তেইশ

 ৪ঠা আগস্ট শনিবার। অশ্রান্ত ভ্রমণে ক্লান্ত দেহ মন, তবুও সমরখন্দের নাম শুনে উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। মধ্যযুগের রাজ্য সাম্রাজ্য ও বাণিজ্যের কেন্দ্র সমরখন্দের খ্যাতি ও ঐশ্বর্য রূপকথার মত সমগ্র এশিয়া ও ইয়োরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতের সঙ্গে সমরখন্দের নানাদিক দিয়ে সম্বন্ধ ছিল। একদিন যেমন তক্ষশীলা এশিয়ার জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার কেন্দ্র ছিল; মধ্যযুগে সমরখন্দ সেই স্থান অধিকার করেছিল। মুসলিম নরপতিরা চিরদিনই জ্ঞানচর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন, জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁরা ধর্মের গোঁড়ামি দেখাতেন না। বোগদাদ, ডামাস্কাসে শাসকেরা ইহুদী খৃষ্টান পণ্ডিতদেরও সমাদর করতেন। তিমুর তাঁর রাজধানীতে সব জাতির পণ্ডিত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এখানে আরব ইরানী ইহুদী খৃষ্টান ও চৈনিক বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য দর্শনের অধ্যাপনা করতেন। উত্তর ভারত থেকে বহু ছাত্র সমরখন্দে অধ্যয়ন করতে যেতো। এ ছাড়া সমরখন্দ মধ্য এশিয়ার শিল্পবাণিজ্যের এক বৃহৎ কেন্দ্র ছিল। গালিচা পশমী পোষাক, পশুচর্ম ও পশম, রেশম অস্ত্র শস্ত্র প্রভৃতি ভারতে আমদানী হত। ইতিহাস ও মধ্যযুগীয় ভ্রমণকারীদের বিবরণ পাঠ করে সমরখন্দের বহু কীর্তিত রূপের যে মোহময় মূর্তি মনের মধ্যে গড়ে তুলেছিলাম বাস্তবের সংঘাতে তা খান খান হয়ে ভেঙ্গে গেল। বিগত বৈভবা মথুরাপুরীর মতই, এখানে কেবল স্মৃতি ও কিছু নিদর্শন রয়েছে। মধ্যযুগের ঐশ্বর্য ও বিলাস, দাক্ষিণ্য ও দস্যুবৃত্তি, প্রেম ও ঈর্ষা, হিংসা ও হত্যা এসব পেছনে ফেলে, স্বেচ্ছাচারী রাজমহিমাকে কবরে চিরপ্রসুপ্ত রেখে সমরখন্দ আধুনিক যুগে চলে এসেছে।

 প্রতপ্ত মধ্যাহ্নে তাসকেণ্ট থেকে বিমানে চলেছি, দক্ষিণ পূব দিকে। দূরে বরফে ঢাকা তিয়েনসিন পর্বতমালা, নীচে অনতিউচ্চ শৈলশ্রেণীর কোলে সবুজক্ষেত্র, ছোট বড় কাটা খালের জলে উর্বর হয়ে উঠেছে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই বিমান ঘাঁটিতে আসা গেল। অসহ্য গরম, যেন মে মাসের দিল্লী। প্রতীক্ষমান মোটরে সহরের দিকে চলেছি, মাঝে মাঝে পুরাতন পরিত্যক্ত কবরখানা ভাঙ্গা মসজিদ পুরোনো দিনের স্মৃতির সাক্ষ্য, কোথাও বা উঁচু বালিয়াড়ি; বায়ু চালিত মরুবালুকা দিয়ে প্রকৃতি কতকাল ধরে এই সব নকল পাহাড় তৈরী করে চলেছেন, কে জানে। সহর দক্ষিণে রেখে এক জায়গায় এসে মোটর থামলো। সামনেই সরাইখানা, পাশে শীতল সুপেয় নির্মল জলধারায় বয়ে চলেছে গিরি নির্ঝর। গাছতলায় সাধারণ টেবিল চেয়ার। সরাইএর একটি বালক জল এনে দিল। তারপর কেটে দিল, সমরখন্দের বিখ্যাত খরমুজা। এই ফলটা তাসকেণ্টেও খেয়েছি। কিন্তু এযে খোদ সমরখন্দের। সম্রাট জাহাঙ্গীর উটের পিঠে করে চামড়ার মশকে বরফচাপা দিয়ে এই ফল কাশ্মীরে নিয়ে যেতেন। সম্রাটের রসনা বিলাসের তারিফ করে টুক্‌রো টুক্‌রো খরমুজা মুখে দিলাম। বরফের মত শীতল, সুস্বাদু এবং মনোরম সুগন্ধ! সম্রাটভোগ্য ফলই বটে!

 অনতিদূরে উলুক বেগের ১৬শ শতাব্দীর মানমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। সোবিয়েত আমলে এর কিছুটা সংস্কার ও রক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। দেখবার মত বিশেষ কিছু নেই। এর পর আমরা দিগ্বিজয়ী তিমুরের প্রাসাদদুর্গের সম্মুখে এসে দাঁড়ালাম। একটা উঁচু স্থানের ওপর তৈরী, স্তরে স্তরে উঠে গেছে। সম্মুখে তোরণদ্বার, সকলের উপরে নীল রংএর টালিতে ছাওয়া বৃহৎ ডোম। ভিতরে বাসের মহল, তিমুরের স্ত্রী ও দাসীদের কবর, একটা মসজিদ, সেখানে প্রার্থনাবেদী এবং তিমুরের কোরান রয়েছে। সবটা মিলে বিশাল কিন্তু না আছে শ্রী না আছে কোন ছাঁদ। তারও অধিকাংশ ভগ্নস্তূপ। দিল্লী বা আগ্রার মুঘল স্থাপত্যের চরম উৎকর্ষের তুলনায়, চেহারার মিল থাকলেও সূক্ষ্ম কারুকার্যের রুচিবোধ নেই, কোন প্ল্যান তো নেই-ই। সম্রাটের খেয়ালে খাপছাড়া ভাবে তৈরী হয়েছে। তৈরী হয়েছে অগণিত দাসের অস্থি মজ্জা বসা অশ্রুজল ও দীর্ঘশ্বাস দিয়ে। যিনি জয় ও পরকীর্তি ধ্বংসের নেশায় দেশদেশান্তরে উল্কাবেগে ঘুরে বেড়িয়েছেন, জীবনটাই কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁবুতে, তাঁর প্রাসাদপুরীতে স্বর্ণ সিংহাসনে বসে রাজ-মহিমা নিশ্চিন্তে উপভোগ করার সময় কোথায়? ভিতরের মসজিদ বা প্রার্থনাঘরে কারুকার্য বিশেষ কিছুই নেই, মলিন গালিচা পাতা রয়েছে। এককোণে দু’জন ইমাম বসে আছেন বিষন্ন মুখে। বোঝা গেল প্রার্থনার সময় আজানের ডাক শুনে বিশ্বাসী ভক্তেরা আজ আর আসে না। আমি ইঙ্গিত করতে একজন উঠে এলেন। জিজ্ঞাসা করলাম এই কোরান স্পর্শ করতে পারি। অনুমতি দিলেন । সাদা তুলোট কাগজে বড় বড় কালো হরপে লেখা, ভারতের বা ইরানের মধ্যযুগীয় কোরান গ্রন্থের মত নানা রংএর কারুকার্য নেই। দেখা শেষ করে বললাম, আমি হিন্দুস্থান থেকে এসেছি। শুনে খুশীতে তাঁর জরাকুঞ্চিত মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠ্‌লো। বাঁ হাতে আমার হাত ধরে, ডান হাত তুলে ঈশ্বরের নামে আমায় আশীর্বাদ করলেন। মনে পড়ে গেল, দিল্লীর জুম্মা মসজিদের বৃদ্ধ ইমামের মুখখানি, তাঁরও স্তিমিত দৃষ্টিতে দেখেছিলাম, অতীত দিনের স্বপ্নের ছায়া। ওঁর হাতে কয়েক রুবল গুঁজে দিলাম, বিহ্বল হয়ে আমার মুখের দিকে চাইলেন।

 সহরের কেন্দ্রস্থলে তিমুরের বিশাল মসজিদ ভূমিকম্পে তিনচতুর্থাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। ফতেপুর সিক্রির মত বৃহৎ খিলান দেওয়া তোরণটি কোনমতে খাড়া আছে। পশ্চিম দিকের অংশটা নানা ভঙ্গীতে ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে, যে কোন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে, কাছে যাওয়া বারণ। এর সংস্কার বা পুনর্গঠন অসম্ভব।

 অনতিদূরে তিমুরের পৌত্রের তৈরী মসজিদ ও মক্তব । এর মিনার চারটি খাড়া আছে। উত্তর ও দক্ষিণের তোরণদ্বার ও মুশাফিরখানা মেরামত হচ্ছে। পশ্চিম দিকের প্রাচীন বিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস অনেকটা অক্ষত। সোবিয়েত গভর্নমেণ্ট বহু অর্থব্যয়ে এর সংস্কার করছেন।  তিমুরের সমাধি সৌধ। খুব বড় নয়; ভেঙ্গে শ্রীহীন হয়ে গিয়েছিল, গম্বুজের নীল টালি বসান শেষ হয়েছে। আগাগোড়া সংস্কার চলেছে। ঐতিহাসিক স্মৃতিরক্ষার কাজে সোবিয়েত গভর্নমেণ্টের কার্পণ্য নেই। দেখলেই বোঝা যায়, ইরানী স্থাপত্যরীতিতে সমাধি সৌধ তৈরী হয়েছিল। নীচের তলায়, তিমুরবংশের তিনপুরুষের বংশধর ও তাঁদের পত্নীদের কবর। দোতালায় কেন্দ্রস্থলে কৃষ্ণ মর্মরে তৈরী হাত তিনেক উঁচু চতুষ্কোণ তিমুরের সমাধি, তার দু’পাশে উলুক বেগ এবং তাঁর আর এক প্রিয়পুত্রের সমাধি। শিয়রে তিমুরের ধর্মগুরু পীরের সমাধি। লক্ষ লক্ষ ছিন্ন নরমুণ্ডের ওপর যাঁর জয়কেতন উড়তো, বিদ্রোহীর তরবারীর আঘাতে তার মস্তকও মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। তিমুরের সমাধি থেকে কঙ্কাল তুলে দেখা গেছে দেহ থেকে তার মস্তক বিচ্ছিন্ন। কঙ্কাল পুনরায় সমহিত করা হয়েছে। কঙ্কাল দেখে জীবদেহ গঠনে কৌশলী সোবিয়েত বিজ্ঞানীরা তিমুরের এক পূর্ণাবয়ব মূর্তি তৈরী করেছেন। ম্যুজিয়মে সেই মূর্তিটা রয়েছে। তিনি খঞ্জ ছিলেন বটে, কিন্তু লম্বায় ছ’ফুটের ওপর বলিষ্ঠ দেহ ছিল।

 সমরখন্দ বিস্তীর্ণ সহর। অধিবাসীর সংখ্যা দু’লাখের ওপর। মধ্যযুগ ও বিংশশতাব্দী হাত ধরাধরি করে আছে। রাস্তায় অনাবৃত মুখ আধুনিকাদের নিঃসঙ্কোচ চলাফেরার মধ্যে কয়েক জন আপাদমস্তক বোরখা বা পাঞ্জারায় ঢাকা নারীও দেখলাম। বড় বড় রাস্তায় ট্রাম বাস চলছে, দু’পাশে আধুনিক সুউচ্চ হর্ম্যমালা। এখানকার গালিচা পশমী ও রেশমী বস্ত্র, রৌপ্য তাম্র এবং ব্রোঞ্জের তৈজসপত্র বিখ্যাত। এই সব শিল্পের কারখানা দেখবার সুযোগ ও সময় পেলাম না, ম্যুজিয়মে সুরক্ষিত নমুনা দেখেই কৌতূহল নিবৃত্তি করতে হ’ল।

 স্থানীয় শিক্ষাবিভাগের একজন বড়কর্তা এক ভোজ সভায় আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। প্রাচ্যের আতিথেয়তার ঔদার্য, ভোজ্যবস্তুর বিপুল সমাবেশ। তিনি ভারত ও সমরখন্দের অতীত সম্পর্ক আলোচনা করে বল্‌লেন, পররাজ্য জয় লুণ্ঠন ও দাস ব্যবসায়ের দিন শেষ হয়েছে, এই বিজ্ঞানের যুগে নানাদেশের মানুষ পরস্পরের নিকটতর হয়েছে। এমন দিন শীগ্‌গীরই আসবে, যখন আমাদের দেশ ও ভারতের মধ্যে বিমানপথ উন্মুক্ত হবে। সেদিন আমরা শিক্ষা ও সংস্কৃতির আদানপ্রদানের মধ্যে আরো ঘনিষ্ঠ হব।

 সন্ধ্যায় তাসকেণ্টে ফিরে এলাম। স্থানীয় লেখক সঙ্ঘের বিদায় সম্বর্ধনায় উভয়দেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হ’ল। উজবেক লোকসাহিত্য প্রাচীন গাঁথা গল্পে সমৃদ্ধ, সেগুলো এঁরা সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন। আধুনিক সাহিত্যও পেছিয়ে নেই। “সংস্কৃতি” শব্দটা আমাদের দেশে আজকাল ছোটবড় বহু রসনা থেকে অহরহ টঙ্কার দিয়ে ওঠে। বাঙ্গলাদেশের তরুণেরা ক্লাব সঙ্ঘ প্রভৃতিতে সংস্কৃতি সম্মেলন করে থাকেন। আমাদের দেশের বিজ্ঞরা ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’ বলে যার গৌরব ঘোষণা করেন, তার সমগ্র রূপটা যে কি সে সম্বন্ধে তাঁদের নিজেদের মনেও কোন স্পষ্ট ধারণা আছে কিনা সন্দেহ! যে দেশে শতকরা আশীজনের জীবন যাত্রার মানদণ্ড এত নীচু যে সহজাত প্রবৃত্তির আবেগে চালিত জীবনযাত্রা নির্বাহ ছাড়া আর কিছু তারা ভাবতেই পারে না, সেখানে সুপ্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী হয়েও, জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি লোকসাধারণের অনুরাগ সম্ভবই নয়। উজবেকদেরও ছিল সেই দশা। কৃষি, পশুপালন ও কুটিরশিল্পের একটা সনাতন ধারা অনুসরণ করে কায়ক্লেশে টিকে থাকার মধ্যে সংস্কৃতির বিলাসিতা চলে না। আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এসেছে কলকারখানা, বৈজ্ঞানিক প্রথায় জলসেচ ও কৃষি ব্যবস্থা। মানুষ স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে বলেই সাহিত্য সঙ্গীত নৃত্যকলা নূতন প্রাণের প্রাচুর্যে ভরে উঠেছে। এখানকার সংস্কৃতির সম্পদ শ্রেণীবিশেষের মধ্যে আবদ্ধ নয়। যা সর্বমানবের সম্পদ, তা লোকসাধারণ জল হাওয়ার মতই সহজে উপভোগ করছে।