আমার বাল্যকথা/ঈশ্বরচন্দ্র নন্দী
ঈশ্বরচন্দ্র নন্দী
Oriental Seminary-র হেড মাষ্টার ঈশ্বরচন্দ্র নন্দী আমাদের ইংরাজি শিক্ষক ছিলেন।—ধীর শান্ত প্রকৃতি, সুবিদ্বান—তাঁর কি এক মোহিনী শক্তি ছিল আমরা সহজেই তাঁকে মেনে চলতুম, আমাদের উপর তাঁর কোন জোর জবরদস্তী করতে হত না। আমাদের কাছে তাঁর ডাক-নাম ছিল কেবলমাত্র ‘Sir’—‘Sir’ এসেছেন শুনলেই আমরা গিয়ে হাজির। বিদ্যালয়ে আমাদের যে সকল পাঠ্য পুস্তক ছিল তা ছাড়াও তিনি আমাদের অনেক বই পড়তে দিতেন। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য—Gibbon’s Decline and Fall—‘রোম রাজ্যের অবনতি ও পতন’ যার পত্রে পত্রে ঘোরতর রাষ্ট্র-বিপ্লব, রোম সম্রাটের অমানুষিক কাণ্ড-কারখানা—গিবনের মৃদঙ্গগম্ভীর ভাষায় পড়ে স্তম্ভিত হতে হত। এতদ্ভিন্ন ইংরাজি প্রবন্ধাদি লেখা, বক্তৃতাদি অভ্যাস করা, এ সকলের প্রতিও তিনি মনোযোগ দিতেন। যাতে আমাদের ইংরাজি ভাল বলবার ক্ষমতা জন্মে সেই উদ্দেশে তিনি আমাদের জন্য এক বক্তৃতা-সমিতি স্থাপন করেছিলেন; প্রতি সপ্তাহে তার অধিবেশন হত এবং পৃথিবীর প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা— নেপোলিয়ন প্রভৃতি মহা মহা বীরদের বীরত্ব-কাহিনী অবলম্বন করে আমরা বড় বড় তর্কবাগীশ একত্র হয়ে বাগ্মিতা ফলাবার চেষ্টা করতুম। সর্বশেষে সভাপতি মহাশয় আমাদের তর্কবিতর্কের সুন্দর মীমাংসা করে দিতেন। এই সভার কার্য অনেক দিন বেশ নিয়মপূর্বক চলেছিল। মাষ্টারমশায়ের প্রতি আমাদের প্রগাঢ় ভক্তি ভালবাসা ছিল তিনিও পিতার ন্যায় আমাদের সর্বাঙ্গীন উন্নতিসাধনে যত্নবান ছিলেন। তাঁরি শিক্ষাগুণে আমি ঐ সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের কোন এক সভায় “প্রাচীন ভারতের রণনীতি” বিষয়ক একটি ইংরাজি প্রবন্ধ পাঠ করি—কেশবচন্দ্র সেন সেই অধিবেশনে একজন প্রধান বক্তারূপে উপস্থিত ছিলেন।
সাত বৎসর বয়সে আমি হিন্দু স্কুলে ভর্তি হই, তখন তার নাম ছিল ‘হিন্দু কলেজ।’ প্রথম দুই বৎসর একাদিক্রমে দুইটি প্রাইজ পাই—দ্বিতীয়খানি সচিত্র Robinson Crusoe—বালকের পক্ষে এমন সুপাঠ্য পুস্তক আছে কি না সন্দেহ। দুবৎসর পরে বনমালী বাবুর ক্লাসে উঠি। তিনি একজন অতি কঠোর প্রকৃতির মাষ্টার ছিলেন। ছেলেদের উপর বড়ই উৎপীড়ন করতেন, সব চেয়ে যে সুশীল বালক সেও তাঁর প্রচণ্ড চটোপঘাত এড়াতে পারত না। বন্ধুবর তারকনাথ পালিত তাঁর চপেটাঘাতে একবার ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আমরা তাঁকে যমের ন্যায় ভয় করে চলতুম—যমদূতের মত তাঁর সেই ভীষণ কৃষ্ণমূর্তি মনে করলে এখনো ভয় হয়।