আমার বাল্যকথা/মনোমোহন ঘোষ

মনোমোহন ঘোষ

 মনোমোহনের সঙ্গে আমাদের পৈতৃক সম্বন্ধ। তাঁর পিতা রামলোচন ঘোষ আমার পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের পরম বন্ধু ছিলেন, ঐ বন্ধুতা সূত্রে মনোমোহনের সঙ্গে আমারও বন্ধুতা জন্মেছিল। একজন ইংরাজ মাষ্টার আমাদের পড়াতে আসতেন, তিনি মনোমোহনের সম্বন্ধে বলতেন, “An old head on young shoulders”—যুবার ধড়ে বুড়ার মাথা। বাস্তবিকই তাই। তিনি আমার চেয়ে কিছু ছোট ছিলেন, তাঁর বয়স তখন ১৭ হবে অথচ Indian Mirror সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদকীয় ভার তিনি অকাতরে স্কন্ধে নিলেন। ঐ বয়সে তাঁর মাথায় Civil Service পরীক্ষার কল্পনা খেলছিল। দুঃখের বিষয় এই যে তাঁর মনের সাধ পূর্ণ হল না। তিনি ভেবেছিলেন এক বলবত্তর দৈব তাঁকে অন্য দিকে নিয়ে গেল। আমার জীবনক্ষেত্র বোম্বাই, তাঁর হল বাঙ্গলা দেশ; আমার কর্ম গবর্ণমেণ্টের চাকরী, তাঁর স্বাধীন আইন ব্যবসা; তিনি যে ক্ষেত্রে জয়লাভ করলেন সেই তাঁর উপযুক্ত ক্ষেত্র, আমিও আমার উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র পেলুম। কেবল দুঃখ রইল আমাদের একযাত্রায় পৃথক ফললাভ ঘটল।

 আমাদের বিলাত যাওয়া একরকম ঠিক হয়েছে এমন সময় আমরা একদিন Botanical Garden-এ বেড়াতে যাই। পার হবার সময় একটা ষ্টিমারের ধাক্কায় আমাদের নৌকা উল্টে গেল। আমি সাঁতার জানতুম, নৌকার একভাগ কোনরকম করে আঁকড়ে ধরে রইলুম কিন্তু মনোমোহন নৌকার তলায় পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলেন তাঁর আর উদ্ধারের কোন উপায় ছিল না। শেষে অনেক ডাকাডাকির পর এক পানসীর মাঝি তাঁকে টেনে ওঠালে। আমারা কাউকে কিছু না বলে সেই ভিজে কাপড়ে আমাদের গম্য স্থানে চলে গেলুম— সেখানে কাপড় শুকিয়ে বেড়িয়ে চেড়িয়ে যথা সময়ে বাড়ী ফিরলুম। এই বৃত্তান্ত বাবামশায়ের কর্ণগোচর হওয়াতে আমাদের বিলাত যাওয়া বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। তিনি বল্লেন, “তোমরা এখানেই আপনাদের আপনারা সামলাতে পার না তোমাদের ঐ দূরদেশে পাঠান যায় কি করে? তোমাদের কেউ সঙ্গী নেই, রক্ষক নেই, আপনার উপরে নির্ভর করেই যেতে হবে, তোমরা তা পেরে উঠবে কিনা এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে।” বাস্তবিক ভেবে দেখতে গেলে আমরা অসমসাহসের কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম বলতে হবে। আমরা দুটি তরুণবয়স্ক বালক আর তখন ইংলণ্ডে যাওয়া এখনকার মত এপাড়া ওপাড়া নয়। Suez Canal তখন প্রস্তুত হয় নাই, Suez থেকে Alexandria পর্যন্ত রেলপথ। এই পথের সমুদায় বিঘ্নবাধা অতিক্রম করে যাওয়া আমাদের মত বালকের পক্ষে সহজ ছিল না। তখনকার কালে লোকে ‘কালাপাণি’ পার হওয়া এক অসাধ্যসাধন মনে করত—অকারণে নহে; কেননা আমাদের মধ্যে প্রথম যে দুইজন যাত্রী যান, রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁদের আর দেশে ফিরে আসতে হয় নাই। কাজেই লোকেদের ধারণা ছিল যে ও দেশে গেলে আর ফিরতে হবে না—

“The land from whose bourne
no traveller returns”

 যা হোক্ শেষে আমাদের যাওয়াই সাব্যস্ত হল। আমি ত আমার প্রিয়জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অকূল পাথারে ভেসে পড়লুম। আমার সে সময়কার একটি বিদায়ের গান এই—

কেমনে বিদায় লব থাকিতে জীবন
কোন প্রাণে চলে যাব বিজন গহন।
কেমনে ছাড়িব তারে, সদা প্রাণ চাহে যারে,
কেমনে সহিব বল বিচ্ছেদ দহন॥

শরীর যদিও যাবে, মন সদা হেথা রবে,
যার ধন তারি কাছে রবে অনুক্ষণ।
দিবস ফুরায় যত, ছায়া যায় দূরে তত,
কভু না ছাড়য়ে তবু পাদপ-বন্ধন॥

 আমার পথের সমুদায় বিঘ্নবাধা অতিক্রম করে ভালয় ভালয় আমাদের গম্যস্থানে গিয়ে পৌঁছলুম, আমাদের জাহাজ Southampton বন্দরে নোঙর করবামাত্র আমার আত্মীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর[১] আমাদের নিতে এলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে লণ্ডনে গিয়ে তাঁর বাড়ীতে উঠলুম। তাঁর স্ত্রী কমলা ও দুই কন্যা আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করে ডেকে নিলেন। তাঁদের অতিথি হয়ে কিছুকাল সুখে কাটান গেল। তাঁদের বাড়ী খৃষ্টমিসনরিদের এক আড্ডা ছিল, তা ছাড়া সেখানকার অন্যান্য লোকদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করবার সুবিধা পেলুম। সেখান Hodgson Pratt নামক ভারতহিতৈষী মহাত্মার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল, তিনি অভিভাবকের ন্যায় আমাদের অত্যন্ত যত্ন করতেন। তাঁরই পরামর্শে আমরা মাসকতক পরে Windsor-এর নিকটবর্তী একটি পল্লীতে এক সম্ভ্রান্ত ইংরাজ পরিবারের মধ্যে বাস করে আমাদের পরীক্ষার উপযোগী পাঠাভ্যাসে নিযুক্ত রইলাম। গৃহটি ছাত্রাবাস ধরণের স্থান, আমরা ছাড়া আরো কয়েকজন ছাত্র ছিল। যিনি গৃহস্বামী তিনি আমাদের ইংরাজী শিক্ষক; সংস্কৃত, আরব্য, ফ্রেঞ্চ প্রভৃতি অন্য বিষয়ের জন্য অন্যান্য শিক্ষক নিযুক্ত ছিল। Dr. G. একজন রুক্ষ্ম প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাঁর স্ত্রীও সেইরূপ মুখরা। বুড় বুড়ীর মধ্যে যে খুব বনিবনাও ছিল তা নয়, মাঝে মাঝে প্রায়ই খিটিখিটি চলত। তাঁদের কন্যারত্ন—একটি প্রাপ্তবয়স্কা কুমারী গৃহের শ্রীস্বরূপা ছিলেন, তিনি অনেক পরিমাণে এই অশান্তির প্রতিবিধান করতেন। আমাদের পড়ার মাঝে যা কিছু সময় থাকত তাঁরই সংসর্গে কাটাতুম। কাছে একটি ছোট্ট নদী ছিল, তাতে আমরা কেহ কেহ বোটে করে ব্যাড়াতে বেরতুম। মনে আছে একবার আমি কৌতুকক্রমে তাঁর মনে ভারি আঘাত দিয়েছিলুম। তিনি আমাকে একটি ফুল উপহার দেন—সযত্নে আমার বুকের উপর কোটে পরিয়ে দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ফুলটি শীঘ্র শুকিয়ে গেল। কে একজন জিজ্ঞাসা করলেন—“এর মধ্যে ফুল শুকিয়ে গেল—এর কারণ কি?” আমি উত্তর দিলুম, ‘ভিতর থেকে রস পায়নি বলে বেচারা অত শীঘ্র মুষড়ে পড়েছে।” Miss G. মনে করলেন আমি তাঁর উপর কটাক্ষ করে এ কথা বল্লুম— যদিও আমি কেবল কথার কথামাত্র বলেছিলুম, কোনই গূঢ় অভিপ্রায় ছিল না। যা হোক্ আমার এই অনবধানের উক্তির দরুণ আমি তাঁর বিরাগভাজন হয়েছিলুম—কত সাধ্য সাধনার পর তাঁর মানভঞ্জন হল। এই ছাত্রাবাসে থেকে পাঠাভাসে আমাদের বিস্তর খাটতে হত; মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যা সকাল পর্যন্ত নিয়মিত পরিশ্রম করতে হত; এই অতিরিক্ত পরিশ্রমে যে আমার শরীর ভেঙ্গে পড়েনি এই আশ্চর্য। এই পরিশ্রমের কুফল হওয়া দূরে থাকুক সদ্যই সুফল ফললো। ১৮৬২ সালে আমি সিবিল সার্বিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলুম। যখন পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় তখন আমি মনোমোহনের সঙ্গে য়ুরোপে ভ্রমণে বেরিয়েছি —প্যারী নগরীতে ‘পাস’ হওয়ার সংবাদ আমার হাতে এল। আমি ‘পাস’ মনোমোহন ফেল। আমি প্রথম বৎসরেই পরীক্ষোত্তীর্ণ হতে পারব এরূপ আশা করি নাই। আমার আশাতীত ফল লাভ হল তাতে আমার আনন্দ কিন্তু আমার বন্ধুর নৈরাশ্য সংবাদে সে এক রকম ‘হরিষে বিষাদ’ বোধ করলুম। সে যাই হোক্ আমাদের মনের কথা মনেই রইল। তখন আমরা ভ্রমণে বেরিয়েছি—আমাদের ব্রত উদ্‌যাপন করা প্রথম কাজ। প্যারী হতে আমার Switzerland-এ প্রবেশ করলুম। ‘প্যারী’ এই নামের সঙ্গে কি মধুর স্মৃতি জড়িত আছে। নগরটি কি সুন্দর দুই বৃক্ষ শ্রেণীর মধ্য দিয়ে প্রশস্ত পথ গিয়েছে—(Boulevards), বিপণিগুলি কি সুসজ্জিত কি লোভনীয়। প্রাসাদ চিত্রশালা সকলি মনোরম, প্যারীর কি এক সম্মোহন মন্ত্র আছে বিদেশীর মন লণ্ডন অপেক্ষা সহজে আকর্ষণ করে। লণ্ডন এক প্রকাণ্ড ব্যাপার, তার ভিতরে অনেক দেখবার জিনিষ, অনেক শেখবার বিষয় আছে— তার সঙ্গে পরিচয় হওয়া বিস্তর সময়সাপেক্ষ; কিন্তু প্যারীর সৌন্দর্য প্রথম দর্শনেই নয়নমন হরণ করে। প্যারী হতে Swiss-দের দেশে গিয়ে সেখানকার দর্শনীয় প্রধান প্রধান স্থানগুলি দেখে নিলুম। সরোবরের ক্রোড়লীন জেনেবা নগরী; Lausanne যেখানে গিবন তাঁর রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস সমাপন করেন; Chillon দুর্গ যার বন্দী কাহিনী বাইরণের কবিতায় বর্ণিত —রিগির পাহাড় যার উপর থেকে সূর্যের উদয়াস্ত শোভা দেখবার জন্যে যাত্রীরা দলে দলে সমাগত হয়। তখন পাহাড়ের শৃঙ্গ পর্যন্ত রেলগাড়ী প্রস্তুত হয় নাই, পদব্রজে ওঠানামা শ্রান্তিজনক কিন্তু উপরে গিয়ে সূর্যাস্তের চমৎকার শোভা দর্শনের ফলে সকল শ্রান্তি দূর হয়। Switzerland এর পার্বত্য দৃশ্য অতি সুন্দর। গিরি সরোবর সমন্বিত চমৎকার শোভা। সেখানকার পাহাড়গুলি হিমালয়ের মত বিরাট মূর্তি নয়—তারা অভ্রভেদী দেব-আত্মা ভীষণ দর্শন নহে—সে গিরি শ্রী অন্যরূপ যেন আমাদের অপেক্ষাকৃত আয়ত্তের ভিতর ঘরের জিনিস। ও-দেশের ধবলগিরি হচ্ছে Mont Blanc সেও ‘সতত ধবলাকৃতি বিশাল অটল। তার অধিত্যকায় শামুনি গ্রামে আমরা কয়েকদিন বাস করি—সেইগ্রাম হতে পর্বতের তুষারমণ্ডিত গাত্র দিয়ে ওঠানামা করে মনের সাধে বেড়িয়ে বেড়াতুম।

 শামুনি হতে সেই গিরিরাজের সম্মুখীন হয়ে কবি কোলরিজের স্তব মনে পড়ত—

“O dread and silent Mont!
I gazed upon thee,

Till thou, still present to the
Bodily sense,
Did'st vanish from my thought
Entranced in prayer,
I worshipped, the Invisible alone!”

 হে গিরিরাজ, তোমাকে ভুলিয়া সেই অমূর্তের ধ্যানে মগ্ন হইলাম ৷

 শেষে ষ্টিমারে করে Lucerne সরোবরের উপর পরিভ্রমণে পাল। সাঙ্গ হল। য়ুরোপের মুক্তক্ষেত্র হতে আবার আমরা ক্ষুদ্র ছাত্রাবাসে প্রত্যাবর্তন করলুম। বাড়ী গিয়ে আমার এই জয়বার্তা ঘোষণা করবার জন্য মন ছটফট করছে কিন্তু এই গেল প্রথম পরীক্ষা, দ্বিতীয় পরীক্ষার জন্য আর এক বৎসর অপেক্ষা করতে হবে। সে বৎসর লণ্ডনে University Hall গৃহে সেই পরীক্ষার উপযোগী পড়াশুনায় সময় কেটে গেল। সেও এক ছাত্রাবাস কিন্তু প্রথমোক্ত পল্লীতে আমরা যে-ভাবে ছিলুম এখানে তা হতে স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত। পারিবারিক শৃঙ্খলার অভাব। যিনি আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি নির্লিপ্তভাবে দূরে থাকতেন— তাঁর সঙ্গে খাবার টেবিলের যা আমাদের দেখা হত। আমাদের সব নিজের গোছগাছ করে নিতে হত। দু একটি ছাত্রের সঙ্গে আমার খুব হৃদ্যতা হয়েছিল। তাদের মধ্যে এখন কেবল একটির নাম (Schwanne) দেখতে পাই, যিনি এক্ষণে পার্লামেণ্টের মেম্বর। দ্বিতীয় পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমার দেশে ফেরবার সময় এল। তখন আমার বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কবির আশীর্বাদ সহকারে ভারত অভিমুখে যাত্রা করলুম। মনোমোহন ‘মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পাতন’ পণে সে দেশেই পড়ে রইলেন। কবির আশীর্বাদ—

সুরপুরে সশরীরে শূরকুলপতি
অর্জুন, স্বকাজ যথা সাধি পুণ্যবলে

ফিরিলা কাননবাসে; তুমি হে তেমতি
যাও সুখে ফিরে এবে ভারত মণ্ডলে,
মনোদ্যানে আশালতা তব ফলবতী!
ধন্য ভাগ্য, হে সুভগ, তব ভবতলে!
যাও দ্রুতে, তরি
নীল মণিময় পথ অপথ সাগরে!
অদৃশ্য রক্ষার্থে সঙ্গে যাবেন সুন্দরী
বঙ্গলক্ষ্মী। যাও, কবি আশীর্বাদ করে![২]

 আমি আগেই বলেছি যে ছেলেবেলায় বাবামশায়ের কাছে আমরা অল্প সময়ই থাকতুম। একালে যেমন পিতাপুত্রে অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে মেলামেশা দেখি, তখনকার কালে তেমনটি ছিল না, ছোটরা বড়দের অত্যন্ত সমীহ করে চলতো। আমাদের যা কিছু আমোদ আহ্লাদ মেলামেশা সে পিতার পারিষদবর্গের সহিত, তাঁদের কাছেই মন খুলে কথা কবার সুযোগ হত।

  1. ইনিই প্রথম বাঙ্গালী ব্যারিস্টার, অনেকে হয়ত তা জানেন না!
  2. মাইকেল মধুসূদন দত্ত—চতুর্দশপদী কবিতাবলী।