইনত নিষিদ্ধ। এখানে রবিবার নেই। শ্রমিকেরা পালা করে প্রতি ৫ দিন পর একদিন ছুটি পায়। সপ্তাহে একবার করে স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়। বিশ্রাম ও চিকিৎসার দরকার হলে হাসপাতালে পাঠান হয়। বছরে একমাস থেকে পনর দিন ছুটি তখন এরা স্বাস্থ্যনিবাসে চলে যায়, খরচ বহন করে কারখানা। ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার সতর্ক প্রহরী।

 এই কারখানা সংলগ্ন ভল্গানদীর তীরে “প্যালেস অফ কালচার” এক বৃহৎ ব্যাপার। এর ২৬টি বিভাগ। শ্রমিক এবং তাদের ছেলেমেয়েদের সাহিত্য, বিজ্ঞান, যন্ত্রশিল্প, সঙ্গীত নৃত্য বাদ্য চিত্রকলা ভাস্কর্য শিক্ষা দেবার বিভিন্ন বিভাগগুলি আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কিশোর কিশোরীরা আমাদের ব্যাণ্ড বাজিয়ে শোনাল। এর অনতিদূরে শিশুপালনাগার। মায়েরা কাজে যাবার সময় ছেলেমেয়েদের রেখে গেছে। ছ’মাস থেকে তিন বছর বয়সের হাজার খানেক শিশু; কেউ ঘুমুচ্ছে কেউ খেলছে কেউ একাই পুতুল নিয়ে নাড়া চাড়া করছে। সেবিকারা সকলের উপর নজর রাখছেন। এরা তাদেরই ঘরের ছেলেমেয়ে, যাদের না ছিল ধন না ছিল মর্যাদা। আমাদের দেশের স্বচ্ছল ভদ্রশ্রেণীর ছেলেমেয়েরাও এত আদর যত্নে মানুষ হয় না। নবযুগের মানুষ তৈরীর কাজ এরা গোড়া থেকেই সুরু করেছে। স্বামী বিবেকানন্দের Man making religion-এর বাস্তবরূপ দেখলাম। এরা সকলের মধ্যে একই ব্রহ্মের প্রকাশ বাস্তবনেত্রে উপলদ্ধি করেছে।

 যুদ্ধে অনাথ শিশু ও কিশোর কিশোরীদের ভবনে গিয়ে দেখলাম, দয়ার দানে প্রতিপালিত অনাথ আশ্রমের ভীরু বাসিন্দা এরা নয়। এরা অনাথাশ্রম বলে না, বলে শিশুদের প্রাসাদ। আমাদের দেশের দু’চারটে অনাথ আশ্রম দেখেছি; যেখানে অভাগারা ধনীর উচ্ছিষ্টে প্রতিপালিত হয়। কড়া শাসনে পঙ্গু মন নিয়ে নিরানন্দে থাকে। এই বা কয়টি? পথে পথে ভিক্ষা করা, নয় অচিকিৎসায় মরা এই তো সনাতন নিয়ম। এখানে দেখলাম ঠিক উল্টো বলিষ্ঠদেহ হাস্যোজ্জ্বল মুখ বালক বালিকারা আমাদের তাদের পড়ার ঘর শোবার ঘর দেখালো, ক্ষুদে রঙ্গমঞ্চে অভিনয় নাচগান করে খুসী প্রকাশ করলো। এরা পারিবারিক জীবনের ভাগ্য বিপর্যয়ে পরিত্যক্ত আবর্জনা নয়, এরা সমাজের সম্পদ।

 অপরাহ্ণে ভল্গায় মোটর বোটে উঠেছি। কিছু দূর যাবার পর সহরের ওপারে থামলো। সকলে নেমে পড়লাম। খাড়া পাড়, বালি ঠেলে ওপরে উঠলাম। একজন বুড়ী নাতি নাতনী নিয়ে এসেছেন, স্নান করবেন। অনেকেই নেমে পড়লেন জলে। আমিও নেমে পড়লাম। আমার সাঁতারকাটা দেখে তো সকলে অবাক। কমরেড অকসানা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, বেশী দূরে যেয়ো না। কে শোনে কথা! আমি অজ বাঙ্গাল, জল দেখে ভয় পাবো! অনেক দিন পরে সাঁতার আর অবগাহন হ’ল। বোট ফিরে চলেছে, আকাশে চাঁদ উঠলো। আমার স্বদেশের সঙ্গে এর কি কোন তফাৎ আছো?

 তফাৎ আছে বৈকি! এখানে কেবল নদীতে নয়, মানুষের মনের মরা গাঙ্গেও জোয়ার এসেছে। আরো বড় স্তালিনগ্রাদ গড়ার অক্লান্ত উদ্যম চলেছে। এরা যে ভাবে চূড়ান্ত ত্যাগস্বীকার করে স্তালিনগ্রাদকে শত্রু কবল থেকে উদ্ধার করেছে সেই ভাবেই নবসৃষ্টির কঠিন দায়িত্ব নিয়েছে। আর আমার স্বদেশ কর্মনির্দেশহীন বাণীর বন্যাস্রোতে তৃণখণ্ডের মত ভেসে চলেছে, তুলনা করতে গেলে চিত্ত বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

 ত্রিশ বর্গ মাইল জুড়ে নূতন স্তালিনগ্রাদ তৈরী হচ্ছে; ‘সিটি আর্কিটেক্টর’-এর আপিসে গিয়ে তার পরিচয় পেলাম। তিনি নূতন নগর তৈরীর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন। সহরের কেন্দ্রস্থলে তিন বর্গ মাইলের মধ্যে টাউন হল থিয়েটার স্কুল কলেজ হোটেল বাগান রাস্তার নক্সা দেখলাম; ১৯৫৬ সালের মধ্যেই নির্মানকার্য শেষ হবে। ভল্গা নদীর উজানে যে বৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরী হচ্ছে ১৯৫২ সাল থেকে তার কাজ আরম্ভ হবে। সেই বিদ্যুৎ শক্তিকে কাজে লাগাবার জন্য শিল্পকেন্দ্র ও কারখানাগুলি প্রস্তুত হচ্ছে। সোবিয়েতের জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছায় চালিত সৃজনী শক্তির দুঃসাহস স্তালিনগ্রাদে মূর্ত হয়ে উঠছে।

 শহীদ চত্বরে দাঁড়িয়ে দেখছি বীরের শোণিত সিক্ত ভূমির ওপর শ্যামল তরুশ্রেণী অজস্র ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে, তারই স্নিগ্ধ ছায়ায় হাস্যমুখর শিশুরা খেলায় মেতেছে। এমন সময় বার বছরের একটি ছেলের হাত ধরে একটি বৃদ্ধা চলতে চলতে আমাদের দেখে দাঁড়ালেন। আমরা ভারতীয় জেনে তার বহু রেখায় কুঞ্চিত ললাটের নীচে নিষ্প্রভ চোখ দুটিতে প্রীতির প্রসন্নতা ফুটে উঠলো। বললেন, ‘তোমাদের দেশের কথা কিছু কিছু শুনেছি তোমরাও তো শান্তি আন্দোলন করছো।’

 বললাম, ‘আমরা শান্তিবাদী। এখানে এসে যা দেখলাম; তাতে তৃতীয় মহাযুদ্ধ যদি ঠেকান না যায় তা’হলে মানুষ সভ্যতার সব সম্পদ খুইয়ে দেউলে হয়ে যাবে।’

 বৃদ্ধা হাত তুলে আঙ্গুল দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ খানে একটা ভাঙ্গা ট্যাঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে আমার পুত্র পুত্রবধূ ও কনিষ্ঠ পুত্র মেশিনগান দিয়ে শত্রুকে ঠেকিয়েছে। পিতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে ওরা তিনজন ঐখানেই এক সঙ্গে প্রাণ দিয়েছে। সেই দারুণ দুর্দিনের স্মৃতি এবং এই শিশুটিকে বুকে করে আমি বেঁচে আছি। স্তালিনগ্রাদের ছেলেমেয়েরা আবার শান্তির নীড় রচনা করছে, সে কি শত্রুর বোমায় ধ্বংস হবার জন্য? তোমরা দেশে ফিরে গিয়ে এই কথাই বলো, আমরা যুদ্ধ চাইনে, কারো সম্পদে আমাদের লোভ নেই ঈর্ষা নেই। আমাদের সন্তানরা মানুষ হবে, বধ্যভূমির বলির পশু হবে না।’

 মধ্যযুগের ইতিহাসের পাতা থেকে যেন কোন বীর পুত্রের আত্মোৎসর্গের গৌরব-গর্বিতা রাজপুত নারী আমাদের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। অপরিচিত বিদেশীদের সম্মুখে তাঁর অবরুদ্ধ ভাবাবেগ সামলে নিয়ে বললেন, ‘আশীর্বাদ করি, ভারত-সন্তানেরা যেন নরঘাতক না হয়।’ নত মস্তকে বললাম, ‘মা, আজকের দিনে এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর নেই।’

 কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গণে শত পুত্র বিয়োগ বিধুরা গান্ধারীর বিলাপ, আজও শত শত পতিপুত্রহীনার কণ্ঠে শোকাবেগে উদ্বেলিত । সে দিন গান্ধারীর সম্মুখে পার্থসারথী নায়ায়ণ হতবাক হয়ে অধোমুখ হয়েছিলেন। আজও কোরিয়া ভিয়েৎমিন মালয়ে শত সহস্র অশ্রুমুখী নারীর আর্তবিলাপ মানবতার বিচারশালার পাষাণবেদীতে নিষ্ফল মাথা কুট্‌ছে!