বিশ

 ৩০শে জুলাই অপরাহ্ণে তাসকেণ্টে আসা গেল। নগর উপকণ্ঠে বাগান ঘেরা একটি বাংলোয় এসে উঠলাম। আগের রাতে মস্কৌএ লেখকসংঙ্ঘের অভ্যর্থনা সভায় বক্তৃতা ও নৃত্যগীতের পালা মিটতে রাত্রি দু’টো হয়েছিল, তারপর আড়াই হাজার মাইল বিমানে পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিকেল বেলা, আমাদের দেশের মতই গরম। স্নান আহার শেষ করে বিশ্রাম। অনেকদিন পর মশলা সহ নদীর মাছের সুস্বাদু ঝোল সহযোগে পোলাও খাওয়া গেল।

 মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্যে উজবেকিস্তান সর্ববৃহৎ। উজবেক জাতিই সংখ্যাগরিষ্ঠ, জনসংখ্যা ৬৬ লক্ষ। তাসকেণ্টের অধিবাসীই সাড়ে সাত লাখ। অন্যান্য সব জাতের মতই এরাও মিশ্র জাতি। এদের ধমনীতে মোঙ্গল ও তাতার রক্ত আছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই জাতের মধ্যেই দিগ্বিজয়ী তিমুরের অভ্যূত্থান। দিল্লী থেকে মস্কৌ এর নিষ্ঠুর অভিযানে কম্পান্বিত হয়েছিল। এখান থেকেই তিমুরের বংশধর বলে কথিত বাবর ফারগানা থেকে দিল্লীতে এসে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সমরখন্দের সঙ্গে হিন্দুস্থানের যোগাযোগ কয়েক শতাব্দীর। দার্শনিক আলবেরুনী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী উলুক বেগ, কবি আলী শের নাভাই-এর খ্যাতি একদিন সমগ্র প্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।

 সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ যে ভাবে সমগ্র প্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, ঠিক সেই ভাবেই সাহসী রণনিপুণ পরিশ্রমী শিল্প ও চারুকলায় উন্নত উজবেকদের জাতীয় জীবনের ওপর অন্ধকার নেমে এলো। জার সাম্রাজ্যবাদ কবলিত উজবেকজাতি মোল্লাতন্ত্র ও জারতন্ত্রের শোষণ শাসনে দরিদ্র কৃষক মজুর ও যাযাবরে পরিণত হ’ল । অক্টোবর বিপ্লব ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ১৯২৪-২৫ থেকে এক নূতন অভ্যূত্থান। সেদিন এরা আমাদের দেশের চেয়েও পিছিয়ে ছিল, শতকরা ৯৮ জন ছিল নিরক্ষর। রুক্ষ্ম মরুভূমির কৃপণ মাটিতে মাথা খুঁড়ে যা পেত তার অধিকাংশই সেখ ও বেগের (অভিজাত) দল নানা ছলে কেড়ে নিত। কিন্তু এক জায়গায় ওদের সঙ্গে আমাদের মিল ছিল। সে হ’ল ধর্ম সম্প্রদায় নিয়ে কলহ। জারের আমলে ওরা আমাদের মতই ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মাথা ফাটাফাটি করতো। সাম্রাজ্যরক্ষার এই ভেদনীতির বিষাক্ত শিকড় আত্মসম্বিতহীন সমাজকে টুক্‌রো টুক্‌রো করেও একত্র বেঁধে রাখে, যেমন বট অশ্বত্থের শিকড় পুরাতন পরিত্যক্ত মন্দিরের শ্রীহীন বিকৃত ঠাটকে আঁকড়ে ধরে থাকে।

 এর দুঃখ ও অপমান আমরা জানি। এই ভেদনীতির আর একরূপ ‘ল’ এণ্ড ওর্ডার’ অর্থাৎ শান্তি ও শৃঙ্খলা! ইংরাজ শাসকেরা জাঁক করে বলতেন, কেবল কি হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতায়ও তোমরা পরস্পর কত বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন, আমরা তোমাদের পিনালকোডের আওতায় ঐক্য দিয়েছি। আমরা চলে গেলে তোমরা কাটাকাটি করে মরবে। মারামারি মাথা ফাটাফাটিটা অনেক ইংরাজ পছন্দ করতেন না বটে, তবে রেষারেষিটা থাকুক এটা তারা চাইতেন। তাই ইংরাজ আমলে আমরা এক শাসন পেয়েছিলাম এক জাতীয়ত্ব পাইনি। এক ভারতীয় ‘নেশন’ রূপে গড়ে উঠ্‌বার বনিয়াদ ছিল, মাল মশলারও অভাব ছিল না; তবুও পরিণামে সাম্প্রদায়িক বিরোধটা ক্রমে বিচ্ছেদে পরিণত হয়ে ভারতের ইতিহাসে এক শোকাবহ পরিণতি লাভ করল, এবং আমরা তা স্বীকার করে নিলাম।

 এখানে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের অবসানের ইতিহাসের ধারা সম্পূর্ণ আলাদা। বলশেভিক বিপ্লবীরা ক্ষমতা হাতে পাবার বহু পূর্বেই রাশিয়ার সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতি ও সম্প্রদায়গুলির সমস্যা মীমাংসা করে রেখেছিল। এ ভার একদিন লেনিন স্তালিনকে দেন। স্তালিনের রচিত “মার্কসবাদ এবং জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্ন” রাষ্ট্র বিজ্ঞানে তাঁর অবিস্মরণীয় দান। স্তালিনের এই মৌলিক গবেষণার ভিত্তিতে ১৯১৭ সালেই নবগঠিত সোবিয়েত সরকার ঘোষণা করেছিলেন, (১) রাশিয়ার জনসাধারণের সকলের অধিকার সমান; (২) স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সকলের; (৩) জাতিগত ধর্মগত কোন বিশেষ সুবিধা ও বাধা বিলুপ্ত করা হ’ল; (৪) সমস্ত সংখ্যালঘু জাতি বা গোষ্ঠীর আত্মোন্নতির স্বাধীনতা অবাধ।

 অতএব যা ঘটলো, তা ক্রমোন্নতি নয়, বিভিন্ন শ্রেণী সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও অধিকারের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের চেষ্টা নয়; একেবারে ঔপনিবেশিক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিষ্ঠা। প্রাচীন অভিজাতশ্রেণী এবং রুশ শাসকশ্রেণী বাধা দিয়ে ছিল প্রচুর। কিন্তু বিপ্লবীরা ভড়কে গিয়ে তাদের সঙ্গে আপস করেনি। তারা শোষকশ্রেণীকে একহাতে উচ্ছেদ করেছে আর একহাতে শোষকশ্রেণীর উৎপত্তির কারণগুলি নির্মূল করে ফেলেছে।

 নূতন অথনৈতিক বনিয়াদের ওপর সমাজব্যবস্থা পত্তন করতে বেগ পেতে হয়েছে। অশিক্ষা ও ধর্মমূঢ়তায় এরা ছিল আচ্ছন্ন। নারীদের অবরোধ মুক্তি এবং শিক্ষাদানের সূচনায় মোল্লারা ক্ষেপে গিয়েছিল। তার অনেক কৌতুককর কাহিনী শুনলাম। বিপ্লবীরা রুশ বর্ণমালায় উজবেক কথ্যভাষায় পাঠ্যপুস্তক ব্যাকরণ তৈরী করল, দেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হ’ল লৌকিক শিক্ষায়তন। জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার বোধ জাগ্রত হ’ল। সম অধিকারভোগী বৃহৎ মানব পরিবার দানা বেঁধে উঠ্‌লো। নিজস্ব শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য নিয়ে উজবেকীরা আজ সোবিয়েত রাষ্ট্রে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এখন উজবেকিস্তানে একজনও নিরক্ষর নেই। মেয়েরা ‘পাঞ্জারা’ (বোরখা) ফেলে অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার ভোগ করছে। এদের নাগরিক জীবনে রুশ সংস্কৃতির দু’শো বছরের ছাপ সুস্পষ্ট। মেয়ে পুরুষ সকলেরই পোষাকে ইয়োরোপীয় ঢং। তবে পুরুষেরা আলখেল্লা ও টুপী ছাড়েনি, মেয়েরাও সোনারূপো ও মূল্যবান পাথরের ঝালর দেওয়া টুপী পরে, দু’পাশে লম্বা বেণী দুলিয়ে দেয়, চোখে দেয় কাজল ও সুর্মা, অলঙ্কারেরও প্রাচুর্য আছে।

 পঁচিশ বৎসর পূর্বে যে সব মেয়ে অন্তঃপুরে ছিল দাসী বাঁদি হয়ে কিম্বা কোন বেগের বহু পত্নীর অন্যতমা, নয়া সমাজব্যবস্থায় শিক্ষার প্রসারে তাদের সহজ সচ্ছন্দ মুক্তি দেখলে চমক লাগে। জড়প্রথার দাসত্বে অভিভূত সনাতন প্রাচ্যের অবগুণ্ঠিত জীবনের এই অসঙ্কোচ আত্মপ্রকাশ দেখতে পাওয়া এক দুর্লভ সৌভাগ্য। উজবেক মেয়েরা কলকারখানায় কাজ করছে, ট্রাম বাস চালাচ্ছে, সরকারী কার্যালয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রঙ্গমঞ্চে সর্বত্র যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছে। কৃষিবিজ্ঞানী চিকিৎসক ইঞ্জিনিয়র বৈজ্ঞানিক লেখিকা গায়িকা নর্তকীর সংখ্যা মেয়েদের মধ্যে কম নয়।

 উজবেক রিপাবলিকের ডেপুটি প্রেসিডেণ্ট নারী। একদিন তাঁর দপ্তরখানায় আমাদের চা-পানের আমন্ত্রণ হ’ল। গিয়ে দেখি প্রতিনিধিস্থানীয়া কয়েকজন মহিলাও রয়েছেন। শুনলাম সুপ্রীম সোবিয়েতের মহিলা সদস্য তেরজন, উজবেক পার্লামেণ্টের মহিলা সদস্য একশ’জন। শাখা মোবিয়েত মণ্ডলীতে নারী সদস্য চৌদ্দ হাজার। এখানকার ৪৭ হাজার শিক্ষক অধ্যাপকের মধ্যে ১৯ হাজার নারী, মহিলা ডাক্তার চার শ’। মাত্র পঁচিশ বছরে মধ্যযুগীয় বর্বর সামাজিক ব্যবস্থায় অধিকারবঞ্চিতা নারীরা চারশতাব্দী অতিক্রম করে বিংশ শতাব্দীতে উত্তীর্ণ হয়েছে।

 গৃহকর্মের সঙ্কীর্ণ পরিবেশের মধ্যে স্বামী পুত্র আত্মীয়বর্গের সেবা এবং অকল্যাণের ভয়ে বার ব্রত পালন দেবতার কাছে মানত করা এই নিয়ে যখন ছিল মেয়েদের জীবন, যখন পুরুষ রচিত শাস্ত্রবিধির বন্ধনের কড়াকড়ি ছিল কঠোর, তখনো গৃহকর্মের গণ্ডি কেটে অনেক নারী নিজেদের প্রতাপ ও প্রতিভা বিস্তার করেছেন, সব দেশের ইতিহাসেই তার নজীর আছে। ইতিহাসে ধন্যা এই সব মহিয়সী নারীদের নিয়ে আমরাও গর্ব করে থাকি। পুরুষ সমাজের বিরুদ্ধতাকে অতিক্রম করে কি সামাজিক অবস্থায় তাঁরা স্বকীয় চেষ্টায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তা আলোচনা করলে বোঝা যাবে ওটা নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম।

 নব্য ইয়োরোপের স্ত্রী-শিক্ষা স্ত্রী-স্বাধীনতার আন্দোলনের তরঙ্গে প্রাচ্যও আন্দোলিত হয়েছিল। বিগত শতাব্দীতে বাঙ্গলাদেশে সুরুতে রক্ষণশীল ও সংস্কারকদের বাদানুবাদের দীর্ঘ ইতিহাস আলোচনা করতে চাইনে। পরিবর্তন হয়েছে প্রচুর, সমাজের বিরুদ্ধতার জোর কমে গেছে। ধর্মের নামে যে সব অনুশাসন মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার বন্ধন থেকে সমাজের শিক্ষিত স্বচ্ছল স্তরে নারীরা কিছুটা মুক্তি পেলেও সমাজের সর্বস্তরে তার প্রভাব পরিব্যাপ্ত হয়নি। আমাদের দেশের অধিকাংশ পুরুষ এমন কি শিক্ষিতবর্গের মনেও এই ধারণা রয়েছে যে কোন অবস্থাতেই মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নয়, তাতে পারিবারিক জীবন হবে অশান্তিময়, সমাজে বাড়বে উশৃঙ্খলতা। যে বিধিনিষেধ পুরুষ মানে না, যে আচার তারা পালন করে না, মেয়েদের বেলায় তারই কড়াকড়ি। মেয়েদের আমরা স্বাধীনতা দিচ্ছি, শিক্ষার ব্যবস্থাও করেছি কিন্তু তা আধুনিক সভ্যতার প্রতি ভদ্র দায়িত্ববোধের চক্ষুলজ্জায় কতক যন্ত্রযুগের অর্থ নৈতিক বিপর্যয়ে নিরুপায় হয়ে। মনটা রয়েছে মনু পরাশর জীমূতবাহনের যুগে।

 রামমোহনের যুগে বিধবাদের স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারবার অনুকূলে সমাজপতিরা এই যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বিধবারা ব্যাভিচারিণী হয়ে ধর্মহানি ঘটাবে। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রস্তাবের বিরোধীতায় শাস্ত্রবাক্যের কুযুক্তির সঙ্গে বড় বড় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এ অধিকার দিলে নারীরা স্বামীদের বিষ দিয়ে হত্যা করে মনোমত পতি অন্বেষণ করবে। এর একশ’ বছর পরে “হিন্দু কোড” বিলের বিরুদ্ধে দেবীরূপিণী ভারত-নারীর প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন ভারত সন্তানগণ তারস্বরে চীৎকার করে বলছেন, মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার পেলে দেশশুদ্ধ নারী স্বৈরিণী হয়ে যাবে, আর বিবাহ বিচ্ছেদ আইনসঙ্গত হলে বউ নিয়ে ঘর করা চলবে না। মেয়েরা মনুষ্যোচিত স্বাধিকার বিসর্জন দিয়ে অন্ধ সংস্কারের মধ্যে মুগ্ধা হয়ে থাকুক, এই নির্বোধ প্রত্যাশা যাদের, তাদের যুগধর্মের নিয়মে পরাভব মানতেই হবে।

 পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থায় আমাদের দেশের অন্তঃপুরিকারা অপমান বোধহীন ভয়ত্রস্ত নিরানন্দ জীবন যাপন করতেন। এক জড়প্রথার অন্ধ আনুগত্যকে নিষ্ঠা মনে করে অবোধের যে সান্ত্বনা, তাই দিয়ে নিজেদের ভোলাতেন, এও দেখেছি। আর অর্ধশতাব্দী পরে দেখছি, আমাদের দেশের মেয়েরাও বিশ্বচিত্ত উদ্বোধনের আহ্বানে, দেশের বিবিধ মঙ্গল কর্মশালার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এসে কল্যাণলক্ষ্মীর মত দাঁড়িয়েছেন। দীর্ঘকাল মনে এই আশা পোষণ করেছি এরাই জ্ঞানের দীপ হাতে অবজ্ঞাত ভগ্নীদের মনের অন্ধকারকোণ আলোকিত করে তুলবেন।