চব্বিশ

 ৫ই আগস্ট রবিবার মধ্যাহ্নে মস্কৌএ ফিরে এলাম, আমাদের সোবিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ শেষ হ’ল। ইয়োরোপ ও এশিয়ায় পরিব্যাপ্ত এই বিশাল দেশের একটা সামান্য অংশ মাত্র দেখবার সুবিধা পেয়েছি। আধুনিক যুগের আকাশচারী দ্রুত ধাবমান বিমান না থাকলে, দু’ মাসে যা দেখলাম তা এক বছরেও সম্ভব হত কিনা সন্দেহ। এখানে যে একটা নূতন সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটছে যে কোন স্থুলদৃষ্টি পর্যটকও তা স্বীকার করবেন। ‘হোটেল ন্যাশনালে’ দু’চার জন ইংরাজ ও আমেরিকান ভ্রমণকারীর সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, এখানকার শ্রমিক ও মস্তিষ্কজীবীরা সুখস্বচ্ছন্দে আছে এটা তাঁরা অস্বীকার করেন না, তবে পশ্চিমা সভ্যতার রীতিনীতি একদম ওলট পালট করে দিয়ে যে সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা গড়ে উঠছে, তার স্থায়িত্ব সম্বন্ধে কেউ কেউ সন্দিহান।

 সোবিয়েতের সমালোচকেরা বলেন, মার্কসীয় অর্থনীতির গোঁড়ামির জবরদস্তী দিয়ে লোকসাধারণের বিচারবুদ্ধিকে এক ছাঁচে ঢালবার যে প্রয়াস তা টিকবে না। এ অপবাদটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। সোবিয়েত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে বোঝা যাবে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি নিয়ে স্বাধীন আলোচনার পথ জোর করে কোথাও অবরুদ্ধ করা হয়নি। যেখানে শিক্ষার ব্যাপ্তি ও বিস্তার অবাধ সেখানে চিন্তার বহুমুখী গতিকে ঠেকান যায় না। তা এরা করেনি, করছে না বলেই জীবনের স্বচ্ছন্দ বিকাশ এখানে সহজ হয়ে উঠেছে।

 একজন বলে উঠলেন, সমস্ত ধনতন্ত্রী জগতের বিরুদ্ধতায় বেষ্টিত হয়ে যে বৈপ্লবিক আবেগে এরা সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমের পথে যাত্রা করেছে তা যখন সিদ্ধিলাভ করবে তখন এই বৈপ্লবিক আবেগ শিথিল হয়ে যাবে। তারপর আজকের এই নিবিড় ঐক্য যাবে ভেঙ্গে আবার শ্রেণীভেদ সমাজে মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠ্‌বে।

 পশ্চিমা মানবহিতৈষীরা এই ভরসা নিয়েই আছেন। ভাবীকালের এই কাল্পনিক চেহারা নিয়ে তর্ক করা চলে না। ধর্ম আর তার অনুশাসন দিয়ে মানুষকে বেঁধে রাখতে তিন হাজার বছর কম বীভৎস চেষ্টা হয় নি। কিন্তু যুক্তিপন্থী বিজ্ঞান সে মোহ ভেঙ্গে দিয়ে মানুষের মুক্তিকে সম্ভব করেছে। এই বিজ্ঞানের সাধনাকেই সোবিয়েত গ্রহণ করেছে, ধর্মমূঢ়তার স্থানে আর এক যুক্তিহীন মূঢ়তাকে তারা প্রশ্রয় দিচ্ছে, মনে এমনতর সন্দেহ জাগবার কোন কিছু আমার চোখে পড়েনি। ব্যক্তিগত স্বার্থের ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা সভ্যতার আওতায় আমাদের চিন্তাধারা ও লোকব্যবহার যে ছাঁচে ঢালাই হয়ে আছে তাই দিয়ে যখন অপরকে বিচার করি, তখন দৃষ্টি ঘোলাটে হবার সম্ভাবনা পদে পদে। সমবায় প্রথায় খাদ্য পণ্য সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতি সৃষ্টিতে এরা একত্র মিলেছে, অথচ সোবিয়েত ভূমিতে কত আলাদা জাত গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় নিজেদের আচার নিয়ম রুচি ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে কোথাও বাধা পাচ্ছে না এই তো দেখলাম জর্জিয়ায় উজবেকিস্থানে।

 কি ছিল এদের আর কি হয়েছে, ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। ১৯১৭-২২এ রুশদেশের যে সব খবর আমাদের দেশের বিদেশী ও স্বদেশী কাগজে রয়েটারের রীগা সংবাদদাতা পরিবেশন করতেন; তা পড়ে ভাবতাম রাশিয়া রসাতলে তলিয়ে গেল বলশেভিকদের পাল্লায় পড়ে। শহরের চলাচলের রাস্তায় গজিয়েছে ঘাস, তার দু’ধারে পরিত্যক্ত পাকা বাড়ী খাঁ খাঁ করছে। গ্রামের খেতখামার অকর্ষিত; আগাছায় উঠেছে ভরে। কারখানার কল বিকল হয়ে মরচে-ধরা, রেল যান বাহন অচল, ঘরে বাইরে অশান্তি! এই পর্বত প্রমাণ ধ্বংসস্তূপের ওপর নূতন রাশিয়া গড়া সম্ভবপর হয়েছে বিশ্ব ধনতন্ত্রের প্রতিকূলতা ও কুৎসা প্রচারের অপবিত্র আয়োজনকে ব্যর্থ করে।

 নবীন রাশিয়া সবে মাত্র মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় ইয়োরোপের অঙ্গনে প্রকাশ পেল নাৎসী ফাসিস্ত বর্বরতা। পরের অধিকার লঙ্ঘনের বলদৃপ্ত নিষ্ঠুরতা নির্লজ্জ মূর্তিতে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ালো। দেখতে দেখতে অগ্নিগিরির গলিত আগ্নেয় স্রাবের মত নাৎসী বাহিনী দিগন্ত রাঙ্গিয়ে সোবিয়েত ভূমির ওপর গড়িয়ে চললো প্রলয়ঙ্কর ধ্বংসের কেতন উড়িয়ে। লেনিন–স্তালিনের সৃষ্টি বুঝি রসাতলে তলিয়ে যায়। কিন্তু আর এক দুর্বার শক্তি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সঞ্চিত হয়েছিল যা ধনতন্ত্রী জগতের সেয়ানা পলিটিসিয়ানদের কল্পনায়ও ছিল না। অঘটন ঘটলো। সোবিয়েত জনগণ দাঁড়ালো লাল-পল্টনের পশ্চাতে, শত্রুর গতি অবরুদ্ধ হ’ল। চারবছর জীবনমরণ তুচ্ছকারী যুদ্ধের মধ্যেও সোবিয়েত রাশিয়া গঠনকাজ ভোলেনি। জয়লাভ করার পরমুহূর্তেই সে নিরহঙ্কৃত কর্তব্যের সাধনাকে অনুদ্বিগ্ন চিত্তে গ্রহণ করেছে।

 এই সোবিয়েত রাশিয়ার জনজীবন এবং সৃষ্টিকে দু’চোখ ভরে দেখলাম। যখন আমেরিকা তার সমস্ত ঐশ্বর্য রণদেবতার অর্ঘ্য রচনায় উৎসর্গ করছে; যখন আমেরিকার নেতৃত্বে জোটবদ্ধ সামরিকশক্তি অতলান্তিক ও প্রশান্ত মহাসাগারর তীরে তীরে পুরনো ছুরি নূতন করে শানাচ্ছে, তখন এখানে এসে দেখি, এদের উদ্বেগ নেই, শঙ্কা নেই। আমেরিকা তাল ঠুকে বলছে, ‘অদ্য যুদ্ধ ত্বয়া ময়া’। সোবিয়েত স্মিতমুখে বলছে, আমি শান্তিনীতিতে বিশ্বাসী, মানুষের শুভবুদ্ধির ওপর আমার ভরসা আছে। বিশ্বশান্তির আগ্রহ ও অকৃত্রিম আবেগ দেখে আনন্দিত হয়েছি। মনুষ্যত্বের ওপর অবিচল বিশ্বাস নিয়ে এই শান্তি আন্দোলনের নেতা স্তালিন বিশ্ব-মানবকে আর একটা ভয়াবহ যুদ্ধের দুর্গতি থেকে রক্ষা করবার সাধনায় সমাসীন।

 এই মহান লোকনায়কের দর্শনলাভের সুযোগ আমার হয়নি, অত কাছে গিয়েও, এই অসাফল্যের দুঃখটা মনে রয়ে গেছে। আমরা মস্কৌ যাওয়ার পরই এক রবিবার সোবিয়েত বিমানবাহিনীর বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেখানে স্তালিন ও অন্যান্য নেতাদের দর্শন পাওয়া যাবে ভেবে উৎফুল্ল হয়েছিলাম কিন্তু আবহাওয়ার দরুণ উৎসব স্থগিত রাখা হ’ল। পরে যখন অনুষ্ঠান হ’ল, তখন আমরা লেনিনগ্রাদে।

 ৫ই আগস্ট রাত্রে ঘটা করে বিদায় ভোজ হ’ল। মস্কৌর সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা ভারত ও সোবিয়েতের স্থায়ী বন্ধুত্ব কামনা করে বক্তৃতা করলেন। আমরাও বললাম, আপনাদের বৃহৎ দেশের নয়া সমাজব্যবস্থা এবং গঠন ও পুনর্গঠনের কথা আমাদের দেশের সাধারণ লোকে আগ্রহের সঙ্গে আলোচনা করে থাকে। আমরা যা দেখে গেলাম, তা যথাযথ ভাবে দেশের লোককে জানাবো। বিশেষভাবে শিশু ও কিশোরদের লালনপালন ও শিক্ষাদানের যে অকৃপণ আয়োজন আপনারা করেছেন, তা থেকে আমাদের গ্রহণ করবার অনেক কিছুই আছে। বিশ্বশান্তি রক্ষার আগ্রহ নিয়ে আমরা আপনাদের সতীর্থ ও সহযাত্রী।

 রাত্রি দুটোয় হোটেলে ফিরে এলাম। জানালা দিয়ে দেখি, ক্রেমলীন অচলপ্রতিষ্ঠ মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে; তার উত্তরতোরণের সমুন্নত ললাটে রক্ততারকার সমুজ্জল জয়টিকা।