আলালের ঘরের দুলাল (১৮৭০)

আলালের ঘরের দুলাল অন্য সংস্করণ দেখুন

আলালের ঘরের দুলাল।

“মদ খাওয়া বড় দায়জাত থাকার কিউপায়” “রামারঞ্জিকা”
“কৃষিপাঠ” “গীতাঙ্কুর” ও যৎকিঞ্চিতের রচয়িতা
শ্রীযুক্ত টেঁকচাদঠাকুর কর্ত্তৃক বিরচিত।

দ্বিতীয় সংস্করণ।
CALCUTTA:

PRINTED AT THE SUCHAROO PRESS, BY LALLCHAND BISWAS, FOR

THE PROPRIETOR, NO. 16, BRITISH INDIAN STREET.


15th, November, 1870-(Price 12 Annas)

PREFACE.

আলালের ঘরের দুলাল।
BY
TEK CHAND THACKOOR.

The above original Novel in Bengali being the first work of the kind, is now submitted to the public with considerable diffidence. It chiefly treats of the pernicious effects of allowing children to be improperly brought up with remarks on the existing system of education on self-formation and religious culture, and is illustrative of the condition of Hindu society, manners, customs, &c. and partly of the state of things in the Moffussil. The work has been written in a simple style, and to foreigners desirous of acquiring an idiomatic knowledge of the Bengali language and an acquaintance with Hindu domestic life it will perhaps be found useful. The writer thinks it well to add that a large portion on of this Tale appeared originally in a monthly publication, which met with the apporoval of a number of friends, at whose request he has been induced to conclude and publish it in the present form.

 Price Per copy, ..............................12 Annas.

ভুমিকা।

 অন্যান্য পুস্তক অপেক্ষা উপন্যাদি পাঠ করিতে প্রায় সকল লোকেরই মনে স্বভাবতঃ অনুরাগ জন্মিয়া থাকে এবং যেস্থলে এতদ্দেশীয় অধিকাংশ লোক কোন পুস্তকাদি পাঠ করিয়া সময় ক্ষেপণ করিতে রত নহে সে স্থলে উক্ত প্রকার গ্রন্থের অধিক আবশ্যক, এতদ্বিবেচনায় এই ক্ষুদ্র পুস্তক খানি রচিত হইল। ইহার তাৎপর্য্য কি পাঠ করিলেই প্রকাশ হইবে। এ প্রকার পুস্তক লেখনের প্রণালী এতদ্দেশ মধ্যে বড় প্রচলিত নাই, ইহাতে প্রথমোদ্যমে অবশ্য সদোষ লইবার সম্ভাবনা, পাঠকবর্গ অনুগ্রহ করিয়া ঐ দোষ ক্ষমা করিবেন! গ্রন্থের নির্ঘণ্ট দেখিলেই গল্পসকলের আভাস ও অন্যান্য প্রকরণ জানা যাইবে। পুস্তকের মূল্য ৸৹ নগদ।

নির্ঘণ্ট


বাবুরাম বাবুর পরিচয়—মতিলালের বাঙ্গালা, সংস্কৃত ও পারসী শিক্ষা,
.. ..
মতিলালের ইংরাজি শিখিবার উদ্যোগ ও বাবুরাম বাবুর বালিতে গমন,
.. ..
মতিলালের বালিতে আগমন ও তথায় লীলাখেলা পরে ইংরাজী শিক্ষার্থ বহুবাজারে অবস্থিতি,
.. ..
১০
কলিকাতায় ইংরাজি শিক্ষার বিবরণ, শিশু শিক্ষার প্রকরণ, মতিলালের কুসঙ্গ ও ধৃত হইয়া পুলিসে আনীত হওন,
.. ..
১৬
বাবুরাম বাবুর নিকট সংবাদ দেওনার্থ প্রেমনারায়ণকে প্রেরণ; বাবুরামের সভা বর্ণন, ঠকচাচার পরিচয়, বাবুরামের স্ত্রীর সহিত কথোপকথন, কলিকাতায় আগমন—প্রভাত কালীন কলিকাতার বর্ণন, বাঞ্ছারামের বাটীতে বাবুরামের গমন, তথায় আত্মীয়দিগের সহিত সাক্ষাৎ ও মতিলাল সংক্রান্ত কথোপকথন,
.. ..
২৩
মতিলালের মাতার চিন্তা, ভগিনীদ্বয়ের কথোপকথন, বেণী ও বেচারাম বাবুর নীতি বিষয়ে কথোপকথন ও বরদাপ্রসাদ বাবুর পরিচয়,
.. ..
৩২
কলিকাতার আদি বৃত্তান্ত, জস্‌টিস অব পিস নিয়োগ, পুলিস বর্ণন, মতিলালের পুলিসে বিচার ও খালাস, বাবুরাম বাবুর পুত্র লইয়া বৈদ্যবাটী গমন, ঝড়ের উত্থান ও নৌকা জলমগ্ন হওনের আশঙ্কা,
.. ..
৪১
উকিল বটলর সাহেবের আপিস—বৈদ্যবাটীর বাটীতে কর্ত্তার জন্য ভাবনা, বাঞ্ছারামবাবুর তথায় গমন ও বিষাদ, বাবুরামবাবুর সংবাদ ও আগমন,
.. ..
৫০
শিশু শিক্ষা—সুশিক্ষা না হওয়াতে মতিলালের ক্রমে২ মন্দ হওন ও অনেক সঙ্গি পাইয়া বাবু হইয়া উঠন এবং ভদ্র কন্যার প্রতি অত্যাচার করণ,
.. ..
৫৭
১০ বৈদ্যবাটীর বাজার বর্ণন, বেচারাম বাবুর আগমন, বাবুরাম বাবুর সভায় মতিলালের বিবাহের ঘোঁট ও বিবাহ করণার্থে মণিরামপুরে যাত্রা এবং তথায় গোলযোগ,
.. ..
৬৪
১১ মতিলালের বিবাহ উপলক্ষে কবিতা ও আগরপাড়ার অধ্যাপকদিগের বাদানুবাদ,
.. ..
৭০
১২ বেচারামবাবুর নিকট বেণী বাবুর গমন, মতিলালের ভ্রাতা রামলালের উত্তম চরিত্র হওনের কারণ বারদাপ্রসাদ বাবুর প্রসঙ্গ—মন শোধনের উপায়,
.. ..
৭৫
১৩ বরদাপ্রসাদ বাবুর উপদেশ দেওন—তাঁহার বিজ্ঞতা ও ধর্ম্ম নিষ্ঠা এবং সুশিক্ষার প্রণালী। তাঁহার নিকট রামলালের উপদেশ, তজ্জন্য রামলালের পিতার ভাবনা ও ঠকচাচার সহিত পরামর্শ। রামলালের গুণ বিষয়ে মতান্তর ও তাঁহার বড় ভগিনীর পীড়া ও বিয়োগ,
.. ..
৮১
১৪ মতিলাল ও তাহার দলবল এক জন কবিরাজ লইয়া তামাস ফষ্টিকরণ, রামলালের সহিত বরদাপ্রসাদ বাবুর দেশ ভ্রমণের ফলের কথা, হুগলি হইতে গুমখুনির পরওয়ানা ও বরদাবাবু প্রভৃতির তথায় গমন,
.. ..
৮৮
১৫ হুগলির ম্যাজিষ্ট্রেট কাছারি বর্ণন, বরদাবাবু, রামলাল ও বেণী বাবুর সহিত ঠকচাচার সাক্ষাত, সাহেবের আগমন ও তজবিজ আরম্ভ এবং বরদা বাবুর খালাস,
.. ..
৯৬
১৬ ঠকচাচার বাটীতে ঠকচাচীর নিকট পরিচয় দান ও তাহাদিগের কথোপকথন, তন্মধ্যে বাবুরামবাবুর ডাক ও তাঁহার সহিত বিষয় রক্ষার পরামর্শ,
.. ..
১০১
১৭ নাপিত ও নাপ্তেনীর কথোপকথন, বাবুরাম বাবুর দ্বিতীয় বিবাহকরণের বিচার ও পরে গমন,
.. ..
১০৪
১৮ মতিলালের দলবল শুদ্ধ বুড়া মজুমদারের সহিত সাক্ষাৎ ও তাহার প্রমুখাৎ বাবুরাম বাবুর দ্বিতীয় বিবহের বিবরণ ও তদ্বিষয়ে কবিতা,
.. ..
১০৮
১৯ বেণীবাবুর আলয়ে বেচারাম বাবুর গমন, বাবুরাম বাবুর পীড়া ও গঙ্গাযাত্রা, বরদা বাবুর সহিত কথোপকথনান্তর তাঁহার মৃত্যু,
.. ..
১১৩
২০ মতিলালের যুক্তি, বাবুরাম বাবুর শ্রাদ্ধের ঘোঁট, বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার অধ্যক্ষতা, শ্রাদ্ধে পণ্ডিতদের বাদানুবাদ ও গোলযোগ,
.. ..
১১৯
২১ মতিলালের গদিপ্রাপ্তি ও বাবুয়ান, মাতার প্রতি কুব্যবহার, মাতা ও ভগিনীর বাটী হইতে গমন ও ভ্রাতাকে বাটীতে আসিতে বারণ ও তাহার অন্য দেশে গমন,
.. ..
১২৭
২২ বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালকে সওদাগরি কর্ম্ম করিতে পরামর্শ দেন, মতিলাল দিন দেখাইবার জন্য তর্কসিদ্ধান্তের নিকট মানগোবিন্দকে পাঠান, পরদিবস রাহি হয়েন ও ধনামালার সহিত গঙ্গাতে বকাবকি করেন,
.. ..
১৩১
২৩ মতিলাল দলবল সমেত সোনাগাজিতে আইসেন, সেখান হইতে এক জন গুরুমহাশয়কে তাড়ান, বাবুয়ানা বাড়াবাড়ি হয়, পরে সৌদাগরি করিয়া দেনার ভয়ে প্রস্থান করেন,
.. ..
১৩৬
২৪ শুদ্ধ চিত্তের কথা, ঠকচাচার জাল করণ জন্য গেরেপ্তারি, বরদাবাবুর দুঃখ, মতিলালের ভয়, বেচারাম ও বাঞ্ছারাম উভয়ের সাক্ষাৎ ও কথোপকথন,
.. ..
১৪৪
২৫ মতিলালের দলবল সহিত যশোহর জমিদারিতে গমন, জমিদারি কর্ম্ম করণের বিবরণ, নীলকরের সঙ্গে দাঙ্গা ও বিচারে নীলকরের খালাস,
.. ..
১৫১
২৬ ঠকচাচার বেনিগারদে নিদ্রাবস্থায় আপনার কথা আপনিই ব্যক্তকরণ, পুলিসে বাঞ্ছারাম ও বটলরের সহিত সাক্ষাৎ, মকদ্দমা বড়ো আদালতে চালান, ঠকচাচার জেলে কয়েদ, জেলেতে তাহার সহিত অন্যান্য কয়েদির কথাবার্ত্তা ও তাহার খাবার অপহরণ,
.. ..
১৫৮
২৭ বাদার প্রজার বিবরণ, বাহুল্যের বৃত্তান্ত ও গ্রেপ্তারি, গাড়িচাপা লোকের প্রতি বরদা বাবুর সতত, বড় আদালতে ফৌজদারী মকদ্দমা করণের ধার, বাঞ্ছারামের দৌড়াদোড়ি, ঠকচাচা ও বাহুল্যের বিচার ও সাজার হুকুম,
.. ..
১৬৪
২৮ বেণীবাবু ও বেচারামবাবুর নিকট বরদা বাবুর সততা ও কাতরতা প্রকাশ, এবং ঠকচাচা ও বাহুল্যের কথোপকথন,
.. ..
১৭৩
২৯ বৈদ্যবাটির বাটী দখল লওন, বাঞ্ছারামের কুব্যবহার, পরিবারদিগের দুঃখ ও বাটী হইতে বহিষ্কৃত হওন—বরদাবাবুর দয়া,
.. ..
১৭৮
৩০ মতিলালের বারাণসী গমন ও সৎসঙ্গ লাভে চিত্তশোধন। তাহার মাতা ও ভগনীর দুঃখ, রামলাল ও বারদাবাবুর সহিত সাক্ষাৎ, পরে তাহাদের মতিলালের সঙ্গে সাক্ষাৎ, পথে ভয় ও বৈদ্যবাটীতে প্রত্যাগমন,
.. ..
১৮৩

দ্বিতীয়বারের ভূমিকা।

 আলালের ঘরের দুলাল—ইতি পূর্ব্বে এই সুললিত উপন্যাসটি একবার রোজারিও কোম্পানির যন্ত্রণালয়ে মুদ্রিত হয়, কিন্তু তাহাতে বহুতর বর্ণাশুদ্ধি ও অস্পষ্ট মুদ্রন জন্য পাঠকগণের অনেক পাঠ ব্যাঘাত হইত। এক্ষণে ঐ মুদ্রিত পুস্তক সমস্ত নিঃশেষ হওয়াতে গ্রন্থকার এতৎ গ্রন্থের সত্ত্ব সুচারু যন্ত্রালয়াধিকারীকে দিবায় তিনি নিমতলা নিবাসী শ্রীযুক্ত গিরীন্দ্রকুমার দত্ত মহাশয়ের কৃত কয়েকখানি লিথোগ্রাফ চিত্র দিয়া ইহা পুনর্ব্বার শুদ্ধ ও স্পষ্টরূপে মুদ্রিত করিতেছেন। বোধ করি এইবার পাঠকগণ ইহার বিশুদ্ধ মুদ্রণ ও সদ্ভাব সম্পন্ন চিত্র গুলিন দেখিয়া পূর্ব্বাবাপেক্ষা অধিকতর সন্তুষ্ট হইবেন। “কিমিবহি মধুরাণ মিত্যাদি’ শ্লোক দ্বারা যদিও সুন্দর বস্তুর অলঙ্কারের অনাবশ্যকতা প্রকাশ করে তথাপি কৃত্রিম অপরিচ্ছন্নতার অপ্রশস্তি ও অলঙ্কারের সৌন্দর্য্য স্বীকার করিতে হয়। অত্র স্থলে “আলালের ঘরের দুলালের” গুণাগুণ বাখ্যাকরা আমাদিগের কর্ত্তব্য বিবেচনায় তদ্বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ লিখিতেছি। যখন বাঙ্গালা ভাষায় ইংরাজদিগের নবেলের ন্যায় রচিত গ্রন্থের অসদ্ভাব ছিল যখন জ্ঞানপ্রদীপ, বেতালপঞ্চবিংশতি বত্রীশসিংহাসন প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠ করিয়াই পাঠকগণের অপ্রশস্ত অন্তঃকরণ সন্তুস্ট হইত, তখন কাহারও এরূপ বোধ ছিলনা যে অমিত্রাক্ষর কবিতা বা সর্ব্ব রসাধার সৎভাব পূর্ণ নব২ নবন্যাস (Novel) হইতে পারে। কিন্তু এক্ষণে শ্রীযুক্ত মাইকেল মধুসূদন দত্তের তিলোত্তমাদি কাব্য পাঠে সজ্জন সমূহ বিলক্ষণ বুঝিয়াছেন, যে ৰাঙ্গালায় অমিত্রণক্ষর কাব্যের মধুরতা অত্যদ্ভুত এবং শ্রীযুক্ত টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলালাদি গ্রন্থই বাঙ্গালা নবন্যাশের মনোহারিত্ত্ব ও হিতকারিত্ত্বের পরিচয় স্থল। কবিবর মাইকেল যে রূপ বাঙ্গালায় অমিত্রাক্ষর কবিতার শ্রষ্ঠা নবপদ্যাতিতে নবন্যাস রচনাবিষয়ে সুধীশ্রেষ্ঠ টেকচাঁদ ঠাকুরও সেই রূপ। ইনিই বঙ্গভাষানুরাগীদিগের অন্তর হইতে “বারাণশী নগরীতে প্রতাপমুকুট নামে” “মিথিলা নগরে গুণাধিপ নামে” ইত্যাদি প্রকার পরম্পরাগত গৌরচঙ্গিক-প্রিয়তা দূর করিয়াছেন, এবং পাঠকসমূহকে নিতান্ত বালকগণের শ্রবণ-প্রিয় পিতামহীর কথিত এক রাজা ও তার দো সো দুই রাণীর গল্পের ন্যায় গল্পপাঠে অনর্থক কালাতিপাত হইতে নিবৃত্ত করিবার পথ প্রদর্শন করিয়াছেন। প্রশংসিত টেকচাঁদ ঠাকুর মহাশয় বাঙ্গালায় অতি সরল ও সর্ব্বসাধারণের অনায়াসে বোধগম্য রচনা-পদ্ধতি প্রচার করিয়াছেন। বর্ত্তমান গ্রন্থে যদিও কাদম্বরীর উৎকট-পদ প্রয়োগ-পটুতা, শকুন্তলার ললিত-পদবিন্যাস মাধুর্য্য, বাসবদত্তার অনুপ্রাস ছটা ও তিলোত্তমার ভাব ঘটা নাই; যদিও ইহার আখ্যায়িকা ভাগ দুর্গেশনন্দিনীর ন্যায় বিস্ময় ও কৌতূহলোদ্দীপক নহে; যদিও ইহাতে সঞ্জুক্তা-স্বয়ম্বরের ন্যায় কোন পুরাণ ইতিহাসিক ব্যাপার বর্ণিত হয় নাই; যদিও ইহাতে কপালকুণ্ডলার ন্যায় জঢ় স্বভাব সৌন্দর্য্য-বিশিষ্টরূপে বর্ণিত হয় নাই; এবং যদিও ইহা সীতার বনবাসের ন্যায় বিশুদ্ধ সাধুভাষায় গ্রথিত নহে; তথাপি ইহাকে উল্লিখিত গ্রন্থ সমস্তের অধিকাংশাপেক্ষা উত্তম বলিয়া গ্রহণ করিতে হয়। ইহা অস্মদ্দিগের কথোপকথনে ব্যবহৃত ভাষায় রচিত, এবং ইহার প্রাঞ্জলতা এত অধিক যে বাঙ্গালিমাত্রেই অনায়াসে বুঝিতে পারে। ইহাতে সজীব ও সান্ত্বর স্বভাব অর্থাৎ মনুষ্য স্বভাব যে প্রকার কৌশলে ও পারিপাট্যের সহিত চিত্রিত হইয়াছে, সেরূগ বাঙ্গালা ভাষায় আর দেখা যায় না। এক্ষণে অনেকেই নবন্যাস রচনায় প্রবর্ত্ত হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদিগের রচিত গ্রন্থ গুলির কার্য্যাদির সমস্তভাগ কালোচিতও সম্ভব নহে এবং পরিচ্ছদাদিরও বৈপরীত্য অনেক দেখা যায় অধিক কি তাঁহাদিগের রচিত গ্রন্থ পাঠে সময় ও স্থান সম্বন্ধ কিছুই অবগত হওয়া যায় না, এবং তাঁহাদিগের বর্ণিত নায়কনায়িকাদি কাহারও মূর্ত্তির প্রতিবিম্ব পাঠকগণের চিত্তদপণে পড়ে না। “আলালের ঘরের দুলাল” সে রূপ নহে ইহাতে আখ্যায়িকার সমকালিক দেশাচার ও অবস্থাদি দর্পণে পতিত প্রতিবিম্বের ন্যায় স্পষ্ট এবং সর্ব্বাঙ্গ সুন্দররূপে চিত্রিত হইয়াছে। পাঠকগণ পাঠ করিতে করিতে মনে করেন যেন সমস্ত সন্মুখে দেখিতেছেন। ইহাতে বালকগণের শিক্ষা বিষয়ে পিত্রাদির অযত্নের দোষ এবং আত্মশুদ্ধি ও ধর্ম্মবুদ্ধির শুভকরীত্ব স্পষ্টরূপে দর্শিত হইয়াছে। ইহার রচনা নানা রসাশ্রয়, ললিত, প্রাঞ্জল, সব্যঙ্গ, সন্তোষপ্রদ ও জ্ঞানগর্ব্ভ এবং ইহার নায়কনায়িকাদি সমস্ত ব্যক্তিই সম্ভব স্বভাব-সম্পন্ন মনুষ্য। পাঠকগণ যত্ন করিলে এখনও পল্লি গ্রামবাসী অনেক বাবুরাম বাবু ও মতিলালকে দেখিতে পারেন, এবং মতিলালের মাত, ভগিনী ও স্ত্রীর স্নেহ ও সরলতা রয়ী প্রতিমূর্ত্তি সজ্জন-বৃন্দ নিজ নিজ অন্তঃপুরেই দেখিতে পারেন। যাঁহারা কখন আদালতে গিয়াছেন, এবং অভিযোগাদি করেন, তাঁহারা ঠকচাচা প্রভৃতির আদর্শ অবশ্যই দেখিয়াছেন। বাহুল্য ভয়ে আমি এই স্থানেই নিবৃত্ত হইতে বাধিত হইলাম, কারণ এই গ্রন্থের গুণাগুণ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিতে হইলে গ্রন্থাপেক্ষা একখানি বড় গ্রন্থ হইতে পারে। “কি মধিকং বিজ্ঞবরেষু বিজ্ঞাপ্যমিতি”।

শ্রীপ্রাণনাথ দত্ত চৌধুরী।

এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।