বাইশ

 ৩রা আগস্ট শুক্রবার। তাসকেণ্ট সহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে কাগানোভিচ কৃষিক্ষেত্রে চলেছি। সহর ছাড়িয়ে, পাকা পীচ ঢালা রাস্তা, দুধারে গ্রাম, ক্ষেতে তুলা ভুট্টা আর গম চোখে পড়ল, আর দেখছি কাটা খালের মধ্যে জলস্রোত। দূরে অনতিউচ্চ শৈলমালার কোলে বহুকাল পতিত জমি জল পেয়ে সজীব ও সবুজ হয়ে উঠছে। অবশ্য আমরা যে অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছি সেটা মরুভূমি নয়—তবু মধ্য এশিয়ার ‘কারাকুম’ বা কালো বালির মরু বিশাল স্থান জুড়ে আছে। এই মরু অচল নয়, সে তার শুষ্ক তৃষার্ত রসনা দিয়ে লেহন করে সরস মাটিকেও গ্রাস করে। প্রকৃতির এই খেয়াল চলেছে চিরকাল ধরে। মানুষের অবুদ্ধি গাছপালা অরণ্য নষ্ট করে মরুভূমিকে আমন্ত্রণ করেছে ঘরের দিকে। দিগ্বিজয়ীরাও প্রতিপক্ষের দুর্গনগরী অবরোধ করবার জন্য জলের স্বাভাবিক ও হাতে তৈরী নহর ভেঙ্গে দিয়ে শত্রুকে কাবু করেছে, ফলে বহু নগর জনপদ বালুকা-সমাধি লাভ করেছে।  বিপ্লবের পর থেকেই সোবিয়েত বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি পড়লো এই বিশাল মরুর ওপর। এদের প্রত্যেক পঞ্চবার্ষিক সঙ্কল্পের মধ্যে মরুজয়ের সাধনা একটা মুখ্য স্থান অধিকার করেছে। শুনলাম, কারাকুমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আমুদরিয়ার জলধারা নিয়ন্ত্রিত করার কাজে হাত দেয়া হয়েছে। এই নদী প্রথমে উত্তর পশ্চিম খাতে চলতে চলতে বোখারার কাছে এসে খাড়া উত্তর মুখো হয়ে আরল সাগরে পড়েছে। পাঁচশ’ বছর আগে পশ্চিমমুখো গিয়ে কাস্পিয়ান সাগরে পড়তো— তার শুকনো খাদ এখনও রয়েছে। নদীকে আবার যদি এই খাতে আনা যায় তাহলে কাস্পিয়ান সাগরের উন্নতি হবে; আর বিস্তীর্ণ অঞ্চল শস্যশালিনী হয়ে উঠবে। এই সঙ্কল্পের ফল তুর্কোমান কেনাল— ৫০০-৬০০ মাইল লম্বা। শেষ হবে ১৯৫৬ সালে। আমি যেমন সহজে লিখছি ব্যাপারটা অত সোজা নয়। মাটির উঁচু নীচু, চারপাশের ঘাস লতা পাতা গাছ, বৃষ্টির জলের ঢলের স্বাভাবিক গতি প্রভৃতি নিয়ে গবেষণা করে তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করে, বাঁধ দিয়ে জলকে উঁচু করে নূতন খাতে বইয়ে দেওয়া হবে, তার মাঝে মাঝে বসবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গড়ে উঠবে নূতন জনপদ ও নগরী।

 গাছের ঘনপ্রাচীর দিয়ে খালগুলি রক্ষা করার ব্যবস্থা পথে যেতে যেতে দেখলাম। খালের ধারে নূতন বসতিও চোখে পড়লো। অসমতল উষর মাটির ঢেউএর নামি কোলে কাপাসের ক্ষেত, গমের চাষ ফলের বাগানও আছে। এইবার আমাদের গাড়ী বড় সড়ক ছেড়ে মেঠো রাস্তায় পড়লো, যেমন রৌদ্রের তাপ তেমনি ধূলো, “ধূলায় ধূসর নন্দকিশোর” হয়ে আমরা গ্রামে প্রবেশ করলাম। পথের ওপর অপেক্ষা করছিল তরুণ তরুণীরা শিঙে বাজিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করা হ’ল। তারপর শুরু হ’ল নৃত্যগীত। উৎসব ভূষণে সজ্জিতা তরুণীদের লোক সঙ্গীত ও নৃত্যে ভারতীয় সাদৃশ্য প্রচুর। গ্রামের প্রধান মোড়ল এবং তাঁর সহকারীরা আমাদের নিয়ে সমিতির আপিসে বসালেন।

 এই গ্রামে ৬৪০টি পরিবার, জনসংখ্যা তিন হাজার। জমির পরিমান ২৩৪০ হেক্‌তার, (১ হেক্তার=২°৪৭ একর)। প্রধান ফসল তুলো গম ভুট্টা ও ধান, এ ছাড়া আঙ্গুর পীয়ার আপেল পীচ প্রভৃতি ফলের বাগান আছে। ১৯২৯ সালে এর পত্তন হয়েছিল। ক্রমে খালের জল আর আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রথায় সার দিয়ে চাষের প্রবর্তন হওয়ায় জমির ফলন তিনগুণ চারগুণ বেড়েছে। বাড়তি আয় থেকে শিশুপালনাগার কিণ্ডারগার্টেন স্কুল হাসপাতাল সংস্কৃতি ভবন নির্মিত হয়েছে।

 জর্জিয়ার জুগদিদি সমবায় কৃষিক্ষেত্রের অধিবাসীদের স্বচ্ছলতার সঙ্গে এদের তুলনা হয় না, তবু মোটামুটি স্বচ্ছল। যারা মাটির দেয়াল ঘেরা গর্তে বাস করতো, তেল কেনবার পয়সার অভাবে যাদের ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বলতো না, সন্ধ্যার আগেই খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে নিতে হ’ত; তাদের আজ চওড়া রাস্তার দু’ধারে পাকাভিতের ওপর বাড়ী, বাড়ীর সামনে ফুলের বাগান, উঠানে মাচার ওপর দ্রাক্ষাকুঞ্জ, থলো থলো আঙ্গুর ফলে আছে। আমরা হাতের নাগালে পাওয়া সরস আঙ্গুর সদ্য তুলে খেলাম। এই আঙ্গুর শুকিয়ে কিসমিস মনাক্কা হয়, বেশীর ভাগ দিয়ে সুমিষ্ট স্বল্প সুরাসার যুক্ত মদ তৈরী হয়, বড় বড় জালায় এই মদ রাখা হয়, সম্বৎসরের পানীয়। গ্রামের পথে ও বাড়ীতে বিজলী আলো, কোন কোন কৃষকের বাড়ীতে রেডিয়ো ও বিজলীর রান্না করবার উনান আছে।

 গ্রামের কেন্দ্রস্থলে প্রমোদভবন, সমবায় দোকান ও শস্য ভাণ্ডার। পাশে একটি নূতন সংস্কৃতিভবন তৈরী হচ্ছে। দোকানে রেশম পশম ও সূতি কাপড়, নানা রকমের মনোহারী ও প্রসাধন দ্রব্য, তৈজসপত্র রয়েছে। ফরাসী সুগন্ধীও আছে। কৃষকদের স্বচ্ছলতা ও ক্রয়ক্ষমতার আভাস পাওয়া গেল। আমাদের দেশের শতকরা নব্বুই জন কৃষক পরিবার যে সব জিনিষ কিনবার কল্পনাও করতে পারে না, এরা তা নিত্য ব্যবহার করে। এদের সমবায় গোলায় সঞ্চিত গমের রাশি দেখে অবাক হলাম। গোলার কর্তা বল্‌লেন, প্রত্যেক পরিবার গড়ে দু’টন শস্য বছরে পায়। অনেকেই পুরোটা নেয় না, তাই এত বাড়তি শস্য জমে গেছে। এই বাড়তি গম হিসেব করে আমরা সহরের শ্রমিক ইউনিয়নের কাছে বেচে দেই। এই সমবায় কৃষিক্ষেত্রে গুটিপোকার চাষের প্রচলন আছে, কুটির শিল্প হিসেবে উৎকৃষ্ট রেশমী বস্ত্র তৈরী হয়।

 গ্রাম পরিক্রমার সময় লক্ষ্য করলাম, এরা সকলেই উজবেক নয়। তাজিক কাজাক তুর্কোমান এমন কি কয়েকঘর রুশ কৃষক ও আছে। এদের গোষ্ঠীগত আচার প্রথা ও বসনভূষণের বৈশিষ্ট্য দেখলেই বোঝা যায় । গ্রামের পূবদিকে উদ্যান, তার একদিকে একটা ছোটখাটো বাড়ীতে পুস্তকাগার ও খেলাধূলার সরঞ্জাম। একটু দূরে তারই পাশে চেনার গাছের সার দেওয়া খালে কল্ কল্ করে জল চলেছে, তুলোর ক্ষেতে। এ খালের ধারে বিরাট ভোজ সভা বসলো। গ্রামের মাতব্বর নরনারীরা এসেছেন। প্রাচ্যের আতিথেয়তার অজস্রতা, ঘরে তৈরী ছয় সাত রকম সুমিষ্ট সুরা। এমন সময় গ্রামের যুবক যুবতীরা এসে নৃত্যগীত জুড়ে দিলেন। ভোজ সমাপ্ত হ’লে কৃষিক্ষেত্রের অধ্যক্ষ আমাদের উজবেক পোষাক উপহার দিলেন। আমাদের উজবেকী পোষাক পরিয়ে যুবতীরা নাচবার জন্য সাধাসাধি শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে এক প্রকার ভালুক নাচ নেচে অব্যাহতি পাই।

 বেলা গড়িয়ে এসেছে, আমরা তুলোর ক্ষেত, ট্রাক্টর ও কৃষিযন্ত্রপাতির ঘর, অশ্বশালা ও গোশালা দেখে অধ্যক্ষের বাড়ীতে গেলাম। আবার ভোজসভা বস্‌লো। তিনি পুরনো দিনের এবং কৃষিক্ষেত্রের ক্রমোন্নতির ইতিহাস শোনালেন। এঁর বয়স ষাটের কোঠা পেরিয়ে গেছে; দীর্ঘ সমুন্নত বলিষ্ট দেহ কর্মী পুরুষ। বল্‌তে লাগলেন, আমি আর দশজনের মতই ছিলাম ভূমিদাস। আমাদের এই গ্রামে ছিল আশী নব্বুই ঘর চাষী, দু’জন জোতদারের ছিল জমি, আমরা ছিলাম ভাগচাষী বা ভূমিদাস। প্রথম মহাযুদ্ধে জারের সৈন্যদলে ভর্তি হয়ে গ্রাম ছাড়লাম, আকর্ষণেরই বা ছিল কি! বলশেভিক বিপ্লবের বার্তা নিয়ে আমরা পাঁচবন্ধু “পার্টিজান” সৈন্য হয়ে গ্রামে ফিরে এলাম। স্থান হ’ল না, মোল্লারা জোতদারের সঙ্গে যোগ দিয়ে লোক ক্ষেপাতে লাগ্‌লো, আমরা বনে জঙ্গলে থেকে সহৃদয় কিষাণদের সহায়তায় দল গড়তে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত প্রতি-বিপ্লবীদের হট্‌তে হ’ল। এরা যে কত দুঃখ পেয়েছে, না-বোঝার ফলে কত ভুল করেছে, সে সব স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, লজ্জা হ’ল লোকসাধারণের জীবনযাত্রা উন্নত করবার জন্য আমরা কি করেছি, কেবল বক্তৃতা ও প্রবন্ধ লিখে যখন আমরা দিনগত পাপক্ষয় করেছি, এরা দু’খানা পোড়া রুটি খেয়ে সমবায় কৃষিক্ষেত্র গড়েছে, খাল কেটে এনেছে জল, উর্বর করেছে শুক্‌নো মাটি। তারপর এলো বৈজ্ঞানিক কৃষিবিদ্যায় সুপটু ওস্তাদেরা, এলো ট্রাকটর এলো শস্য ও তুলা ঝাড়াই কল । বহু বছরের অচলায়তন কৃষকজীবনের ধারাই আগাগোড়া বদলে গেল। আজ এরা রাষ্ট্রের দাক্ষিণ্যের দ্বারে প্রার্থী নয়, এরা কৃতী। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পাকা করে পেয়েছে বীরের আসন। আমাদের দেশে দেখি আরাম ঐশ্বর্য লাভের নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা আর এখানে দেখলাম উৎপন্ন খাদ্য ও সম্পদ সকলের মধ্যে বণ্টনের সহৃদয় সহযোগিতা।