একুশ

 গ্রামের বাংলো থেকে রোজ তাসকেণ্ট সহরে দু’বার যাতায়াত করছি। কিণ্ডারগার্টেন, ম্যুজিয়ম, রাষ্ট্রের বৃহৎ গ্রন্থাগার, পাঠভবন দেখে মনে হচ্ছে এ এশিয়ার অনগ্রসর দেশ নয়, আধুনিক বিজ্ঞানের সমৃদ্ধি এর সর্বাঙ্গে ঝলমল করছে। এই বৃহৎ সহরের চারদিকে বহু শিল্প কেন্দ্র রয়েছে। তুলোর দেশ বলে, কয়েকটি কাপড়ের কল আছে। একটি বৃহৎ কাপড়ের কল দেখলাম, নাম “টেক্সটাইল কম্বাইন”। বোম্বাই বা আমেদাবাদের আট দশটা কারখানা একত্র করলেও এর সমান হবে না। সাদা রঙ্গীন এবং নক্সাদার ছিট তৈরী হচ্ছে। সমস্ত মধ্য এশিয়ার কাপড়ের চাহিদা এখান থেকেই জোগান দেওয়া হয়। ১৯৩৪ সালে এর পত্তন হয়, ১৯৪১ সালে তিনগুণ হয়েছে। আরো বাড়ানো হচ্ছে। দুই বর্গ মাইল কারখানা, ফুলের বাগান, সারিবদ্ধ বৃক্ষশ্রেণীর মধ্য দিয়ে পথ। সূতো তৈরীর কলের টাকু তাঁত ছিট ছাপাবার রোটারী যন্ত্র সবই লেনিনগ্রাদ কারখানার তৈরী। এখানে উন্নত ধরনের ২৪টি তাঁতের তদারক করে একজন শ্রমিক। ৪৮ খানা তাঁত একা দেখেন এমন কয়েক জন স্টাকানোভাইট শ্রমিক দেখলাম। সমস্ত কারখানাটা ঘুরে দেখতে চার ঘণ্টা সময় লাগলো। সর্বত্র যেমন এখানেও তেমনি কারখানা সংলগ্ন স্কুল হাসপাতাল প্রসূতিভবন বিশ্রামাগার সংস্কৃতিকেন্দ্র রয়েছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য আনন্দ ও শিক্ষার ব্যবস্থা মস্কৌ স্তালিনগ্রাদের মতই ।

 বিকেলে একটা বৃহৎ সাধারণ উদ্যান দেখলাম । নাম গর্কী উদ্যান। এখানে সিনেমা নাচঘর পাঠাগার বক্তৃতার হল প্রভৃতি রয়েছে। ছেলেমেয়েদের খেলাধূলার কত সাজ-সরঞ্জাম। এমন প্রমোদ উদ্যান তাসকেণ্টে অনেক আছে। একটি উদ্যানে একশত বিঘা জমির ওপর কৃত্রিম হ্রদ। তার চারদিকে স্নান ও সাঁতার কাটবার ব্যবস্থা, ডিঙ্গী নৌকায় ছেলেমেয়েরা বাইচ খেলছে। ছোট্ট একখানা স্টীমারও রয়েছে হ্রদের মধ্যে বেড়াবার। চারদিকে উপবন, খাবারের দোকান।

 বাগান থেকে আমরা তাসকেণ্টের নবনির্মিত নাট্যশালায় এলাম । চারতলা বিশাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহে স্তরে স্তরে প্রায় দু’হাজার বসবার আসন। তিনতলায় সাতটি বড় বড় হলঘর। শ্বেত কৃষ্ণ নীল পীত নানা রংএর মর্মর পাথরের সূক্ষ্ম কারুকার্যে প্রাচীন শিল্পকলা অনুসরণ করা হয়েছে। প্রত্যেকটির গঠনপ্রণালী স্বতন্ত্র, খিবা বোখারা সমরখন্দ ফারগানা তাসকেণ্টের প্রাচীন বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত। বিশ বছর পূর্বে এদের নাটক অভিনয় নাট্যশালার কোন অস্তিত্ব ছিল না। এখন বহু নর্তকী ও গায়িকার খ্যাতি সমগ্র সোবিয়েত রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিখ্যাত লোকনটী তামারা খানুমের কথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এখানে বিখ্যাত ও স্তালিন পুরস্কারের অধিকারিণী, শ্রীমতী গালিয়া ইসমাইলোভা ও মুকারম তুর্গু নবায়েভার নৃত্য দেখলাম। ভারতীয় নর্তকীদের সঙ্গে এদের ভঙ্গীর সাদৃশ্য বিস্ময়কর। বাহুবল্লরীর লীলায়িত সঞ্চালন আঙ্গুলের মুদ্রা গ্রীবাভঙ্গী তালে তালে লঘু পদক্ষেপ চঞ্চল চোখের চটুলতা বার বার দেশের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এই নৃত্য অসংস্কৃত ভাবে আবদ্ধ ছিল বাদশা সুলতানদের হারেমে বাঁদীদের মধ্যে, আজ শিক্ষিতা তরুণীরা তাকে জনগণের রসবোধ পরিতৃপ্ত করবার ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছেন।

 এই জাতীয় নাট্যশালায় ৬২৭ জন নর্তক নর্তকী অভিনেতা আছেন। আমরা যখন প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করলাম, তখন সমগ্র জনতা দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। ভারতের নরনারী এই তাঁরা প্রথম দেখলেন।

 বলশেভিক বিপ্লবের গোড়ার দিকে স্ত্রী স্বাধীনতা, ‘পাঞ্জারা’ বা বোরখা ও মোল্লাদের অনুশাসন বর্জন নিয়ে একটি তিন অঙ্কের গীতি-নাট্যের অভিনয় হ’ল। নাটকের বিষয় বস্তু হ’ল, এক আধুনিক যুবক তার স্ত্রীকে পর্দার বাইরে এনেছে, সংবাদ পেয়ে মেয়ের বাপ চটে লাল। মোল্লারা বিচার করে বিবাহ বিচ্ছেদের ফতোয়া দিলেন, বাবা মেয়েকে বাড়ীতে নিয়ে এলেন। সুন্দরী যুবতী, মোল্লাদের আনাগোনা চলে, এক বুড়ো মোল্লার সঙ্গে আবার সাদীর ষড়যন্ত্র চল্‌ছে। মায়ের আপত্তি, বাপ কান দেয় না। এদিকে প্রতিবেশিনী মেয়েরাও চঞ্চল হয়ে উঠেছে; অন্দরমহলে প্রবেশ করেছে বিপ্লবের ঝড়ো হাওয়া। তারা ওর স্বামীর খবর আনে, উৎসাহ দেয়। গোঁড়া মুসলমান বাপ একদিন মোল্লাদের প্ররোচনায় স্ত্রীকে শাসন করতে গিয়ে খুন করে বসলো। মেয়ে আর সহ্য করতে পারলো না, পাঞ্জারা টুক্‌রো টুক্‌রো করে ছিঁড়ে ফেল্‌লো, তার করুণ সঙ্গীতে প্রতিবেশিনী যুবতীরাও বোরখা-মেধ যজ্ঞে যোগ দিল। মিলনান্তক পরিসমাপ্তি। নাটকে গোঁড়া মোল্লাদের যে ভাবে বিদ্রুপ করা হ’ল, তা দেখে দর্শকরা করতালি দিয়ে হেসেই কুটিপাটি। আমাদের দেশে এমন নাটকের অভিনয় কল্পনাও করা যায় না, হলে রক্তারক্তি কাণ্ড বেধে যেতো।

 সমাজতান্ত্রিক নবজাতীয়তাবাদের প্রভাবে ধর্মবিধির অন্ধ অনুবর্তনা রাশিয়ার কোথাও নেই। শুনেছি, বিপ্লবের গোড়ার দিকে ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত সমাজ-জীবনের আড়ষ্টতার বিরুদ্ধে তরুণেরা বিদ্রোহ করেছিল। এখন ধর্মাচরণের স্বাধীনতা সকলে মেনে নিয়েছে। পাদ্রী পুরোহিত মোল্লারা এখনও গীর্জা মসজিদ আগলে বসে আছেন, বুড়োবুড়িরা মাঝে মাঝে সেখানে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে যায়। কেউ ফিরেও চায় না । মনে আছে প্রাগের হাপস্‌বুর্গ বংশীয় সম্রাটদের আমলের সুবৃহৎ প্রাচীন গীর্জায় কয়েকজন খ্রীষ্টীয় সাধুকে দেখে এক চেক যুবককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমরা তো গীর্জায় যাও না, তাহলে এঁরা কি করেন? যুবক হেসে উত্তর দিয়েছিল, “They pray for themselves.”— ওঁরা নিজেদের উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করেন।