দুই

 অবশেষে মস্কৌ-এ আসা গেল। ২৩শে জুন শনিবার বেলা সাড়ে এগারটা। বিমান-ঘাঁটিতে সোবিয়েত লেখক-সঙ্ঘের প্রতিনিধিরা রাশি রাশি পুষ্পগুচ্ছ উপহার দিয়ে সম্বর্ধনা করলেন। নির্মেঘ আকাশ, উজ্জ্বল রৌদ্রালোক, আরামপ্রদ প্রশস্ত মোটরকারে চলেছি। পথের দু’ধারে বন, উপবন, বার্চ গাছের শুভ্র সমুন্নত ঋজু দেহ, চেনার ও ওকেরা মাথা তুলে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তারি ফাঁকে-ফাঁকে বাগান, কত রকমারি রং-এর ফুল। ত্রিশ মাইল পথের দু’ধারে কৃষিক্ষেত্রও আছে। সহরের কাছাকাছি আসতেই অনেক পুরানো ধরনের বাড়ি দেখা গেল। বামে নূতন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি তৈরী হচ্ছে, ছোট-বড় ক্রেন হেলছে-দুলছে। ক্রমে মস্কোয়া নদীর সেতু পার হয়ে ক্রেমলিন প্রাসাদ-দুর্গ ডাইনে রেখে, আমাদের গাড়ি হোটলের দরজায় থামলো। হোটেলটির নাম, “হোটেল ন্যাশনাল।” এর আসবাবপত্র, সাজসজ্জা, মখমল ও রেশমের পর্দা, সুবিন্যস্ত শয়নগৃহ, পরিপাটি ভোজনাগার; বোম্বাই-এর বিখ্যাত তাজমহল হোটেলও এর তুলনায় দরিদ্র। এই পাঁচতলা হোটেলে পাঁচশ’র ওপর কামরা আছে। এই হোটেলেই আমরা বরাবর থেকেছি। সাত সপ্তাহের মধ্যে তিন সপ্তাহই আমরা মস্কৌ-এ ছিলাম। মস্কৌ-এ এমন এবং এর চেয়েও বড় চার-পাঁচটা হোটেল আছে। শুনলাম, আরও গোটাকয়েক অতিকায় হোটেল তৈরী হচ্ছে। এরই ১২৭ নং কামরা আমার জন্য নির্দিষ্ট হ’ল। পুব দিকে জানলা, সম্মুখে সিকি মাইল চওড়া রাস্তা, তার ওধারে ক্রেমলিন; উচ্চ প্রাচীরের ওপরে জারের আমলের গীর্জার গম্বুজ, পথের দুই প্রান্তে সারিবদ্ধ চেনার গাছগুলি গ্রীষ্মকালের পত্রসম্ভারে ঘন সবুজ। ট্রাম, বাস, ট্রলি-বাস মোটর চলেছে, আর চলেছে জলস্রোতের মত জনস্রোত। ভীড় নেই, ঠেলাঠেলি নেই, নেই চীৎকার ও হট্টগোল। এ কোন্ লোক থেকে কোন্ লোকে এলাম!

 অপরাহ্ণে পুষ্পগুচ্ছ নিয়ে আমরা রেড স্কোয়ারের দিকে অগ্রসর হলাম। প্রায় দুই মাইল লম্বা শ্রেণীবদ্ধ জনতা মন্থর পদে এগিয়ে যাচ্ছে লেনিনের সমাধির দিকে। আমাদের ‘গাইড’ গিয়ে পরিচয় দিলেন, “ইণ্ডিসকী পিশাচলী ডেলীগাৎসী—” জনতা সম্ভ্রমে বিদেশীদের জন্য পথ করে দিল। রুশ ভাষায় সাহিত্যিক লেখকদের বলে “পিশাচ”। আমাদের দেশে লেখকদের যে দশা, তাতে ও-শব্দটা বাঙ্গলা ভাষাতেই মানানসই হ’ত। যা হোক, আমরা সমাধির দ্বারদেশে পুষ্পস্তবকের শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। মর্মর-নির্মিত বেদীর ওপর ডিম্বাকৃতি কাঁচের আবরণের মধ্যে, চিরপদদলিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম ও প্রধান সেনাপতি মহামানব লেনিন চিরনিদ্রায় শায়িত, প্রশস্ত ললাটে দৃঢ়নিবদ্ধ ওষ্ঠে স্বল্প শ্মশ্রুমণ্ডিত কপোলে চিবুকে বিশ্বমানবের মুক্তির মৃত্যুঞ্জয়ী সঙ্কল্প। অবনত শিরে প্রণাম নিবেদন করে নিষ্ক্রান্ত হলাম। মানবের ইতিহাসে এ এক অভাবনীয়ের আবির্ভাব। প্রত্যহ জানলা দিয়ে দেখেছি, কাতারে কাতারে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা চলেছে তাদের মহান্ নেতা লেনিনকে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করতে। লেনিন ও স্তালিন এই দুই বিপ্লবী নেতার প্রতি লোক-সাধারণের কি অবিচল শ্রদ্ধা! এক জন সোবিয়েত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্রষ্টা। অপর তাঁর উত্তরাধিকারকে অঙ্গীকার করে পালয়িতা। দেখেছি, এই দুই নরকেশরীর প্রতিমূর্তি এবং প্রতিকৃতি রাশিয়ার সর্বত্র। ভারতেও এক দিন স্বতন্ত্র ভাবে এমনি ঘটনা ঘটেছিল। তন্ত্রমন্ত্রসহায় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের কুহকে অধিকার-বঞ্চিত স্ত্রী-শূদ্র ভগবান বুদ্ধদেবের জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে ধর্মের সমানাধিকারের নামে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল, সেদিন ভগবান তথাগতের অগণিত মূর্তিতে সমস্ত এশিয়া ছেয়ে গিয়েছিল। যুগ-যুগান্ত থেকে মানুষ নর-পূজক। অহিংসা শান্তি মৈত্রী সর্বমানবের কল্যাণ এ সব আদর্শ যখন কোন মানুষের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে, তখনই তিনি বহু মানবের পূজা পেয়েছেন। রুশদের এই বীরপূজা হয়তো অনেকের দৃষ্টিতে আতিশয্য মনে হবে, কিন্তু আমার ভারতীয় দৃষ্টিতে এটা অস্বাভাবিক মনে হবে কেন? আমরাও রাজঘাটকে তীর্থ করেছি, সরকারী দপ্তরখানায় আপিস-আদালতে বিদ্যালয়ে বৈঠকখানায় গান্ধীজীর প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠা করেছি।

 ২৩শে জুন থেকে ৬ই জুলাই দু’সপ্তাহ মস্কৌ-এ কাটলো। এখানে যা দেখছি সবই আশ্চর্য লাগছে। ৭০ লক্ষ নরনারীর বাসভূমি এই বিশাল সহরে বাসগৃহের টানাটানি আছে, বসবাসের কৃচ্ছ্রতাও আছে, কিন্তু বস্তি নেই, আমাদের দেশের মত কেউ ফুটপাথেও সংসার পাতেনি। বড় বড় নূতন রাস্তা ও সহরের উপকণ্ঠে অতিকায় প্রাসাদ নির্মিত হচ্ছে কর্মীদের বাসের জন্য। দশ-বারো তলা একটা বাড়ি একশ’ দিনে তৈরী হচ্ছে। শুনলাম, বছর খানেকের মধ্যে গৃহ-সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। শ্রমিকদের থাকবার বাড়িগুলোকে বলে ‘এপার্টমেণ্ট হাউস’। এক থেকে পাঁচ কামরার ফ্লাট; পারিবারিক প্রয়োজন মত স্টেট বা ট্রেড ইউনিয়ন থেকে বণ্টন করে দেওয়া হয়। উপার্জনের তারতম্যে বাড়িভাড়া উপার্জনের শতকরা এক ভাগ থেকে চার ভাগ। বাড়ির ভাড়া বাড়িয়ে অথবা খালি বাড়ি নজর নিয়ে চড়া ভাড়ার দাঁও মারা এ দেশে বহু কাল বাতিল হয়ে গেছে। এখানে জমি ও বাড়ির (সহরে) মালিক হয় রাষ্ট্র, নয় শ্রমিক ইউনিয়ন কিম্বা ম্যুনিসিপালিটি। বিগত যুদ্ধে মস্কৌ এত সুরক্ষিত ছিল যে নাৎসী বিমান বোমাবর্ষণ করতে এসে বারম্বার পুচ্ছ-প্রদর্শন করে পালিয়েছে। মহাযুদ্ধের সময় ও গঠন-কাজ চলেছে পুরোদমে। এমন কয়েকটা হাসপাতাল স্কুলবাড়ি বাসগৃহ ও সংস্কৃতি-ভবন দেখলাম, যা যুদ্ধের সময় তৈরী হয়েছে। বাড়ির পর বাড়ি উঠছে, সহরের আয়তন ও পরিধি বেড়ে চলেছে, নগরীর উপকণ্ঠে দু’টো নূতন সহর পত্তন হচ্ছে। তবে এখন লোকে ঠাসাঠাসি করে বাস করে, কারো মুখে নালিশ নেই। আমার এক পুরাতন বন্ধুর বাসায় গেলাম, ইনি বুদ্ধিজীবী, সাড়ে চার হাজার রুবল মাসে মাইনে পান। সস্ত্রীক থাকেন; সম্প্রতি একটি ছেলে হয়েছে। একখানা ঘর শোবার ও বৈঠকখানা; স্নানাগার ও রান্নাঘর। বিজলী ও বাড়িভাড়া দেন ত্রিশ রুবল। এক দিন এক রুশ যুবতীর সঙ্গে আলাপ হ’ল। টাইপিস্ট, ইংরেজী জানে, দোভাষীর কাজও করে। বিয়ে করেছে একজন মোটর-মিকানিককে। দু’জনের উপার্জন মাসে প্রায় দু’হাজার আটশ’ রুবল। এরাও এক কামরার ফ্লাটে থাকে। আমি বললাম, এ দেশের নিয়মে বিবাহের পর তোমরা তো দু’কামরা ফ্লাট চাইলেই পেতে পার। মেয়েটি হেসে বললে, দরকার হয় না, যাদের ছেলেপুলে আছে তাদের দরকার আমাদের চেয়ে বেশী। আমি কৌতুক করে বললাম, ধর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মান-অভিমানের ব্যাপার ত আছে, আর একটা ঘর থাকলে গোসা করে স্বতন্ত্র হবার সুবিধা হয়। আমার কথা শুনে সলজ্জ ভাবে বললো ওটা আমরা মানিয়ে নেই। সোবিয়েত শিক্ষাপদ্ধতির ফলে এই স্বার্থবুদ্ধিহীন সমাজ-চেতনা ওদের মনে জাগ্রত হয়েছে। আরো অনেক ব্যাপারে প্রমাণ পেয়েছি, সোবিয়েত তরুণ-তরুণীদের মনের চেহারা আমাদের দেশের মতই নয়। আত্মপরায়ণ অনুদারতা এদের সমাজ-ব্যবস্থায় প্রায় দূর হয়েছে।

 মস্কৌ সহরে দশ-বারটি বৃহৎ ম্যুজিয়ম আছে। এগুলিতে ঐতিহাসিক, কলাবিদ্যা, কারুশিল্প প্রাচীন ও হাল আমলের নিদর্শন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়ার বিভিন্ন বিভাগের ক্রমবিবর্তনের ধারা স্তরে স্তরে সাজনো হয়েছে। দেখলেই বোঝা যায়, বাদশাহী আমলের অভিজাতদের প্রাসাদগুলিকে এরা জনশিক্ষার নিকেতনে পরিণত করেছে। মস্কৌ পুনর্গঠন ম্যুজিয়ম এর অন্যতম। মস্কৌ নগরীর আটশ’ বছরের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস এখানে ছবি নক্সা মানচিত্র নানা মডেলে স্তরে স্তরে সুবিন্যস্ত। সমাজতান্ত্রিক আমলে পুরাতন মস্কৌ কি ভাবে বদলাচ্ছে ও বদলাবে তার বড় বড় ইমারতের খসড়া ও নমুনা। কেবল পাদদেশে পরিচয় লেখা বস্তুপুঞ্জের সমাবেশ নয়। প্রত্যেক ঘরে সব বিষয় বুঝিয়ে দেবার জন্য উপদেষ্টা আছে। দেখলাম, দর্শকদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী। এরা রাজধানীর সমস্ত পরিচয় জানছে বুঝছে ভবিষ্যতের গঠনের কথা শুনছে। আমাদের ‘সবে ধন নীলমণি’ কলকাতার যাদুঘরে এমন ব্যবস্থা নেই। লোকে ভীড় করে দেখে যায়, লোক-সাধারণ বুঝলো কি না বুঝলো তা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেছে এমন কথা শুনিনি। এখানে সোবিয়েত রাশিয়ার গর্ব ও গৌরবের ‘মস্কো-মেট্রো’ বা ভূগর্ভ রেল-লাইনের পরিকল্পনা দেখলাম। কতটা হয়েছে, কতটা প্রসারিত হবে, কি ভাবে কাজ এগুচ্ছে, নানা রং-এর আলোক সম্পাত করে তা আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হ’ল। বড় বড় বাড়ি কি ভাবে অক্ষত অবস্থায় ইচ্ছামত সরিয়ে নেওয়া হয়, সেই যন্ত্রের একটা মডেল দেখলাম। ইঞ্জিনিয়রিং বিদ্যায় এরা কোন দেশ থেকে পিছিয়ে নেই। এদের মস্কৌ-ভল্গা কেনাল, মরুভূমিতে খাল কেটে সেচ-ব্যবস্থা, মেট্রো বা ভূগর্ভস্থ রেলপথ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্রগুলি সোবিয়েতের তরুণ ইঞ্জিনিয়রদের সৃজনীপ্রতিভার সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছে।

 যে প্রশস্ত রাস্তাটি ‘রেড স্কোয়ার’ থেকে বেরিয়ে ‘হোটেল ন্যাশনালের’ গা ঘেঁষে পশ্চিমমুখো চলে গেছে, তার নাম গর্কী স্ট্রীট। সহর-কর্তারা স্থির করলেন, রাস্তাটাকে চওড়া করতে হবে, অতএব এক পাশের বাড়িগুলো ভেঙ্গে ফেলা যাক। আপত্তি উঠলো, ওতে অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতি-মণ্ডিত ভবন লুপ্ত হবে। অতএব ইঞ্জিনিয়রদের পরামর্শে বাড়িগুলো সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা হ’ল। শুনলাম, দশ-বারতলা অতিকায় ইমারতগুলি, বিজলী টেলিফোন ও জলের পাইপের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না করে, যন্ত্রযোগে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ মাত্র দু’বৎসর পূর্বের কথা। এই গর্কী স্ট্রীট দিয়ে বহু বার যাতায়াত করেছি, দেখেছি দু’ধারে ১০।১২ হাত উঁচু চেনার গাছের সার। দু’বছরে গাছগুলি এত বড় হ’ল কি করে? জবাব পেলাম, সমান মাপের এই গাছগুলিকে বন থেকে তুলে এনে লাগান হয়েছে। এখানে বাগান ও গাছ-পালার কত যত্ন! পথের ধারের গাছের গোড়ায় বৃত্তাকার লৌহবেষ্টনী, যাতে গাছের শিকড়ে পথিকের পায়ের চাপ না লাগে।

 মস্কৌর রাস্তায় দিবারাত্র লোক চলাচল করছে। সকলেরই ফিটফাট পোষাক, দৈন্যের মালিন্য নেই। দেখলেই বোঝা যায়, এরা সব কাজের লোক। অথচ জীবন-সংগ্রামের নিষ্ঠুর তাগিদে এরা উন্মত্তের মত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে না। মেয়েদের পোষাকে রুচিবোধ আছে, কিন্তু বিলাসিতার পালিশ নেই। ঠোঁটে-মুখে রং দেওয়া, আঁকা ভ্রূ, অতি-প্রকট প্রসাধন কদাচিৎ চোখে পড়েছে। রূপের কৃত্রিম জৌলুষ রুশ-যুবতীরা পছন্দ করে না, তারা স্বাস্থ্যের স্বাভাবিক লাবণ্যের শ্রী-মণ্ডিত। এরা প্রগলভা নয়। রাস্তায় পুরুষের সঙ্গে কোমর জড়াজড়ি করে এরা চলে না। সোহাগে গলে পুরুষের বাহু নির্ভর করে এরা মরালগামিনী নয়। পশ্চিম-ইয়োরোপের মত পথে-ঘাটে-উদ্যানে প্রকাশ্য ভাবে চুম্বন আলিঙ্গন এরা কল্পনাও করতে পারে না। এক দিন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রীযুক্ত রাধাকৃষ্ণণ সোবিয়েত নারীদের খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘শিক্ষাবিধি এদের চরিত্র বদলে দিয়েছে। এদের চরিত্রে কঠোরতা আছে, রুক্ষতা নেই। এরা পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার ভোগ করে, জাতীয় কর্মশালার সকল বিভাগেই এরা কাজ করে। এ দেশ থেকে বিলাসিনীর দল অন্তর্ধান করেছে। বৃহৎ যন্ত্র এরা পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালাচ্ছে, বিপণি, কারখানা, হাসপাতাল, বিদ্যালয় এরা কর্ত্রী হয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে। এরা অবলাও নয়, দুর্বলাও নয়, অথচ স্নেহ-মমতায় ভরা নারী।’

 কয়েক দিন ক্রমাগত ৮।১০ ঘণ্টা হেঁটে ম্যুজিয়ম কারখানা নানা প্রতিষ্ঠান দেখার শ্রম দেহে সইল না; একদিন শেষ রাত্রে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। সকালে লেডী ডাক্তার এসে ওষুধের ব্যবস্থা করলেন, দুপুরে আর এক জন এলেন, নাক কান গলা পরীক্ষা করে দেখলেন। হোটেলের বুড়ি ঝি ওষুধ খাওয়ায়, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ভেবো না আমরা আছি। হেসে বলি, আমার দেশে এর চেয়ে বেশী যত্ন হ’ত না। শুনলাম, এখানে শতকরা চল্লিশ জনই নারী ডাক্তার। সেদিন আমার শয্যার পাশে এলেন এক জন মহিলা, আমার নিঃসঙ্গতা দূর করবার জন্য। নাম কমরেড রুবী। ইংরেজী ও জর্মন ভাষা জানেন। বহু বর্ষ চীনে কাটিয়েছেন। চীনের কমিউনিস্টদের অনেক গল্প বললেন। ভারতেরও অনেক খবর রাখেন। চীনে জনগণের দারিদ্র্য, রক্ষণশীলতা আর চিরাগত অভ্যাসের মূঢ়তা কেমন ভাবে বদলাচ্ছে, সেই কথা বলতে বলতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা তো আত্মকর্তৃত্ব পেয়েছ, তোমরা পারছো না কেন? আমাদের কি দারিদ্র্য ও দুঃখ ছিল, তা আমি নিজেই ভোগ করেছি। এখন যা দেখছো, এ তো আমাদেরও স্বপ্নের অগোচর ছিল।’ আমরা যে কেন পারি নে, সে অক্ষমতা আমাদের স্বভাবের মধ্যে পাকা আসন পেতেছে। জড়প্রথার দাসত্ব করতে করতে আমরা দৈব ও পরের ইচ্ছায় চালিত হই। এটা এই বিদেশিনীকে কেমন করে বোঝাই। দেড়শ’ বছরের ইংরেজ শাসন আমাদের সর্বরিক্ত দারিদ্র্যের মধ্যে, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ-অবিশ্বাসের মধ্যে পঙ্গু করে ফেলে রেখে গেছে। ইংরেজের পরিত্যক্ত ব্যবস্থা আমরা বদলাতে পারিনি, সে সাহসও পাই নে। আত্মকর্তৃত্ব লাভ আমাদের ভাগ্যে ফাঁকিই রয়ে গেল। মুখে বলি, ‘বিপ্লবের পর লেনিন-স্তালিনের পার্টির নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তোমরা প্রাচীন বাঁধনগুলো ছিড়ে ফেলতে পেরেছ বলেই তোমাদের সমাজের সর্বস্তরে এমন মুক্তির হাওয়া বইছে।’ রুবী সচকিত হয়ে বললেন, ‘সর্বস্তর বলতে তুমি কি বোঝ? আমাদের সমাজে শ্রেণী নেই। শ্রেণীভেদ আমরা লুপ্ত করেছি। আমাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর অস্তিত্ব সম্ভবপর নয়। ফলে সমাজের জ্ঞান বিদ্যা ঐশ্বর্য, একটা অংশে সঞ্চিত না হয়ে তা সকলের সম্পদ হয়েছে। মানুষের মধ্যে জাতিগত বা কুলগত বিশেষ গুণ বংশগত হয়ে সঞ্চারিত হয়, এ থিয়োরী যে মিথ্যা আমাদের সমাজের দিকে চাইলেই বুঝতে পারবে।’

 ‘সকল মানুষকে সমান অধিকার দেবার নামে, তোমরা বিশেষ মাপের মানুষ তৈরী করার জবরদস্তি চালাও, দেশে থাকতে এমন অভিযোগ শুনেছি।’

 রুবী হেসে বললেন, ‘ধনতন্ত্রী দেশের বুর্জোয়ারা দীর্ঘকাল এই অপবাদটা রটাচ্ছে। সোস্যালিজম এদের দৃষ্টিতে ব্যক্তির বিকাশকে দাবিয়ে দেওয়া, ব্যক্তিগত চেষ্টাকে নিরুৎসাহ করা, প্রত্যেককে কলে তৈরী পণ্যের মত সমান মাপে তৈরী করা। এই যদি হ’ত, তা’ হলে স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে, সোবিয়েতের যুবক-যুবতীরা এত সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, স্বকীয় শক্তির প্রেরণায় কাজ করার উৎসাহ পেল কোথা থেকে? তুমি চোখ খুলে যদি আমাদের দেশটা দেখ, তা’হলে দেখবে, সোবিয়েত যুবশক্তি কমিউনিস্ট-সমাজ গঠন করবার জন্য এগিয়ে আসছে,—আবিষ্কারক শিক্ষক কারুশিল্পী ইঞ্জিনিয়র স্থপতি বৈজ্ঞানিক শিল্পী অভিনেতা সঙ্গীতজ্ঞ। এরা কি কলে-ছাঁটা এক মাপের মানুষ?’

 রুবীর সঙ্গে সেদিনের আলোচনার পর আমার দেখে-শুনে মনে হয়েছে, কশাকের কশাঘাতে অপহৃত পৌরুষ, ধর্মমোহে আবিষ্ট, প্রথার অনুবর্তনে পঙ্গু মানুষকে সচল করবার জন্য প্রথম দিকে হয়তো বলশেভিকদের জবরদস্তি ছিল, ধনিক শ্রেণীকে উচ্ছেদ করার কঠোরতাও ছিল। বহু দিনের পতিত জমিতে ফসল ফলাতে হলে প্রথমে আগাছা মারতে হয়। বলশেভিকরা তীক্ষ্ণ লাঙ্গল চালিয়ে এক দিন পুরাতন বিধি-ব্যবস্থা শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলেছিল। সেই অবস্থা এখনো চলছে, এ কথা বললে এদের ওপর অবিচার করা হবে। শাসননীতির জবরদস্তি চলে, যেখানে অধিকাংশ মানুষ অবুদ্ধির অন্ধকারে থেকে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণীর দাসত্বকেই বিধিলিপি বলে মেনে নেয়। কিন্তু যারা শিক্ষা-প্রচারকে এমন প্রবল করে তুলেছে, যুক্তিপন্থী আধুনিক যুগের জ্ঞান-ভাণ্ডার সর্বসাধারণের সম্মুখে উন্মুক্ত করেছে, সেখানে জবরদস্তিকে সংযত হতেই হয়।

 এ দেশে পুলিশী রাষ্ট্রের বিভীষিকা, গুপ্ত গোয়েন্দা পুলিশের নিঃশব্দ পীড়নের কাহিনী অনেক শুনেছি। দেশসুদ্ধ লোককে সর্বদা ভয়ার্ত করে রাখার পাকাপাকি ব্যবস্থা। কিন্তু মুস্কিল এই, এ জিনিষটা চোখে দেখা যায় না। আমাদের বাঙ্গলা দেশে শৈশব কাল থেকেই পুলিশী-পীড়নের ব্যবস্থা দেখেছি। পুলিশের বিষাক্ত দংশনে কত তরুণ জীবন মুকুলে ঝরে গেছে। রাজদ্রোহের অপরাধে কারাদণ্ড এক দিন নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছিল। বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছে এই সন্দেহে গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্টে কত যুবক বিনা বিচারে আটক হয়েছে, দ্বীপান্তরে বছরের পর বছর আকাশের নক্ষত্র গোনে কাটিয়েছে। ইংরাজরাজের সেই পুলিশী ব্যবস্থা আজও অব্যাহত আছে। বিশেষ রাজনৈতিক মত পোষণের অপরাধে গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্টে সরকারী চাকুরী পায়নি বা চাকুরী থেকে বরখাস্ত হয়েছে, স্বাধীন ভারতেও এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের হাতবদল হলেও শাসকশ্রেণী পুলিশী দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করেনি। এই তো সেদিন স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে পুলিশী নিষ্ঠুরতার একখানি ছায়াচিত্র কর্তৃপক্ষ দীর্ঘকাল মঞ্জুর করেননি। তাঁদের যুক্তি, এতে পুলিশের প্রতি জনচিত্তে ঘৃণার উদ্রেক হবে। ইংরাজ আমলের পুলিশের আচরণ সম্পর্কেও সেন্সারী সতর্কতা আমরা দেখি। নাটকাভিনয় সম্বন্ধেও এমনি সতর্কতা আছে। পক্ষান্তরে, সোবিয়েত রাশিয়ায় এমন অনেক চলচ্চিত্র দেখেছি, যাতে জারের আমলের পুলিশের বীভৎস নিষ্ঠুরতা উলঙ্গ করে দেখান হয়েছে। একদিন মস্কৌ-এর এক সার্কাসে দু’জন পুলিশ কনেস্টবলকে কয়েকটি ছেলে কি ভাবে নাকাল ও নাস্তানাবুদ করলে, তার ব্যঙ্গাভিনয়ে সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ হাস্যধ্বনিতে মুখরিত হ’ল, এও দেখলাম। ম্যুজিয়মেও পুলিশী অত্যাচারের ছবি দেখেছি, বিপ্লবীদের প্রতি জারীয় পুলিশের অমানুষিক অত্যাচার কেবল ছবির পর্দায় নয়, রঙ্গমঞ্চের অভিনয়েও দেখেছি। নিষ্ঠুর পুলিশী শাসনের ধারা যদি তেমনিই থাকতো, তবে তার প্রতি জনচিত্তে ঘৃণার উদ্রেক করাটা আর যাই হোক, সোবিয়েত গভর্নমেণ্টের দূরদর্শিতার পরিচয় নয়। আমাদের ইংরাজ শাসকেরা তো নয়ই, দেশী শাসকেরাও এমন ভুল করেন না।