দশ

 মস্কৌএ ফিরে অপরাহ্ণে আমরা ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে শ্রীযুত রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে দেখা করলাম। মস্কৌএর পণ্ডিত মহলে এঁর বিশেষ সমাদর। সোভিয়েতের মন্ত্রী ও কূটনীতিবিদ্‌রাও তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। এই মেলামেশায় তিনি খোলাখুলি ভাবে যে সব আলোচনা করেন, তার কিছু কিছু গল্প বল্‌লেন। আমাদের এখানের অভিজ্ঞতা শুনে তিনি বল্‌তে লাগলেন, এদের শান্তি আন্দোলনটা লোক দেখান ব্যাপার নয়, সত্যিই এরা শান্তি চায়। যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম এরা দেখেছে। দেখলে তো কি ভাবে এরা পুনর্গঠনে হাত দিয়েছে। এদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর সমাজ-জীবন নির্ভরশীল। তাই অর্থনৈতিক উন্নতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের রূপও বদলাচ্ছে, লোক ব্যবহারে কোথাও অতিনির্দিষ্টতা নেই। এরা ভুল স্বীকার করে এবং সংশোধন করে নেয়। এদের সমাজের এই সচলতা বিদেশীর দৃষ্টিতে সহসা ধরা পড়ে না।

 এদেশের মেয়েদের পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার ও অসঙ্কোচ আচরণ সম্বন্ধে আলোচনা উঠ্‌তেই রাধাকৃষ্ণণ বলে উঠ্‌লেন, শিক্ষা বিস্তার আর মেয়েদের দায়িত্বপূর্ণ কাজ দেওয়াতেই এটি সম্ভবপর হয়েছে। তোমরা লক্ষ্য করেছ, এরা প্রগলভা নয়, এদের হাবভাব সাজসজ্জা সংযত। আধুনিক রাশিয়ান তরুণীদের তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।

 কেবল তরুণীরা নয়, হাল আমলের তরুণরাও যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ইস্পাত হয়ে উঠেছে। এদের সমাজ চেতনা, পরস্পরের প্রতি সুবিবেচনা এদের চরিত্রের বনিয়াদ। আমি এক দিন লেনিন ম্যুজিয়মে দোতালার সিঁড়ি বেয়ে উঠ্‌ছি কয়েক ঘণ্টা ঘুরে ক্লান্ত হয়েছিলাম নিশ্চয়। হয় তো তাই দেখে দুটি মেয়ে আমার দু’পাশে এসে আমার দুই বাহু ধরে উঠ্‌তে সাহায্য করলো। সঙ্কোচের সঙ্গে বল্‌লাম, “নিয়ে‍ নিয়েৎ” অর্থাৎ প্রয়োজন নেই। আমার দোভাষীকে দিয়ে বলালাম, আমার বয়স হয়েছে, তবে এত বুড়ো হইনি যে সাহায্যের প্রয়োজন আছে। ওরা শুনে হাসতে লাগলো, কিন্তু ছাড়ল না। পরে আমি দোভাষীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি বিদেশী বলেই বুঝি এতখানি সৌজন্য দেখালো। সে বললে, মোটেই নয় আমরা ছেলেবেলা থেকেই বুড়োবুড়ীদের সম্মান করতে শিক্ষা পেয়েছি। বয়স্কদের অবজ্ঞা করা বা তাদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করা অভদ্রতা। আমি এই ঘটনার পর থেকে লক্ষ্য করেছি, ট্রাম বাস বা দোকানের ‘কিউ’এ এরা প্রাচীনদের অগ্রাধিকার দেয়। ট্রামে বাসে বুড়োবুড়ীদের বসবার আসন ছেড়ে দেয়। আর এক দিনের কথা মনে আছে, সাংস্কৃতিক উদ্যানে উক্রেন কুটির শিল্পের প্রদর্শনী দেখে, ধূমপানের জন্য বাগানের একটা বেঞ্চে বসেছি, আমার সামনের বেঞ্চে একজন যুবক ধূমপান করছে, এমন সময় একজন বৃদ্ধ এসে পাশে বস্‌তেই সে সিগারেট্‌টা ফেলে দিল। যুবকটি যখন উঠে যাচ্ছে, তখন ইঙ্গিত করতেই আমার সম্মুখে এসে সলজ্জভাবে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি সিগারেট্‌টা ফেলে দিলে কেন?’

 ‘ওঁর অসুবিধা হতে পারে।’

 ‘জিজ্ঞাসা করলেই পারতে।’

 ‘তা হলে কি আর উনি বলতেন। অনর্থক ওঁকে পীড়া দিতাম, তাই ফেলে দিলাম।’

 বুঝলাম এদের শ্রদ্ধাটা কত স্বাভাবিক। এটাও লক্ষ্য করেছি, বুড়োবুড়ীদের এরা শ্রমসাধ্য কাজে নিয়োগ করে না। আপিস কারখানা রেল স্টেশন বিমান ঘাঁটিতে দেখেছি, দরজায় পাহারা বা বিশ্রামাগারের তদারক বয়স্করাই করে। হোটেলের ছোট ছোট কাজে এরাই রয়েছে। অথচ এই দেশের বিরুদ্ধে এমন কথা রটনা করা হয় যে, এ দেশের নরনারীকে দিয়ে কৃতদাসের হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খাটিয়ে নেয়া হয়।

 মস্কৌএ একটা “হাউস অফ্ রেস্ট” বা বানপ্রস্থীদের বিশ্রামাগার দেখতে গিয়েছিলাম। ৩০০ লোক থাকবার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু বাসিন্দা মাত্র ৫০।৬০ জন। অধ্যক্ষ বললেন, পেনসান পাওয়ার পর মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের সংসারেই বেশীর ভাগ রয়ে যায়। যাদের কেউ নেই তারাই এখানে আসে। এরাও অলস ভাবে বসে থাকে না, সাধ্য মত ছোটখাট কাজ করে। পড়াশোনা ও দাবা খেলা নিয়ে সময় কাটায় এমন লোকও অবশ্য আছে। বাপ-মা নিয়ে পারিবারিক জীবনটা অবশ্য ইয়োরোপীয় সমাজসম্মত নয়, হয় তো এদের সামাজিক অর্থনীতির ফলে এটা সম্ভব হয়। বিবাহিত ভাইবোনেরা একত্র থাকে এও দেখেছি, এমন কি আমাদের দেশে উপহাসভাজন ঘরজামাইও দেখেছি। তবে এরা শ্বশুরাশ্রিত জীব নয়, রোজগার করে।

 প্রবীন বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধাসম্মান আমাদের দেশেও ছিল, পল্লীতে এখনও কিছুটা আছে। কিন্তু কলকাতা সহরের যুদ্ধোত্তর নাগরিক সভ্যতায় ওর আর কোন চিহ্ন নেই। পথে ঘাটে, ট্রামে বাসে, ট্রেনে বিপণীতে পরস্পরের প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শনের রেওয়াজই উঠে গেছে। আমাদের সহরে ট্রামে বাসে দুর্বল দেহ বৃদ্ধকে বসবার আসন কেউ ছেড়ে দেয় না, সামান্য আরাম ছেড়ে ভদ্রতার বিলাস এখানে অচল।

 যে দেশে পরশ্রমজীবীর দল একেবারে বিলুপ্ত হয়েছে, যেখানে সমাজের লোক-সাধারণকে খাটিয়ে মুনাফার পাহাড় তৈরী করে সঞ্চিত ধন ব্যক্তিগত ভোগে অথবা অধিকতর মুনাফা সংগ্রহে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই, সেখানে মানব-প্রকৃতির পরিবর্তন অনিবার্য। এই পরিবর্তন এসেছে সর্বমানবের সমান অধিকার বোধ থেকে। এক নয়া অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর এদেশের সমাজ-জীবন দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভাবীকালে কি রূপ নেবে, তা’ আজ নিশ্চিতরূপে বলা যায় না, তবে সর্বসাধারণের সম্মুখে শিক্ষার দ্বার এরা যে ভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছে, তাতে মনুষ্যত্বের মর্যাদা ও উৎকর্ষ অনিবার্য। বঞ্চক ও বঞ্চিত, শোষক ও শোষিত, সুবিধাভোগী ও অধিকার বঞ্চিতের লোভ ও ক্ষোভের সংঘাতে যে শ্রেণীবিদ্বেষ নানা আকারে সমাজদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে, সে স্তর পার হতে এদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, ব্যক্তিগত মতস্বাতন্ত্র্যকে সমষ্টির কল্যাণে সংযত করতে হয়েছে। কিন্তু আজকের সমাজের চেহারাটা দেখলে বোঝা যায় যে, লেনিন-স্তালিনপন্থীরা ওপর থেকে জনগণের ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি, সমাজের সমগ্র মনকে তারা উদ্বুদ্ধ করেছে, দেশের সৌভাগ্যসৃষ্টির কাজে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। লক্ষ্য সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা না থাকলে নূতন সমাজ গড়া যায় না। সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ রুশ জনসাধারণের আত্মনির্ভর বিশ্বাস, তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদ্‌লে দিয়েছে বলেই জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষই আত্মীয় হয়ে উঠেছে। লোক ব্যবহারে বৈষম্য নেই।