তিন

 প্রতিদিন ম্যুজিয়ম, লাইব্রেরী, পাঠাগার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেখছি, মোটরে সহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাচ্ছি। সকাল ১০টার পর থেকে পরিদর্শন সুরু হয়, সান্ধ্য ভোজনের পর অভিনয়, গীতি-নাট্য, ব্যালে নৃত্য দেখবার জন্য যাই, রাত্রি ১২টার পর নৈশ-ভোজন ও শয়ন। ১লা জুলাই থেকে নাট্যশালা বন্ধ হয়ে যাবে। নাটুকে দল, নট-নটীরা কেউ গ্রীষ্মাবকাশ যাপন করতে যাবেন অথবা নানা প্রান্তের নাট্যশালায় অভিনয় করতে যাবেন। আমরা বলশই থিয়েটার, মস্কৌ আর্ট থিয়েটার, মালী থিয়েটার, চেকোভস্কী ম্যজিক হল প্রভৃতি নাট্যশালায় নৃত্য-গীত-অভিনয় দেখেছি। এক মস্কৌ সহরেই ২৫।৩০টি নাট্যশালা আছে। বিপুল এগুলির আয়তন, ৪৫ তলায় অর্ধবলয়াকৃতি বসবার সুখদ আসন, দেয়ালে স্বর্ণরঞ্জিত কারুকার্য, মহার্ঘ আস্তরণ। এ সমস্তই জাতীয় সম্পদ। পুরাকালে যা অভিজাত ও ধনী সম্প্রদায়ের বিলাস ও ব্যসন ছিল, তার দ্বার আজ কৃষক ও শ্রমিক-শ্রেণীর জন্য উন্মুক্ত। অভিনয় সঙ্গীত বিশেষত ব্যালে নৃত্য ও অপেরায় এরা সকল দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। সঙ্গীত সম্বন্ধে আমার রসবোধ আদৌ নেই, ও নিয়ে অনধিকার চর্চা করবো না। ভাষা না জানার দরুণ অভিনয়ের অনেকখানি আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। উক্রেন লোক-নৃত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। একদিন সন্ধ্যায় বলশই থিয়েটারে এক স্বপ্নরাজ্য চক্ষুর সম্মুখে প্রকাশিত হ’ল। বিখ্যাত নর্তকী চিখামিরনোভা তাঁর দলবল নিয়ে ‘সোয়ান লেক’ অপেরা-পালা অভিনয় করলেন।

 আমি তরুণ বয়সে কলকাতায় আনা পাবলোভার রাজহংস নৃত্য দেখেছি। নৃত্যশাস্ত্রে আমার এমন কোন জ্ঞান নেই যে, তুলনামূলক বিচার করবো। পঞ্চাশটি রূপসী নর্তকীর মধ্যে চিখামিরনোভার অপূর্ব সাবলীল দেহের বিচিত্র ভঙ্গিমা, লীলাচঞ্চল পদদ্বয়ের লঘু গতি, তিন হাজার দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন। নৃত্যের অনায়াস নৈপুণ্যে তিনি প্রণয়বেদনা-বিহ্বল একটা ভাবলোকের সৃষ্টি করলেন, যার মাধুর্য রসে অভিভূত হয়ে গেলাম। মূর্খ ইন্দ্রিয়পরায়ণ ধনীর মন-ভোলানো নটীর চপল নৃত্য নয়, মানুষের নীচ প্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করবার জন্য বিশেষ অঙ্গের স্থূল সঞ্চালন নয়, এ দেহাতীত আনন্দময় সত্তার প্রকাশ। এই অভিনয়ের রাতে বৃটেনের ‘রেড-ডীন’ ডাঃ হিউলেট জনসন উপস্থিত ছিলেন। তিনি যবনিকা পড়লে, আমাদের ‘বক্সে’ এসে ভারতীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। পক্ক-কেশ, সৌম্য মূর্তি দেখলেই শ্রদ্ধায় অবনত হতে হয়।

 রুশ-দর্শকেরা আনন্দ প্রকাশ করবার বা নট-নটীদের অভিনন্দিত করবার জন্য বারম্বার দীর্ঘস্থায়ী করতালি দিয়ে থাকে। যবনিকা পড়া মাত্র হাততালি গ্রামে গ্রামে উঠতে থাকে। যার বা যাঁদের উদ্দেশ্যে এই করতালি, তাঁরা পর্দা সরিয়ে দর্শকদের সম্মুখে উপস্থিত হন। তাঁরা অন্তরালে গেলে আবার দ্বিগুণ জোরে হাততালি পড়তে থাকে। এই ভাবে অন্তত তিন-চার বার নট-নটীদের গুণমুগ্ধ ভক্তদের দর্শন দিতে হয়। যবনিকা পড়া মাত্র আমি তো কানে আঙ্গুল দিতাম, পার্শ্ববর্তীরা অবাক হয়ে তাকাত। আনন্দে আত্মহারা হয়ে এই বিরামহীন করতালির মাধুর্য আমি কিছুতেই উপভোগ করতে পারতাম না। এটা আতিশয্য সন্দেহ নেই, কিন্তু এ দেশে শিল্পী লেখক কবির প্রতি লোক-সাধারণের যে অনুরাগ ও শ্রদ্ধা দেখেছি, তা আমাদের দেশের শতকরা আশী জন অশিক্ষিত এবং শিক্ষিতম্মন্য কুশিক্ষিতদের কাছে প্রত্যাশাই করা যায় না।

 এদের অভিনয়, সঙ্গীত, নৃত্যকলার উৎকর্ষ সাধনের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রের সাহায্য। জাতীয় নাট্যশালা আমাদের দেশে এখনও কল্পনার ব্যাপার। কলকাতা সহরে এক কালে বেসরকারী নাট্যশালার সমাদর ছিল। কিন্তু সিনেমার খেলো চটকদার ছবি তাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। অন্যত্র দূরস্থান, রাজধানী নয়াদিল্লীতেও একটা নাট্যশালা নেই। রাশিয়ায় দেখলাম, সিনেমায় বা নাট্যশালায় যৌন আবেদনপূর্ণ অভিনয় নেই, প্রায়-উলঙ্গ নারী-দেহের অংশ-বিশেষকে অনতি-উদ্ঘাটিত করে লোভীদের উদ্‌ভ্রান্ত করা ওখানে অচল। কেন না এরা এগুলোকে লোকশিক্ষার বাহন বলেই মনে করে। লোকের রুচিবোধ নেমে না যায়, সেদিকে এদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। আর আমাদের দেশে হলিউডের নকলে চলচ্চিত্র-শিল্পের দিনে-দিনে যে কত অধঃপতন হচ্ছে, তা নিয়ে বিলাপ করাও নিষ্ফল। আমি রাষ্ট্রের সাহায্যের কথা বলেছি, কিন্তু এখানে সিনেমা নাটকের ওপর রাষ্ট্র বা কমিউনিস্ট পার্টির দরদ আছে, খবরদারী নেই। চলচ্চিত্র এবং অভিনয়ের গল্প ও নাটক নির্বাচন করেন লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘ। এঁদের ইউনিয়ন থেকেই এগুলো সাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করা হয়, লোকে পয়সা দিয়ে দেখে এবং যে আয় হয়, তা থেকে শিল্পীরা মজুরী পান এবং তৈরী ও পরিচালনার খরচাও উঠে আসে।

 মস্কৌ-এর সরকারী শিশুসাহিত্য প্রকাশভবন। কিন্তু শিশুসাহিত্য বললে ভুল হবে। পাঁচ থেকে সতের বছরের স্কুলের ছেলেদের জন্য ছবি গল্প উপন্যাস ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগীয় বই সুনির্বাচিত হয়ে এখান থেকে প্রকাশিত হয়। নির্বাচন করেন শিশুসাহিত্যিক-সঙ্ঘ। কেবল রুশ ভাষা রমৌলিক রচনা নয়, পৃথিবীর সব ভাষার ভাল বই অনুবাদ করে প্রকাশের ব্যবস্থা আছে। সংস্কৃত ভাষার কথাসরিৎসাগর, দশকুমারচরিত ও বিষ্ণুশর্মার উপাখ্যানের অনুবাদ দেখলাম, অবশ্য ভারতীয় চলতি ভাষা থেকে অনুবাদ খুবই কম হয়েছে। ফরাসী, জর্মন ও ইংরেজীই বেশী। প্রবেশ-পথের পরই পাশাপাশি দুটো পাঠাগার। একটায় ৫৬ বছররের ছেলেরা নানা রঙ্গীন ছবির বই দেখছে, আর একটায় ১৪।১৫ বছরের ছেলে-মেয়েরা পড়ছে। দেয়ালে সাহিত্যিকদের ছবি— দু’পাশের তাকে থরে থরে বই সাজান। পড়ুয়াদের সাহায্য করার জন্য পরিদর্শিকারা রয়েছেন। এখানে কর্ত্রী থেকে সকলেই নারী। পরিপাটি পড়বার ও বসবার জায়গা।

 পড়ুয়ারা আমাদের দেখে সচকিত হয়ে উঠলো। আমরা এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটি ১৪ বছরের মেয়ে ভিক্তর হুগোর “নাইনটি থ্রি” পড়ছে, আর একটি মেয়ে পড়ছে, বিশ্ব ইতিহাস। সে ভারতের অংশটা বার করে দেখালো, সম্প্রতি ভারত যে ভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়েছে সে খবরও রাখে। এদের সঙ্গে আমরা আলাপ জমিয়ে নিলাম। এ একজন মোটর-চালকের মেয়ে, জিজ্ঞাসা করলে, তোমাদের দেশে কিশোর-আন্দোলন, কিশোর-সঙ্ঘ আছে? উত্তর দিলাম; ছাড়া ছাড়া ভাবে সঙ্ঘ-সমিতি আছে বৈকি? তারা কি করে? বিজ্ঞান-ইতিহাস আলোচনা করে কি না, দেশের পরিচয় লাভের জন্য দল বেঁধে ভ্রমণে যায় কি না? উত্তর দিলাম, এ-রকম সুবিধা আমাদের দেশে খুব কম ছেলে-মেয়েই পেয়ে থাকে। একটি ছোট মেয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো, কোরিয়ার যুদ্ধ সম্বন্ধে তোমার মত কি? আমি বললাম, আমাদের দেশের লোক যুদ্ধকে ঘৃণা করে। আমেরিকার এই জুলুমে আমাদের সহানুভূতি কোরিয়ানদের দিকে। সে উৎসাহিত হয়ে বললে; তোমাদের দেশে শান্তি-আন্দোলন আছে? নিশ্চয়ই আছে। আমার কথা শুনে মেয়েটি দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল। এক মুঠো চীনে মাটির ছোট্ট ঘুঘু এনে আমাদের জামায় পরিয়ে দিল। আগ্রহ ভরে বললো, তোমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীদের আমাদের অভিনন্দন জানিয়ো, বলো, আমরাও যুদ্ধবিরোধী শান্তি-আন্দোলন করছি।

 এখানে নানা বিভাগ। একটা বড় হল দেখলাম, মাসে দু’বার নামজাদা শিশু-সাহিত্যিকেরা এসে এখানে বক্তৃতা করেন, দেশ-বিদেশের শিশুশিক্ষার কথা শোনান। অগ্রসর হয়ে দেখি, একটি কক্ষে ১৫।২০টি যুবতী মেয়ে শিশু-সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছে। এরা গ্রাজুয়েট, গবেষণামুলক প্রবন্ধ লিখে ডিপ্লোমা পেলে, হয় শিক্ষয়িত্রী নয় লাইব্রেরিয়ান হবে। শিক্ষা স্বাস্থ্য শিশুপালন সমাজসেবা ব্যাপারে এখানে নারীদেরই প্রাধান্য। শিশুদের সব রকম যত্ন নিয়ে মানুষ করে তোলা এরা ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে। ছোটদের সব রকম প্রতিষ্ঠানে কমরেড স্তালিনের বাণী লেখা দেখেছি, শিশুদের অকল্যাণে রাষ্ট্রের অকল্যাণ। একটি শিশুকেও যেন অবহেলা না করা হয়। ছোটদের মানসিক উন্নতির জন্য এখান থেকে বৎসরে ৫০ লক্ষ বই সোবিয়েতের নানা কেন্দ্রে পাঠান হয়, এদের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী আছে। আমরা অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করলাম, কোন্ শ্রেণীর বই-এর চাহিদা বেশী। তিনি বললেন, গল্প ও জীবজন্তুর কথা ও ভ্রমণকাহিনীর পরেই ছোটরা বিজ্ঞান-ইতিহাসের বই বেশী পছন্দ করে। ডিটেক্‌টিভ বা খুন-চুরি-ডাকাতি নিয়ে লেখা বই আমরা ছোটদের হাতে দেই না।

 আমরা যখন মস্কৌ-এ তখন স্কুল-কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি। এ সময় সহরের ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। চলে যায় গ্রামে, স্বাস্থ্যনিবাসে। সাইবেরিয়া, ককেশাস, কৃষ্ণসাগরের তীর, সর্বত্র ছোটদের পাইওনীয়র ক্যাম্প ও সেনাটোরিয়াম আছে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা আসে সহরে। গ্রামের ও সহরের খালি স্কুল-কলেজের বাড়িগুলোতে এরা খাবার-থাকবার ব্যবস্থা করে নেয়। এই ভাবে এদের শিক্ষা তো চলেই, বিশাল দেশের সঙ্গে পরিচয়ও নিবিড় হয়ে ওঠে। এর জন্য সরকার থেকে এবং বিভিন্ন শ্রমিক-সঙ্ঘ থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। কৃষ্ণসাগরের তীরে সুকুমীতে দেখেছি, বেলো-রুশ, উক্রেনের ছেলে-মেয়েরা এসেছে, মহানন্দে সমুদ্র-স্নান করছে। আবার লেনিনগ্রাদের “পাইওনীয়র্স প্যালেস” বা কিশোর প্রাসাদে দেখেছি, দূর-দূরান্তর থেকে ছেলে-মেয়েরা এসেছে। এটি জারের আমলের প্রকাণ্ড প্রাসাদ ছিল। ২০০ কারুকার্যময় কক্ষ। এখন ৯ থেকে ১৪ বছরের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা ও আনন্দ-নিকেতনে পরিণত হয়েছে। আমরা যখন গেলাম, তখন দেখি বাজনার তালে তালে বাগানে প্রায় দু’শো ছেলে-মেয়ে গান গেয়ে নাচছে। বাগানের গাছতলায় ছেলে-মেয়েরা জটলা করে নানা রকম খেলায় মেতেছে। এই প্রাসাদে সিনেমা, থিয়েটার, পুতুলের থিয়েটার, লাইব্রেরী, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, প্রাণীবিদ্যার বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। জারের আমলে যে সব সুরম্য কক্ষে কার্পেটের ওপর অভিজাত সুন্দরীরা নৃত্যে-লাস্যে বিভোল হতেন, সেখানে কৃষক-শ্রমিকের ছেলে-মেয়েরা নানা রকম শিক্ষা লাভ করছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষা-কক্ষটি দেখে চমৎকৃত হলাম। আলো নিবে যাওয়া মাত্র দেখি, উপরে আকাশে সূর্য চন্দ্র পৃথিবী গ্রহগুলি অগণিত তারকামণ্ডলীর মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। গ্রহ-নক্ষত্রের গতি, দূরত্ব প্রভৃতি এই ভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। এটাকে ছোটদের একটা বিশ্ববিদ্যালয় বললে অত্যুক্তি হয় না। এমনি সব শিক্ষায়তন এরা দেশের সর্বত্র গড়ে তুলেছে। ভাবীকালের সুস্থ-সবল মানুষ গড়বার জন্য।

 ২৫শে জুন সোমবার। সোমবার এখানে ছুটির দিন। জানলা দিয়ে দেখছি, মেয়েরা থলেয় রুটি-তরকারী, মাছ-মাংস নিয়ে চলেছে। সোমবার অন্য সব দোকান বন্ধ হলেও খাবারের দোকানগুলো খোলা থাকে। কাজেই অত্যধিক ভীড়। একটা দোকানে ঢুকে দেখি, চিনি কিনবার জন্য বিরাট কিউ। যেখানে রেশনকার্ড নেই, বাঁধাবরাদ্দ নেই, সেখানে এত ভীড় কেন? জানতে পারলাম, এখন স্ট্রবেরীর মরশুম। মেয়েরা সারা বছরের জন্য জ্যামজেলী তৈরী করে রাখবে, তাই চিনির চাহিদা বেড়ে গেছে। শুনেছিলাম, এ দেশে গেরস্থালী বলে কিছু নেই। সকলেই সরকারী লঙ্গরখানায় পাইকারী ভাবে তৈরী খাবার খায়, ব্যক্তিগত রুচির বালাই নেই। কিন্তু দেখলাম, এখানে মেয়েরা কারখানায় হাসপাতালে স্কুলে আপিসে কাজে করে বটে, তেমনি আবার স্বামী ছেলেপেলে নিয়ে ঘরকন্নাও করে। বাজার মেয়েরাই বেশীর ভাগ করে। কয়েকটা দোকান ঘুরে দেখলাম, তরি-তরকারী আমাদের দেশের মতই। আলু পেঁয়াজ ফুলকপি বাঁধাকপি টমাটো শাক মটরশুটি মায় আমাদের লাউ কুমড়ো বেগুন পর্যন্ত। এ ছাড়া শশা আঙ্গুর আপেল পীয়ার স্ট্রবেরী প্রভৃতি ফল। অবশ্য ফলের অজস্রতা দেখেছি জর্জিয়ায়, উজবেকীস্থানে। মস্কৌ-এ বেশীর ভাগ ফল বাইরে থেকে আমদানী করা। দোকানে এদের জিনিষপত্র কেনা দেখে লোক-সাধারণের স্বচ্ছলতার আঁচ পাওয়া যায়। যাকে বলে একেবারে নিঃস্ব, এ দেশে তারা লোপ পেয়েছে।

 মস্কৌ এবং অন্যান্য সহরের সর্বত্র দেখেছি, ঠেলা-গাড়ির ওপর রাস্তার ফুটপাতে সরবত ও আইসক্রীমের দোকান। ছেলে-বুড়ো সকলেই রাস্তায় আইসক্রীম বা “মারোজনা” চিবুতে চিবুতে যাচ্ছে। দাম কম নয়, ৭৫ কোপেক থেকে দেড় রুবল। এ কথাটা মনে পড়লো একটা বিশেষ কারণে। রাশিয়া থেকে ফিরবার পথে কয়েক দিন রোমে ছিলাম। এখানে আমেরিকানরা ইংরেজীতে দৈনিক “রোম আমেরিকান” নামে একখানা কাগজ বার করে। এক দিন দেখি, ঐ কাগজে লিখেছে, বার্লিন যুব-উৎসবে যোগদানকারী দেড় হাজার রুশ যুবক-যুবতী পুলিশ-কর্ডন ভেঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন এলাকায় প্রবেশ করে। ওরা পেটুকের মত আইসক্রীম খেতে লাগলো। এ জিনিষ ওরা জীবনে কখনও খায়নি। রাশিয়ানদের সম্বন্ধে এমন আজগুবী গল্প বললে, বিশ্বাস করার লোকের অভাব হয় না! খাবার ওদেশে প্রচুর ও সস্তা। ওদেশে ভেজিটেবল ঘি বা মার্গারিন নেই। কৃত্রিম স্নেহ-পদার্থ ওদেশে আইনতঃ নিষিদ্ধ।

 দলবদ্ধ হয়ে দোভাষী সঙ্গে নিয়ে লাইব্রেরী, ম্যুজিয়ম, কারখানা প্রভৃতি দেখার সুবিধে আছে, এ ছাড়া অল্প সময়ে অনেক জিনিষ দেখাই কঠিন। মোটরে পথের দু’ধারে যা দেখি, তার পরিচয় রুশ-সঙ্গী না থাকলে অজ্ঞাতই থেকে যায়, তবুও মাঝে মাঝে আমি মস্কোর রাস্তায় একা বেড়িয়ে পড়তাম। আমাদের ভ্রমণ-তালিকা সুরু হত ১০টায় প্রাতরাশের পর। প্রভাতে অনেকটা সময় পেতাম। সুযোগ পেলেই ৩।৪ মাইল চক্কর দিয়ে আসতাম। দোকান-পশার আর জনতা দেখতাম, কথা বলার কোন সুবিধাই হ’ত না। কিন্তু চোখে দেখার শিক্ষাও কম নয়। দেখতাম, ঝাড়ুদারণী হাতওয়ালা লম্বা ঝাঁটা নিয়ে রাস্তা সাফ করছে, পায়ে জুতো, সিল্কের মোজা, রঙ্গীন ছিটের পোষাক, হাতে হাতঘড়ি, হাঁটু পর্যন্ত একটা সাদা কাপড়ের আবরণী। মাথায় রুমাল দিয়ে চুল বাঁধা। নিটোল স্বাস্থ্য, মুখে বিরক্তির চিহ্ন নেই। চোখের সম্মুখে ভেসে উঠতো কলকাতার মেথরাণীরা, রূপ ও সজ্জার বর্ণনার প্রয়োজন নেই। নীল রঙের কোট, পাতলুন পরা পোর্টার ঠেলাগাড়িতে দুধ বা দৈ-এর বোতল, বরফ নিয়ে চলেছে, আমাদের দেশের মতো শতছিন্ন মলিন কটিবাস পরা নয়। একটি লোকও কোন দিন রাস্তায় ভিক্ষের জন্য হাত পাতেনি। বড় রাস্তার পাশ দিয়ে গলিতে ঢুকেও দেখেছি, উলঙ্গদেহ ধূলি-ধূসরিত অপুষ্ট দেহ ছেলে-মেয়ে নেই। মস্কৌ-এর নাগরিকেরা সকলেই ধনী, স্বচ্ছল এমন কথা বলিনে, কিন্তু আমাদের দেশে হতদরিদ্র, পরের উচ্ছিষ্ট-ভোজী, পশুর মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়া মানুষের সঙ্গে তুলনায়, এরা জীবন যাপনের অসম্মান ও হীনতা থেকে মুক্তি পেয়েছে, এ কথা স্বীকার করতেই হবে।

 রোমের রাস্তায় ধুতিপাঞ্জাবী পরে বেরিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছিলাম, ছেলের দঙ্গলের টিট্‌কারীর চোটে পালিয়ে এসে হোটেলে ফিরিঙ্গী সেজে বাঁচি। কিন্তু মস্কৌ, স্তালিনগ্রাদ, তাসকেণ্টে আমার বাঙ্গালী পোষাক দেখে, ছেলে-বুড়ো সকলেই বিদেশী বলে সম্ভ্রম দেখিয়েছে। বহু জাতির বাস সোবিয়েতে জাতি, বর্ণবিদ্বেষ একেবারেই লুপ্ত হয়েছে। এর কারণ, সোবিয়েত আমার দেখা রাশিয়া গভর্নমেণ্ট সর্বসাধারণের দেশভ্রমণের দরাজ ব্যবস্থা করেছেন। ইয়োরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত সুবৃহৎ এদের দেশ, বহু ভাষাভাষী বিচিত্র জাতীয় মানুষ এর অধিবাসী। আমাদের বিশাল ভারতে কিছু তীর্থযাত্রী ও সৌখিন ভ্রমণকারী ছাড়া কে দেখেছে বিচিত্র মানবমণ্ডলীকে! আমাদের এবং অন্যান্য দেশে যেমন ভ্রমণ সখের ও ব্যয়সাপেক্ষ, যা ধনীলোকের পক্ষেই সম্ভব, সোবিয়েতে ঠিক তার উল্টো। কৃষক শ্রমিক বুদ্ধিজীবী নরনারীরা দল বেঁধে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সরকারী খরচে ও ব্যবস্থায় ভ্রমণ করছে, এ ও-দেশের সাধারণ নিয়ম। বিভিন্ন রিপাবলিকে ভ্রমণের উৎসাহ দেওয়া, তার সুবিধে করে দেওয়ার ফলে অপরিচয়ের সঙ্কোচ গেছে ঘুচে। তাই এরা ভারতীয় পোষাক দেখলেও চমকায় না, আত্মীয়ই মনে করে। মস্কোর রাস্তায় বাঙ্গালী পোষাকে ভ্রমণ করার সময় দেখেছি, অনেক মেডেলওয়ালা সামরিক কর্মচারী আমাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে অভিবাদন করে অপ্রস্তুত করেছেন। এরা কেবল শ্রেণীভেদ লুপ্ত করেনি, জাতিভেদ, বর্ণভেদও লুপ্ত করেছে।