সাত

 রাশিয়ার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সঙ্গে নানা উপলক্ষে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশবার সুযোগ পেয়েছি। এক মস্কৌ সহরেই ৭।৮ খানা দৈনিক পত্র প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন বিষয়ের সচিত্র ও সাধারণ সাপ্তাহিক মাসিক ও সাময়িক পত্রিকা অগুনতি। দৈনিক পত্রিকার মধ্যে ‘প্রাবদা’র প্রচারই সর্বাধিক। লণ্ডনের ‘টাইমসের’ মত মস্কোর ‘প্রাবদা’ আধা-সরকারী কাগজ, এতে কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারী মতের প্রাধান্য দেওয়া হয়। লেনিনগ্রাদ ও স্তালিনগ্রাদ থেকেও প্রত্যহ ‘প্রাবদা’ প্রকাশিত হয়। ‘প্রাবদা’র পরেই ‘ইজভেস্থা’ ও অন্যান্য দৈনিক। প্রত্যেক দৈনিক পত্র নিজস্ব ভঙ্গীতে বিশেষ বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সংবাদ পরিবেশন ও আলোচনা করে থাকেন। এদের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য আছে, বৈশিষ্ট্য আছে। রুচিভেদে পাঠক-শ্রেণীও স্বতন্ত্র। সমাজতান্ত্রিক সমাজের কাগজে চুরি-ডাকাতি আইন-আদালত ধনীদের খেয়াল ভোজসভায় আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকা নেতাদের ভাষণ ধনী সমাজের বিবাহ বা প্রণয়-ঘটিত কেলেঙ্কারী এ সব সংবাদ প্রকাশিত হয় না। বিদেশী সংবাদের মধ্যে শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলন-আলোড়ন যুদ্ধ কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রভৃতি সংবাদ কিছু কিছু থাকে, কিন্তু প্রাধান্য পায়, সোবিয়েত রাশিয়ার নিজস্ব সংবাদ। ইদানীং শান্তি আন্দোলনের সংবাদ দৈনিকের অনেক স্থান অধিকার করছে। গঠন পুনর্গঠন শিক্ষা স্বাস্থ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাপারেরই বেশী প্রাধান্য। খেলাধুলা অভিনয় নৃত্য সিনেমা কলকারখানা নিয়ে আলোচনা হয়, এমন সংবাদপত্রও আছে।

 এক দিন সন্ধ্যায় ‘লিটারারি গেজেটে’র প্রধান সম্পাদক সিমোনভের আমন্ত্রণে আমরা তাঁর আপিসে এক সান্ধ্য বৈঠকে যোগদান করলাম। কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। দৈনিক ‘লিটারারি গেজেটে’র প্রচার-সংখ্যা ৭ লক্ষ ৫০ হাজার। এতে দেশ-বিদেশের সাহিত্য সমালোচনা এবং ভাল ভাল রচনার অনুবাদকেই মুখ্য স্থান দেওয়া হয়। এ ছাড়া ঘরের ও বাইরের আন্তর্জাতিক সমস্যা আলোচিত হয়। রুশীয় বুদ্ধিজীবী মহলেই এর পাঠক-সংখ্যা বেশী। আলোচনা প্রসঙ্গে সিমোনভ বললেন, ‘আমাদের দেশের সংবাদপত্র সম্বন্ধে বাইরের লোকের অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে। আমাদের বিরুদ্ধে এই কথাটাই জোর করে বলা হয়, আমাদের সংবাদপত্র পরিচালনায় কোন স্বাধীনতা নেই। সরকারী সেন্সরের অনুমোদন ছাড়া আমরা কিছুই প্রকাশ করতে পারি না। গভর্নমেণ্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির গুণগান করাই আমাদের একমাত্র কাজ। এ সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। সরকারী বিভাগীয় ভুল-ত্রুটির আমরা প্রয়োজন মত সমালোচনা করে থাকি। তিনি তাঁর কাগজের ফাইল থেকে দু’টো দৃষ্টান্ত আমাদের দেখালেন। কোন তৈল-শোধনের কারখানায় তেলের অপচয় সম্বন্ধে তথ্যসম্বলিত সমালোচনা হয়েছিল। তার জবাবে তেল বিভাগের মন্ত্রী স্বয়ং পত্র লিখে দোষ স্বীকার করে ভুল দেখিয়ে দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং আশ্বাস দিয়েছেন যে, অবিলম্বে এর প্রতিকার করা হবে।’

 কমিউনিস্ট পার্টির কাজের তীব্র সমালোচনা করে লেখা একটি প্রবন্ধ তিনি পাঠ করে শোনালেন, এতে পার্টির কালচারাল ফ্রণ্টের কর্মীদের বিদ্যাবুদ্ধি ও প্রচারকার্যের ধারা সম্বন্ধে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা হয়েছে। ‘গ্রীষ্মের বন্ধে বিভিন্ন স্বাস্থ্যনিবাসে শ্রমিক ও কৃষকদের সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য যাদের পাঠান হয়েছে, তাদের অপুটতার এবং এই ধরনের আরো সমালোচনা আমরা করে থাকি। সরকারী ও বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য হ’ল জনকল্যাণ। ভুলভ্রান্তি সর্বত্রই আছে এবং ঘটেও থাকে, সেদিকে সজাগ থাকাই সাংবাদিকের ব্রত। এই কর্তব্য পালনে আমাদের স্বাধীনতা আছে।’

 আমি রুশ ভাষা জানি না, এ সম্বন্ধে সব তথ্য জানাও কঠিন। তবে এদের সংবাদ সংগ্রহ প্রচার এবং পরিচালনার ধারা আমাদের দেশের মত নয়। আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলি তার শৈশবকাল থেকেই বৃটিশ সংবাদপত্রগুলির স্তন্য পান করে সাবালক হয়েছে। এ নাড়ীর যোগ এখনো অব্যাহত আছে। আবার আয়তন ভঙ্গিমায় আমরা বিলিতী কাগজের হুবহু নকল করে চলেছি। কোনো স্বকীয় ধারা সৃষ্টি করে নেবার সাহস পাই নে। মনে আছে, একবার এক বিখ্যাত ফরাসী সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের দেশের ইংরাজী কাগজগুলোতে বিদেশী সংবাদের এত প্রাধান্য কেন? দেখলে মনে হয়, যেন ইংলণ্ডের কোন কাগজ পড়ছি।’ উত্তরে বলেছিলাম, ‘আমরা ভারতে ইংরেজ চালিত কাগজগুলোর আদর্শ অনুসরণ করি, তারা যে শ্রেণীর সংবাদকে প্রাধান্য দেয়, সেগুলোকে তেমনি ভাবে ফলাও না করতে পারলে, ইংরেজীনবীশ ভারতীয়রা দেশী কাগজ ছোঁবেও না। দ্বিতীর কারণ, সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে আমাদের কোন জাতীয় প্রতিষ্ঠান নেই। সংবাদের একচেটিয়া কারবারী ‘রয়েটার’ই আমাদের একমাত্র সম্বল।’ অবশ্য এখন অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

 এক জন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেমন, সে সম্বন্ধে কিছু বল।’

 উত্তরে আমাদের এক জন বললেন, ‘আমাদের দেশের নয়া শাসনতন্ত্রে সংবাদপত্রে স্বাধীন মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়নি। প্রেসকে সংযত রাখবার জন্য আইনও আছে। তবু আমরা সরকারী ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালোচনায় যথেষ্ট স্বাধীনতা পেয়ে থাকি।’ আমি বললাম, ‘আমাদের দেশের অধিকাংশ বড় বড় দৈনিক কাগজ মালিকানা স্বার্থে চালিত হয়। কায়েমী স্বার্থের সমর্থক এই সব কাগজের বড় বেশী স্বাধীনতার দরকার হয় না। কেন না, এদের কোন নির্দিষ্ট মতবাদ নেই। সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাতেই প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের সুবিধে আছে। কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে কৃষক শ্রমিক এবং নিম্নমধ্যশ্রেণীর দাবী সমর্থন করে, এমন দু’চারখানা কাগজও আছে। অন্যান্য ধনতন্ত্রী দেশের মতই আমাদের দেশে বিভিন্ন মতবাদের সংবাদপত্র আছে। প্রেস-দমন আইন থাকলেও ইংরেজ আমলের মত কড়াকড়ি নেই।’

 আলোচনা ক্রমে সাংবাদিকদের বৃত্তির নিরাপত্তা ও উপার্জনের প্রসঙ্গে এসে পৌঁছল। একজন বললেন, ‘আমাদের ইউনিয়ন সাংবাদিকদের স্বার্থ ও অধিকারের সতর্ক প্রহরী। ইউনিয়নের সদস্যরা স্বাধীন ভাবে স্ব স্ব রুচি ও যোগ্যতা অনুসারে কাজ করেন। বেতন ভাতা ছুটি এবং লেখার মজুরীর হার নির্দিষ্ট রয়েছে। মালিকের মুনাফার স্বার্থে কাগজ পরিচালিত হয় না বলে লাভের সমস্তটাই বাড়ি স্বাস্থ্যনিবাস শিক্ষালয় হাসপাতাল প্রভৃতির জন্য ব্যয় হয়। সাংবাদিকদের ছেলেমেয়েদের পায়োনীয়র্স ক্যাম্প বা দেশভ্রমণের ব্যবস্থাও আমরা করে থাকি। সাংবাদিকরা প্রথম দেড় হাজার রুবল মাসিক বেতনে কাজ আরম্ভ করেন। অধিকাংশের মাসিক বেতন আড়াই হাজার থেকে ছয় হাজার রুবল। বিশেষ রচনার জন্য প্রতি কলমে ১০০ রুবল দেওয়া হয়। এ ছাড়া সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস ভ্রমণকাহিনী প্রভৃতি প্রবন্ধের মজুরী দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার রুবল। ত্রিশ বছর কাজ করার পর পেনসনেরও ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশে সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রের এত প্রসার হচ্ছে যে, বেকার সমস্যার প্রশ্নই ওঠে না।’

 দেশে ফেরার পর অনেকে আমাকে বলেছেন, ওখানে সাংবাদিকদের আর্থিক অবস্থা ভাল হতে পারে, কিন্তু তাঁদের তো একটি বিশেষ মতবাদের পোষকতা করতে হয়, স্বাধীন ভাবে চিন্তা ও সমালোচনা করার অধিকার কতটুকু? এ বিষয়ে প্রশ্ন করে কোন সদুত্তর পেয়েছেন কি? অকপটে স্বীকার করছি, এমন প্রশ্ন আমি করিনি। কেন না পাল্টা প্রশ্ন করলে, জবাব দিতে বিব্রত হতে হত। আমার নিজের দেশে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে হ’লে কি মূল্য দিতে হয় তা আমি জানি। প্রত্যেক বৃহৎ সংবাদপত্রে তার মালিক এবং মালিকের পৃষ্ঠপোষক ধনী ও রাজনীতিক ক্ষমতাচক্রের অধিপতিদের মতামত প্রতিফলিত হয়, সম্পাদক যদি ‘বিবেকে’র দোহাই দিয়ে ভিন্ন মত অবলম্বন করেন তবে নির্ঘাত তার অন্ন মারা যাবে এবং তার আপীল করবার মত কোন দরবার নেই। এ নিয়ে আলোচনা বাড়িয়ে পাঁক ঘুলিয়ে না তোলাই ভালো।

 রাশিয়ার সাংবাদিকেরা তাঁদের বৃত্তির নিরাপত্তা ও উপার্জন এবং অপটু হয়ে পড়লে নিরাশ্রয় হয়ে অনাহারে না মরা সম্বন্ধে যেমন নিশ্চিন্ত তেমন নিরাপত্তা কিছুটা ইয়োরোপ ও আমেরিকাতেও আছে। সঙ্ঘবদ্ধ সাংবাদিক-সঙ্ঘ মালিকদের স্বেচ্ছাচার সংযত করেছেন, বৃত্তিগত নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের দেশের মালিকেরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষার জন্য। গত ১০।১২ বছরে এঁরা সাংবাদিকদের বৃত্তিগত নিরাপত্তার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন গ্রহণ করেননি। কোন কোন কাগজের প্রভিডেণ্ট ফাণ্ড আছে, ব্যক্তিগত ভাবে কোন মালিক দয়া-দাক্ষিণ্যও দেখিয়ে থাকেন, কিন্তু সেটা অনুগ্রহ মাত্র। সাংবাদিকদের তরফ থেকে গত ত্রিশ বৎসর অনেক খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত চেষ্টা বিফল হয়েছে। সাংবাদিকদের স্বার্থ ও বৃত্তিগত মর্যাদা রক্ষার পথে প্রধান অন্তরায়, শিক্ষিত শ্রেণীর বেকার সমস্যা যার সুযোগ নেবেন না, মালিকরা এত নির্বোধ নন।

 এখানে দেখলাম, আমেরিকা বৃটেন অপেক্ষাও অধিক সংখ্যায় মেয়েরা সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছেন। ‘টাস’ ‘প্রাবদা’ কিম্বা অন্য কোন সংবাদ ও সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান থেকে যাঁরা আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, তাঁদের অধিকাংশই নারী। আমাদের দেশ সম্বন্ধে এঁদের প্রশ্নের ধরন দেখে মনে হয়েছে, ভারত সম্বন্ধে এঁরা অনেক খোঁজ-খবর রাখেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের দেশে শিক্ষিতা মেয়েরা সাংবাদিক বৃত্তি গ্রহণ করে না কেন?’

 বললাম সুযোগের অভাবে। অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ের আগ্রহ দেখেছি, কিন্তু আমাদের দেশের খবরের কাগজের আপিসের পরিবেশ নানা কারণে মেয়েদের কাজ করার অনুকূল নয়, তার ওপর একটা সামাজিক রক্ষণশীলতাও আছে। আধুনিক শিক্ষিতা মেয়েরা অবশ্য নানা বৃত্তিতে এগিয়ে আসছেন। আমাদের দেশে সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখিকা অনেক আছেন; কিন্তু এখনও এক জন মেয়েও পুরোপুরি বৃত্তিজীবী সাংবাদিক হন নি।

 এ দেশের সংবাদপত্র আকারে আমাদের দেশের চেয়েও ছোট। চার পাতার বেশী দৈনিক কাগজ নেই। এদের কাগজে বিজ্ঞাপন নেই, কেন না ব্যবসাদারী প্রতিযোগিতা নেই। কাগজ বিক্রি করে যে আয় হয়, তাতেই ছাপাখানা ও কর্মীদের ব্যয় সঙ্কুলান করতে হয়। কয়েকটি সংবাদপত্রের আপিসের আয়তন, আসবাবপত্র, বিশাল ছাপাখানার নানা বিভাগ দেখে আশ্চর্য হলাম। আমাদের প্রধান সংবাদপত্রের কার্যালয়গুলি তুলনায় এদের দেশের কাছে-ধারেও এগুতে পারে না।