আলালের ঘরের দুলাল (১৮৭০)/৬
৬ মতিলালের মাতার চিন্তা, ভগীনিদ্বয়ের কথোপকথন,
বেণী ও বেচারাম বাবুর নীতি বিষয়ে কথোপকথন ও
বরদাপ্রসাদ বাবুর পরিচয়।
বৈদ্যবাটীর বাটীতে স্বস্ত্যয়নের ধূম লেগে গেল। সূর্য্য উদয় না হইতে হইতে শ্রীধর ভট্টাচার্য্য, রামগোপাল চূড়ামণি প্রভৃতি জপ করিতে বসিলেন। কেহ তুলসী দেন —কেহ বিল্বপত্র বাছেন —কেহ বববম্২ করিয়া গালবাদ্য করেন —কেহ বলেন যদি মঙ্গল না হয় তবে আমি বামুন নহি —কেহ কহেন যদি মন্দ হয় তবে আমি পৈতে ওলাব। বাটীর সকলেই শশব্যস্ত —কাহারো মনে কিছু মাত্র সুখ নাই।
গৃহিণী জানালার নিকট বসিয়া কাতরে আপন ইষ্টদেবতাকে ডাকিতেছেন। কোলের ছেলেটি চূষী লইয়া চূষিতেছে —মধ্যে২ হাত পা নাড়িয়া খেলা করিতেছে। শিশুটির প্রতি এক২ বার দৃষ্টিপাত করিয়া গৃহিণী মনে মনে বলিতেছেন —জাদু! তুমি আবার কেমন হবে বলিতে পারি না। ছেলে না হবার এক জ্বালা —হবার শতেক জ্বালা —যদি ছেলের একটু রোগ হল, তো মার প্রাণ অমনি উড়ে গেল। ছেলে কিসে ভাল হবে এজন্য মা শরীর একেবারে ঢেলে দেয় —তখন খাওয়া বল —শোয়া বল, সব ঘুরে যায়— দিনকে দিন জ্ঞান হয় না, রাতকে রাত জ্ঞান হয় না, এত দুঃখের ছেলে বড় হয়ে যদি সুসন্তান হয় তবেই সব সার্থক —তা না হলে মার জীয়ন্তে মৃত্যু —সংসারে কিছুই ভাল লাগে না —পাড়াপড়শীর কাছে মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না —বড় মুখটি ছোট হয়ে যায় আর মনে হয় যে পৃথিবী দোফাঁক্ হও আমি তোমার ভিতরে সেঁদুই। মতিকে যে করে মানুষ করেছি তা গুরুদেবই জানেন —এখন বাছা উড়তে শিখে আমাকে ভাল সাজাই দিতেছেন। মতির কুকর্ম্মের কথা শুনে অমি ভাজা২ হয়েছি—দুঃখেতে ও ঘৃণাতে মরে রয়েছি। কর্ত্তাকে সকল কথা বলি না, সকল কথা শুনিলে তিনি পাগল হতে পারেন। দূর হউক, আর ভাবিতে পারি না। আমি মেয়েমানুষ, ভেবেই বা কি করিব?—যা কপালে আছে তাই হবে।
দাসী আসিয়া খোকাকে লইয়া গেল। গৃহিণী আহ্ণিক করিতে বসিলেন। মনের ধর্ম্মই এই, যখন এক বিষয়ে মগ্ন থাকে তখন সে বিষয়টি হঠাৎ ভুলিয়া আর একটি বিষয়ে প্রায় যায় না। এই কারণে গৃহিণী আহ্ণিক করিতে বসিয়াও আহ্ণিক করিতে পারিলেন না। এক২ বার যত্ন করেন জপে মন দি, কিন্তু মন সেদিকে যায় না। মতির কথা মনে উদয় হইতে লাগিল —সে যেন প্রবল স্রোত, কার সাধ্যি নিবারণ করে। কখন২ বোধ হইতে লাগিল তাহার কয়েদ হুকুম হইয়াছে —তাহাকে বাঁধিয়া জেলে লইয়া যাইতেছে, তাহার পিতা নিকটে দাঁড়াইয়া আছেন, দুঃখেতে ঘাড় হেঁট করিয়া রোদন করিতেছেন। কখন বা জ্ঞান হইতেছে পুত্র নিকটে আসিয়া বলিতেছেন, মা আমাকে ক্ষমা কর —আমি যা করিয়াছি তা করিয়াছি আর আমি কখন তোমার মনে বেদনা দিব না, আবার এক একবার বোধ হইতেছে যে মতির ঘোর বিপদ উপস্থিত, তাহাকে জন্মের মত দেশান্তর যাইতে হইবেক। গৃহিণীর চটক ভাঙিয়া গেলে আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন —এ দিনের বেলা— আমি কি স্বপ্ন দেখিতেছি? না— এ তো স্বপ্ন নয়, তবে কি খেয়াল দেখিলাম? কে জানে আমার মনটা আজ্ কেন এমন হচ্চে। এই বলিয়া চক্ষের জল ফেল্তে২ ভূমিতে আস্তে২ শয়ন করিলেন।
দুই কন্যা মোক্ষদা ও প্রমদা ছাতের উপর বসিয়া মাথা শুকাইতে ছিলেন।
মোক্ষদা। ওরে প্রমদা। চুলগুলা ভাল করে এলিয়ে দে না, তোর চুল গুলা যে বড় উষ্কখুষ্ক হয়েছে! না হবেই বা কেন? সাত জন্মে তো একটু তেল পড়ে না—মানুষের তেলে-জলেই শরীর, বার মাস রুক্ষু নেয়ে২ কি একটা রোগনারা করবি? তুই এত ভাবিস্ কেন? ভেবে২ যে দড়ি বেটে গেলি।
প্রমদা। দিদি! আমি কি সাধ করে ভাবি? মনে বুঝে না কি করি? ছেলেবেলা বাপ একজন কুলীনের ছেলেকে ধরে এনে আমাকে বিবাহ দিয়েছিলেন —এ কথা বড়ো হয়্যে শুনেছি। পতি কত শত স্থানে বিয়ে করেছেন, আর তাঁহার যেরূপ চরিত্র তাতে তাঁহার মুখ দেখ্তে ইচ্ছা হয় না। অমন স্বামী না থাকা ভালো।
মোক্ষদা। হাবি! অমন কথা বলিস্নে —স্বামী মন্দ হউক ছন্দ হউক, মেয়েমানুষের এয়ত্ থাকা ভাল।
প্রমদা। তবে শুন্বে? আর বৎসর যখন আমি পালা জ্বরে ভুগ্তেছিনু —দিবারাত্রি বিছানায় পড়ে থাকতুম —উঠিয়া দাঁড়াইবার শক্তি ছিল না, সে সময় স্বামী আসিয়া উপস্থিত হলেন। স্বামী কেমন, জ্ঞান হওয়া অবধি দেখি নাই, মেয়ে মানুষের স্বামির ন্যায় ধন নাই। মনে করিলাম দুই দণ্ড কাছে বসে কথা কহিলে রোগের যন্ত্রণা কম হবে। দিদি বল্লে প্রত্যয় যাবে না —তিনি আমার কাছে দাঁড়াইয়াই অমনি বললেন ষোল বৎসর হইল তোমাকে বিবাহ করে গিয়াছি —তুমি আমার এক স্ত্রী —টাকার দরকারে তোমার নিকটে আসিতেছি —শীঘ্র যাব —তোমার বাপকে বল্লাম তিনিতো ফাঁকি দিলেন —তোমার হাতের গহনা খুলিয়া দাও। আমি বল্লাম —মাকে জিজ্ঞাসা করি —মা যা বলবেন তাই কর্বো। এই কথা শুনিবা মাত্রে আমার হাতের বালা গাছাটা জোর করে খুলে নিলেন। আমি একটু হাত বাগড়াবাগড়ি করেছিনু, আমাকে একটা লাথি মারিয়া চলিয়া গেলেন —তাতে আমি অজ্ঞান হয়্যে পড়েছিনু, তারপর মা আসিয়া আমাকে অনেকক্ষণ বাতাস করাতে আমার চেতনা হয়।
মোক্ষদা। প্রমদা তোর দুঃখের কথা শুনিয়া আমার চক্ষে জল আইসে, দেখ তোর তবু এয়ত্ আছে, আমার তাও নাই।
প্রমদা। দিদি! স্বামীর এই রকম। ভাগ্যে কিছুদিন মামার বাড়ী ছিলাম তাই একটু লেখা পড়া ও হুনুরি কর্ম্ম শিখিয়াছি। সমস্ত দিন কর্ম্ম কাজ ও মধ্যে২ লেখা পড়া ও হুনুরি কর্ম্ম করিয়া মনের দুঃখ ঢেকে বেড়াই। এক্লা বসে যদি একটু ভাবি তো মনটা অমনি জ্বলে উঠে।
মোক্ষদা। কি কর্বে? আর জন্মে কত পাপ করা গিয়েছিল তাই আমাদের এত ভোগ হতেছে। খাটা খাটুনি করলে শরীরটা ভাল থাকে মনও ভাল থাকে। চুপ করিয়া বসে থাকিলে দুর্ভাবনা বল, দুর্মতি বল, রোগ বল, সকলি আসিয়া ধরে। আমাকে এ কথা মামা বলে দেন —আমি এই করে বিধবা হওয়ার যন্ত্রণাকে অনেক খাটো করেছি, আর সর্ব্বদা ভাবি যে সকলই পরমেশ্বরের হাত, তাঁর প্রতি মন থাকাই আসল কর্ম্ম। বোন্! ভাবতে গেলে ভাবনার সমুদ্রে পড়তে হয়। তার কূল-কিনারা নাই। ভেবে কি কর্বি? দশটা ধর্ম্ম কর্ম্ম কর্ —বাপ মার সেবা কর্ —ভাই দুটির প্রতি যত্ন কর্, আবার তাদের ছেলেপুলে হলে লালন পালন করিস্ তারাই আমাদের ছেলেপুলে।
প্রমদা। দিদি! যা বল্তেছ তা সত্য বটে কিন্তু বড়ো ভাইটিতো একেবারে অধঃপাতে গিয়াছে। কেবল কুকথা কুকর্ম্ম ও কুলোক লইয়া আছে। তার যেমন স্বভাব তেমনি বাপ মার প্রতি ভক্তি —তেমনি আমাদের প্রতিও স্নেহ। বোনের স্নেহ ভায়ের প্রতি যতটা হয় ভায়ের স্নেহ তার শত অংশের এক অংশও হয় না। বোন ভাই২ করে সারা হন কিন্তু ভাই সর্ব্বদা মনে করেন বোন বিদায় হলেই বাঁচি। আমরা বড় বোন —মতি যদি কখন২ কাছে এসে দু-একটা ভাল কথা বলে তাতেও মনটা ঠাণ্ডা হয় কিন্তু তার যেমন ব্যবহার তা তো জান?
মোক্ষদা। সকল ভাই এরূপ করে না। এমন ভাইও আছে যে বড় বোনকে মার মত দেখে, ছোট বোনকে মেয়ের মত দেখে। সত্যি বল্চি এমন ভাই আছে যে ভাইকেও যেমন দেখে বোনকে তেমন দেখে। দু-দণ্ড বোনের সঙ্গে কথাবার্ত্তা না কহিলে তৃপ্তি বোধ করে না ও বোনের আপদ্ পড়িলে প্রাণপণে সাহায্য করে।
প্রমদা। তা বটে কিন্তু আমাদিগের যেমন পোড়া কপাল তেমনি ভাই পেয়েছি। হায়! পৃথিবীতে কোনো প্রকার সুখ হল না!
দাসী আসিয়া বলিল মা ঠাকুরুন কাঁদ্ছেন —এই কথা শুনিবামাত্র দুই বোনে তাড়াতাড়ি করিয়া নীচে নামিয়ে গেলেন।
চাঁদনীর রাত্রি। গঙ্গার উপর চন্দ্রের আভা পড়িয়াছে—মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে—বনফুলের সৌগন্ধ মিশ্রিত হইয়া এক একবার যেন আমোদ করিতেছে—ঢেউগুলা নেচে২ উঠিতেছে। নিকটবর্ত্তী ঝোপের পাখীসকল নানা রবে ডাকিতেছে। বালীর বেণী বাবু দেওনাগাজীর ঘাটে বসিয়া এদিক্ ওদিক্ দেখিতে দেখিতে কেদারা রাগিণীতে “শিখেহো” খেয়াল গাইতেছেন। গানেতে মগ্ন হইয়াছেন, মধ্যে২ তালও দিতেছেন। ইতিমধ্যে পেছন দিক্ থেকে “বেণী ভায়া২ ও শিখেহো” বলিয়া একটা শব্দ হইতে লাগিল। বেণী বাবু ফিরিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারাম বাবু আসিয়া উপস্থিত অমনি আস্তে ব্যস্তে উঠিয়া সম্মানপূর্ব্বক তাঁহাকে নিকটে আনিয়া বসাইলেন।
বেচারাম। বেণী ভায়া। তুমি আজ বাবুরামকে খুব ওয়াজিব কথা বলিয়াছ। তোমাদের গ্রামে নিমন্ত্রণে আসিয়াছিলাম —তোমার উপর আমি বড়ো তুষ্ট হইয়াছি —এজন্য ইচ্ছা হইল তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।
বেণী। বেচারাম দাদা। আমরা নিজে দুঃখী প্রাণী লোক, মজুরি করে এনে দিনপাত করি। যেসব স্থানে জ্ঞানের অথবা ধর্ম্মকথার চর্চ্চা হয় সেই সব স্থানে যাই। বড়মানুষ কুটুম্ব ও আলাপী অনেক আছে বটে কিন্তু তাহাদিগের নিকট চক্ষুলজ্জা অথবা দায়ে পড়ে কিংবা নিজ প্রয়োজনেই কখন২ যাই, সাধ করে বড় যাই না, আর গেলেও মনের প্রীতি হয় না কারণ বড়মানুষ বড়মানুষকেই খাতির করে আমরা গেলে হদ্দ বল্বে—“আজ বড় গরমি—কেমন কাজকর্ম্ম ভাল হচ্ছে—অরে এক ছিলিম তামাক দে।” যদি একবার হেসে কথা কহিলেন তবে বাপের সঙ্গে বত্তে গেলাম। এক্ষণে টাকার যত মান তত মান বিদ্যারও নাই ধর্ম্মেরও নাই। আর বড়মানুষের খোসামোদ করাও বড় দায়। কথাই আছে “বড়র পিরীতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ” কিন্তু লোকে বুঝে না —টাকার এমন কুহক যে লোকে লাথিও খাচ্ছে এবং নিকট গিয়া যেআজ্ঞাও কর্ছে। সে যাহা হউক, বড়োমানুষের সঙ্গে থাক্লে পরকাল রাখা ভার, আজ্কের যে ব্যাপারটি হইয়াছিল তাতে পরকালটি নিয়ে বিলক্ষণ টানাটানি!
বেচারাম। বাবুরামের রকম সকম দেখিয়া বোধ হয় যে তাহার গতিক ভাল নয়। আহা! কি মন্ত্রি পাইয়াছেন। এক বেটা নেড়ে তাহার নাম ঠকচাচা। সে বেটা জোয়াচোরের পাদশা। তার হাড়ে ভেল্কি হয়। বাঞ্ছারাম উকিলের বাটীর লোক! তিনি বর্ণচোরা আঁব —ভিজে বেড়ালের মত আস্তে২ সলিয়া কলিয়া লওয়ান্। তাঁহার জাদুতে যিনি পড়েন তাঁহার দফা একেবারে রফা হয়, আর বক্রেশ্বর মাস্টারগিরি করেন —নীতি শিখান অথচ জল উঁচু নীচু বলনের শিরোমণি। দূঁর২! যাহা হউক, তোমার এ ধর্ম্ম জ্ঞান কি ইংরাজী পড়িয়া হইয়াছে?
বেণী। আমার এমন কি ধর্ম্মজ্ঞান আছে? এরূপ আমাকে বলা কেবল অনুগ্রহ প্রকাশ করা। যৎকিঞ্চিৎ যাহা হিতাহিত বোধ হইয়াছে তাহা বদরগঞ্জের বরদা বাবুর প্রসাদাৎ। সেই মহাশয়ের সহিত অনেক দিন সহবাস করিয়াছিলাম। তিনি দয়া করিয়া কিঞ্চিৎ উপদেশ দিয়াছেন।
বেচারাম। বরদা বাবু কে? তাঁহার বৃত্তান্ত বিস্তারিত করিয়া বল দেখি। এমন কথা সকল শুন্তে বড় ইচ্ছা হয়।
বেণী। বরদাবাবুর বাটী বঙ্গদেশে—পরগনে এটেকাগমারি। পিতার বিয়োগ হইলে কলিকাতায় আইসেন—অন্নবস্ত্রের ক্লেশ আত্যন্তিক ছিল —আজ খান এমত যোত্র ছিল না। বাল্যাবস্থাবধি পরমার্থ প্রসঙ্গে সর্ব্বদা রত থাকিতেন, এজন্য ক্লেশ পাইলেও ক্লেশ বোধ হইত না। একখানি সামান্য খোলার ঘরে বাস করিতেন—খুড়ার নিকট মাস২ যে দুটি টাকা পাইতেন তাহাই কেবল ভরসা ছিল। দুই-একজন সৎলোকের সঙ্গে আলাপ ছিল —তদ্ভিন্ন কাহারও নিকট যাইতেন না, কাহার উপর কিছু ভার দিতেন না। দাসদাসী রাখিবার সঙ্গতি ছিল না—আপনার বাজার আপনি করিতেন—আপনার রান্না আপনি রাঁধিতেন, রাঁধিবার সময় পড়াশুনা অভ্যাস করিতেন আর কি প্রাতে কি মধ্যাহ্নে কি রাত্রে একচিত্তে পরমেশ্বরকে ধ্যান করিতেন। স্কুলে ছেঁড়া ও মলিন বস্ত্রেই যাইতেন, বড়মানুষের ছেলেরা পরিহাস ও ব্যঙ্গ করিত। তিনি শুনিতেন না ও সকলকে ভাই দাদা ইত্যাদি মিষ্ট বাক্যের দ্বারা ক্ষান্ত করিতেন। ইংরাজি পড়িলে অনেকের মনে মাৎসর্য্য হয় —তাহারা পৃথিবীকে শরাখান্ দেখে। বরদাবাবুর মনে মাৎসর্য্য কোনপ্রকারে করিতে পারিত না। তাঁহার স্বভাব অতি শান্ত ও নম্র ছিল, বিদ্যা শিখিয়া স্কুল ত্যাগ করিলেন। স্কুল ত্যাগ করিবারমাত্র স্কুলে একটি ৩০ টাকার কর্ম্ম হইল। তাহাতে আপনি ও মা ও স্ত্রী ও খুড়ার পুত্রকে বাসায় আনিয়া রাখিলেন এবং তাঁহারা কিরূপে ভালো থাকিবেন তাহাতেই অতিশয় যত্ন করিতে লাগিলেন। বাসার নিকট অনেক গরীব-দুঃখী লোক ছিল তাহাদিগেকে সর্ব্বদা তত্ত্ব করিতেন —আপনার সাধ্যক্রমে দান করিতেন ও কাহারো পীড়া হইলে আপনি গিয়া দেখিতেন এবং ঔষধাদি আনিয়া দিতেন। ঐ সকল লোকের ছেলেরা অর্থাভাবে স্কুলে পড়িতে পারিত না এজন্য প্রাতে তিনি আপনি তাহাদিগকে পড়াইতেন। খুড়ার কাল হইলে খুড়াতুতো ভায়ের ঘোরতর ব্যামোহ হয়, তাহার নিকট দিনরাত বসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করাতে তিনি আরাম হন। বরদা বাবুর খুড়ীর প্রতি অসাধারণ ভক্তি ছিল, তাঁহাকে মায়ের মত দেখিতেন। অনেকের পরমার্থ বিষয়ে শ্মশান বৈরাগ্য দেখা যায়। বন্ধু অথবা পরিবারের মধ্যে কাহারো বিয়োগ হইলে অথবা কেহ কোন বিপদে পড়িলে জগৎ অসার ও পরমেশ্বরই সারাৎসার এই বোধ হয়। বরদা বাবুর মনে ঐ ভাব নিরন্তর আছে, তাঁহার সহিত আলাপ অথবা তাঁহার কর্ম্ম দ্বারা তাহা জানা যায় কিন্তু তিনি একথা লইয়া অন্যের কাছে কখনই ভড়ং করেন না। তিনি চটুকে মানুষ নহেন —জাঁক ও চটকের জন্য কোনো কর্ম্ম করেন না। সৎকর্ম্ম যাহা করেন তাহা অতি গোপনে করিয়া থাকেন। অনেক লোকের উপকার করেন বটে কিন্তু যাহার উপকার করেন কেবল সেই ব্যক্তিই জানে, অন্য লোকে টের পাইলে অতিশয় কুণ্ঠিত হয়েন। তিনি নানা প্রকার বিদ্যা জানেন কিন্তু তাঁহার অভিমান কিছুমাত্র নাই। লোকে একটু শিখিয়া পুঁটি মাছের মতো ফর্২ করিয়া বেড়ায় ও মনে করে আমি বড় বুঝি —আমি যেমন লিখি এমন লিখিতে কেহ পারে না —আমার বিদ্যা যেমন, এমন বিদ্যা কাহারো নাই —আমি যাহা বলিব সেই কথাই কথা। বরদা বাবু অন্য প্রকার ব্যক্তি, তাঁহার বিদ্যাবুদ্ধি প্রগাঢ় তথাচ সামান্য লোকের কথাও অগ্রাহ্য করেন না এবং মতান্তরের কোন কথা শুনিলে কিছু মাত্র বিরক্তও হয়েন না বরং আহ্লাদপূর্ব্বক শুনিয়া আপন মতের দোষগুণ পুনর্ব্বার বিবেচনা করেন। ঐ মহাশয়ের নানা গুণ, সকল খুঁটিয়া বর্ণনা করা ভার —মোট এই বলা যাইতে পারে যে তাঁহার মত নম্র ও ধর্ম্মভীত লোক কেহ কখন দেখে নাই —প্রাণ বিয়োগ হইলেও কখন অধর্ম্মে তাঁহার মতি হয় না। এমতো লোকের সহবাসে যত সৎ উপদেশ পাওয়া যায় বহি পড়িলে তত হয় না।
বেচারাম। এমত লোকের কথা শুনে কান জুড়ায়। রাত অনেক হইল, পারাপারের পথ, বাটী যাই। কাল যেন পুলিশে একবার দেখা হয়।