আলোর ফুলকি/১
দূরে একটা মহা বন, সেখানে বসন্ত-বাউরি ‘বউ-কথা-কও’ ব’লে থেকে থেকে ডাক দেয়; কাছে পাহাড়তলির আবাদের পশ্চিমে, ঢালু মাঠের ধারে, পুরোনো গোলাবাড়ির গায়ে মাচার উপর কুঞ্জলতার বেড়া-দেওয়া কোঠাঘর; সেখানে একটা ঘড়ি বাজবার আগে পাপিয়ার মতো ‘পিয়া পিউ’ শব্দ করে। যার বাড়ি তার পাখির বাতিক; পোষা পাখি, বুনো পাখি, এই গোলাবাড়ির আর কোঠাবাড়ির ফাঁকে ফাঁকে কত যে আছে ঠিক নেই, কেউ দরজা-ভাঙা খাঁচায়, কেউ ছেড়া ঝুড়িতে, চালের খড়ে, দেয়ালের ফাটলে বাসা বেঁধে সুখে আছে। ও-পাড়ার ডালকুত্তো তন্মা মাঝে মাঝে মুরগির ছানা চুরি করতে এদিকে আসে, কিন্তু পাখিদের বন্ধু পাহাড়ী কুত্তানি জিম্মার সামনে এগোয়, তার এমন সাহস নেই। বাড়ি যার, সে যখন বাইরে গেল, পাহারা দিতে রইল জিন্মা, আর রইল মোরগ-ফুল-মাথায়-গোঁজা কুঁকড়ো— সে এমন কুঁকড়ো যে সবার আগে চোখ খোলে, সবার শেষে ঘুমে ঢোলে।
এই কুঁকড়োর চার রঙের চার বউ। সাদি, মেমসাহেবের মতো গোলাপী ফিতে মাথায় বেঁধে সাদা ঘাগর প’রে ঘুর-যুর করছেন; কালি, চোখে কাজল আর নীলাম্বরী শাড়ি-পরা মাথায় সোনালী মোড়া বেনে খোঁপা, যেন কালতে ঠাকরুন; সুরকি, তিনি ঠোঁটে আলতা দিয়ে, গোলাপী শাড়ি প’রে যেন কনে বউটি; আর খাকি, তিনি ধূপছায়া রঙের সায়া জড়িয়ে বসে রয়েছেন, যেন একটি আয়া।
বেলা পড়ে আসছে, গোলাবাড়ির উঠোনে বিকেলের রোদ এসেছে। সফেদি, সিয়াঈ, সুরকি, খাকি, গুলবাহারি সব মুরগি মিলে জটলা করছে। বাচ্ছারা এক দিকে একটা কেঁচো। নিয়ে টানাটানি মারামারি চেঁচামেচি বাধিয়ে দিয়েছে; ঘরের মধ্যে ঘড়ি সাড়া দিলে “পিয়া পিউ।” সফেদি বলে উঠল, “ওই পাপিয়া ডাকল।” খাকি তাড়াতাড়ি ছুটে এসে বললে, “পাপিয়া লো কোন্ পাপিয়া? বনের না ঘরের? ঘড়ির ভিতরে যার বাসা, সে কি ডাক দিলে।” সফেদি তখন ধান খুঁটে খুঁটে গালে দিচ্ছিল; এবার খুব দূর থেকে শব্দ এল, “পিউ পিউ।” সফেদি বললে, “এ যেন বনেরই বোধ হচ্ছে। শুনছিস, কত দূর থেকে ডাক দিয়ে গেল।” ঘড়ির মধ্যে থেকে যে ‘পিয়া’ ব’লে থেকে থেকে দিনে রাতে অনেকবার ডাক দেয় খাকি একবার আড়াল থেকে তার চেহারাখানি দেখে নেবার জন্যে থাকে-থাকে কুঠিবাড়ির দিকে ঘুরে আসে; ‘পিউ’ বলে যেমন ডাকা, অমনি সে সোনার মন্দিরের মতো সেই ঘড়িটার কাছে ছুটে যায়, খুট করে দরজা বন্ধ হবার মতো একটা শব্দ শোনে, তখন চক্ষুশূল হুটো ঘড়ির কাঁটাই সে দেখতে পায়। পাখি, যে ‘পিয়া পিউ’ বলে ডাকলে, তার আর দেখা পায় না, এমনি নিত্য ঘটে বারে বারে। ঘড়ির মধ্যে যে পাখি, সে এখনো ডাকে নি, ডেকে গেল বনের পাখিট। শুনে খাকি বললে, “আঃ, তবু ভালো,এই বেলা গিয়ে ঘুলঘুলিতে আড়াসি পেতে বসে থাকি, আজ সে পিউ-পাখির দেখা নিয়ে তবে অন্য কাজ, রোজই কি ফাঁকি দেবে।”
খাকি কেন যে ঘন ঘন ঘড়ি দেখে আসে, সফেদির কাছে আজ সেটা ধরা পড়ে গেল। খাকির মন-পাখি যে কোন্ পাখির কাছে বাঁধা পড়েছে, সবার কাছে সেই খবরটা জানিয়ে দেবার জন্যে সফেদি চলেছে, এমন সময় চালের উপর থেকে কে একজন ডাক দিলে, “সাদি, ও দিদি, ও সফেদি।” “কে রে, কে রে”— ব’লে সাদি চারি দিক চাইতে লাগল। উত্তর হল, “আমি কবুত গো কবুত।” সফেদি রেগে বললে, “আরে তা তো জানি। কোথায় তুই?”
“ছাতে গো ছাতে।”
সাদি দেখলে, এক গাঁ থেকে আর-এক গাঁয়ে নীল আকাশের খবর বয়ে চলে যে নীল পায়রা তারি একটা একটুখানি জিরোতে আর একটু গল্প করে নিতে কোঠাবাড়ির আলসেতে বসেছে।
গোলাবাড়ির কুঁকড়োকে একটিবার চোখে দেখতে, তার একটুখানি খবর শুনে জীবনটা সার্থক করে নিতে পায়রা অনেক দিন ধরে মনে আশা করে আসছে; সাদা মুরগির কাছে ঠিক খবর পাবে মনে করে পায়রা তাকে শুধোতে যাবে, এমন সময় উঠোনের কোণে একটা মাসকলাই চোখে পড়তেই সাদি সেদিকে ‘রও’ বলেই দৌড়ে গেল। সাদিকে কলাইখুঁটতে দেখে সুরকি ছুটে এল, কালি বালি গুলজারি সবাই এসে সাদিকে ঘিরে শুধোতে লাগল, “দেখি, কী পেলি। দেখি, কী খেলি। দেখি দেখি, কী কী।” সাদি টুপ করে মাসকলাইটা গালে ভরে ফিক করে হেসে বললে, “কট্ কট্ কলাট, মা-স ক-লা-ই।” ব’লেই সাদি কোঠাবাড়ির ঘুলঘুলির ধারে যেখানে খাকি চুপটি করে বসে ছিল, সেখানে চলে গেল।
সাদি বললে, “ওলো, ঘুলঘুলিটা খোলা পেলি কি।” খাকি সাদিকে দরমার বীপে একটা ইদুরের গর্ত দেখিয়ে বলছে, “যেমনি ঘণ্টা পড়বে, আর অমনি সে ওই গর্তটায় চোখ দিয়ে...”
এমন সময় পায়রা ডাক দিলে, খুব নরম করে, মিষ্টি করে, “দুধি-ভাতি সাদি সাহাজাদী, ও সফেদি।”
এবার সাদি সাড়া দিলে, “নীলের বড়ি, নীল পোখরাজ। কী বলবে বলো।”
পায়রা খুব খানিক গলা ফুলিয়ে গদগদ সুরে বললে, “যদি একবার, একটিবার, বলব তবে —শুধু একটিবার যদি দেখাও...”
খাকি, সুরকি, গুলজারি সব মুরগি ইতিমধ্যে সেখানে জুটেছিল। তারা সবাই সাদির সঙ্গে বলে উঠল, “কী, কী, কী, কী দেখাব।”
পায়রা অনেকখানি ঢোক গিলে বললে, “তাঁর মাথার মোরগফুলটি যদি একটিবার...”
সব মুরগি হেসে এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ে বলতে লেগেছে, “চায় লা, চায় লা, দেখতে চায়, দেখতে চায়।”
পায়রা বলছে, “দেখবই দেখব, দেখবই দেখব,” আর আলসের উপর গলা ফুলিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
সাদা মুরগি তাকে ধমকে বললে, “অত ব্যস্ত কেন। আলসেটা ভাঙবে নাকি।”
পায়রা ডান চুলকে বললে, “না, না, তবে কিনা আমরা তাঁকে ছেরেদ্ধা করে থাকি..”
সাদি বুক ফুলিয়ে বলে উঠল, “ছেরেদ্ধা কে না করে।”
খোপ ছেড়ে আসবার সময়, কবুতনিকে সে ফিরে এসে যে জগদ্বিখ্যাত পাহাড়তলির কুঁকড়োর রূপ-বর্ণনা শুনিয়ে দেবে, দিব্যি করে এসেছে, সাদিকে পায়রা সে কথা বলে নিলে। সাদি ইতিমধ্যে আবার ধান খুটতে লেগেছিল, সে পায়রার কথার উত্তর দিলে, “চমৎকার, দেখতে চমৎকার, এ কথা সবাই বলবে।”
পায়রা বলছিল, কতদিন খোপের মধ্যে বসে তারা ফুটিতে তাঁর ডাক শুনেছে, নীল আকাশ ভেদ করে আসছে, সোনার সূচের মতো ঝকঝকে সেই ডাক, আকাশ আর মাটিকে যেন বিনি সুতোর মালাখানিতে বেঁধে এক ক’রে দিয়ে। কুঞ্জলতার আড়ালে বেড়ার গায়ে ভাঙা খাচায় তাল-চড়াই এদিক-ওদিক করছিল, হঠাৎ বলে উঠল, “ঠিক, ঠিক, সবারি প্রাণ তার জন্তে ছটফটায়।”
এক মুরগি বলে উঠল, “কার কথা হচ্ছে, আমাদের কুঁকড়োর নাকি।”
চড়াই বলে উঠল, “কুঁকড়ো কি শুধু তোদেরই না তোরাই শুধু তার। তুই মুই সেই, তোরা মোরা তারা, তোদের মোদের তাদের, সবাই তার, সে সবার।”
কিছু দূরে গোবদামুখো পেরু বসে বসে এই-সব কথা শুনছিল, এখন আস্তে আস্তে পায়রার কাছে এসে, কুঁকড়ো যে এল ব'লে এবং এখনি যে সে তার চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে কুঁকড়োকে দেখে জীবন সার্থক করতে পারবে, এই কথা খুব ঘটা করে জানিয়ে দিলে। পায়রা বললে, “পেরু মশায়, আপনিও তাকে চেনেন?”
পেরু গলার থলিট দুলিয়ে বলে উঠল, “আমি চিনি নে! কুঁকড়োকে জন্মাতে দেখলেম, সেদিন।”
কুঁকড়োর জন্মস্থানটা দেখবার জন্যে পায়রা ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠল। পেরু তাকে একটা পুরোনো বেতের পেটরা দেখিয়ে বললে, “এইখানে কুঁকড়োর জন্ম হয় কর্কট রাশিস্থে ভাস্করে, মুক্তোর মতো এক ডিম থেকে।” যে মুরগি এই ডিমে তা দিয়েছিলেন, তিনি এখনো বর্তমান কিনা, শুধোলে পেরু পায়রাকে বললে, “এই পেটরার মধ্যেই তিনি আছেন, এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, বড়ো একটা বাইরে আসেন না, কেবলই ঝিমোচ্ছেন, কুঁকড়োর কথা হলেই যা এক-একবার চোখ মেলেন।” ব'লেই পেরু সেই পেটরার কাছে মুখ নিয়ে বললে, “শুনছ গিন্নি, তোমার কুঁকড়োর এখন খুব বাড়-বাড়ন্ত”—বলতেই পেটরার ডালা ঠেলে বুড়ি মুরগি হেঁয়ালিতে জবাব দিলে, “পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে গো, ভাতে বাড়ে।” জবাব দিয়েই বুড়ি পেটরার মধ্যে মুড়িসুড়ি দিয়ে লুকিয়ে পড়ল।
পেরু বলে উঠল, “আমাদের গিন্নি হেঁয়ালি বলতে খুব মজবুত, মুখে মুখে হেঁয়ালি জুগিয়ে বলতে এঁর মতো দুজন দেখা যায় না। কলির বিষ্ণুশর্মার অবতার কিম্বা চাণক্য পণ্ডিতাও বলতে পারে।” অমনি পেটরার মধ্যে থেকে জবাব হল, “ময়ুর গেলেন লেজ গুড়িয়ে, পেরু ধরলেন পাখা।” “দেখলে, দেখলে” বলতে বলতে পেরু সেখান থেকে সরলেন। পায়রা সাদা মুরগিকে শুধোলে, “শুনেছি নাকি, সুখেও যেমন দুখেও তেমনি, শীতে-বর্ষায় কালে-অকালে তাঁর গলার স্বর সমান মিঠে।”
মুরগি উত্তর দিলে, “ঠিক, ঠিক।”
“শুনেছি তাঁর সাড়া পেলে শিকরে বাজ আর একদণ্ড আকাশে তিষ্ঠে থাকতে পায় না, সবার মন আপনা হতেই কাজে লাগে।”
“ঠিক, ঠিক।”
“শুনেছি, ডিমের মধ্যে যে কচি কচি পাখি তাদেরও রক্ষে করে তাঁর গান,বেজি আর ভাম বাসার দিকে মোটেই আসে না।”
অমনি চড়াই বলে উঠল, “তাওয়ায় চড়ানো ডিমসিদ্ধ খেতে।”
“ঠিক, ঠিক।”
পায়রা এবার আলসে থেকে একেবারে মুখ ঝুঁকিয়ে বললে, “আর শুনেছি নাকি তিনি কী গুণগান জানেন, যার গুণে তিনি নাম ধরে ডাক দিলেই পৃথিবীর রাঙা ফুল, তারা শুনতে পায়, আর অমনি চারি দিকে ফুটে ওঠে, রাজ্যের অশোক শিমুল পারুল পলাশ জবা লাল পারিজাত গোলাপ আর গুল্-আনার?”
“এও ঠিক সত্যি, ঠিক সত্যি।”
আর নাকি যার গুণে এমন হয়, সে-মন্তর জগতে তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না।”
সাদা মুরগি উত্তর দিলে, “না। শুনেছি, তাঁর পিয়ারী যে পাখি, সেওজানেন, কী সে-মন্তর।”
“তাঁর পিয়ারী পাখিরা জানে না বল।”
সাদা মুরগি উত্তর করলে না।
পায়রার একটিমাত্র পিয়ারী— কপোতনী; কাজেই কুঁকড়োর অনেক পিয়ারী শুনে সে একটু চমকে গেল। চড়াই বলে উঠল, “অবাক হলে যে? কুঁকড়োর পিয়ারী অনেক হবে না তো কি তোমার হবে। তুমি তো বল কেবল ঘুঘু, আর তিনি যে নানা ছন্দে গান করেন।”
পায়রা বললে, “কী আশ্চর্য। তাঁর সব চেয়ে পিয়ারী মুরগি, সেও জানে না তবে কী সে মহামন্ত্র।” অমনি সুরকি খাকি কালি সাদি গুলজারি যে যেখানে ছিল, সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “না গো না, জানি না তো, জানি না তো।”
এই-সব কথা হচ্ছে, ইতিমধ্যে দেখা গেল একটি মনুয়া কুঞ্জলতার পাতার উপর এসে বসেছে আর একটা সরু আটাকাঠি আস্তে আস্তে মনুয়াটির দিকে বেড়ার ওধার থেকে এগিয়ে আসছে— কাঠির মাথায় সাপের চক্করের মতো দড়ির ফাঁস।
তাল-চড়াই মনুয়াটিকে দেখছে কিন্তু সেই একটুখানি মনুয়াকে ধরবার জন্যে অত বড়ে ফাঁস-লাগানো আটাকাঠিটা যে এগিয়ে আসছে, সেটা তার চোখে পড়ে নি। সে আপনার মনেই বকে যাচ্ছে, “মন-মনুয়া, বনের টিয়া।” হঠাৎ দূর থেকে কুঁকড়োর সাড়া এল, খবরদারি...। আমনি চমকে উঠে মনুয়া-পাখি ডানা মেলে উড়ে পালাল, আটাকাঠিটা সাঁ করে একবার আকাশ আঁচড়ে বেড়ার ওধারে আস্তে আস্তে লুকিয়ে পড়ল।
চড়াইটা অমনি ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, “দেখলে কুঁকড়োর কীর্তি। এইবার কর্তা আসছেন।”
কুঁকড়ো আসছেন শুনে সবাই শশব্যস্ত। পায়রা এদিক-ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে, তালচড়াই সেটা সইতে না পেরে বললে, “এমনি কী অস্তুত কুঁকড়োর চেহারাখানা। পাকা ফুটিতে ফুটি শজনেখাড়া গুঁজে দাও, মাথার দিকে একটা বিটপালং কিম্বা কতকটা লাল পুঁইশাক, চোখের জায়গায় দুটো পাকা কুল, কানের কাছে ঝোলাও লাল দুটো পুলি-বেগুন, লেজের দিকে বেঁধে দাও আনারসের মুকুটি— বস্, জল্জ্যাস্ত কুঁকড়োটা গড়ে ফেলো।”
পেরু এই কুঁকড়োর রূপ-বর্ণনা খুব মন দিয়ে শুনছিল, আর তাল-চড়াইয়ের বুদ্ধির তারিফ করছিল। পায়রা গলা ফুলিয়ে বললে, “চড়াই ভায়া, তোমার কুঁকড়ো যে সাড়া দেয় না, দেখি।” চড়াই বললে, “ওই ডাকটুকু ছাড়া আর সবখানি ঠিক কুঁকড়ো হয়েছে, না?”
পায়রা রেগে গলা ফুলিয়ে বলে উঠল, “বোকো না, বোকো না, মোটে না, মোটে না, বোকো না।” ঠিক সেই সময় বেড়ার উপরে ঝুপ করে এসে কুঁকড়ো বসলেন। পায়রা দেখলে মানিকের মুকুট আর সোনার বুক-পাটায় সেজে যেন এক বীরপুরুষ এসে সামনে দাঁড়িয়েছেন। সন্ধ্যার আলো তাঁর সকল গায়ে পলকে পলকে রামধনুকের রঙ ধ’রে ঝিকমিক ঝিকমিক করছে, দৃষ্টি তাঁর আকাশের দিকে স্থির। মিষ্টি মধুর সুরে তিনি ডাকলেন, “আ-লো। অ-লো। অ-লো।” তার পর তাঁর বুকের মধ্যে থেকে যেন সুর উঠল,“অতু-ল ফু-উ-ল। আলোর ফুল! আলো— প্রাণের ফুলকি আলো, চোখের দৃষ্টি আলো, এসে ফুলের উপর দিয়ে, শিশির মুছে দিয়ে, এসো পাতায়-লতায় ফুলে ঝিক্মিক। আলোতে ঝিক্মিক— দেখা দিক, সব দেখা দিক, ভিতরে যাক তোমার প্রভা, বাইরে থাক্ তোমার আভা, একই আলো ঘিরে থাক্ শত দিক শতধারে, অনেক আলোর এক আলো, অনেক ছেলের এক মা। তোমার স্তুতি গাই আলোকবাদিন, আলোকের স্তোতা। তোমায় দেখি ছোটো হতে ছোটো, বড়ো হতে বড়ো, নানাতে, নানা কালে— কাচে, মানিকে, মাটিতে, আকাশে, জলে-স্থলে; সকালে জ্বলজ্বল, সন্ধ্যায় ঝিলমিল, মন্দিরে, কুটিরে, পথে বিপথে। ভিখারীর কাঁথার শোভা,রাজার পতাকায় প্রভা— আলো। বনের তলায় সোনার লেখা, সবুজ ঘাসে সোনার চুমকি, আলোর ফুলকি, আলপনা অ-তু-উ-ল অমূল আলো।”
আর-সব পাখি যে-যার কাজে ব্যস্ত ছিল, কেউ ধান খুঁটছিল কেউ গা ঝাড়ছিল,গুলজারি করছিল কিচমিচ, সুরকি মাখছিল ধুলো, খাকি ঘাঁটছিল ছাইপাঁশ, কালি খুঁড়ছিল গর্ত, সাদি মাজছিল গা, পেরু বকছিল বকবক, চড়াই বলছিল ছি-ছি, কেবল সেই আকাশের মতো নীল পায়রা অবাক হয়ে শুনছিল—
জয় জয় আলোর জয়।
পায়রা আর স্থির থাকতে পারলে না, গলা কাঁপিয়ে দুই ডানা ঝটপট করে বলে উঠল, “সাধু সাধু।” কুঁকড়ো আঙিনায় নেমে পায়রাকে দেখে বললেন, “ধন্যবাদ হে অচেনা পাখি, এখনি কি যাওয়া হবে।”
পায়রা বললে, “আপনার দর্শন পেয়ে কৃতার্থ হয়েছি, এখন ঘরে গিয়ে কপোতীকে আপনার আশীর্বাদ দিয়ে চরিতার্থ হই।” কপোতনীর প্রবালের মতো রাঙা পায়ে নমস্কার জানিয়ে কুঁকড়ো কবুতকে বিদায় করলেন। পায়রা তাল-চড়াইয়ের ভাঙা খাঁচায় ডানার এক ঝাপটা মেরে গায়ের দিকে উড়ে গেল।
চড়াইটা গজগজ করতে লাগল, “সুঁড়ির জয় মাতালে কয়।” কুঁকড়ো ডাক দিলেন, “কাজ ভুলো না, কাজ ভুলো না।” আর অমনি রাজহাঁস সে আর চুপচাপ বসে রইল না, পাতিহাঁস, চিনেহাঁস, সব হাঁসগুলোকে দিঘির পাড়ে জল খাইয়ে আনতে চলল। কুঁকড়ো হুকুম দিলেন, যত কুঁড়ে হাঁসের ছানা সবাইকে বেলা পড়বার আগে অন্তত বত্রিশটা করে গুগলি সংগ্রহ করে আনা চাই। একটা বাচ্চা মোরগ, তাকে পাঠালেন কুঁকড়ো বেড়ার উপর দাঁড়িয়ে চারশো'বার ‘ককুর-কু’ বলে গলা সাধতে, এমন চড়া সুরে, যেন ওদিকের পাহাড়ে ঠেকে তার গলার আওয়াজ এদিকের বনে এসে পরিষ্কার পৌঁছয়।
বাচ্চা মোরগ গলা সাধতে একটু ইতস্তত করছে দেখে কুঁকড়ো তাকে আস্তে এক ঠোকর দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, তার বয়েসে তাঁকেও প্রতিদিন ঠিক এমনি করেই গলা সাধতে আর পড়া মুখস্থ কণ্ঠস্থ সবি করতে হয়েছে। বাচ্চ মোরগের মা গুলজারি ছেলের হয়ে কুঁকড়োর সঙ্গে একটু কোদল করবার চেষ্টা করতেই, “যাও, জালার মধ্যে ডিমগুলোতে তা দাও সারারাত।”— গুলজারির উপর এই হুকুম-জারি করে আর-সব মুরগিদের সবজি বাগানে যে-সব পোকা শাক-পাতা কেটে নষ্ট করছে, তার সব কটিকে বেছে সাফ করতে পাঠিয়ে দিয়ে কুঁকড়ো পেটরার মধ্যে তাঁর মায়ের কাছে উপস্থিত। কুঁকড়োর মা তাকে ধমকে বলে উঠল, “এইটুকু বয়েসে তোর এই বিদ্যে হচ্ছে। কেবল টো টো করে ঘুরে বেড়ানো।” কুঁকড়ো একটু হেসে বললেন, “মা, আমি যে এখন মস্ত এক কুঁকড়ো হয়ে উঠেছি।” “যা, যাঃ, বকিস নে। 'বেঙাচি বলাতে চান তিনি কোলা ব্যাং, ওরে বাপু সময়েতে সব হয়, চিল হন চ্যাং।' আজ না হয় হবে কাল।” বলেই কুঁকড়োর মা পেটরার ডালাটা বন্ধ করলেন।
সাদি, কালি, সুরকি, খাকি কুঁকড়োর মার চার বউ। কুঁকড়ো আসতেই তারা বলে উঠল, “ঘরে কুঁড়োটি নেই যে, তার কী করছ।” “চরে খাওগে” বলেই কুঁকড়ো গা-ঝাড়া দিয়ে বসলেন। একদল বসে-বসে খাবে আর পরচর্চা করবে, আর অন্যদল তাদের খোরাক জোগাবার জন্যে খেটে মরবে, কুঁকড়োর পরিবারে সেটি হবার জো নেই, তা তুমি উপোসই কর, আর ন-খেয়েই মর। কাজেই কালি সাদি সবাই যেখানে যা পায়, ছমুঠো খেয়ে নিতে চলল। কিন্তু খাকি— সে নড়তে চায় না, সাদিকে চুপিচুপি বললে, “তোরা যা না, আমি সেই ঘড়ির মধ্যেকার পিউ-পাখির সন্ধানে রইলেম।” বলে খাকি একটা ঝাঁপির আড়ালে লুকোল। আরসব মুরগি গেছে, কেবল সুরকি বসে বসে নখে মাটি খুঁড়ছে মুখ ভার করে, দেখে কুঁকড়ো শুধোলেন, “তোর আজ হল কী।”
সুরকি ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে বললে, “কুঁ-ক বলি—”
কুঁকড়ো গম্ভীর মুখে বললেন, “বলেই ফেল্ না। বনিতার ভনিতার কবিতার কোন্টা বাকি?” উত্তর হল, “বল তো ভালোবাস, কিন্তু—”
“কথাটা চেপে যাও ছোটো বউ, চেপে যাও।” কুঁকড়ো উত্তর করলেন।
ছোটো বউ ছাড়বার পাত্রী নয়, কান্না ধরলে, “না আমি শুনবই।” কুঁকড়ো বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, “আর ছাই শুনবে কি-ই-ই।” কুঁকড়োকে সুরকি একলা পেয়ে কিছু মতলব হাসিলের চেষ্টায় আছে সব মুরগিই সেটা এঁচেছিল। তারা খাবারের চেষ্টায় কেউ যায় নি। এখন সাদি এক-কোণ থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে বললে, “তোমার পাটরানী আমি, সাদি।” কুঁকড়ো বিষম গম্ভীর হয়ে বললেন, “কে বললে— না।” সাদি একটু গলা চড়িয়ে বললে, “আমায় বলতেই হবে।” ইতিমধ্যে এক দিক থেকে কালি এসে বলছে, খুব বিনিয়ে বিনিয়ে, “কও, আমি তোমার সু-ও-রা-নী।” কুঁকড়ো ঠিক তেমনি সুরে উত্তর করলেন, “কি— না— বল— গা।” কালি সুর ধরলে “বল না, বল না...” অমনি সাদি বলে উঠল, “মন্তরটা কী? যার গুণে তুমি গুণীর মতো গান গাও?” কাছে ঘেঁষে সুরকিও সুর ধরলেন, “হ্যাঁগা, শুনেছি তোমার গলার মধ্যে একটা পিতলের রামশিঙে পরানো আছে, আর তাতেই নাকি লোকে তোমার নাম দিয়েছে আম-পাখি।”
কুঁকড়ো ব্যাপার বুঝে খুব খানিকটা হেসে মাথা হেলিয়ে বললেন, “আছে তো আছে। এই গলার একেবারে টুঁটির ঠিক মাঝখানে খুব শক্ত জায়গায় সেটা লুকোনো আছে, খুঁজে পাওয়া শক্ত।” বীজমন্তরটা মুরগিদের কানে দেবার জন্যে কুঁকড়ো মোটেই ব্যস্ত ছিলেন না, তবু খুব চুপিচুপি তাদের প্রত্যেকের কানের কাছে মুখ নিয়ে নিয়ে বললেন, “দেখে, মাঠের মধ্যে যখন চরতে যাচ্ছ, তখন খবরদার ঘাসের ফুল মাড়িয়ে না, ফুলের পোকা খেয়ে কিন্তু ফুল যেন ঠিক থাকে। খবরদার, যা-ও।”
মুরগিরা চলে যাচ্ছিল, কুঁকড়ো তাদের ডেকে বললেন, “জানে, যখন যাবে চরতে—”
এক মুরগি পাঠ বললে, “বাগিচায়”। কুঁকড়ে বললেন, “পয়লা মুরগি—” ইস্কুলের মেয়েদের মতো সব মুরগি একসঙ্গে বলে উঠল, “আগে যায়।” কুঁকড়ো হুকুম দিলেন, “যা— ও।” মুরগির যাচ্ছিল, কুঁকড়ো তাড়াতাড়ি তাদের ডেকে সাবধান করে দিলেন, “সড়ক পার হবার সময় রাস্তায় কী আছে, তা খুঁটে নেবার চেষ্টা করা ভুল, গাড়িচাপা পড়তে পার।”
মুরগিরা ভালোমানুষের মতো বেড়ার ফাঁকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কুঁকড়ো চারি দিক দেখে বললেন, “তুই তিন চার, সিধে হও পার।” ঠিক সেই সময় দূরে মটরগাড়ির ভেঁপু বাজল, “হাউ মাউ— খাউ।” কুঁকড়োর অমনি সাড়া পড়ল— ভেঁপুর চেয়ে জোর আওয়াজ— ‘স বু-উ-উ-র। বেড়ার ধার দিয়ে সাঁ-করে খানিক ধুলো আর ধোঁয়া গড়াতে গড়াতে চলে গেল। মিনিট কতক পরে যখন সব পরিষ্কার হল, তখন কুঁকড়ো মুরগিদের যাবার পথ ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়ালেন। একে একে মুরগির চলল, সাদি খাকি গুলজারি। সুরকি সব-শেষে। সে কুঁকড়োকে বলে গেল, “কাব্যাৎ, যা-খাই তাতেই আজ তেল-তেল গন্ধ করছে, যেন তেলাকুচোর তেলফুলুরি।” বাপির আড়ালে খাকি মুরগি, সে মনে মনে বললে, রক্ষে, তিনি আমাকে দেখেন নি, বাঁচলেন বাপু।