শিক্ষা

 আমি ইতিপূর্বে পাঠশালায় গুরুমশায়ের কাছে আমার প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলেছি, তার পরের ধাপ হচ্ছে পণ্ডিত মহাশয়ের নিকট সংস্কৃত অধ্যয়ন। পিতৃদেব যে চারজন পণ্ডিতকে বেদশিক্ষার জন্যে কাশীতে পাঠান—বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার তার মধ্যে একজন। ইনিই আমার সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। যদিও আমার শিক্ষক, কিন্তু এঁর উপাধির উপযুক্ত পাণ্ডিত্যের যদি সার্টিফিকেট দিতে হয় তাতে আমার সঙ্কোচ বোধ হবে। এঁর শিক্ষাগুণে সংস্কৃতশাস্ত্রে আমার যে বিশেষ ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল তা বলতে পারি না। মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের ‘সহর্ণের্ঘঃ ‘চপোদিত। কানিভার্ণঃ’ প্রভৃতি সূত্র ও তস্য বৃত্তিগুলি কণ্ঠস্থ ও আবৃত্তি করতেই সব সময় যেত। তিনি বলতেন—

‘আবৃত্তিঃ সর্ব্বশাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী।’

অর্থাৎ আবৃত্তিই সর্বশাস্ত্রের সার, বোঝো আর না বোঝো তাতে কিছু যায় আসে না। কাব্যের মধ্যে রঘুবংশের কয়েক সর্গ বই আর বেশীদূর এগোয়নি। আমি যতদিন বিদ্যালঙ্কারের কাছে সংস্কৃত শিখেছিলুম, ততদিন যদি আর একজন ভাল পণ্ডিতের কাছে,— ওকথা থাক আর গুরুনিন্দা করব না। তাঁর নিকট শিক্ষায় আমার একটা লাভ হয়েছিল স্বীকার করতেই হবে! সংস্কৃত ভাষার বিশুদ্ধ উচ্চারণ এক প্রকার আয়ত্ত করে নিয়েছিলুম। কাশীতে সংস্কৃত অধ্যয়নের ফলে আর কিছু না হোক তাঁর ঐটুকু পাণ্ডিত্য—ঐ উচ্চারণ শুদ্ধিটুকু উপার্জিত হয়েছিল, আর তাঁর ছাত্রও অল্পবিস্তর তার ফলভাগী হয়েছিল। বাঙ্গলা দেশে সংস্কৃত উচ্চারণ যে কি বিকৃত তা সকলেরই জানা আছে, সে উচ্চারণ ত আমার কাণে ভারি অশ্রাব্য ঠ্যাকে। আমাদের বড় বড় দিগ্‌গজ পণ্ডিতদেরও উচ্চারণ শুনলে মাথা হেঁট করতে হয়। আমাদের যেমন একপ্রকার ‘বাবু’ ইংরিজি আছে যা নিয়ে ইংরেজেরা বিদ্রূপ করে, তেমনি ‘বাবু’ সংস্কৃত উচ্চারণ শুনে না জানি তৈলঙ্গী বা মহারাষ্ট্রীয় পণ্ডিতেরা কি মনে করেন! সংস্কৃত কলেজের একজন ভূতপূর্ব অধ্যক্ষের সহিত আমার এই বিষয়ে কথা হয়। আমি বিনীতভাবে নিবেদন করেছিলুম যে, কালেজের বিদ্যার্থীদের বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ শেখাবার একটা সুব্যবস্থার প্রয়োজন। তিনি আমার একথা হুট করে উড়িয়ে দিলেন। বল্লেন “এদেশে যে উচ্চারণ চলতি তাই ঠিক—মেডুয়াবাদীদের কাছে আমরা আবার উচ্চারণ কি শিখব? আর কোন্ প্রদেশকেই বা উচ্চারণের মানদণ্ড বলে গ্রহণ করা যেতে পারে?”

 কিন্তু এ তর্কের মীমাংসা গায়ের জোরে হয় না। সংস্কৃতের কোন বর্ণের কি উচ্চারণ তা পরীক্ষা করবার অনেক উপায় আছে, আর সে পরীক্ষায় বাঙ্গলা-সংস্কৃত উচ্চারণের ভ্যাজাল ধরা পড়বেই। “ভাষা বিজ্ঞানের পারিপাট্যে সংস্কৃত অতুলনীয়। ভাষায় যতগুলি উচ্চারণ ঠিক ততগুলি বর্ণ সংস্কৃত বর্ণমালায় স্থান পাইয়াছে। প্রত্যেক বর্ণের একটিমাত্র নির্দিষ্ট উচ্চারণ।” কিন্তু এদেশে আমরা কি সংস্কৃত বর্ণের যথানির্দিষ্ট উচ্চারণ রক্ষা করি? তা ত নয়। আমরা বর্গীয় জ, অন্তস্থ্য য, দুই ব, মূর্দ্ধণ্য ণ, দন্ত্য ন, তালব্য মূর্দ্ধণ্য ও দন্ত্য স এই সকল ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের উচ্চারণে কোন প্রভেদ মানি না। যুক্তাক্ষরে প্রতি বর্ণের পৃথক উচ্চারণ না করে বাঙলা ধরণে এক বিকৃত উচ্চারণ করে থাকি; যথা—

কৃষ্ণ (ষ্ ণ)=কিষ্ট। আত্মা=আত্তাঁ।
স্নান=স্তান। ক্ষীর (ক্‌ষীর)=ক্ষীর ইত্যাদি।

 অন্ত্যস্থ ‘য’র পৃথক উচ্চারণ বাঙ্গলায় আদৌ নাই, যুক্তাক্ষরেও নহে। সংযুক্তবর্ণে ‘ষ’কারের উচ্চারণ হয় না—যে অক্ষরে সংযুক্ত থাকে তার দ্বিরুক্তির মত উচ্চারণ হয়, যেমন—

সত্য=সত্ত। বাদ্য=বাদ্দ ইত্যাদি।

 বাঙ্গলার অনেক স্থলে ‘অ’কারের উচ্চারণ প্রাকৃত হ্রস্ব ‘ও’কারের মত, যথা— অরি অসি ইত্যাদি। সংস্কৃত উচ্চারণের বেলাতেও আমরা এই নিয়ম অনুসরণ করি। বাঙ্গলা উচ্চারণের নিয়ম সংস্কৃত উচ্চারণে আরোপিত হয় বলে এখানে সংস্কৃতের উচ্চারণ এরূপ দূষিত হয়েছে। তাই হয়েছে। তাই বলছি সংস্কৃতের মত ঠিক উচ্চারণ করতে হলে আমাদের রীতিমত সংস্কৃত উচ্চারণ শিক্ষার প্রয়োজন। একথা সত্য যে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের সংস্কৃত উচ্চারণের বিশুদ্ধতা কোন কোন অংশে নষ্ট হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে বাঙ্গলা দেশের কাছে আর সকলেই হার মানতে হয়। এদেশে সংস্কৃত উচ্চারণ যেরূপ বিকৃতি ধারণ করেছে এমন আর কোথাও দেখি নাই। বারাণসী বল, দাক্ষিণাত্য বল, এসকল স্থানের যে কোন পণ্ডিত হোন তাঁদের উচ্চারণ যে আমাদের তুলনায় বিশুদ্ধ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। দুএকটি ব্যতিক্রম থাকতে পারে; যেমন মহারাষ্ট্রে দেখেছি ‘দ’এ ‘ন’এ ‘জ্ঞ’র উচ্চারণ হয়; কিন্তু সেগুলি ধর্তব্যের মধ্যে নহে। অতএব এ ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয়ই ওসকল স্থানের সংস্কৃতজ্ঞদের গুরুস্থানীয় বলে মেনে নিতে পারি। সে যা হোক্, আমাদের মনে হয় বঙ্গদেশে সংস্কৃতের উচ্চারণ-সংস্কার নিতান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে এবং আমাদের সংস্কৃতানুরাগী বিদ্বন্মণ্ডলী এবিষয়ে মনোযোগ করুন, এই আমার সবিনয় নিবেদন।

 বিদ্যালঙ্কার মহাশয়ের নিকট সংস্কৃত-সাহিত্যে আমার যা কিছু জ্ঞানলাভ হয়, সিবিল সর্বিস পরীক্ষায় সেই বিদ্যাটুকু আমার বিলক্ষণ কাজে এসেছিল। আমার সময়ে সংস্কৃত ও আরব্য ভাষায় ৫০০ মার্ক পূর্ণমাত্রা নির্ধারিত ছিল। এই ৫০০ মার্কের মধ্যে আমি সংস্কৃতে ৩৫০-এরও উপর পেয়েছিলুম। আমার পরীক্ষক ছিলেন ভট্ট মোক্ষমূলর। তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। বোধ করি আমার লেখা পরীক্ষা করবার সময় আমার কাগজটার উপরে একটু সদয়ভাবে চোখ বুলিয়েছিলেন, নইলে অত উচ্চ সংখ্যা পাবার আমার আশা ছিল না। আমি সিবিল সর্বিস পরীক্ষায় লাটিন গ্রীকের পরিবর্তে আমাদের দুই Classic—সংস্কৃত ও আরবিক নিয়েছিলুম। ওখানকার ছাত্রদের নিজের ভাষায় অথবা ওদের চিরাভ্যস্ত লাটিন গ্রীক ভাষায় যদি আমাকে পরীক্ষা দিতে হত, আর আমাদের ক্লাসিকদ্বয় তালবেতালরূপে যদি আমার সহায় না থাকত তাহলে ঐ পরীক্ষায় আমার জয়লাভের কোন সম্ভাবনাই থাকত না।