আলালের ঘরের দুলাল (১৮৭০)/২২
২২ বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালকে সৌদাগরী
কর্ম্ম করিতে পরামর্শ দেন, মতিলাল দিন দেখাইবার
জন্য তর্কসিদ্ধান্তের নিকট মানগোবিন্দকে পাঠান,
পর দিবস রাহি হয়েন ও ধনামালার সহিত গঙ্গাতে
বকাবকি করেন।
মতিলাল দেখিলেন বাটী হইতে মা গেলেন, ভাই গেলেন, ভগিনী গেলেন। আপদের শান্তি! এতদিনের পর নিষ্কণ্টক হইল —ফেচ্ফেচানি একেবারে বন্ধ —এক চোক রাঙ্গানিতে কর্ম্ম কেয়াল হইয়া উঠিল আর “প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ” সে সব হল বটে কিন্তু শরার রুধির ফুরিয়ে এল —তার উপায় কি? বাবুয়ানার জোগাড় কিরূপে চলে? খুচরা মহাজন বেটাদের টাল্মাটাল আর করিতে পারা যায় না। উটনোওয়ালারাও উটনো বন্ধ করিয়াছে —এদিকে সাম্নে স্নানযাত্রা —বজরা ভাড়া করিতে আছে —খেম্টাওয়ালিদের বায়না দিতে আছে —সন্দেশ মেঠাইয়ের ফরমাইস দিতে আছে —চরস, গাঁজা ও মদও আনাইতে হইবে —তার আটখানার পাটখানাও হয় নাই। এই সকল চিন্তায় মতিলাল চিন্তিত আছেন এমত সময়ে বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা আসিয়া উপস্থিত হইল। দুই-একটা কথার পরে তাহারা জিজ্ঞাসা করিল —বড়বাবু! কিছু বিমর্ষ কেন? তোমাকে ম্লান দেখিলে যে আমরা ম্লান হই —তোমার যে বয়েস তাতে সর্ব্বদা হাসি খুসি করিবে। গালে হাত কেন? ছি! ভাল করিয়া রসো। মতিলাল এই মিষ্ট বাক্যে ভিজিয়া আপন মনের কথা সকল ব্যক্ত করিল। বাঞ্ছরাম বলিলেন —তার জন্যে এত ভাবনা কেন? আমরা কি ঘাস কাট্ছি? আজ একটা ভারি মতলব করিয়া আসিয়াছি —এক বৎসরের মধ্যে দেনা-টেনা সকল শোধ দিয়া পায়ের উপর পা দিয়া পুত্র পৌত্র ক্রমে খুব বড়মানুষি করিতে পারিবে। শাস্ত্রে বলে “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” —সৌদাগরিতেই লোক ফেঁপে উঠে—আমার দেখ্তা কত বেটা টেপাগোঁজা, নড়েভোলা, টয়েবাঁধা, বালতিপোতা, কারবারে হেপায় আণ্ডিল হইয়া গেল —এ সব দেখে কেবল চোখ টাটায় বইতো না! আমরা কেবল একটি কর্ম্ম লয়ে ঘষ্টিঘর্ষণা করিতেছি —এ কি খাট দুঃখ! চণ্ডীচরণ ঘুঁটে কুড়ায়, রামা চড়ে ঘোড়া।
মতিলাল। এ মতলব বড় ভাল —আমার অহরহ টাকার দরকার। সৌদাগরি কি বাজারে ফলে না আপিসে জন্মে? না মেঠাই মণ্ডার দোকানে কিনিতে মেলে? একজন সাহেবের মুৎসুদ্ধি না হইলে আমার কর্ম্ম কাজ জমকাবে না।
বাঞ্ছরাম। বড়বাবু! তুমি কেবল গদিয়ান হইয়া থাকিবে, করাকর্ম্মার ভার সব আমাদিগের উপর —আমাদিগের বটলর সাহেবের একজন দোস্ত জান সাহেব সম্প্রতি বিলাত হইতে আসিয়াছে —তাহাকেই খাড়া করিয়া তাহারই মৎসুদ্ধি হইতে হইবে। সে লোকটী সৌদাগরি কর্ম্মে ঘুন।
ঠকচাচা। মুইবি সাতে সাতে থাক্ব, মোকে আদালত, মাল, ফৌজদারি, সৌদাগরি কোন কামই ছাপা নাই। মোর শেনাবি এ সব ভাল সমজে। বাবু আপসোস এই যে মোর কারদানি এ নাগাদ নিদ যেতেচে —লেফিয়ে২ জাহের হল না। মুই চুপ করে থাকবার আদমি নয়— দোশমন পেলে তেনাকে জেপ্টে, কেমড়ে মেটিতে পেটিয়ে দি —সৌদাগরি কাম পেলে মুই রোস্তম জালের মাফিক চলব।
মতিলাল। ঠকচাচা —শেনা কে?
ঠকচাচা। শেনা তোমার ঠকচাচি —তেনার সেফত কি কর্ব? তেনার সুরত জেলেখাঁর মাফিক আর মালুম হয় ফেরেস্তার মাফিক বুজ সমজ।
বাঞ্ছারাম। ও কথা এখন থাকুক। জান সাহেবকে দশ পনরো হাজার টাকা সরবরাহ করিতে হইবে তাতে কিছু মাত্র জখম নাই। আমি স্থির করিয়াছি যে কোতলপুরের তালুকখানা বন্ধক দিলে ঐ টাকা পাওয়া যাইতে পারে— বন্ধকি লেখাপড়া আমাদিগের সাহেবের আপিসে করিয়া দিব —খরচ বড় হইবে না —আন্দাজ টাকাশচার-পাঁচের মধ্যে আর টাকা শপাঁচেক মহাজনের আমলা-ফাম্লাকে দিতে হইবে। সে বেটারা পুন্কে শত্রু —একটা খোঁচা দিলে কর্ম্ম ভণ্ডুল করিতে পারে। সকল কর্ম্মেরই অষ্টম খষ্টম আগে মিটাইয়া নষ্ট কোষ্ঠী উদ্ধার করিতে হয়। আমি আর বড় বিলম্ব করিব না, ঠকচাচাকে লইয়া কলিকাতায় চলিলাম —আমার নানা বরাৎ —মাথায় আগুন জ্বল্ছে। বড়বাবু! তুমি তর্কসিদ্ধান্ত দাদার কাছ থেকে একটা ভাল দিন দেখে শীঘ্র দুর্গা২ বলিয়া যাত্রা করিয়া একেবারে আমার সোনাগাজির দরুণ বাটীতে উঠিবে। কলিকাতায় কিছু দিন অবস্থিতি করিতে হইবে তার পর এই বৈদ্যবাটীর ঘাটেতে যখন চাঁদ সদাগরের মতন সাত জাহাজ ধন লইয়া ফিরিয়া আসিয়া দামামা বাজাইয়া উঠিবে তখন আবাল, বৃদ্ধ, যুবতি, কুলকন্যা তোমার প্রত্যাগমনের কৌতুক দেখিয়া তোমাকে ধন্য২ করিবে। আহা! এমন দিন যেন শীঘ্র উদয় হয়! এই বলিয়া বাঞ্ছারাম ঠকচাচাকে লইয়া গমন করিলেন।
মতিলাল আপন সঙ্গিদিগকে উপরোক্ত সকল কথা আনুপূর্ব্বিক বলিল। সঙ্গিরা শুনিয়া বগল বাজাইয়া নেচে উঠিল —তাহাদিগের রাতিব টানাটানির জন্য প্রায় বন্ধ। এক্ষণে সাবেক বরাদ্দ বহাল হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। তাড়া তাড়ি, হুড়াহুড়ি করিয়া মানগোবিন্দ এক চোঁচা দৌড়ে তর্কসিদ্ধান্তের টোলে উপস্থিত হইয়া হাঁপ ছাড়িতে লাগল। তর্কসিদ্ধান্ত বড় প্রাচীন, নস্য লইতেছেন —ফেঁচ্২ করিয়া হাঁচতেছেন —খক্২ করিয়া কাস্তেছেন —চারিদিকে শিষ্য —সম্মুখে কয়েকখানা তালপাতায় লেখা পুস্তক —চস্মা নাকে দিয়ে এক২ বার গ্রন্থ দেখিতেছেন, এক২ বার ছাত্রদিগকে পাঠ বলিয়া দিতেছেন। বিচলির অভাবে গোরুর জাবনা দেওয়া হয় নাই —গোরু মধ্যে২ হাম্মা২ করিতেছে —ব্রাহ্মণী বাটীর ভিতর হইতে চীৎকার করিয়া বলিতেছেন —বুড় হইলেই বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ হয়, উনি রাতদিন পাঁজি পুথি ঘাঁট্বেন, ঘরকন্নার পানে একবার ফিরে দেখ্বেন না। এই কথা শিষ্যেরা শুনিয়া পরস্পর গা টেপাটিপি করিয়া চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। তর্কসিদ্ধান্ত বিরক্ত হইয়া ব্রাহ্মণীকে থামাইবার জন্য লাঠি ধরিয়া সুড়২ করিয়া উঠিতেছেন এমন সময়ে মানগোবিন্দ ধরে বসিল —ওগো তর্কসিদ্ধান্ত খুড়! আমরা সব সৌদাগরি করিতে যাব একটা ভাল দিন দেখে দেও। তর্কসিদ্ধান্ত মুখ বিকটসিকট করিয়া গুমরে উঠিলেন —কচুপোড়া খাও —উঠ্ছি আর অম্নি পেচু ডাক্ছ আর কি সময় পাওনি? সৌদাগরি কর্তে যাবে! তোর বাপের ভিটে নাশ হউক —তোদের আবার দিনক্ষণ কি রে? বালাই বেরুলে সকলে হাঁপ ছেড়ে গঙ্গাস্নান কর্বে —যা বল্গে যা যে দিন তোরা এখান থেকে যাবি সেই দিনই শুভ।
মানগোবিন্দ মুখছোপ্পা খাইয়া আসিয়া বলিল যে কালই দিন ভাল, অমনি সাজ্রে২ শব্দ হইতে লাগিল ও উদ্যোগ পর্ব্বের ধূম বেধে গেল। কেহ সেতারার মেজ্রাপ হাতে দেয় —কেহ বাঁয়ার গাব আছে কি না তাহা ধপ্সপ্ করিয়া পিটে দেখে —কেহ তবলায় চাঁটি দিয়া পরক করে —কেহ ঢোলের কড়া টানে —কেহ বেহালায় রজন দিয়া ডাডা২ করে —কেহ বোচ্কা বুঁচ্কি বাঁধে —কেহ চরস গাঞ্জা মায় ছুরি, কাঠ লইয়া পোঁটলা করে —কেহ ছর্রার গুল চাটের সহিত সন্তর্পণে রাখে —কেহ পাকামালের ঘাট্তি কম্তি তদারক করে। এইরূপে সারা দিন ও সারা রাত্রি ছট্ফটানি, ধড়্ফড়ানি, আন্, নিয়ে আয়, দে, শোন, ওরে হেঁরে, সজ্জাগজ্জা, হো হাতে কেটে গেল।
গ্রামে ঢিঢিকার হইল বাবুরা সৌদাগরি করিতে চলিলেন। পর দিবস প্রভাতে যাবতীয় দোকানি, পসারি, ভিকিরি, কাঙ্গালি ও অন্যান্য অনেকেই রাস্তায় চাহিয়ে আছে ইতিমধ্যে নববাবুরা মত্ত হস্তির ন্যায় পৈয়িস্২ করত মস্২ শব্দে ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আহ্নিক করিতেছিলেন, গোলমাল শুনিয়া পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করিয়া একেবারে জড়সড় হইলেন। তাঁহাদিগকে ভীত দেখিয়া নববাবুরা খিল্২ করিয়া হাসিতে২ গঙ্গামৃত্তিকা, ঝামা ও থুৎকুড়ি গাত্রে বর্ষণ করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণেরা ভগ্নাহ্নিক হইয়া গোবিন্দ২ করিতে২ প্রস্থান করিলেন। নববাবুরা নৌকায় উঠিয়া সকলে চীৎকার স্বরে এক সখীসম্বাদ ধরিলেন —নৌকা ভাঁটার জোরে সাঁসাঁ করিয়া যাইতেছে কিন্তু বাবুরা কেহই স্থির নহেন —এ ছাতের উপর যায় ও হাইল ধরে টানে —এ দাঁড় বহে ও চক্মকি নিয়ে আগুন করে। কঞ্চিৎদূর যাইতে২ ধনামালার সহিত দেখা হইল —ধনামালা ড়ব মুখড় —জিজ্ঞাসা করিল— গ্রামটাকে তো পুড়িয়ে খাক কর্লে আবার গঙ্গাকে জ্বলাচ্ছ কেন? নববাবুরা রেগে বলিল —চুপ শূয়র —তুই জানিসনে যে আমরা সব সৌদাগরি করতে যাচ্ছি? ধনা উত্তর করিল —যদি তোরা সৌদাগর হস্ তো সৌদাগরি কর্ম্ম গলায় দড়ি দিয়া মরুক!