আমার বাল্যকথা/বিলাত যাত্রা
বিলাত যাত্রা
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আমার বিলাত যাত্রা। আমি কখনও স্বপ্নেও যা ভাবি নাই আমার ভাগ্যে তাই ঘটল। আমাদের জীবনে পদে পদে দেখা যায়—দৈবের কি বিচিত্র গতি! এক একটা অদৃষ্টপূর্ব আকস্মিক ঘটনা এসে কত সময় আমাদের জীবনস্রোতকে কোন্ এক অজ্ঞাত নূতন পথে যেন বলপূর্বক টেনে নিয়ে যায়—যার পূর্বাভাস কিছুই পাওয়া যায় নাই। আমার জীবনে এ কথা সপ্রমাণ দেখতে পাই। আমি বাল্যকালে একভাবে শিক্ষিত হচ্ছিলুম, আমার জীবন একভাবে গঠিত ও নিয়মিত হচ্ছিল, দৈবঘটনায় কোন এক বন্ধুমিলনে সে সমস্তই উল্টে গেল, আমার জীবন প্রবাহ অন্য দিকে বিবর্তিত হল। সেই বন্ধুর মন্ত্রণায় আমার বিদেশযাত্রা, ইংলণ্ডে গিয়ে সিবিল সর্বিসের পরীক্ষা দেওয়া ইত্যাদি কারণে আমার পূর্ব-নির্দিষ্ট জীবনের সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটল।
বাল্যকাল হতে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে আমার জীবন-সূত্র গ্রথিত ছিল। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের এই সমাজ এমন মৃদু মন্দ গতিতে চলছিল যে, তার প্রভাব বিশেষ অনুভব করতে পারিনি। আমার পিতা সিমল। পাহাড় থেকে ফিরে আসবার পর এমন এক ঘটনা উপস্থিত হল যাতে সেই সমাজের ইতিহাসে এক নূতন পৃষ্ঠা উদ্ঘাটিত হল। সেই ঘটনা হচ্ছে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে মিলন। কেশবের আগমনে আমাদের সমাজে নবজীবনের সঞ্চার হল। তিনি কোন্ সূত্রে প্রথমে আমাদের এই দলে প্রবেশ করলেন তা আমার বেশ মনে পড়ে। তিনি প্রথমে আমার সঙ্গে এসে সাক্ষাৎ করেন— আমি তাঁকে আমার পিতার নিকট নিয়ে যাই। তিনি আপনাদের কুলাচার অনুসারে গুরুমন্ত্র গ্রহণ করবেন কিনা এই বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে মহা আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল। পিতার সহিত তিনি এ বিষয় পরামর্শ করতে আসেন। পরামর্শে স্থির হল যে এই মন্ত্রে যখন তাঁর বিশ্বাস নাই তখন তাহা গ্রহণ করা যুক্তিসিদ্ধ নয়। মন্ত্র গ্রহণ না করাই তিনি স্থির করলেন। সেই অবধি তাঁর উপর তাঁর বাড়ীর লোকদের অত্যাচার আরম্ভ হল পরিশেষে তিনি সব ছেড়েছুড়ে সস্ত্রীক আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন—পিতাও তাঁকে স্নেহপূর্বক আপনার পুত্ররূপে বরণ করে নিলেন। সেই সময় থেকে কেশবচন্দ্র ও তাঁর পত্নী আমাদের পরিবারভুক্ত হয়ে আমাদের বাড়ীতে কিছুকাল বাস করেন। ব্রাহ্মসমাজের সেই মধ্যাহ্নকাল; কেশবের প্রভাবে সমাজ এক নূতন মূর্তি ধারণ করলে। আমিও সেই উৎসাহ-তরঙ্গে গা ঢেলে দিলুম। ব্রাহ্মসমাজের বেদী হতে পিতার হৃদয়ভেদী প্রার্থনা ও উপদেশ; আর আমাদের রচিত নব নব ব্রহ্মসঙ্গীত মিলে সমাজে সাপ্তাহিক উপাসনার মধ্যে এক নূতন শ্রী, নূতন প্রাণ সঞ্চারিত হল। আমি এই সব নিয়ে মেতে আছি এমন সময় মনোমোহন ঘোষ আমাদের বাড়ী অতিথি হয়ে থাকতে এলেন। যেন একটা বোমা আকাশ থেকে পড়ে সব ভেঙ্গে চুরে দিয়ে গেল।