এক

 “লৌহ-যবনিকার” ওপার থেকে যখন সোবিয়েত রাশিয়ার লেখক-সঙ্ঘের আমন্ত্রণ এলো, তখন জানতাম না এপারেও একটা ‘খাদি-যবনিকা’ আছে। অহিংস নিরপেক্ষতায় সমুজ্জ্বল দুগ্ধ-ধবল সাদা, কিন্তু তার ওপরও সিকিউরিটি পুলিশের ছায়ামূর্তি অস্পষ্ট ভাবে নড়াচড়া করে। চেনা যায় না, কিন্তু বোঝা যায়। রোম্বাই-এর দু’জন সাংবাদিক ছাড়পত্র পেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হ’ল। তিন জনকে ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করা হ’ল। ৭ই জুন (১৯৫১) বোম্বাই থেকে পাঁচ জন সাংবাদিক, লেখক কবি ও বৈজ্ঞানিক এক বিবৃতিতে বললেন, “যাঁরা বৃটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের অবারিত ভাবে সুবিধা দেওয়া হয়, কিন্তু যাঁরা সোবিয়েত রাশিয়া বা গণতান্ত্রিক চীনে বা অনুরূপ দেশে ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের নানা ভাবে বাধা দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের বৈদেশিক নীতির মূল ভিত্তি, কোনো শক্তি-শিবিরে জড়িয়ে না পড়া এবং নিরপেক্ষ নীতির ঘোষিত উদ্দেশ্যের এটা বিপরীত।

 “আমরা ব্যক্তিগত ভাবে ও সম্মিলিত ভাবে চেষ্টা করেও, গভর্নমেণ্টের পক্ষ থেকে ছাড়পত্র না দেবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ জানতে পারিনি, গভর্নমেণ্টের মনোভাব দুর্বোধ্যই রয়ে গেল। এ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের একমাত্র অপরাধ আমরা মস্কৌ থেকে আমন্ত্রিত হয়েছি। এটা তাঁরা অস্বীকার করবেন, কিন্তু আমাদের ভারতের বাইরে যাওয়াটা অবাঞ্ছনীয় কেন, তার কোন যুক্তিসঙ্গত হেতু তাঁরা নির্দেশ করবেন না। আমরা দাবী করছি, শিষ্টাচারের খাতিরেও তাঁরা আমাদের ও জনসাধারণের নিকট একটা কৈফিয়ৎ দিন। কেন না, এর সঙ্গে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িত।”

 ১১ই জুন নয়াদিল্লীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কৈফিয়ৎটা দিলেন স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল। তিনি বললেন, ৩৯ জন নিমন্ত্রিতের মধ্যে ৩০ জনকেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বিদেশে যেতে কাউকে বাধা দেবার প্রশ্ন ওঠে না। যে-কয়জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি, তার কারণ তাঁরা রাশিয়া যেতে চাচ্ছেন বলে নয়। নিয়ম মত এ ব্যাপারে প্রাদেশিক গভর্নমেণ্টগুলিরও বক্তব্য আছে এবং তাঁরা ঐসকল ব্যক্তির “অতীত কার্যকলাপ” বিবেচনা করে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। আমি ত্রিশ বৎসর বাঙ্গলা দেশে সাংবাদিকতা করছি। স্বাধীনতা লাভের পরও আমার “অতীত কার্যকলাপ” রাজ্য-সরকারের নিকট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে আছে জেনে বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হলাম। ছাড়পত্র না পাই, কিন্তু এই অপবাদ নিঃশব্দে পরিপাক করা কঠিন। নয়াদিল্লীর বৈদেশিক দপ্তরে কথাটা জানালাম। তারের উত্তরে জবাব এলো ছাড়পত্র মঞ্জুর হয়েছে। ১৫ই জুন বিকালে ছাড়পত্র নিয়ে সেই দিন রাত্রেই দিল্লী যাত্রা করলাম। ‘খাদি-যবনিকা’ উত্তোলিত হ’ল।

 ১৯শে জুন সকালে আমরা ১৬ জন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক দিল্লী বিমানঘাঁটিতে বন্ধুবান্ধবদের নিকট বিদায় নিয়ে লাহোরগামী বিমানে যাত্রা করলাম। দুপুরে লাহোর ফেলেটি হোটেলে বিশ্রাম করে বিকেলের ট্রেনে পেশোয়ার যাত্রা। আফগান-কনসাল এসে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন এবং কাবুল-যাত্রার ব্যবস্থা করে দিলেন। জমরুদ দুর্গের সামনে পাশপোর্ট ইত্যাদি পরীক্ষা হ’ল। আমার কিছুটা দূর অগ্রসর হয়েছি, এমন সময় কাবুলের সোবিয়েত দূতাবাসের এক জন রুশ কর্মচারী আমাদের সঙ্গে মিলিত হলেন। খাইবার পাস আঁকাবাঁকা রাস্তা, দু’ধারে রুক্ষ তরুগুল্মহীন তরঙ্গায়িত পর্বতমালা। ইংরাজ সরকার সাম্রাজ্যরক্ষার প্রয়োজনে চমৎকার রাস্তা করেছেন। একটি রেলপথও খাইবারের পশ্চিম প্রান্তে লাণ্ডিখানা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। আমি পূর্বে দু’বার রেলপথে লাণ্ডিখানা পর্যন্ত এসেছি। তখন এটা বৃটিশ ভারতের সীমান্ত ছিল। তোরখামে এসে মোটর থামলো, সুরু হ’ল আফগান দেশ।

 লৌহদ্বার উন্মুক্ত হল। রাস্তা কদর্য, যেন কোন শুকিয়ে-যাওয়া নদীর উপল-আস্তীর্ণ বুকের উপর দিয়ে চলেছি। ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছি, উলঙ্গ পাহাড়শ্রেণী, মাঝে দুর্গ বা পাহারা দেবার ঘাঁটির ধ্বংসাবশেষ পাহাড়ের গায়ে ঝুলছে। কোথাও সবুজের রেশ দেওয়া ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। ডেকায় এসে আবার ছাড়পত্র পরীক্ষা হ’ল। যুবক অফিসারটি যথেষ্ট সৌজন্য দেখালেন। তরমুজ ও খরমুজা খাওয়ালেন। মাঝখানে খরস্রোতা নদী, নদীর দুই তীরে শস্যক্ষেত্র, সবুজ গালিচার মত বিস্তৃত। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। কিছুকাল বিশ্রাম করে বেলা ৪টা আন্দাজ জেলালাবাদ ডাকবাংলোয় পৌঁছান গেল। তখন দস্তুর মত খিদে পেয়েছে। কিন্তু রমজান মাস। খাদ্য তো দূরের কথা, এক পেয়ালা চা’ও পাওয়া গেল না। সহরের খাবার দোকানও বন্ধ। দেখলাম, স্থানে স্থানে সরবতের পাত্র নিয়ে লোকে পশ্চিমমুখো হয়ে বসে আছে, কামান দাগা হলেই রোজাভঙ্গ করার প্রতীক্ষায়। হতাশ হয়ে যাত্রা করা গেল। রাত্রি নয়টায় সুরাইয়া পান্থনিবাসে আসা গেল। দুপুরে ছিল অসহ্য গরম। এখন শীতল হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল। এটা জার্মানরা তৈরী করেছিল, আধুনিক আরামের সাজ-সরঞ্জামের অভাব নেই। আহার-পর্ব শেষ করে, বাইরে চত্বরে খাটিয়ার ওপর নরম বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ফুলের গন্ধ, চেনার গাছের মর্মর ধ্বনি, গিরি নির্ঝরিণীর কলস্বরের একতারা, তরল চাঁদের আলো—মনোরম পরিবেশ!

 বুধবার ২০শে জুন চা-পান শেষ করে যাত্রা শুরু হ’ল। এখান থেকে কাবুল ৪০ মাইল। তরঙ্গায়িত পর্বতশ্রেণীর বুক চিরে খরস্রোতা কাবুল নদী— তার দু’পাশে চাষের জমি, ফলের বাগান। নদীর জল নিয়ন্ত্রণ বা সেচ-ব্যবস্থা এ সব কিছুই নেই। কৃষি-ব্যবস্থা সনাতন কালের, মাংসপেশী ও আদিম যন্ত্রের ওপর নির্ভর। কৃপণ প্রকৃতি দয়া করে যা দেয়, দরিদ্র কৃষকদের তাই সম্বল। শুনলাম, জল-বিদ্যুৎ কারখানা ও আধুনিক সেচ ব্যবস্থা পত্তন করবার ভার এক মার্কিন কোম্পানীকে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা তিন বৎসর কেবল জরিপ করছেন। যন্ত্র-শিল্প আফগানিস্থানে নেই, সামন্ততান্ত্রিক যুগের ধারা অব্যাহত। পথে দেখলাম, উট, গাধা, খচ্চরের পিঠে গৃহস্থালির জিনিসপত্র ও ছাগল ভেড়া মুরগী শিশুদের বোঝাই দিয়ে একশ্রেণীর যাযাবর চলেছে। পাহাড়ের ওপর থেকে আমরা নামতে লাগলাম। সম্মুখে সমতল কাবুল উপত্যকা, শ্রীহীন জীর্ণ কুটিরে মলিন-বসন নর-নারী, ছোট ছেলেরা ভেড়া চরাচ্ছে। ক্রমে রাস্তা চওড়া হ’ল। দু’ধারে শস্যক্ষেত্র, ফলের বাগান, গাছপালায় ঘেরা পাকা বাড়ি দেখতে দেখতে আমরা কাবুল সহরের দ্বারে এলাম। এখানে আফগান সরকার, সোবিয়েত ও ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধিরা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। আমরা আফগান সরকারের অতিথিরূপে কাবুল হোটেলে এসে উঠলাম।

 হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে কাবুল সহর, মাঝখানে নদী। বাজার বা চাঁদনীতে আবর্জনা, বিশৃঙ্খলা আমাদের দেশের সহরের মতই, আধুনিক সহর অনেকটা পরিচ্ছন্ন। এখানেও চৌরঙ্গী আছে, আবার বস্তীও আছে। বড় রাস্তার পাশের গলিতে ঢুকলেই দারিদ্র্য, আবর্জনা, উলঙ্গ ধূলিধূসর শিশুর দল প্রাচ্যের অচলায়তনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা রাজা আমানুল্লার প্রাসাদ, ম্যুজিয়ম, সম্রাট বাবরের সমাধি প্রভৃতি দর্শন করলাম। রাত্রে হোটেলে আফগান স্বরাষ্ট্র-সচিব এক বিরাট ভোজে আমাদের আপ্যায়িত করলেন। অনেক রাত্রি পর্যন্ত গান-বাজনা হ’ল। কাবুলী ওস্তাদদের সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র ভারতীয় বলেই মনে হ’ল।

 ২২শে জুন প্রভাতে কাবুল বিমান ঘাঁটি। সোবিয়েত বিমান প্রস্তুত। সোবিয়েত রাশিয়ার জয়ধ্বনি দিয়ে বিমানে আরোহণ করলাম। বিমান অতি ঊর্ধ্বে উঠেছে—নীচে হিন্দুকুশ পর্বতমালা, কৃষ্ণকঠিন বিস্তারে বহু বিচিত্র আকার ও আয়তনের তুষার স্তূপ দেখতে দেখতে আমরা আমুদরিয়া নদী পার হয়ে সোবিয়েত ভূমি তেরমেজে অবতরণ করলাম। তেরমেজ আফগানিস্থান ও উজবেকীস্থানের সীমান্তে একটা ছোট্ট সহর—সোবিয়েত রেলপথের শেষ সীমা। বাক্স-পেট্‌রা ও ছাড়পত্র পরীক্ষার পর আবার বিমান আকাশে উঠলো। অল্পক্ষণ পরেই আমরা উজবেক রিপাবলিকের রাজধানী তাসকেণ্টে এসে পৌঁছলাম। স্থানীয় লেখক-সঙ্ঘ মহিলা কবি জুলফিয়ার নেতৃত্বে অভ্যর্থনা করলেন। এখান থেকে আমাদের ভার নিলেন সোবিয়েত লেখক-সঙ্ঘের বৈদেশিক বিভাগের সহকারী সভাপতি মিকায়েল এপ্লেটিন। বয়স ৬৩ বৎসর, সুগঠিত দেহ শক্তিমান প্রৌঢ়, সদা হাস্যময়, পরিহাস-রসিক। রুশ ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানেন না। এ ছাড়া যিনি আট সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে সর্বদা ছিলেন এবং দোভাষীর কাজ করেছেন, তাঁর সঙ্গেও পরিচয় হ’ল। বিধবা যুবতী, মহাযুদ্ধে স্বামী নিহত হয়েছেন। একটি কন্যা আছে। কমরেড ক্রগারাস্কায়া অকসানা সিমনোভার মত বিদুষী মার্জিতরুচি দৃঢ়চেতা মহিলা জীবনে কম দেখেছি। অসঙ্কোচ সারল্যে অল্পক্ষণের মধ্যেই আপনার জন হয়ে গেলেন। এঁর আদরযত্ন নিরলস সেবা সব জিনিস খুঁটিয়ে দেখাবার আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আমার অপটু দেহের জন্য খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম সম্বন্ধে সর্বদা সতর্ক থাকতেন, অভিভাবকের মত তিনি নিষেধ করতেন, নির্দেশ দিতেন। আমি ওঁকে ডাকতাম ‘বউমা’। বউমা কি? আমি বললাম পুত্রবধু। শুনে তো হেসে কুটিপাটি। কর্তব্যে কঠোর, কর্মে নিরলস কমরেড অকসনা, আধুনিক সোবিয়েত সমাজের একজন আদর্শ নারী।

 তাসকেণ্ট সহরটি ছোট নয়, লোকসংখ্যা সাত লক্ষের ওপর। জারের আমলে এখানে শিল্প কারখানা বিশেষ কিছু ছিল না। দরিদ্র কৃষক-শ্রমিকদের মাটির কুঁড়ে আর যাযাবরদের তাঁবু, নোংরা বস্তী আর সরকারী কর্মচারীদের বাড়ি ও আপিস-আদালত নিয়ে ছিল মফঃস্বলের সহর। বর্তমান সহর দেখে বিস্মিত হলাম। চওড়া রাস্তা, রাস্তার মাঝখানে দু’ধারে গাছের সার দেওয়া ফুলবাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটবার পথ। ট্রাম, বাস, ট্রলী-বাস চলছে। অতি আধুনিক সহরের সমস্ত ব্যবস্থা রয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সহর। আমরা ঘুরতে ঘুরতে একটা বাগানে এলাম। বাগানে উজবেক জাতীয় কবি আলি শের নভই-এর প্রকাণ্ড মূর্তি, দক্ষিণে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত প্রকাণ্ড পাঁচতলা সংগীত সংস্কৃতি ভবন। আমরা বাগানে বসতেই এক পাল ছেলেমেয়ে ঘিরে দাঁড়ালো, বিদেশী দেখে কৌতূহলী হয়েছে। আমরা যখন নিজেদের দেখিয়ে বললাম ‘হিন্দী’, তখন ওদের মধ্যে উল্লাসের রোল পড়ে গেল। কেউ বলে রুশী, কেউ কেউ পরিচয় দেয় উজবেকী, তাতার, তুর্কী, তাজিক ব’লে। পোষাকে ও চাল-চলনে লক্ষ্য করলাম, এই সহরে মধ্য-এশিয়ার সমস্ত রিপাবলিকের লোক আছে, এবং জারের আমলের প্রবাসী রুশরাও আছে। মধ্য-এশিয়ার বস্ত্রশিল্পের প্রধান কেন্দ্র তাসকেণ্ট থেকেই ২২শে জুন আমাদের সোবিয়েত ভ্রমণ আরম্ভ। ৪ঠা আগষ্ট আমাদের ভ্রমণের পরিসমাপ্তি তাসকেণ্টেই।

 বহু ভাষাভাষী বহু জাতি-অধ্যুষিত সোবিয়েত রাশিয়া বিশাল দেশ। ছয়-সাত সপ্তাহ প্রায় অবিশ্রান্ত আমরা বিমানে, ট্রেনে, মোটরে হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করেছি, উত্তরে লেনিনগ্রাদ, মধ্যে মস্কৌ ও স্তালিনগ্রাদ, দক্ষিণ-পূর্বে সমরখন্দ, দক্ষিণ-পশ্চিমে কৃষ্ণসাগরের তীরে ককেশাশ পর্বতমালার কোলে সুকুমী গাগরী। জর্জিয়া ও উজবেকীস্থান এই দুইটি এশিয়ার রিপাবলিকের গ্রাম, নগর দেখেছি। মনে রাখতে হবে, ত্রিশ বছর পূর্বে জারতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের শাসন-শোষণে এখানকার কৃষক-শ্রমিকরা ছিল হতদরিদ্র, নিরক্ষর, কুসংস্কারে পঙ্গু। দশাটা আমাদের দেশের মতই। আমাদের দেশের মতই মুষ্টিমেয় ধনী, জমিদার, সরকারী চাকুরিয়া এবং স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত চূড়ার ওপর ময়ূরপাখার মত বিরাজ করতেন। রুশ দেশের এই মন্দভাগ্য জন-জীবন আমরা টলস্টয়, তুর্গেনিভ, গর্কীর লেখার মধ্যে দেখেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ পশুর স্তরে নেমে কি ভাবে নতশিরে অসীম অমর্যাদার মধ্যে জীবন যাপন করে তা তো স্বদেশে চক্ষুর সম্মুখেই প্রকট। যারা যত কঠোর পরিশ্রমী, সমাজে তাদের অবজ্ঞা ও অসম্মান তত বেশী। সকল প্রকার হীনতা স্বীকার করে শূদ্র দাসবৎ সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর ধন-ঐশ্বর্য আরাম-আয়াসের ব্যবস্থা করবে, ধর্মতন্ত্রে এই বিধান বহু শতাব্দী পূর্বেই পাকা করে দেওয়া হয়েছে। এই দুর্বল নিরুপায়েরা যে কোন দিন জোটবদ্ধ হয়ে মানুষের অধিকার দাবী করবে, এ তো কল্পনারও অগোচর ছিল। হাজার হাজার বছরের চেষ্টায় তৈরী সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার দুর্ভেদ্য দুর্গ ধুলিসাৎ করে দিয়ে সোবিয়েত রাশিয়া সর্বমানবের সমানাধিকারের ভিত্তিতে এক নয়া সমাজ-ব্যবস্থা পত্তন করেছে, যার নিন্দা ও প্রশংসা দীর্ঘকাল শুনে এসেছি।

 ১৯১৭-এর মহান্ অক্টোবর বিপ্লব, লেনিন-স্তালিন চালিত বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবার দুর্বার সঙ্কল্প বিশ্ব-ইতিহাসের এক বৃহৎ পটপরিবর্তন। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মান আক্রমণে দেশ ক্ষতবিক্ষত; বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির দ্বারা আক্রান্ত, প্রতিবিপ্লবীদের কৃতঘ্ন আঘাত অতিক্রম করে শিশু-সোবিয়েত নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো, প্রতি পাঁচ বছরে এক এক শতাব্দী এগিয়ে যাবে, এই তার পণ। দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বহু কালের দাসত্ব ও শোষণে পঙ্গু মানুষের জড়বুদ্ধি এই দুস্তর বাধা অতিক্রম করে তারা সকল রকম শোষকশ্রেণীর উচ্ছেদ করলো। গড়ে উঠলো এক ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে সর্বসাধারণের অভিপ্রায় ও উদ্যম কেন্দ্রীভূত হয়ে অসাধ্য সাধনকে সম্ভব করল। উদ্দেশ্যের ঐক্য লক্ষ্যের ঐক্য—সমাজতান্ত্রিক কলকারখানা, সমবায় কৃষিপদ্ধতি, সর্বজনীন শিক্ষাবিস্তারের বিস্ময়কর ক্ষিপ্র অগ্রগতির মধ্য দিয়ে যখন এরা কমিউনিজমের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন আচম্বিতে হিটলারের ফাসিস্ত বাহিনীর কৃতঘ্ন আক্রমণ। মনুষ্য জাতির ইতিহাসে কোন দেশ কোন জাতি এত বড় যুদ্ধের সম্মুখীন হয়নি। ভূমিকম্পের মত প্রচণ্ড আলোড়নের মধ্যে দৃঢ়পদে দাঁড়ালেন মার্শাল স্তালিন। তাঁর নির্দেশে লাল পল্টন অকুতোভয় শৌর্যে মানব-মুক্তির রণক্ষেত্রে ধাবিত হ’ল। তার আঘাত ও প্রতিঘাত করবার প্রচণ্ড শক্তি মহাসমরের রক্তাক্ত বহ্নিশিখায় দীপ্যমান হয়ে উঠলো। জগত বিস্ফারিত নেত্রে দেখলো সোবিয়েত রাশিয়ার কঠিনবীর্য পৌরুষ, তার রণনৈপুণ্য, তার সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালীর বিস্ময়কর সাফল্য। অগ্নিপরীক্ষায় বিজয়ী সোবিয়েত রাশিয়ার এই নৈতিক শক্তি আজ আবার শান্ত-সমাহিত চিত্তে গঠন ও পুনর্গঠন কাজে প্রবৃত্ত। মহাযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েও সে অতলান্তিকের ওপারে ভিক্ষের জন্য হাত পাতেনি, ধনতন্ত্রী দুনিয়া তাকে একঘরে করেছে, তবু সে ক্ষোভহীন নিঃশঙ্ক। এই নূতন জগতকে চোখে দেখবার সুযোগ এক দুর্লভ সৌভাগ্য। কৌতুহল ছিল, তাই শ্রদ্ধাসন্নত মন নিয়েই সোবিয়েত ভূমিতে এসেছি। এই বিশাল দেশের বন্ধনজর্জর পরস্পরবিচ্ছিন্ন বক্রমেরুদণ্ড মানুষগুলিকে এরা মাত্র ত্রিশ বছরে জ্ঞানের ক্ষেত্রে, আনন্দের ক্ষেত্রে, সৃষ্টির ক্ষেত্রে কত বড় মুক্তি দিয়েছে, তার কিছুটা পরিচয় দেবার চেষ্টা করবো।