নয়

 ৬ই জুলাই রাত্রি ১২টায় আমরা ট্রেনে মস্কৌ থেকে লেনিনগ্রাদ যাত্রা করলাম। সকাল ছ’টায় বিছানা ছেড়ে সোফায় বসলাম। বোতাম টিপতেই ট্রেনের ‘ভ্যালেট’ এসে চা দিয়ে গেল। নির্মল কাঁচের জানলা দিয়ে দেখছি, ছোট বড় গ্রাম, সবুজ ক্ষেত, পাইন বার্চ পপলারের সমুন্নত তরুশ্রেণী পাহাড়ের গা ঘেঁষে রয়েছে, কোথাও বা বিস্তৃত হ্রদ। রেল লাইনের দু’ধারে মৌসুমী ফুলের সমারোহ, রৌদ্রে উজ্জ্বল। বেলা দশটায় লেনিনগ্রাদ স্টেশনে গাড়ি থামলে।, আমরা পৃথিবীর অন্যতম সেরা হোটেল আস্তোরিয়ায় এসে উঠলাম। জারের আমলে ইয়োরোপ আমেরিকার ধনীদের বিলাস ও প্রমোদ নিকেতনের বাসিন্দা বদলালেও অতীত বৈভব ম্লান হয়নি। প্রত্যেক কামরায় টেলিফোন রেডিয়ো বসবার ও শয়নগৃহ, স্নানাগার ঠাণ্ডা ও গরম জল। হোটেলে ৪টা ভোজনাগার বড় বড় বৈঠকখানা মূল্যবান আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। এমন দিন ছিল, যখন এর এক সপ্তাহের বিলাসের খরচা জোগাতে আমাদের দেশের ছোটখাট জমিদারেরা ফতুর হয়ে যেতো। এর নৃত্যশালা একদিন বহু সম্রাজ্ঞী রাণী ও অভিজাত বিলাসিনীদের কলহাস্য ও চটুল নৃত্যে মুখরিত হত। রসিক ম্যানেজার সে সব কথা শোনালেন। গত যুদ্ধের সময় জার্মানরা যখন নগরের বিশ মাইলের মধ্যে এসে পড়েছে, তখন এক দিন তিনি খোদ হিটলারের স্বাক্ষরিত এক হুকুমনামা পেলেন, অমুক তারিখ রাত্রে লেনিনগ্রাদে তিনি বিজয়োৎসব উপলক্ষে একটা ভোজসভা করবেন। পাঁচশ’ অতিথির জন্য খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থা রাখবে। বলা বাহুল্য এ-হুকুম তাঁকে তামিল করতে হয়নি। তিন বৎসর এই নগরী প্রায় অবরুদ্ধ ছিল। ঝটিকাক্ষুব্ধ জলধি তরঙ্গের মত বারম্বার নাৎসী বাহিনী, জনগণের প্রতিরোধের পাষাণ-প্রাচীরে নিষ্ফল মাথা কুটেছে। সহরের বিদ্যুৎ জলসরবরাহ জ্বালানী ছিল না, লোকের দু’বেলা এক টুকরো রুটিও জুটতো না, তবু জনগণ ও সৈন্যদলের মৃত্যুপণ সঙ্কল্প টলেনি। এ সব কথা মনে হচ্ছিল। কিন্তু এই কয়বৎসরে নাৎসী আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন প্রায় লুপ্ত হয়েছে।

 পিটার দি গ্রেটের গড়া সেণ্ট পিটার্সবুর্গ রূপসী নগরী। ভূমিদাসদের অস্থি-মজ্জার ভিত্তির উপর নেভানদীর দুই তীরের জলাভূমিতে এই মহানগরী আড়াই শ’ বছরে গড়ে উঠেছে। রুশ সম্রাটদের প্রতাপের খর রশ্মিতে শোষিত জনসাধারণের অর্থ রাজভাণ্ডার থেকে বর্ষাধারার মত বর্ষিত হয়েছে; কত প্রাসাদ গীর্জা উপবন সে দিনের সাম্রাজ্য মহিমার স্মৃতি বহন করছে। এখান থেকেই রুশ সাম্রাজ্য প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম তীর থেকে হিমালয় হিন্দুকুশের উত্তর ভাগ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়েছিল। স্বৈরশাসনের এই সুদৃঢ় দুর্গের ভিতের তলায়ই বিপ্লবের বারুদও সঞ্চিত হয়েছিল, বিংশ শতাব্দীর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের অপেক্ষায়।

 ইয়োরোপ প্রবেশের বল্টিক সমুদ্রপথের পাহারাদার নৌ-দুর্গ ক্রোনস্টাডের দ্বারা সুরক্ষিত লেনিনগ্রাদ সোবিয়েত রাশিয়ার দ্বিতীয় মহানগরী। হোটেল আস্তোরিয়ার সম্মুখে বাগান দক্ষিণে বিখ্যাত গীর্জা বামে পিটার দি গ্রেটের অশ্বারূঢ় বিরাট প্রতিমূর্তি। অপরাহ্ণ ৫টায়, আমরা সহর দেখতে বেরুলাম। চওড়া রাস্তা, মাঝে মাঝে ছোট ছোট খাল, খালের ওপর সাঁকো, দু’ধারে বড় বড় প্রাসাদ (এখন শ্রমিকদের বাসভবন নয় সামরিক দপ্তরখানা) স্কোয়ার বাগান দেখতে দেখতে আমরা জারদের বিখ্যাত ‘উইনটার প্যালেসের’ সম্মুখে এলাম। প্রাসাদের সম্মুখে পাথর দিয়ে বাঁধান প্রশস্ত চত্বর মাঝখানে গ্রানিট পাথরের বর্তুলাকার সুউচ্চ জয়স্তম্ভ। এইখানেই এক দিন সাম্রাজ্যবাদের পাহারাদার কুকুর কশাক অশ্বারোহী সৈন্যের কুচকাওয়াজ হয়েছে, এইখানে সমবেত প্রজাবৃন্দকে প্রাসাদের অলিন্দ থেকে স্বর্গস্থ পিতার প্রতিভূ ‘লিটিল ফাদার’ জার দর্শন দিয়ে ধন্য করতেন। এবং এইখানেই ১৯০৫ সালে নিরস্ত্র ক্ষুধিত জনতার আবেদনের উত্তরে জার সৈন্যরা গুলি বর্ষণ করেছিল।

 এই চত্বর রাশিয়ার জালিয়ানালাবাগ। দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার আশ্চর্য মিল, সাম্রাজ্যবাদী কূটনীতির একই খেলা। ১৯১৯-এ বৃটিশ সাম্রাজ্যনীতির বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের অসন্তোষ যখন বিদ্রোহের সীমানায়, তখন জনসাধারণকে শিক্ষা দেবার জন্য কর্তৃপক্ষ ষড়যন্ত্র করলেন। লালা হংসরাজ নামে পুলিশের এক গুপ্তচর জালিয়ানালাবাগে এক সভা আহ্বান করলো। সে দিন বৈশাখী পূর্ণিমার মেলাও ছিল। এই প্রাচীরবেষ্টিত স্থানে বেরোবার পথ রোধ করে জেনারেল ডায়ার নিরস্ত্র আবালবৃদ্ধবনিতার ওপর অতর্কিকে গুলী বর্ষণ করে কয়েক হাজার লোককে হতাহত করেছিল।

 ১৯০৫ সালে অবিকল এমনি ঘটনাই ঘটেছিল। ঐতিহাসিক পটভূমিকার সঙ্গেও মিল আছে। ফরাসী বিপ্লব, রুশো ভলতেয়ারের ভাবধারায় অনুপ্রাণীত রুশ অভিজাত মহলে জাতীয়তাবাদ এবং নিয়মতান্ত্রিক গভর্নমেণ্ট প্রতিষ্ঠার জল্পনা কল্পনা অনেক আগেই সুরু হয়েছিল, এই আন্দোলন থেকেই গুপ্তহত্যাকারী নানা বিপ্লবীদলের সৃষ্টি হয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এই অসন্তোষ শ্রমিক কৃষকশ্রেণীতেও দেখা দিল। রুশ জাপান যুদ্ধে জারের পরাজয় ও সামরিক শক্তির বিপর্যয়ে এই অসন্তোষ সেণ্ট পিটার্সবুর্গের কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মঘটে ব্যাপক হয়ে উঠলো। বিদ্রোহের আশঙ্কায় জারতন্ত্র বধ বন্ধন নির্বাসনের ভীতির রাজত্ব কায়েম করলো। কিন্তু এ-ও যথেষ্ট নয়। ছোটলোকের আস্পর্ধা অসহ্য। সমুচিত শিক্ষা দিতে হবে। পুলিশের বড়কর্তা এবং জারের কর্ণধার ট্রিপভ জাল পাতলো। ফাদার গাপেন নামে এক পাদ্রী ছিল পুলিশের গুপ্তচর এবং “কারখানা শ্রমিক পরিষদের” নেতা। এই গুপ্তচর গাপেন এক দরখাস্ত রচনা করে, ধর্মঘটি শ্রমিকদের বললো, চল শোভাযাত্রা করে জারের কাছে যাই। তিনি আমলাতান্ত্রিক জবরদস্তীর একটা বিহিত করবেন। দেড় লাখ শ্রমিক তার অনুগামী হ’ল। আবেদনপত্রের ভাষা দেখলেই বোঝা যায়, এ কোন বিপ্লবীর রচনা নয়। ক্ষুধিত সর্বরিক্ত শ্রমিকদের বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার চতুর পুলিশ গুপ্তচরের ছলনা।

 “সেণ্ট পিটার্সবুর্গের শ্রমিক আমরা আপনার দুয়ারে এসেছি, আমরা দুর্ভাগা, বহু নিন্দিত ক্রীতদাস। স্বেচ্ছাচার ও অত্যাচারে আমরা ভেঙ্গে পড়েছি। আমরা কাজ বন্ধ করেছি, কিন্তু মালিকদের কাছে আমাদের এই ভিক্ষে, যতটুকু না হ’লে ছেলেপুলে নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না, তার বেশী আমরা চাইনে। কিন্তু এই বাঁচবার দাবীও মালিকরা মানলো না, আমরা যেন মানুষ নই, আপনার কর্মচারীরাও আমাদের দাস করে রাখবার মালিকদের জেদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। প্রভো, আপনার নিরুপায় নির্যাতীত প্রজাদের আপনি সাহায্য করুন। আপনার প্রজাদের আবেদন মঞ্জুর করুন। যদি আপনার দয়া না হয়, তা’হলে এইখানেই মরা ছাড়া আমাদের আর পথ নেই।”

 ‘দয়ালু লিটিল ফাদার’ জার দর্শন দিলেন না। কিন্তু তাদের প্রার্থনার দ্বিতীয় আবেদন মঞ্জুর করলেন। প্রাসাদের বুরুজ থেকে শিলাবৃষ্টির মত রাইফেলের গুলী বর্ষিত হ’ল। মরণাহতের আর্তনাদ মুখরিত চত্বরে অশ্বারোহী কশাকবাহিনী হিংসা ও হত্যার মহোৎসবে মেতে বইয়ে দিল রক্তগঙ্গা। পরদিন পুলিশ-রিপোর্টে প্রকাশিত হ’ল, এক হাজার নিহত ও দু’হাজার আহত হয়েছে। বেসরকারী হিসেবে হতাহতের সংখ্যা ছ’ হাজারের ওপর! রুটি বা জীবিকার বদলে বুলেট। ১৯০৫ সালের ৯ই জানুয়ারী ‘রক্তাক্ত রবিবার’ রূপে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।

 এত বড় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে সেদিনের ইয়োরোপের কূটনীতিক মহলে বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়নি। কেবল পারীর প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা ফ্রান্সের নানা স্থানে সভা করে এর প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৯০৫-এর ৩০শে জানুয়ারী পারীর এক জনসভায় বিখ্যাত সাহিত্যিক ও মনীষী আনাতোল ফ্রাঁসের বজ্রস্বর মন্দ্রিত হ’ল; “জার ক্ষুধিত নরনারীকে হত্যা করেছে, তারা চেয়েছিল খাদ্য, পেয়েছে বুলেট, জার জারকেই হত্যা করেছে। যে সব নির্দোষীর রক্তে নেভা নদীর জল রাঙ্গা হ’ল, তার প্রত্যেক শোণিতবিন্দু থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ জন্মাবে, যারা এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবে। জার যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালালেন, তা তারই চিতাশয্যা। নিকোলাস আলেকজেণ্ডারের দিন ফুরিয়েছে, ইতিহাসে তার কলঙ্কিত স্মৃতিমাত্র থাকবে। জার গভর্নমেণ্ট শ্রমিকদের হত্যা করেছে, শিক্ষিত যুবকদের জেলে পুরছে, সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠাচ্ছে। আমি দেখছি, যে বিপ্লব বিদ্রোহ আরম্ভ হ’ল, তা থামবে না। আমার একমাত্র শঙ্কা, এই রক্তাক্ত পথ যেন দীর্ঘ না হয়। এ দৃশ্য ভয়াল অথচ গরিমাময়। ছাত্র অধ্যাপক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী শ্রমিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, মরণ অভিসারে। একটা পীড়িত জাতির মর্মমথিত ক্রন্দন বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তার থেকে উঠে, আকাশে প্রতিধ্বনি তুলছে। জারের নৃশংস পাশবিকতা, আজ রুশজাতির সত্যানুরাগ ও সততার সম্মুখীন। অত্যাচারই অত্যাচারীকে গ্রাস করবে, সে দিনের বেশী বিলম্ব নেই।”

 আনাতোল ফ্রাঁস রাশিয়ার সর্বহারা (প্রোলেটারিয়েট) দের যে বিজয় কামনা করেছিলেন, তা লেনিন-স্তালিন চালিত বলশেভিক পার্টি মাত্র বার বছরের মধ্যেই সফল করেছিল। সেই শুভদিন দেখবার পূর্বেই আন্তর্জাতিক মৈত্রী ও বিশ্বশান্তির পুরোধা আনাতোল ফ্রাঁস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।

 এখান থেকে বিখ্যাত কবি পুসকিনের আবাস, সম্প্রতি ম্যুজিয়ম। গত শতাব্দীর স্বচ্ছল মধ্যশ্রেণীর অভিজাতদের বাড়ী ঘর আসবাবপত্রের স্মৃতি। পুসকিনের ছবি, লেখার পাণ্ডুলিপি, বইএর বিভিন্ন সংস্করণ, তাঁর লাইব্রেরী, নিত্য ব্যবহারের জিনিষপত্র সাজান রয়েছে। সেকালের প্রথায় শত্রুর সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধে পুসকিন গুরুতর আহত হয়ে মারা যান, তাঁর শেষ শয্যা দেখলাম। সোবিয়েত রাশিয়ায় পুসকিন সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি। নূতন রাজাধানী সেণ্ট পিটার্সবুর্গ নিয়ে একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, “নব বধুর রূপ যৌবন অলঙ্কারে ভূষিতা তুমি, তোমার জৌলুসে প্রৌঢ়া শাশুড়ীর মত মস্কৌ পরিম্লান।”

 নেভা নদীর ধার দিয়ে চলেছি, স্রোত মন্থর, গাঢ় নীল জল। মোটর বোট ও স্টীমার চলেছে, দুই তীরে কারখানা, বাসগৃহ। এখানে এক বাগানে নেভা নদীর দিকে মুখ করে, অশ্বারোহী পিটার দি গ্রেটের বৃহৎ মূর্তি, পায়ের তলায় একটা সাপ বা ড্রাগনকে বর্শায় বিদ্ধ করছেন। মূর্তিটির বীরত্ব ব্যঞ্জক ভঙ্গী শিল্পী জীবন্ত করে তুলেছেন। সমস্ত সহরে আর কোন জারের মূর্তি নেই। জার নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করার পর কেরেনেস্কী গভর্নমেণ্টের আমলে প্রাক্-বলশেভিক বিপ্লবীরা সেগুলি ধ্বংস করে ফেলেছিল।

 ক্রমে অগ্রসর হয়ে আমরা জারের দুর্গে প্রবেশ করলাম। বড় বড় দু’তিনটি গীর্জা। একটি গীর্জার প্রাঙ্গণে শ্বেত ও কৃষ্ণ মর্মরে জার ও জারিনাদের সমাধি, দেয়ালের গায়ে বাইবেলের কাহিনীর চিত্র। এগুলিতে এখন আর প্রার্থনা করবার জন্য নরনারীর ভীড় হয় না, কৌতূহলী জনতা ম্যুজিয়ম দেখতে আসে। দুর্গের মধ্যে প্রাচীন কারাগার। এর সেলগুলি এক একটি ভয়াবহ অন্ধকূপ, বারান্দায় পাহারারত প্রহরীর জুতোর শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যেতো না। কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলের ৪০ ডিগ্রীর সেলগুলি এর তুলনায় আরামপ্রদ। এক একটি সেল যেন সাম্রাজ্যনীতির প্রতিহিংসার নিষ্প্রাণ নিষ্ঠুরতা। এখানে কত বিপ্লবী পাগল হয়েছে, কত আত্মহত্যা করেছে; কত প্রতিভাশালী যুবকের সুগঠিত দেহ জরায় জীর্ণ হয়ে গেছে এই নিরানন্দ পুরীতে। লেনিনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ১৯ বছরের যুবক উলিয়ানভ ফাঁসির পূর্বে যে সেলটিতে ছিলেন সেটি এবং গর্কী ও অন্যান্য প্রাক বলশেভিক বিপ্লবীদের সেলগুলি চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। ১৯০৪-৬ সালের বিদ্রোহের সময় এই জেলখানায় অতি বীভৎস নারকীয় অত্যাচার হয়েছে, তার কতকগুলি মরচে ধরা পীড়ন যন্ত্র দেখলাম। মন বিষাদে ভরে উঠ্‌লো। মনে পড়লো, আমাদের দেশের ইলিসিয়াম রোর (অধুনা লর্ড সিংহ রোড) গোয়েন্দা ঘাঁটির কথা। পীড়ন করে পেটের কথা বার করবার ওস্তাদিতে এরাও ছিল রুশ-পুলিশের সাঙ্গাৎ। যৌবনে আমি এবং আমার বন্ধুরা অনেকেই গোয়েন্দা পুলিশের মোলায়েম ব্যবহারের স্বাদ পেয়েছেন। তফাৎ এই, সোবিয়েত গভর্নমেণ্ট তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছে, আর আমাদের গভর্নমেণ্ট সেই সব ক্ষণজন্মা মহাপুরুষদের প্রমোশন দিয়ে পুলিশ-বিভাগের চূড়োয় বসিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বড় দুঃখেই বলেছিলেন, “যে লোক স্বার্থপর বেইমান, যে উদাসীন নিশ্চেষ্ট, বর্তমানের গুপ্ত ব্যবস্থায় তারই জীবনযাত্রা সব চেয়ে নিরাপদ তারই উন্নতি ও পুরস্কারের পথে সকলের চেয়ে বাধা অল্প।”

 ৮ই জুলাই রবিবার মেঘলা প্রভাত। বৃষ্টি মাথায় করে আমরা ‘স্মোলনী ইনস্টিটিউটে’ গেলাম। পূর্বে অভিজাত মেয়েদের আবাসিক বিদ্যালয় ছিল। ১৯১৭র বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্বে বলশেভিকদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এই সদর দপ্তরখানা থেকে লেনিন ও স্তালিন বিদ্রোহী সৈন্যদের সংহত ও শৃঙ্খলিত করে, ৭ই নভেম্বর প্রায় বিনা রক্তপাতে পেট্রোগ্রাদ দখল করেন। ৭ই নভেম্বর রাত্রি ১০টা ৪৫ মিনিটে, ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে সোবিয়েত সোস্যালিস্ট গভর্নমেণ্ট আবির্ভূত হয়েছিল।

 প্রকাণ্ড বাড়ী, অধিকাংশ‍ই এখন সামরিক দপ্তরখানা, চারদিকে কড়া পাহারা দোতালার কতকগুলো ঘর ম্যুজিয়ম, লেনিনের ছোট্ট শয়ন কক্ষ, সাধারণ খাট বিছানা বসবার চেয়ার। যে ঘরে সামরিক বৈঠক বসতো, তাতে অনেক ঐতিহাসিক দলিল ও ছবি আছে। এখানেই প্রথম বলশেভিক কংগ্রেসে লেনিন বিপ্লবী সেনাদের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ৪৭ বৎসর বয়সের লেনিনের তৈলচিত্র, সুগঠিত দেহ উজ্জ্বল মর্মভেদী দৃষ্টিতে তেজস্বী জীবনের বহ্নিজ্বালা, কক্ষগাত্রে বিলম্বিত।

 বলশেভিক বিপ্লবের ইতিবৃত্ত আলোচনা করতে করতে আমরা নগর ছাড়িয়ে অগ্রসর হলাম। মেঘের ঘোমটা সরিয়ে সূর্য প্রকাশ পেয়েছে, সদ্যস্নাত গাছের পাতাগুলি চিকচিক করছে, প্রশস্ত পথের দু’ধারে অজস্র রঙ্গীন ফুল ফুটে রয়েছে, মাঠের মধ্যে নূতন বাড়ী, তার পাশেই জার্মান আক্রমণে বিধ্বস্ত ও পরিত্যক্ত বাড়ীও রয়েছে। ক্রমে আমরা পুসকিন গ্রামে প্রবেশ করলাম। এটা জার্মানরা দখল করেছিল, দু’পক্ষের গোলাগুলী বর্ষণে অধিকাংশ বাড়ীই জখম হয়েছিল। আবার এরা আরো সুন্দর করে বাড়ী বাগান পথ গড়ে তুলেছে। এখানকার এক বিশাল জারীয় প্রাসাদে জার্মান সৈন্যরা থাক্‌তো, পালাবার সময় ইচ্ছে করে এর ক্ষতি করে গেছে, শিল্পকলার নিদর্শনগুলি কতক লুট করেছে, কতক নষ্ট করে গেছে। বাড়ীটা খাড়া আছে, তাই ধীরে ধীরে মেরামত হচ্ছে। এর একটা অংশ মেরামত করে পুসকিন ম্যুজিয়ম হয়েছে। বহু চিত্র ও পুরনো শিল্পের নিদর্শনের সংগ্রহ। এখানে নবীন রাশিয়ার অফুরন্ত প্রাণশক্তির প্রাচুর্য, নব সৃষ্টির আনন্দে বিকশিত হচ্ছে নগর নির্মাণের সুষ্ঠু পরিকল্পনায়।

 আমরা যখন সহরে ফিরে এলাম, তখন সূর্যের আলো ম্লান হয়ে এসেছে, নেভা নদীর গাঢ় নীল জলে রক্তিম আলো কাঁপছে। নদীতীরে নোঙ্গর করা ক্রুজার অরোরা বা আবরোরা। এই রণতরীর নৌ-সৈন্যরা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলশেভিকদের সঙ্গে যোগ দেয়, এবং ‘উইনটার প্যালেসে’র সম্মুখে তাদের কামানশ্রেণী উদ্যত করে। অরোরার কামানশ্রেণীর গর্জনে কেরেনেস্কী পন্থীরা পালিয়ে যায়। সেই নৌ-বিদ্রোহীদের মধ্যে জীবিত এক জন প্রৌঢ় এখন এর অধ্যক্ষ, ইনি আমাদের সবদিক ঘুরিয়ে দেখালেন এবং সেদিনের গল্প শোনালেন। এটি ১৯০০ সালে তৈরী হয়, ৬৫০০ টন, দু’পাশে ও সম্মুখে অনেকগুলি কামান। এখন এটিতে শিক্ষার্থী নৌ-সৈন্যরা থাকে।

 সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিত্রশালা, শিশুপ্রাসাদ, শিক্ষাগার, সংস্কৃতিভবন দেখি, তারপর থিয়েটার, বালে নৃত্য, ‘পাপেট থিয়েটার’। গ্রীষ্মকালে এখানে দিনরাতের ব্যবধান নেই, এখানে রাত্রি শুভ্র রৌদ্রময়ী। পাপেট বা পুতুলের থিয়েটার আমার চোখে এক অভিনব ব্যাপার। কৌতুককর একটা মিলনান্তক প্রেম কাহিনী, পুতুলেরা মানুষের মত কথা বলছে, অভিনয় করছে, জীবনে এমনটি কখনো দেখিনি।

 বিখ্যাত উইনটার প্যালেসে প্রবেশ করলাম। বিপুলতায় বিশালতায় ভাস্কর্যে স্থাপত্যে চিত্রাঙ্কনে এর জুড়ি পৃথিবীতে আছে কিনা জানিনে। ফরাসী সম্রাটদের ভার্সাই প্রাসাদের রূপের খ্যাতি আছে, কিন্তু দুইএর প্রকৃতি ভিন্ন। এর রূপ পুষ্পপেলব কমনীয় নয়, ঐশ্বর্য ও প্রতাপের উগ্রতায় প্রদীপ্ত। ফরাসী ইতালীয় ডেনিস জার্মান শিল্পীদের তিন শতাব্দীর সৌন্দর্য সৃষ্টি এই প্রাসাদের প্রতি কক্ষে অলিন্দে চত্বরে স্থির বিদ্যুতের মত অচপল হয়ে আছে।

 এই প্রাসাদের অধিকাংশ অর্থাৎ ৩৪০টি কক্ষ ম্যুজিয়ম। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিত্র, পুরাতন মূর্তি অস্ত্রশস্ত্র বসন-ভূষণাদিতে সুসজ্জিত এই ‘যাদুঘর’ এখন আর্মিটাস বা হার্মিটেজ নামে পরিচিত। মোটামুটি দেখতে গেলেও ৫।৭ দিন সময় লাগে। ৩।৪ ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম, গ্রীক ও রোমক ভাস্কর্যের নিদর্শনের প্রচুর সংগ্রহ দেখে বিস্মিত হলাম।

 লেনিনগ্রাদের লোকসাধারণের জীবনযাত্রা দোকান পশার কারখানা হাসপাতাল মস্কৌর মতই, মস্কৌর মতই সহর প্রসারিত হচ্ছে, নূতন নূতন আবাসগৃহ তৈরী হচ্ছে। ১০ই জুলাই অপরাহ্ণে স্থানীয় লেখক ও সাংবাদিক সঙ্ঘের বিদায় সম্বর্ধনার পর রাত্রের ট্রেনে আমরা লেনিনগ্রাদ ত্যাগ করলাম।