পাঁচ

 প্রাক্-বিপ্লব যুগের রুশ-সাহিত্যের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সকলেরই জানা। পুষকিন, গোগোল, টলস্টয়, তুর্গেনিভ, গর্কির রচনার সঙ্গে ভারতীয় সাহিত্যামোদীদের অল্প-বিস্তর পরিচয় আছে। রুশীয় সাহিত্যের এই প্রাচীন সম্পদ যা এক দিন মুষ্টিমেয় শিক্ষিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঐতিহ্যের ধারায় সমসাময়িক সোবিয়েত সাহিত্যও স্বদেশের গণ্ডী অতিক্রম করে সকল দেশের প্রগতিশীল নর-নারীর চিত্তে রেখাপাত করছে। শ্রেণীহীন সমাজ-ব্যবস্থায় নবযুগের নর-নারীর রূপান্তরিত জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্যোতনায় অনুরঞ্জিত আধুনিক রুশ-সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও রচনাভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও বিশ্ব-মানবের বাস্তব জীবনের সঙ্গে এর যোগসূত্র অব্যাহত রয়েছে। এই কারণেই বিপ্লবোত্তর যুগের কবি নাট্যকার লেখকেরা আমাদের কাছে অপরিচয়ের বিস্ময় নন।

 সোবিয়েত রাশিয়ায় আমরা মস্কৌ লেখক-সঙ্ঘের অতিথিরূপে গিয়েছিলাম। এই কারণে নানা উপলক্ষে এঁদের সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। মস্কৌ, লেনিনগ্রাদ, স্তালিনগ্রাদ, তিবলিসি, তাসকেণ্ট প্রভৃতি সহরে লেখক, কবি, নাট্যকারদের ইউনিয়ন আমাদের অভ্যর্থনা করেছেন। কেবল ভাবের আদান-প্রদানের শিষ্টাচার নয়, বর্তমান যুগের সঙ্কট ও সমস্যাগুলি সমাধানে সকল দেশের সাহিত্যিকদের কর্তব্য কি, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার উপায় কি, এসব নিয়েও আলোচনা চলতো। দেখেছি, কোন বিশেষ মতের পোষকতা করবার জন্য এঁরা সাহিত্যকে একই মাপে ঢালাই বা যাচাই করেন না। ডিকেন্স, আনাতোল ফ্রাঁস, সেক্সপিয়র, বায়রন, গেটে প্রভৃতির রচনা এখানে খুবই জনপ্রিয়। ভারতের প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হবার এঁদের আগ্রহ অকৃত্রিম। অনেকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এঁদের মনের প্রসারতা দেখে মুগ্ধ হলাম। সাহিত্যসাধনার ক্ষেত্রে এঁরা দেশ-বিদেশের গণ্ডি অতিক্রম করে, সর্বমানবের কল্যাণে অতীতের রক্ষণশীলতার কুহকমুক্ত জ্ঞানের সাধনাকে গ্রহণ করেছেন। সাহিত্যের মধ্যে সর্বকালের একটা আনন্দরূপ আছে, যে তীর্থে প্রাচীন ও নবীনের সৃষ্টির অর্ঘ্য এক সমন্বয়ের মধ্যে বিধৃত, এইটি অস্বীকার করলে রুচিবিকার ঘটে, এবং তা এড়াতে হলে ভাবের আদানপ্রদান চাই। এই কারণেই এঁরা রামায়ন মহাভারত, কালিদাস অনুবাদ করেছেন, সংস্কৃত ভাষার আবরণে অতীতের মহার্ঘ চিন্তাসম্পদ, এঁরা স্বদেশবাসীর সম্মুখে উপস্থিত করেছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের চলতি ভাষা এবং আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে এঁদের আগ্রহ ও ঔৎসুক্য খুব বেশী। মস্কৌ বিশ্ববিদ্যাল‍য়ে বাঙ্গলা, হিন্দী, উর্দু সাহিত্যের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, প্রেমচন্দ, কিষেণচন্দ, মুলুকরাজ আনন্দ, ভবানী ভট্টাচার্যের রচনা রুশ ভাষায় অনুদিত হয়েছে, এর পাঠক সংখ্যা কম নয়। শ্রমিকদের সংস্কৃতি ভবনগুলির লাইব্রেরীতে এসব বই দেখেছি। সোবিয়েতের সাধারণ মানুষের পাঠস্পৃহা, সকল দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি এদের অনুরাগ প্রশংসনীয়।

 রবীন্দ্রনাথ কোন উপলক্ষ্যে বলেছিলেন, সাহিত্যসৃষ্টি যৌথ কারবার নয় বলেই একক নিঃসঙ্গ সাধনায় আমরা সাহিত্যসৃষ্টি করতে পেরেছি। বৈষয়িক ক্ষেত্রে সকলে মিলে কাজ করবার অপটুতা সত্ত্বেও সাহিত্য-ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যমে বাঙ্গালীর সাফল্য স্বীকার করতেই হবে। কথাটা আমিও স্বীকার করি কিন্তু এও তো সত্য, এই শতকরা ৮৫ জন নিরক্ষরের দেশে সাধারণ কবি ও লেখকদের তো কথাই নেই, রবীন্দ্রনাথের রচনার রস কয় জন উপভোগ করতে পারে? এখানে সমষ্টি মানবের মনের দ্বার বাতায়ন রুদ্ধ। আমাদের দেশে একক চেষ্টায় যেখানে সাহিত্যসাধনা সফল হয়েছে, তার সার্থকতার পিছনে একটা বেদনার ইতিহাসও আছে। গিরি-নির্ঝরিণীর কল্লোলিত নৃত্যের নুপূর নিক্কণে পাষাণবদ্ধ ভেদ করার বেদনার সুরও ধ্বনিত হয়। এমন দিন ছিল যখন কবিরা ছিলেন সভাকবি। সম্রাট বা সামন্ত নৃপতিদের স্তাবক ও বিদূষক হয়ে, তাঁদের প্রসাদ-লালিত কবিরা স্তুতিবাদ রচনার ফাঁকে ফাঁকে কাব্য রচনা করতেন। কালিদাস, বাণভট্ট থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতচন্দ্র পর্যন্ত এই ধারাই চলেছে। বাঙ্গলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার শ্রেণীর মধ্যেও এই ধারা গত শতাব্দীতেও ক্ষীণভাবে বয়েছে। বিদেশী শাসন ও ইংরাজী শিক্ষিতবর্গের অবজ্ঞা সত্ত্বেও সাহিত্যপ্রতিভার যে বিকাশ হ’ল, তাও জমিদারী ও সরকারী চাকুরীর আওতায়। পরবর্তী যুগে দেখলাম, হঠাৎ টাকা করা এক শ্রেণীর মূর্খ ও আত্মম্ভরী ধনীর আবির্ভাব; সাহিত্য শিল্পকলা এদের নিকট অবজ্ঞেয়। অথচ গণতান্ত্রিক জনতা মহারাজও তাঁর সিংহাসন পাননি। এই প্রতিকূলতা ঠেলে যাঁরা জনপ্রিয় হয়েছেন, তাঁদের বন্দনা করবার সময় আমার মনে হয়, সেই সব কবি ও সাহিত্যিকের কথা, যারা দারিদ্র্য ও বুভুক্ষার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, উদরান্নের জন্য রক্তপিপাসু প্রকাশকের নিকট সামান্য মূল্যে গ্রন্থ বেচে দিয়েছে, অথবা আশ্বাস পেয়ে বঞ্চিত হয়েছে। যে মনের ক্ষেত্রে সাহিত্যের ফসল ফলবে, সেই মন চতুর বিষয়ীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসে মরুভূমি হয়ে গেছে। কল্পনাপ্রবণ সংবেদনশীল তরুণ মন, যেখানে সোনা ফলতো, সেখানে অচরিতার্থতার গ্লানির ক্লেদ দীর্ঘশ্বাসে দুলে ওঠে। কে নভেল লিখে পরসা করলো, কে সিনেমার গল্প লিখে বাড়ি-গাড়ি করলো, আমরা তাই চোখ মেলে দেখি। কিন্তু দেখিনে, একটু সহানুভূতি সাহায্য এবং জীবিকার নিষ্ঠুর প্রয়াস থেকে অবকাশ পেলে যারা জাতীয় সাহিত্যের গৌরববৃদ্ধি করতে পারতো, তারা ঝরে যায়, সরে যায়, কালের চিহ্নহীন পথে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। যৌবনে কবি গোবিন্দদাসকে তিন দিন চিড়ে খাওয়ার পর অভুক্ত অবস্থায় মরতে দেখেছি, সুরেশ সমাজপতিকে প্রায় অচিকিৎসায় চিরনিদ্রায় অভিভূত হতে দেখেছি। মলিন শয্যাশায়ী রুগ্ন পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমার হাত ধরে বলতে শুনেছি, “আমার জন্য তোরা চাঁদার খাতা খুলিসনি। হয়তো ২৭॥৴০ আনা চাঁদা উঠবে, সে তো মরণাধিক অপমান।” পরিণত বয়সে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকেও নিদারুণ যক্ষ্মা রোগে প্রায় অচিকিৎসায় মারা যেতে দেখলাম। রাগ বা অভিমান করে এ সব কথা বলছিনে, যে পাটোয়ারী বুদ্ধি, সাহিত্যিক লেখকদের অপমান করে বঞ্চনা করে, কটূভাষী সাহিত্যিক ভাড়াটে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে পরিবাদ রটনা করে, তাদের আমি অভিশাপ দেবো না। যে সমাজের মধ্যে জন্মেছি, তার মূঢ়তাকে ক্ষমা করবো; কিন্তু দেশের সাহিত্যসেবকদের বেদনা ও অপচয় তো ভুলে থাকতে পারিনে। ভাবি, সিনেমার ছবির চটকদার খেলো ও ক্ষণিক উন্মাদনা আর রেডিও যন্ত্রের সঙ্গীতের নামে রাসভ নিনাদ তার স্থূল রুচি নিয়ে বর্তমানকে আচ্ছন্ন করে রাখবে, এই কি আমাদের বিধিলিপি!

 সোবিয়েত রাশিয়ার অবস্থা স্বতন্ত্র। এখানে সাহিত্যিক লেখক সাংবাদিকদের প্রচুর উপার্জন ও প্রভূত সম্মান। দেশের সাংস্কৃতিক জীবনের মানদণ্ড উন্নত করবার ভার যাঁদের হাতে, তাঁরা যাতে নিরুদ্বেগ স্বচ্ছল জীবন যাপন করতে পারেন, সেদিকে সোবিয়েত রাষ্ট্র ও সমাজ অবহিত। অন্যান্য বৃত্তিজীবী শ্রমিকদের মত এঁদের সঙ্ঘ বা ইউনিয়ন আছে। সঙ্ঘবদ্ধভাবে এঁরা অবশ্য ফরমাইসী সাহিত্য সৃষ্টি করেন না, তবে লেখকদের বৃত্তিগত স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করেন। এখানে বুভুক্ষু লেখকদের সংবাদপত্রের মালিক বা প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় না। বিভিন্ন শ্রেণীর দৈনিক সপ্তাহিক মাসিক সাময়িক পত্রিকা আছে, লেখক-সঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রের আনুকূল্যে রুশ ও অন্যান্য ভাষায় বই প্রকাশ ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। ইংরাজী, ফরাসী, জর্মন প্রভৃতি ভাষা থেকে অজস্র বই অনুবাদ করা হয়। এর জন্য সকলেই প্রায় সমান মজুরী পেয়ে থাকেন। লেখকের অবস্থা বুঝে প্রকাশকদের দাঁও মারবার দর কষাকষি নেই।

 বিখ্যাত “লিটারারি গেজেটের” সম্পাদক, কবি ও নাট্যকার সিমোনভের আমন্ত্রণে আমরা একদিন “গর্কী লিটারারি ইনস্টিটিউট” দেখতে গেলাম। তরুণ-তরুণীদের কবি সাহিত্যিক সাংবাদিকরূপে তৈরী করে তুলবার এই প্রতিষ্ঠানটি লেখক-সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ছাত্র-জীবনে যাদের মধ্যে সাহিত্যানুরাগ ও রচনাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, তাদের এখানে শিক্ষা ও আত্মবিকাশের সুযোগ দেওয়া হয়। সাহিত্য রচনা ছাড়াও, শিক্ষার্থীদের ভাষাতত্ত্ব, বিভিন্ন দেশের সাহিত্যের ইতিহাস, মার্কসীয় দর্শন প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হয়। খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও অধ্যাপকগণ এখানে নিয়মিত ক্লাস নেন, ছাত্রদের রচনা সংশোধন করেন। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭০ জন। এখানে পাঁচ বৎসর অধ্যয়ন ও শিক্ষানবীসী করতে হয়। ছাত্রদের কোন বেতন দিতে হয় না, বরং গুণানুযায়ী ২৫০ থেকে ৮০০ রুবল ভাতা পায়। বিনা ভাড়ায় ট্রামে বাসে ট্রেনে যাতায়াত এবং সরকারী ভোজনালয়ে সস্তা দামে খাবার সুবিধেও এরা পায়। দেখলাম, বাপ-মার ওপর নির্ভরশীল ছাত্রদের সংখ্যা অতি অল্প।

 সহরের মাঝখানে বাগান-ঘেরা একটা পুরানো বাড়ি, চাপা সিঁড়ি বেয়ে আমরা হল-ঘরে প্রবেশ করলাম। ছাত্রেরা ভারত-সোবিয়েত মৈত্রী ও বিশ্বশান্তির জয়ধ্বনি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলো। একটা লম্বা টেবিলের দু’ধারে ছাত্রদের নিয়ে আমরা বসলাম। এরা চা কেক বিস্কুট ফল সরবতের ব্যবস্থা করেছে। ছেলে-মেয়েদের মুখ আগ্রহে ও প্রীতিতে উজ্জ্বল। এরা এই প্রথম ভারতীয় লেখকদের অভ্যর্থনা করার সুযোগ পেয়েছে। এখানে প্রায় সব রিপাবলিকের ছাত্র আছে। রুশ মোঙ্গল কাজাক আর্মানি তুর্কোমান সাইবেরিয়ান জর্জিয়ান উজবেক ছাড়াও, বুলগেরিয়া রুমানিয়ার ছাত্র আছে। একজন অধ্যাপক আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানালেন এবং প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেবার পর, ছাত্রদের অনুরোধে আমরাও একে একে আত্মপরিচয় দিলাম। এইবার সুরু হ’ল প্রশ্নের পালা। আলোচনা কেবল প্রগতিশীল সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো না, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, কৃষক-শ্রমিকদের আন্দোলন, ভারতের শিক্ষাবিধি, সাহিত্যিকদের অবস্থা এ-সব আমাদের বলতে হ’ল। বৃটিশ আমলে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের যে ব্যবস্থা ছিল এখন তা অনেক পরিমাণে শিথিল হয়েছে একথা বলায় এক জন ছাত্র জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদের গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতিতে বিনাবিচারে বন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে তোমরা আন্দোলন কর কি না? গোঁজামিল দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া কোন সদুত্তর দিতে পারলাম না। এইবার আমরা প্রশ্ন করতে লাগলাম। একজন মোঙ্গল যুবককবি বললে, সোবিয়েত প্রতিষ্ঠা হবার পূর্বে আমাদের কথ্য ভাষার কোন বর্ণমালা ছিল না, কতকগুলি লোকসঙ্গীত ও মুখে মুখে চলতি গল্প গাথা ছিল। সোবিয়েত আমলে আমাদের নিজস্ব বর্ণমালা (রুশ নয়) হয়েছে। মোঙ্গল ভাষায় কবিতা ও সাহিত্য রচিত হয়েছে। বিদ্যালয়ে মোঙ্গল ভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া হয়। আমার রচিত কবিতা জনসাধারণ প্রশংসা করায়, মোঙ্গল রিপাবলিক বৃত্তি দিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য এখানে পাঠিয়েছেন।

 শুনলাম, জারের আমলে মধ্য-এশিয়ায় জাতীয় ভাষার পরিবর্তে জোর করে রুশ ভাষা চালান হ’ত। বিদ্যালয়ে, আপিস-আদালতে দেশী ভাষা চলতো না। সোবিয়েত আমলে জাতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য অতি ক্ষুদ্র উপজাতিদের কথ্য ভাষাকেও উন্নত করে তোলা হয়েছে। কাব্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, অভিনয় প্রভৃতির মধ্য দিয়ে প্রত্যেক ভাষা জীবন্ত ও গতিশীল হয়ে উঠেছে মাত্র ২৫ বৎসরের মধ্যে। কোথাও মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে জোর করে রুশ ভাষা চালাবার চেষ্টা নেই। এক জন আর্মেনীয়ান যুবতী বললে, এক দিকে তুর্কীদের অত্যাচার, অন্য দিকে জারের পীড়ন-নীতি এই দুই চাপে পড়ে বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছিল। সোবিয়েত প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আমাদের জাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি তার অতীত ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এক জন উজবেক তরুণীর মুখে ঐ কথাই শুনলাম। মোল্লা-মৌলভীরা আরবি, পারসিক ভাষা চর্চা করতেন; উজবেক ভাষা কেবল কথ্য ভাষা ছিল। আমরা রুশ বর্ণমালা গ্রহণ করে সাহিত্যসৃষ্টি করেছি; নানা দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য উজবেক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়কলার এত উন্নতি হয়েছে যে, সমস্ত সোবিয়েত রাশিয়ার সংস্কৃতিতে আমরা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছি।

 এই সব শিক্ষার্থীরা, পাঁচ বছরের অধ্যয়ন শেষ করে ‘ডিপ্লোমা’ পাবে; তার পর লেখক ও সাংবাদিক সঙ্ঘের সভ্য হয়ে কর্মজীবন আরম্ভ করবে। অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে জীবিকার অন্বেষণে সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত করার নিষ্ঠুর অপচয় এখানে নেই। যৌথ ভাবে এরা সাহিত্যসৃষ্টি করে না, পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল নিবিড় ঐক্যের মধ্যে এরা অনুদ্বিগ্ন চিত্তে সাহিত্যসাধনা করে। সে সাধনার প্রস্তুতির মধ্যে কত অধ্যবসায়, কত সহানুভূতি, রাষ্ট্র ও সমাজের কত আনুকূল্য—‘গর্কী সাহিত্য শিক্ষালয়’ তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাহিত্য ললিতকলা ও কারুশিল্পের সাধকগণের চিন্তা কল্পনা ও সৃষ্টির ঐশ্বর্য বিস্তারের অবাধ সুযোগের পথ এরা সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এদের সাম্প্রতিক সাহিত্য রচনায় যুদ্ধ হিংসা জাতিবিদ্বেষ বর্ণবিদ্বেষের স্থান নেই। সাহিত্যিক ও লেখকদের প্রত্যেক অভ্যর্থনা সভায় তাঁরা ভারতের সভ্যতা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেছেন, আপনারা দেশে ফিরে গিয়ে আপনাদের সতীর্থদের বলবেন যে, সোবিয়েতের লেখকেরা মানবমৈত্রী ও বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী। মুনাফাশিকারীদের লোভের দ্বারা কলুষিত রাষ্ট্রনীতি বহু মানবের দুর্গতির প্রতি অন্ধ হয়ে আর একটা যুদ্ধের ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলছে, ভারতের প্রগতিশীল লেখকেরা তার বিরুদ্ধে জনমত সজাগ করে তুলুন। আমরা যখন উত্তরে বলেছি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আমাদের আত্মকর্তৃত্ব ছিল না, ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বৈরশাসনের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা। তবুও রবীন্দ্রনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা ফাসিস্ত বর্বরতার বিরুদ্ধে জনমত সজাগ করেছি, ফাসিজমের নিদারুণ বলদৃপ্ত পরের অধিকার লঙ্ঘনের নির্লজ্জ পাশবিকতা থেকে আপনারা কেবল আত্মরক্ষা করেননি, ইয়োরোপ তথা মানব-সভ্যতাকে বহু ত্যাগস্বীকারে রক্ষা করেছেন; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়ে আমরা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু আমাদের জীবন খর্ব, দারিদ্র্যে পীড়িত, শিক্ষায় বঞ্চিত; আমাদের লোকসাধারণের বৈষয়িক রিক্ততার মধ্যেও নৈতিক বল আছে, আজ অতলান্তিকের দুই তীর থেকে সভ্যতার প্রতি ভদ্রদায়িত্ববোধহীন যে বিদ্বেষ-বিষ উদগ্র মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করছে, তার অভিসন্ধি আমাদের অজানা নেই, আত্মপ্রকাশ করবার যে স্বাধীনতা বিংশ শতাব্দীর মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্র তার কণ্ঠরোধ করতে উদ্যত হয়েছে; এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা আপনাদের সহযাত্রী, আমরাও শান্তি ও বিশ্বমানবের মিলনে বিশ্বাসী—তখনই প্রত্যেক সভায় সমর্থনসূচক করতালিধ্বনি উঠেছে। এশিয়ার প্রতি ভারতের প্রতি হয় অবজ্ঞা নয় মুরুব্বীয়ানার ভঙ্গীতে অনুকম্পা, ইয়োরোপ-আমেরিকার এই মনোভাবের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘকালের পরিচয়। কিন্তু রুশ লেখকদের মানসিক গঠন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রাচ্যের প্রতি এদের শ্রদ্ধা অনুরাগ ও আগ্রহ দেখে আনন্দিত হয়েছি।