আমার দেখা রাশিয়া/এগার
এগার
১২ই জুলাই প্রভাত ৭টায় মস্কৌ বিমান ঘাঁটি থেকে স্তালিনগ্রাদ যাত্রা করা গেল। বেলা ৯টার সময় ভরোনেৎসে বিমান থামল। আমরা চা-পান করতে করতে বিমান ঘাঁটির ভোজনাগারের দোতালার জানালা দিয়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত নগর দেখলাম, বহু শুভ্র সম্মুন্নত বাড়ী আবার আকাশে মাথা তুলেছে।
বিমান নিচু দিয়ে চলেছে, ডন নদীর দু’পাশে সমবায় কৃষিক্ষেত্রের বিশাল বিস্তার, অরণ্যখণ্ড, স্তেপভূমি ও ছোট বড় গ্রাম। দেখতে দেখতে বেলা সাড়ে এগারটায় স্তালিনগ্রাদে অবতরণ করা গেল। প্রচণ্ড মধ্যাহ্ন, রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করছে। মোটরে সহরের দিকে অগ্রসর হলাম, দুইদিকে ধ্বংসস্তূপ কাঁটাতারের বেড়া, পরিত্যক্ত পরিখার খাদ, তারই মধ্যে নূতন জনপদ গড়ে উঠছে। পথের দু’ধারে সহরতলীর চেহারা সুশ্রী নয়। ক্রমে প্রশস্ত মসৃণ পথে নগরীর কেন্দ্রস্থলে এসে পড়লাম। একটা মাঝারী গোছের হোটেলে আস্তানা পেলাম। বাঙ্গলা দেশের মত গরম। ফিরিঙ্গী পোষাক ছেড়ে, স্নান করে ধূতি পাঞ্জাবী পরে বাঁচি। লেনিনগ্রাদ থেকে স্তালিনগ্রাদ, এ যেন দারজিলিং থেকে গ্রীষ্মকালের কলকাতা।
হোটেলের জানালা দিয়ে দেখছি, দূরে ভল্গা নদী, সম্মুখে প্রকাণ্ড একটা ছ’তালা বাড়ী, সমবায় সমিতির বিপণী। দূরে দূরে বড় বড় বাড়ীর ধ্বংসস্তূপ, আর তার পাশেই উঠ্ছে নূতন সৌধমালা। মহাসর্বনাশের বুকে নবসৃষ্টি রূপায়িত হয়ে উঠছে। প্রলয় ও সৃষ্টির মহারহস্য রৌদ্রতপ্ত নগরীর বুকে এক বিভ্রান্তিকর মরিচীকার মত মনে হ’ল। প্রণাম করে বললাম, স্তালিনগ্রাদ তুমি আজ মস্কৌ বা লেনিনগ্রাদের মত রূপসী নও, তুমি বীর্যবতী। নাৎসী-দানব দলনে তোমার ভীমা ভৈরবী মূর্তি আজ সংযত। লক্ষ নরমুণ্ডের ওপর তুমি কমলামূর্তিতে নবসৃষ্টির সাধনায় বসেছ মহিয়সী রাণীর মত।
১৯১৮ সালের কথা। জারের আমলে জারিৎসিন নামে খ্যাত নগরী, বিদেশী সাহায্যপুষ্ট প্রতিবিপ্লবী সেনাপতিদের দ্বারা অবরুদ্ধ। অবস্থা সঙ্গীন। লাল পল্টনের ব্যূহ বিচ্ছিন্ন। উত্তর ককেশিয়া থেকে মস্কৌএ গম পাঠাবার পথ প্রতিবিপ্লবী কশাক সৈন্য অধিকার করেছে, এমন সঙ্কটের দিনে লেনিনের নির্দেশে স্তালিন জারিৎসিন অবরোধ মুক্ত করবার ভার গ্রহণ করলেন। রাজনীতিক বিপ্লবী নেতা স্তালিন সামরিক নেতৃত্বেও তাঁর প্রতিভা ও কর্মশক্তির পরিচয় দিলেন। জারিৎসিন বন্দর অবরোধ মুক্ত হল; তাঁর উৎসাহে অনুপ্রাণিত লালপল্টন জেনারেল ক্রাসনফের সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করে দিল। এই বিপুল সাফল্যের স্মৃতিরক্ষায় সোবিয়েত গভর্নমেণ্ট বন্দরের নূতন নাম দিলেন স্তালিনগ্রাদ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাৎসী বাহিনী পরিবেষ্টিত স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের ইতিহাস অনেকেরই জানা। ১৯৪১এর সেপ্টেম্বর মাসে হিটলারের ঝটিকাবাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে, নির্মম নিষ্ঠুর সংগ্রাম। ৩০শে সেপ্টেম্বর হিটলার ঘোষণা করলেন, “আমাদের জয় সম্পূর্ণ হয়ে এল। আমরা স্তালিনগ্রাদ আক্রমণ করেছি, তোমরা নিশ্চিন্ত থাক, স্তালিনগ্রাদ আমরা দখল করবোই।” পৃথিবীর ইতিহাসে এমন যুদ্ধ হয় নি। ধ্বংসের মহাশ্মশানে পরিণত নগরীর প্রতি গৃহে প্রতি পথে আধুনিক মারণাস্ত্রের সংঘাত, চারদিকে ভগ্ন কামান বিমান শেলের আবরণী, রাইফেল এবং অগণিত মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে। জয়াশাহীন জার্মানরা হত্যা ও ধ্বংসের উৎসবে মেতেছে, এমন সময় ৮ই জানুয়ারী সোবিয়েত সেনাপতি চরমপত্র দিলেন, তোমাদের জয় বা পলায়নের কোন ভরসা নেই, অনর্থক রক্তপাত থেকে নিবৃত্ত হয়ে আত্মসমর্পণ কর। এই উদার প্রস্তাব জার্মান সেনাপতি অগ্রাহ্য করলেন। কিন্তু ক্রুদ্ধ আহত সিংহের মত লালপল্টনের আক্রমণের সম্মুখে নাৎসী বাহিনী দাঁড়াতে পারলো না। সাত মাস অবরোধের পর ৬০ ডিভিসন শত্রু সৈন্যকে উৎসাদিত করে মার্শাল জুকভ স্তালিনগ্রাদ অধিকার করলেন। এবং মার্শাল ফন পাউলুস ২৪ জন জেনারেল, ২৫০০ অফিসার এবং ২০ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করলেন। ১৯৪৩ এর ৫ই ফেব্রুয়ারী বিধ্বস্ত মহানগরী স্তালিনগ্রাদে নাৎসী বিজয় অভিযানের সমাধি রচিত হ’ল।
জারিৎসিন ও স্তালিনগ্রাদের দুই-দুইবার অকুতোভয় শৌর্যে শত্রু পরাভবের নিদর্শনগুলি একটি ম্যুজিয়মে সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া কামান বন্দুক তরবারী, লেনিনের লেখা চিঠি, স্তালিনের উত্তর, অনেক দলিল, ছবি দেখতে দেখতে আমরা একটি কক্ষে উপস্থিত হলাম। এখানে নাৎসী বিজয়ী স্তালিনগ্রাদ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব অভিনন্দন ও উপহার পেয়েছে তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বৃটিশরাজ ষষ্ঠ জর্জের তরবারী রুজভেল্টের স্বর্ণখচিত অভিনন্দনপত্র। নাৎসী দাসত্বের নিগঢ় থেকে শুধু নিজেদের নয়, পৃথিবীকে মুক্ত করলো যারা, তারা দেশ দেশান্তর থেকে কত উপহার কত অভিনন্দন পেয়েছে। আমার মাতৃভূমি ভারত কোথায়? দেখলাম ভারতের উপহার একমাত্র ছাত্র ফেডারেশানের দিল্লী শাখা থেকে দেওয়া একখানি বেনারসী শাড়ী ও নেকলেস। আমার ভাগ্য ভাল, বাঙ্গলা ছাত্র ফেডারেশানের উপহার নয়। আমরা শাড়ী, চুড়ী বা হার কাপুরুষদেরই বিদ্রুপ করবার জন্য উপহার দিয়ে থাকি।
ম্যুজিয়ম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সম্মুখে শহীদ চত্বর। পুবদিকে মাইল তিনেক দীর্ঘ ‘শান্তি সড়ক’, দু’পাশে ৫৭ তলা বাড়ী, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীদের আবাস ভবন। চত্বরের পশ্চিমে বিশাল নাট্যশালা গড়ে উঠছে, উত্তরে বাগান। আমরা চলেছি, ভল্গা নদীর দিকে। রাস্তার দু’পাশে যেমন নূতন ইমারত, তেমনি ভাঙ্গা বাড়ীগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। প্রতিদিন চারদিক ঘুরে দেখেছি, প্রলয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা। এক একটা বাড়ী বহুভাবে বিদীর্ণ হয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় জীবের কঙ্কালের মত পড়ে আছে; আবার ৫।৭ তলা বাড়ী ঠিক খাড়া আছে কিন্তু সর্বাঙ্গে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। এ বাড়ীগুলির উপর বোমা পড়েনি। এর প্রত্যেক তলায়, প্রত্যেক কক্ষে, সিঁড়িতে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়েছে।
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। পথে স্ত্রীপুরুষ ছেলেমেয়ে চলেছে নদীর ধারে। ধূতিচাদর পরা বাঙ্গালী আমি কৌতূহল নিয়ে চলেছি। এই ভল্গা নদী! সহরের পূর্বপার ঢালু হয়ে নেমে গেছে, পশ্চিম পার খাড়া উঁচু। স্রোত মন্থর। কাস্পিয়ান সাগর সঙ্গম বেশী দূরে নয়। ভল্গার তীরে দাঁড়িয়ে প্রথমেই মনে হ’ল একখণ্ড পূর্ববঙ্গ যেন রাশিয়ায় ছিটকে এসে পড়েছে। এ নারায়নগঞ্জ না চাঁদপুর? সেই স্টীমার ঘাট, গাধাবোট টেনে চলেছে ছোট্ট স্টীমলঞ্চ, যাত্রীবাহী স্টীমার নোঙ্গর করে আছে ঘাঠে, পালতোলা নৌকো চলেছে বুক ফুলিয়ে, গাঙচিলের দল আকাশে পাখা মেলে উড়ছে। আমার দেশ আমার জন্মভূমির স্মৃতি বড় বেশী করে মনে পড়তে লাগল, উন্মনা হয়ে গেলাম। পদ্মা যমুনা ধলেশ্বরী মেঘনা কোথায়, আর কোথায় ভল্গা! ওপারের তরুশ্রেণী-ঢাকা গ্রামের নিস্তব্ধ নিকেতনে সারাদিনের কর্মশ্রান্ত মানুষ আমার দেশের মতই স্নেহ মমতা ভালবাসার একান্ত নির্ভরপর শান্তির নীড়ে ফিরে চলেছে; কল্পনানেত্রে যেন প্রত্যক্ষ করলাম। অনেকদিন আগের কথা, এমনিভাবে একদিন মালাবারে পূর্ববঙ্গের শ্যামলশ্রী মনকে অভিভূত করেছিল। স্তালিনগ্রাদ তুমি কেবল বীর্যবতী নও, তুমি রূপসীও। পূর্ববঙ্গের সজল কোমল শ্যামলশ্রী, অস্তরবির রক্তিম আলোয় কি অপরূপ হয়ে দিগ্বলয় পর্যন্ত উদ্ভাসিত।