আলালের ঘরের দুলাল (১৮৭০)/৭
৭ কলিকাতার আদিবৃত্তান্ত, জাস্টিস অব পিস নিয়োগ, পুলিশ বর্ণন, মতিলালের পুলিশে বিচার ও খালাস, বাবুরাম বাবুর পুত্র লইয়া বৈদ্যবাটী গমন, ঝড়ের উত্থান ও নৌকা জলমগ্ন হওনের আশঙ্কা।
সংসারের গতি অদ্ভুত—মানববুদ্ধির অগম্য! কি কারণে কি হয় তাহা স্থির করা সুকঠিন। কলিকাতার আদি বৃত্তান্ত স্মরণ করিলে সকলেরই আশ্চর্য্য বোধ হইবে ও সেই কলিকাতা যে এই কলিকাতা হইবে ইহা কাহারো স্বপ্নেও বোধ হয় নাই।
কোম্পানীর কুঠি প্রথমে হুগলীতে ছিল, তাঁহাদিগের গোমাস্তা জাব চারনক সাহেব সেখানকার ফৌজদারের সহিত বিবাদ করেন, তখন কোম্পানীর এত জারিজুরি চল্তো না সুতরাং গোমাস্তাকে হুড় খেয়ে পালিয়ে আসিতে হইয়াছিল। জাব চারনকের বারাকপুরে এক বাটী ও বাজার ছিল এই কারণে বারাকপুরের নাম অদ্যাবধি চার্নক বলিয়া খ্যাত আছে। জাব চারনক একজন সতীকে চিতার নিকট হইতে ধরিয়া আনিয়া বিবাহ করিয়াছিলেন কিন্তু, ঐ বিবাহ পরস্পরের সুখজনক হইয়াছিল কি না তাহা প্রকাশ হয় নাই। তিনি নূতন কুঠি করিবার জন্য উলুবেড়িয়ায় গমনাগমন করিয়াছিলেন ও তাঁহার ইচ্ছাও হইয়াছিল যে সেখানে কুঠি হয় কিন্তু অনেক২ কর্ম্ম হ পর্যন্ত হইয়া ক্ষ বাকি থাকিতেও ফিরিয়া যায়। জাব চারনক বটুকখানা অঞ্চল দিয়া যাতায়াত করিতেন, তথায় একটা বৃহৎ বৃক্ষ ছিল তাহার তলায় বসিয়া মধ্যে২ আরাম করিতেন ও তামাক্ খাইতেন, সেই স্থানে অনেক ব্যাপারিরাও জড় হইত। ঐ গাছের ছায়াতে তাঁহার এমনি মায়া হইল যে সেই স্থানেই কুঠি করিতে স্থির করিলেন। সূতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা এই তিন গ্রাম একেবারে খরিদ হইয়া আবাদ হইতে আরম্ভ হইল; পরে বাণিজ্য নিমিত্ত নানা জাতীয় লোক আসিয়া বসতি করিল ও কলিকাতা ক্রমে২ শহর হইয়া গুলজার হইতে লাগিল।
ইংরাজী ১৬৮৯ সালে কলিকাতা শহর হইতে আরম্ভ হয়। তাহার তিন বৎসর পরে জাব চারনকের মৃত্যু হইল, তৎকালে গড়ের মাঠ ও চৌরূঙ্গী জঙ্গল ছিল, এক্ষণে যে স্থানে পারমিট্ আছে পূর্ব্বে তথায় গড় ছিল ও যে স্থানকে এক্ষণে ক্লাইবষ্ট্রীট্ বলিয়া ডাকে সেই স্থানে সওদাগরি কর্ম্ম হইত।
কলিকাতায় পূর্ব্বে অতিশয় মারীভয় ছিল এজন্য যে২ ইংরাজেরা তাহা হইতে পরিত্রাণ পাইত তাহারা প্রতি বৎসর নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে একত্র হইয়া আপন আপন মঙ্গলবার্ত্তা বলাবলি করিত।
ইংরাজদিগের এক প্রধান গুণ এই যে, যে স্থানে বাসকরে তাহা অতি পরিষ্কার রাখে। কলিকাতা ক্রমে২ সাফশুতরা হওয়াতে পীড়াও ক্রমে২ কমিয়া গেল কিন্তু বাঙ্গালিরা ইহা বুঝিয়াও বুঝেন না। অদ্যাবধি লক্ষ্মীপতির বাটীর নিকটে এমন খানা আছে যে দুর্গন্ধে নিকট যাওয়া ভার!
কলিকাতার মাল, আদালত ও ফৌজদারী এই তিন কর্ম্ম নির্ব্বাহের ভার একজন সাহেবের উপর ছিল। তাঁহার অধীনে একজন বাঙ্গালি কর্ম্মচারী থাকিতেন ঐ সাহেবকে জমিদার বলিয়া ডাকিত। পরে অন্যান্য প্রকার আদালত ও ইংরাজদিগের দৌরাত্ম্য নিবারণের জন্য সুপরিম কোর্ট স্থাপিত হইল, আর পুলিশের কর্ম্ম স্বতন্ত্র হইয়া সুচারুরূপে চলিতে লাগিল। ইংরাজি ১৭৯৮ সালে স্যার জান রিচার্ডসন প্রভৃতি জসটিস অব পিস মোকরর হইলেন। তদনন্তর ১৮০০ সালে ব্লাকিয়র সাহেব প্রভৃতি ঐ কর্ম্মে নিযুক্ত হন।
যাঁহারা জসটিস অব পিস হয়েন তাঁহাদিগের হুকুম এদেশের সর্ব্বস্থানে জারি হয়। যাঁহারা কেবল মেজিস্ট্রেট, জসটিস অব পিস নহেন, তাঁহদিগের আপন২ সরহদ্দের বাহিরে হুকুম জারি করিতে গেলে তথাকার আদালতের মদৎ আবশ্যক হইত এজন্যে সম্প্রতি মফঃস্বলের অনেক মেজিস্ট্রেট জসটিস অব পিস হইয়াছেন।
ব্লাকিয়র সাহেবের মৃত্যু প্রায় চারি বৎসর হইয়াছে। লোকে বলে ইংরাজের ঔরসে ও ব্রাহ্মণীর গর্ব্ভে তাঁহার জন্ম হয়। তাঁহার প্রথম শিক্ষা এখানে হয়—পরে বিলাতে যাইয়া ভালরূপ শিক্ষা করেন। পুলিশের মেজিস্ট্রেটী কর্ম্ম প্রাপ্ত হইলে তাঁহার দবদবায় কলিকাতা শহর কাঁপিয়া গিয়াছিল—সকলেই থরহরি কাঁপিত। কিছুকাল পরে সন্ধান সুলুক করা ও ধরা পাকড়ার কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া তিনি কেবল বিচার করিতেন। বিচারে সুপারগ ছিলেন, তাহার কারণ এই দেশের ভাষা ও রীতি ব্যবহার ও ঘাঁৎঘুঁৎ সকল ভাল বুঝিতেন—ফৌজদারী আইন তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল ও বহুকাল সুপ্রিম কোর্টের ইণ্টর্পিটর্ থাকাতে মকদ্দমা কিরূপে করিতে হয় তদ্বিষয়ে তাঁহার উত্তম জ্ঞান জন্মিয়াছিল।
সময় জলের মতো যায়—দেখিতে২ সোমবার হইল—গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া দশটা বাজিল। সারজন্, সিপাই, দারোগা. নায়েব, ফাঁড়িদার, চৌকিদার ও নানা প্রকার লোকে পুলিশ পরিপূর্ণ হইল। কোথাও বা কতকগুলা বাড়িওয়ালি ও বেশ্যা বসিয়া পানের ছিবে ফেল্ছে — কোথাও বা কতকগুলা লোক মারি খেয়ে রক্তের কাপড় সুদ্ধ দাঁড়িয়া আছে—কোথাও বা কতকগুলা চোর অধোমুখে এক পার্শ্বে বসিয়া ভাব্ছে—কোথাও বা দুই একজন টয়েবাঁধা ইংরেজিওয়ালা দরখাস্ত লিখ্ছে—কোথাও বা ফৈরাদিরা নীচে উপরে টংঅস২ করিয়া ফিরিতেছে— কোথাও বা সাক্ষী সকল পরস্পর ফুস্২ করিতেছে—কোথাও বা পেশাদার জামিনেরা তীর্থের কাকের ন্যায় বসিয়া আছে—কোথাও বা উকিলদিগের দালাল ঘাপ্টিমেরে জাল ফেলিতেছে—কোথাও বা উকিলেরা সাক্ষীদিগের কাণে মন্ত্র দিতেছে—কোথাও বা আমলারা চালানি মকদ্দমা টুক্ছে—কোথাও বা সারজনেরা বুকের ছাতি ফুলাইয়া মস্২ করিয়া বেড়াচ্ছে—কোথাও বা সরদার২ কেরানীরা বলাবলি কর্চে—এ সাহেবটা গাধা—ও সাহেব পটু—এ সাহেব নরম—ও সাহেব কড়া— কাল্কের ও মকদ্দমাটার হুকুম ভাল হয় নাই। পুলিশ গস্২ করিতেছে— সাক্ষাৎ যমালয়—কার্ কপালে কি হয়— সকলেই সশঙ্ক।
{,larger|বাবুরাম বাবু}} আপন উকিল, মন্ত্রি ও আত্মীয়গণ সহিত তাড়াতাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠকচাচার মাথায় মেন্তাই পাগড়ি—গায়ে পিরাহান, পায়ে নাগোরা জুতা, হাতে ফটিকের মালা—বুজর্গ ও নবীর নাম নিয়া এক২ বার দাড়ি নেড়ে তসবি পড়িতেছেন কিন্তু সে কেবল ভেক। ঠকচাচার মত চালাক লোক পাওয়া ভার। পুলিশে আসিয়া চারিদিকে যেন লাটিমের মত ঘুরিতে লাগিলেন। একবার এদিগে যান—একবার ওদিগে যান—একবার সাক্ষীদিগের কাণে২ ফুস্২ করেন—এক২ বার বাবুরাম বাবুর হাত ধরিয়া টেনে লইয়া যান—এক২ বার বটলর সাহেবের সঙ্গে তর্ক করেন—এক২ বার বাঞ্ছারাম বাবুকে বুঝান। পুলিশের যাবতীয় লোক ঠকচাচাকে দেখিতে লাগিল। অনেকের বাপ পিতামহ চোর ছেঁচড় হইলেও তাহাদিগের সন্তান-সন্ততিরা দুর্ব্বল স্বভাব হেতু বোধ করে যে তাঁহারা অসাধারণ ও বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, এজন্য অন্যের নিকট আপন পরিচয় দিতে হইলে একেবারে বলিয়া বসে আমি অমুকের পুত্র— অমুকের নাতি। ঠকচাচার নিকট যে আলাপ করিতে আসিতেছে, তাহাকে অমনি বলিতেছেন— মুই আবদর রহমান গুলমহামদের লেড়খা ও আমপক্২ গোলামহোসেনের পোতা। একজন ঠোঁটকাটা সরকার উত্তর করিল, আরে তুমি কাজ কর্ম্ম কি কর তাই বল— তোমার বাপ-পিতামহের নাম নেড়ে পাড়ার দুই-এক বেটা শোরখেকো জান্তে পারে— কলিকাতা শহরে কে জান্বে? তারা কি সইস গিরি কর্ম্ম করিত? এই কথা শুনিয়া ঠকচাচা দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিলেন— কি বল্ব এ পুলিশ, দুসরা জেগা হলে তোর উপরে লাফিয়ে পড়ে কেমড়ে ধরতুম। এই বলিয়া বাবুরাম বাবুর হাত ধরিয়া দাঁড়াইলেন ও সরকারকে পাকতঃ দেখাইলেন যে আমার কত হুরমত—কত ইজ্জত।
ইতিমধ্যে পুলিশের সিঁড়ির নিকট একটা গোল উঠল, একখানা গাড়ী গড়২ করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল—গাড়ীর দ্বার খুলিবামাত্র একজন জীর্ণ শীর্ণ প্রাচীন সাহেব নামিলেন—সারজনেরা অমনি টুপি খুলিয়া কুরনিশ করিতে লাগিল ও সকলেই বলিয়া উঠিল ব্লাকিয়র সাহেব আস্ছেন। সাহেব বেঞ্চের উপর বসিয়া কয়েকটা মারপিটের মকদ্দমা ফয়সালা করিলেন পরে মতিলালের মকদ্দমা ডাক হইল। একদিকে কালে খাঁ ও ফতে খাঁ ফৈরাদি দাঁড়াইল আর একদিকে বৈদ্যাবাটীর বাবুরাম বাবু, বালীর বেণী বাবু, বটতলার বক্রেশ্বর বাবু, বৌবাজারের বেচারাম বাবু, বাহির সিমলার বাঞ্ছারাম বাবু ও বৈটকখানার বটলর সাহেব দাঁড়াইলেন। বাবুরাম বাবুর গায়ে জোড়া, মাথায় খিড়কিদার পাগড়ি, নাকে তিলক, তার উপরে হোমের ফোঁটা—দুই হাত জোড়া করিয়া কাঁদো২ ভাবে সাহেবের প্রতি দেখিতে লাগিলেন—মনে করিতেছেন যে চক্ষের জল দেখিলে অবশ্যই সাহাবের দয়া উদয় হইবে। মতিলাল, হলধর, গদাধর ও অন্যান্য আসামীরা সাহেবের সম্মুখে আনীত হইল। মতিলাল লজ্জায় ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল, তাহার অনাহারে শুষ্ক বদন দেখিয়া বাবুরাম বাবুর হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল। ফৈরাদিরা এজেহার করিল যে আসামীরা কুস্থানে যাইয়া জুয়া খেলিত, তাহাদিগকে ধরাতে বড় মারপিট করিয়া ছিনিয়ে পালায়—মারপিটের দাগ গায়ের কাপড় খুলিয়া দেখাইল। বটলর সাহেব ফৈরাদির ও ফৈরাদির সাক্ষির উপর অনেক জেরা করিয়া মতিলালের সংক্রান্ত এজেহার কতক কাঁচিয়া ফেলিলেন। এমতো কাঁচান আশ্চর্য্য নহে কারণ একে উকিলী ফন্দি, তাতে পূর্ব্বে গড়াপেটা হইয়াছিল— টাকাতে কি না হইতে পারে? “কড়িতে বুড়ার বিয়ে হয়”। পরে বটলর সাহেব আপন সাক্ষিসকলকে তুলিলেন। তাহারা বলিল, মারপিটের দিনে মতিলাল বৈদ্যবাটীর বাটীতে ছিল কিন্তু ব্লাকিয়র সাহাবের খুঁচনিতে এক২ বার ঘবড়িয়া যাইতে লাগিল। ঠকচাচা দেখিলেন গতিক বড় ভালো নয়—পা পিছলে যাইতে পারে—মকদ্দমা করিতে গেলে প্রায় লোকের দিগ্বিদগ্ জ্ঞান থাকে না— সত্যের সহিত ফারখতাখতি করিয়া আদালতে ঢুক্তে হয়— কি প্রকারে জয়ী হইব তাহাতেই কেবল একিদা থাকে, এই কারণে তিনি সম্মুখে আসিয়া স্বয়ং সাক্ষী দিলেন অমুক দিবস অমুক তারিখে অমুক সময়ে তিনি মতিলালকে বৈদ্যবাটীর বাটীতে ফার্সি পড়াইতেছিলেন। মেজিস্ট্রেট অনেক সওয়াল করিলেন কিন্তু ঠকচাচা হেল্বার-দোল্বার পাত্র নয়—মামলার বড় টঙ্ক, আপনার আসল কথা কোন রকমেই কমপোক্ত হইল না। অমনি বটলর সাহেব বক্তৃতা করিতে লাগিলেন। পরে মাজিস্ট্রেট ক্ষণেক কাল ভাবিয়া হুকুম দিলেন মতিলাল খালাস ও অন্যান্য আসামির এক২ মাস মেয়াদ এবং ত্রিশ২ টাকা জরিমানা। হুকুম হইবামাত্র হরিবোলের শব্দ উঠিল ও বাবুরাম বাবু চিৎকার করিয়া বলিলেন—ধর্ম্মাবতার! বিচার সুক্ষ্ম হইল, আপনি শীঘ্র গবর্ণর হউন।
পুলিশের উঠানে সকলে আসিলে হলধর ও গদাধর প্রেমণারায়ণ মজুমদারকে দেখিয়া তাহার খেপানের গান তাহার কানে২ গাইতে লাগিল— “প্রেমনারায়ণমজুমদার কলা খাও, কর্ম্ম কাজ নাই কিছু বাড়ী চলে যাও। হেন করি অনুমান তুমি হও হনূমান, সমুদ্রের তীরে গিয়া স্বচ্ছন্দে লাফাও।” প্রেমনারায়ণ বলিল—বটে রে বিট্লেরা—বেহায়ার বালাই দূর—তোরা জেলে যাচ্ছিস্ তবুও দুষ্টুমি করিতে ক্ষান্ত নহিস্—এই বল্তে২ তাহাদিগকে জেলে লইয়া গেল। বেণী বাবু ধর্ম্মভীতু লোক—ধর্ম্মের পরাজয় অধর্ম্মের জয় দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন— ঠকচাচা দাড়ি নেড়ে হাসিতে২ দম্ভ করিয়া বলিলেন—কেমন গো এখন কেতাবি বাবু কি বলেন, এনার মসলতে কাম কর্লে মোদের দফা রফা হইত। বাঞ্ছারাম তেড়ে আসিয়া ডান হাত নেড়ে বলিলেন—একি ছেলের হাতের পিটে? বক্রেশ্বর বল্লেন—সে তো ছেলে নয়, পরেস পাথর। বেচারামবাবু বলিলেন—দূঁর২! এমন অধর্ম্মও করিতে চাই না—মকদ্দমা জিতও চাই না—দূঁর২! এই বলিয়া বেণী বাবুর হাত ধরিয়া ঠিকুরে বেরিয়ে গেলেন।
বাবুরাম বাবু কালীঘাটে পূজা দিয়া নৌকায় উঠিলেন। বাঙ্গালিরা জাতের গুমর সর্ব্বদা করিয়া থাকেন, কিন্তু কর্ম্ম পড়িলে যবনও বাপের ঠাকুর হইয়া উঠে। বাবুরাম বাবু ঠকচাচাকে সাক্ষাৎ ভীষ্মদেব বোধ করিলেন ও তাহার গলায় হাত দিয়া মকদ্দমা জিতের কথাবার্ত্তায় মগ্ন হইলেন—কোথায়্ বা পান পানীর আয়েব— কোথায়্ বা আহ্নিক— কোথায়্ বা সন্ধ্যা? সবই ঘুরে গেল। এক এক বার বলা হচ্ছে, বটলর সাহেব ও বাঞ্ছারাম বাবুর তুল্য লোক নাই— এক২ বার বলা হচ্ছে, বেচারাম ও বেণীর মত বোকা আর দেখাযায় না। মতিলাল এদিক ওদিক দেখ্ছে— এক২ বার গলুয়ে দাঁড়াচ্ছে—এক২ বার দাঁড় ধরে টান্ছে—এক২ বার ছত্রির উপর বস্ছে— এক২ বার হাইল ধরে ঝিঁকে মার্ছে। বাবুরাম বাবু মধ্যে২ বল্তেছেন— মতিলাল বাবা ও কি? স্থির হয়্যে বসো। কাশীজোড়ার শঙ্কুরে মালী তামাক্ সাজ্ছে— বাবুর আহ্লাদ দেখে তাহারও মনে স্ফূর্ত্তি হইয়াছে—জিজ্ঞাসা করছে—বাও মোশাই। এবাড় কি পূজাড় সময় বাকুলে বাওলাচ হবে? এটা কি তুড়ার কড়? সাড়ারা কত কড় করেছে?
প্রায় একভাবে কিছুই যায় না—যেমন মনেতে রাগ চাপা থাকিলে একবার না একবার অবশ্যই প্রকাশ পায় তেমনি বড় গ্রীষ্ম ও বাতাস বন্ধ হইলে প্রায় ঝড় হইয়া থাকে। সূর্য্য অস্ত যাইতেছে— সন্ধ্যার আগমন— দেখিতে২ পশ্চিমে একটা কালো মেঘ উঠিল— দুই-এক লহমার মধ্যেই চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া আসিল— হু-হু করিয়া ঝড় বহিতে লাগিল— কোলের মানুষ দেখা যায় না— সামাল্২ ডাক পড়ে গেল। মধ্যে২ বিদ্যুৎ চম্কিতে আরম্ভ হইল ও মুহুর্মুহু২ বজ্রের ঝঞ্জন কড়্ মড়্ হড়্মড়্ শব্দে সকলের ত্রাস হইতে লাগিল— বৃষ্টির ঝর২ তড়তড়িতে কার্ সাধ্য বাহিরে দাঁড়ায়। ঢেউগুলা এক২ বার বেগে উচ্চ হইয়া উঠে আবার নৌকার উপর ধপাস্২ করিয়া পড়ে। অল্পক্ষণের মধ্যে দুই তিনখানা নৌকা মারা গেল। ইহা দেখিয়া অন্য নৌকার মাজিরা কিনারায় ভিড়্তে চেষ্টা করিল কিন্তু বাতাসের জোরে অন্য দিগে গিয়া পড়িল। ঠকচাচার বকুনি বন্ধ—দেখিয়া শুনিয়া জ্ঞাশূন্য— তখন এক২ বার মালা লইয়া তস্বি পড়েন— তখন আপনার মহম্মদ আলি ও সত্যপিরের নাম লইতে লাগিলেন। বাবুরাম অতিশয় ব্যাকুল হইলেন, দুষ্কর্ম্মের সাজা এইখানেই আরম্ভ হয়! দুষ্কর্ম্ম করিলে কাহার্ মন সুস্থির থাকে? অন্যের কাছে চাতুরীর দ্বারা দুষ্কর্ম্ম ঢাকা হইতে পারে বটে কিন্তু কোনো কর্ম্মই মনের অগোচর থাকে না। পাপী টের পান যেন তাঁহার মনে কেহ ছুঁচ বিঁধ্ছে— সর্ব্বদাই আতঙ্ক— সর্ব্বদাই ভয়— সর্ব্বদাই অসুখ—মধ্যে২ যে হাঁসিটুকু হাসেন সে কেবল দেঁতোর হাঁসি। বাবুরাম বাবু ত্রাসে কাঁদিতে লাগিলেন ও বলিলেন—ঠকচাচা কি হইবে! দেখিতে পাই অপঘাত মৃত্যু হইল— বুঝি আমাদিগের পাপের এই দণ্ড। হায় হায় ছেলেকে খালাস করিয়া আনিলাম, ইহাকে গৃহিণীর নিকট নিয়ে যাইতে পারিলাম না— যদি মরি তো গৃহিণীও শোকে মরিয়া যাইবেন—এখন আমার বেণী ভায়ার কথা স্মরণ হয়— বোধ হয় ধর্ম্মপথে থাকিলে ভাল ছিল। ঠকচাচারও ভয় হইয়াছে কিন্তু তিনি পুরাণ পাপী— মুখে বড় দড়— বলিলেন— ডর কেন কর বাবু? লা ডুবি হইলে মুই তোমাকে কাঁধে করে সেঁতরে লিয়ে যাব— আফদ তো মরদের হয়। ঝড় ক্রমে২ বাড়িয়া উঠিল— নৌকা, টল্ মল্ করিয়া ডুবুডুবু হইল, সকলেই আঁকু পাঁকু ও ত্রাহি২ করিতে লাগিল, ঠকচাচা মনে২ কহেন “চাচা আপনা বাঁচা”।