ব্যায়াম

 ছেলেবেলায় আমাদের ব্যায়াম চর্চার অভাব ছিল না। ভোরে উঠে যোড়াসাঁকো থেকে গড়ের মাঠ বরাহনগর প্রভৃতি দূর দূর পাল্লা পদব্রজে বেড়িয়ে আসতুম। সেই আমাদের Morning Walk— তাছাড়া ঘোড়ায় চড়া, Cricket, সাঁতার দেওয়া এ সব ছিল। আমাদের বাড়ীতে একটা পুকুর ছিল, তাতে আমরা অনেক সময় সাঁতার দিতে যেতুম। বাজী রেখে সাঁতার দেওয়া আমাদের এক রকম খেলা ছিল আমরা তিন ভায়ে মিলে যেতুম—কলার গাত আমাদের ভেলা। সেই ভেলায় চড়ে মাঝখান পর্যন্ত গিয়ে দেখা যেত কে কাকে সিংহাসনচ্যুত করতে পারে। সেই কলার বাহন কেড়ে নেওয়া চাই—আরোহী সাধ্যমত চেষ্টা করছে আততায়ীকে হটিয়ে দিতে—চোখে জল ছিটিয়ে হোক আর যে কোন উপায়েই হোক তার আক্রমণ হতে আপনাকে রক্ষা করতে হবে।—বলপূর্বক সেই কলাবাহন যে দখল করতে পারবে তারই জিৎ। এই রকম সাঁতারে আমরা খুব পরিপক্ব হয়ে উঠেছিলুম। বাবামশায়ের সঙ্গে যখন গঙ্গায় ব্যাড়াতে যেতুম তখন সাঁতার দিয়ে স্নানে আমার বিশেষ আমোদ হত। আমি সাঁতার দিতে দিতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতুম বাবামশায় তাতে কোন আপত্তি করতেন না, বোধ করি যদিও এক একবার তাঁর মনটা অস্থির হয়ে পড়ত।

 বড়দাদা সাঁতারে সর্বাপেক্ষা মজবুত ছিলেন। তাঁর রেখাক্ষরের মত সাঁতারেও তিনি যে কত রকম কারদানী করতেন তার ঠিক নেই। যখন গঙ্গার ধারের বাগানে থাকতেন তখন মাঝে মাঝে সাঁতার দিয়ে গঙ্গাই পার হতেন; আর সকলে ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ত।

 হীরাসিং বলে এক পালওয়ানের কাছে আমরা কুস্তী শিখতুম, তাতে আমার খুব উৎসাহ ছিল। ডনের পর ডন, বড় বড় মুগুর ভাঁজা—আর কত রকম কুস্তীর দাঁও, মার পেঁচ শিক্ষা। আমি কুস্তীতে একজন ওস্তাদ হয়ে উঠেছিলুম। কেউ আমার সঙ্গে সহজে পেরে উঠত না। হীরাসিংহের চ্যালাদের মধ্যে অনেক আমার সমবয়স্ক ছিল, তাদের সঙ্গে আমার কুস্তি হত—তাদের মধ্যে যারা বড় তাদেরও আমার কাছে হার মানতে হত; সহজে কেউ আমাকে ধরাশায়ী করতে পারত না। অথচ আমার বল যে বেশী তা নয়— এই কুস্তীতে শুধু বলীর জয় তা নয়, ছলে বলে কৌশলে যে কোন প্রকারে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে পারলেই জিৎ। একদিন কুস্তী করতে করতে বেকায়দায় পড়ে আমার হাত মুচকে গিয়েছিল। কাউকে কিছু না বলে সেটা ঢেকে রাখবার চেষ্টা করা গেল। আমার ওস্তাদের টোটকা ওষুধে সেরে যাবে এই ভেবে ছোলা ভিজিয়ে হাত বেঁধে রাখলুম; কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। শেষে ডাক্তার সাহেবের রীতিমত চিকিৎসায় তবে আরাম হল। তখন থেকে সেবারকার মত আমার কুস্তী বন্ধ। এই সব বিষয়ে আমি অল্পেতে সন্তুষ্ট থাকতুম না, সবাই বলত “যা করবে সব তাতেই বাড়াবাড়ি— এ তোমার কেমন স্বভাব।” তার ফল ভোগও করতে হত—হাত পা ভাঙ্গা, মাথা ভাঙ্গা, কত বিপত্তি যে আমার উপর দিয়ে গিয়েছে তার অন্ত নেই। অথচ এখনো পর্যন্ত ত বেঁচে আছি। এত প্রকার বিঘ্ন বিপত্তির মধ্যে শিশুজীবন যে কি করে রক্ষা পায়, বিধাতার এ এক আশ্চর্য বিধান। সে যাহা হোক, একথা বলা যেতে পারে কোন বিষয়েরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়’— এটা বড় ঠিক কথা। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমে অনেক সময় উল্টা উৎপত্তিই হয়। তার সাক্ষী আমাদের ওস্তাদ হীরাসিং। তার কুস্তীর বিরাম নেই, যখনই দেখি কোন না কোন কঠোর ব্যায়ামে নিযুক্ত; কিন্তু তার শরীর বেশী দিন টিঁকল না, শীঘ্রই ভেঙ্গে পড়ল। শুনেছি এই সব পালোয়ানেরা দীর্ঘজীবী হয় না। শরীর রক্ষা করতে হলে আহার বিহার ব্যায়াম এ সকল বিষয়ে মিতাচারী হওয়া আবশ্যক। গীতানির্দিষ্ট মধ্যপথই প্রশস্ত—

যুক্তাহার বিহারস্য যুক্ত চেষ্টস্য কর্ম্মসু
যুক্ত স্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা।

 নিয়মিত আহার বিহার, নিয়মিত কর্ম চেষ্টা, নিয়মিত নিদ্রা ও জাগরণ—ইহাতেই দুঃখহারী যোগ সাধন হয়।