আমার বাল্যকথা/নবগোপাল মিত্র

নবগোপাল মিত্র

 উপরে যে জাতীয় মেলার কথা বলেছি তার প্রধান উদ্যোগী ছিলেন নবগোপাল বাবু। তিনি হিন্দু স্কুলে আমার সহাধ্যায়ী ছিলেন, স্কুল ছেড়ে আমাদের সহকর্মী হলেন; আমাদের মধ্যে প্রণয় ও ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ল, তিনি সর্বদা আমাদের বাড়ীতে যাওয়া আসা করতে লাগলেন। তিনি ভারী চালাক চতুর, খুব একজন কাজের লোক ছিলেন। তিনি একটা অশ্বশালা খুলেছিলেন, তাকে সবাই বলত নবগোপালের Circus, তাতে আমরা কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়া শিখতে যেতুম। ‘Indian Mirror’ পত্র যখন আমার পিতৃদেবের হাত হতে হস্তান্তর হল, সেই পত্রের প্রতিযোগী ‘National Paper’ বলে একটা ইংরাজি সাপ্তাহিক পত্র আমাদের বাড়ী থেকে বেরতে লাগল, নবগোপাল বাবু তার সম্পাদক হয়েছিলেন। ‘ব্রাহ্মবিবাহ’ আইন যখন বিধিবদ্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল তখন যাঁরা আদি ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ সমর্থন করবার জন্য সিম্‌লার পাহাড়ে প্রেরিত হন, নবগোপাল বাবু তাঁদের মুখপাত্র ছিলেন। আদি সমাজের বিরুদ্ধাচরণের ফলে দাঁড়াল এই যে, হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান প্রভৃতি প্রচলিত কয়েকটি প্রধান প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের বাইরে না গেলে আর রেজিস্ট্রী বিবাহ সিদ্ধ হয় না। সুতরাং আমাদের মধ্যে যাঁরা এই আইনের শরণাপন্ন হতে চান তাঁরা আপনাদের অহিন্দু বলে প্রকাশ্যে পরিচয় দিতে বাধ্য। এই আবর্তের মধ্যে পড়ে এখন আমরাই আর্তনাদ ছাড়ছি—এই অহিন্দু Declaration উঠিয়ে দিয়ে বিবাহ আইন সংস্কারের জন্য সচেষ্ট হয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের হাজার চেষ্টাতেও কোন ফল হচ্ছে না।

 বোম্বাই থেকে আমি একবার ছুটিতে কলকাতায় এসে বোম্বাই প্রদেশের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, ধর্মসম্প্রদায়, তীর্থস্থান, ইত্যাদি বিষয়ে একটা সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলুম—ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন সভাপতির আসন গ্রহণ করেছিলেন। সেই বক্তৃতায় আমি কথায় কথায় বলেছিলুম বাঙালীদের যেমন প্রধান আহার ভাত ওদেশে সেরূপ নয়, ভাতের ব্যবহার আছে বটে কিন্তু সাধারণ লোকের মধ্যে বেশীর ভাগ রুটিই প্রচলিত, কোথাও বজরী (বজরা), কোথাও জোয়ারী বা গমের হাত-গড়া রুটি! ভাতই আমাদের যেমন প্রধান খাদ্য ওদেশে তেমনি রুটি। এই ভাতখোর ও রুটিখোর, দুই জাতির মধ্যে বলিষ্ঠ কোন জাতি? এই প্রশ্ন উঠল। আমি বলেছিলুম ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক জাতির তুলনায় বাঙালী দুর্বল! আবহাওয়ার গুণাগুণ এই পার্থক্যের এক কারণ হতে পারে, আহারের তারতম্যও আর আর কারণের মধ্যে ধরা অসঙ্গত হয় না। যব ও গমের মত ভাত পুষ্টিকর খাদ্য নয়, সুতরাং ভাতখোর বাঙালী যে দুর্বল তাতে আর বিচিত্র কি? এই কথা শুনে নবগোপাল বাবু মহা চটে উঠলেন। তিনি চীৎকার করে আপনার অমত প্রকাশ করে বল্লেন, “তা কখনই হতে পারে না। তোমরা যাই বল, আমরা একবার ভাত খাব, দুবার ভাত খাব, তিনবার ভাত খাব।” এ তর্কের আর কোন উত্তর নেই। “সভা হল নিস্তব্ধ।”

 তখনকার কালে নবগোপাল ন্যাশনাল দলের দলপতি ছিলেন। তাঁরি নেতৃত্বে জাতীয় মেলা সফলতা লাভ করেছিল; দুঃখের বিষয়, সে উৎসাহ অধিক দিন স্থায়ী হল না, শীঘ্রই নিবে গেল। এই স্বদেশী ভাবের যে পুনরুদ্দীপন হয়েছে এভাব যদি দেশময় বিস্তার লাভ করে শাশ্বতকাল স্থায়ী হয়, তাহলেই দেশের মঙ্গল প্রত্যাশা করা যায়।

 পূর্বে বলেছি যে, পূর্বে আমরা দুই কাকার সঙ্গে একান্নবর্তী পরিবারভুক্ত ছিলাম। তখন ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য শাখার মধ্যেও যথেষ্ট সদ্ভাব ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। ভিন্ন ভিন্ন বাড়ীর ছেলেরা আমাদের বাড়ীর দালানে গুরুমশায়ের কাছে ক খ শিখতে আসত। গুরুমশায়ের কাছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় হাতে খড়ি। সেই উগ্রচণ্ডা গুরুমশায় বেত্রহস্তে শেখাতে বসেছেন, কখনো বা সে বেত তাঁর কোন ছাত্রপৃষ্ঠে চালিত হচ্ছে—সে চিত্র মন থেকে কখনো যাবে না। আমরা গুরুমশায়কে কি মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত মনে করতুম—ঠিক যেন Goldsmith-এর সেই গ্রাম্য গুরুমশায়—

And still they gazed and still
The wonder grew
That one small head could
Carry all he knew.
অবাক হইয়া দেখে, না জানি কি করে
অত বিদ্যা ওই ক্ষুদ্র মাথার ভিতরে।

 আমরা গুরুমশায়ের কাছে ক খ, বানান নামতা, কড়াঙ্কে, ষটকে —এই সব শিখতুম, তাছাড়া চিঠিপত্র লেখা অভ্যাস করতুম। যত ওঁচা ফ্যালা, জিনিষ মোড়বার মত ব্রাউন কাগজ আনা হত, —শ্রীরামপুরের সাদা কাগজ যেদিন আসত খুব ভাগ্যি মনে করতুম। এই কাগজের উপর বাঙলা কলম দিয়ে আঁচড়কাটা— সেই আমাদের পত্রলেখা। যতদূর মনে আছে পত্রের দুই পাঠ ছিল—‘সেবক শ্রী’ আর ‘আজ্ঞাকারী শ্রী’— দিনের পর দিন বদলে বদলে এই দুই পাঠ লেখা হচ্চে। এখন দেখতে পাই বাঙলা চিঠিতে পাঠ লেখা বড় সহজ ব্যাপার নয়। বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুজন, স্নেহের সম্পর্কীয় কনিষ্ঠ ছোট বড় আত্মীয় স্বজন বন্ধু, অপরিচিত দূরের লোক, formal informal!—বাংলায় কাকে কি পাঠ, ও কোন্ সময় কি পাঠ লিখতে হয় সে এক বিষম সমস্যা। গুরুমশায় এই বিষয় আমাদের মনোযোগ দিয়ে শেখালে ভবিষ্যতে অনেক কাজ দেখত। তবে ওরূপ মূর্খ পণ্ডিতের কাছে বেশী কিছু প্রত্যাশা করা অন্যায়, আমরা ঐ গুরুর কাছে লেখাপড়া বেশী দূর না এগিয়ে থাকি—নিদেন গোড়া পত্তন সেই।