আলোর ফুলকি/২
২
সাদি, কালি, গুলজারি— এরা সবাই সেটা জানবার জন্য ধরাধরি করছে। পায়রা থেকে চড়াই এমন-কি, টিকটিকি পর্যন্ত পাহাড়তলির এ-পাড়া ও-পাড়ার ছেলেবুড়ো যে যেখানে আছে, সবাই যে লুকোনো জিনিসের কথা বলাবলি করছে, কুঁকড়ো সেই লুকোনো জিনিসের খবরটা বুকের মধ্যে নিয়ে বসে আছেন; কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেন না, অথচ না বললেও বুক যে ফেটে যায়। অতি গোপনীয় বীজমন্ত্রটি যার কানে চুপিচুপি বলে দেওয়া চলে, এমন উপযুক্ত পাত্র— সে কোথা। এ যে অতি গোপন কথা, অতি নিগুঢ় রহস্য। মেয়ের তো এ কথা একটি দিন চেপে রাখতে পারবে না। বিশেষত সাদি কালি মুরকি আর খাকি এমনি সব গুলবাহারি গুলজারি, যাদের মুখ চলছেই, তাদের এ কথা একেবারেই বলা যেতে পারে না, শোনবার জন্যে তাঁরা যতই ইচ্ছুক থাকুক-না কেন। না, বুক ফেটে যায় যাক, মনের কথা মনেই থাক্, গুপ্ত মন্তর, অন্তরের ভাবনা মন থেকে দূর করে যেমন আর সবাই, তেমনি আমিই বা কেন না থাকি— দিব্যি আরামে, পাহাড়তলির রাজবাহাদুর কুঁকড়ো। এইটুকুই যথেষ্ট, আর এইটুকুতেই আমার আনন্দ, কিমধিকমিতি। মনে মনে এই তর্কবিতর্ক করতে করতে বুক ফুলিয়ে কুঁকড়ো ধানের মরাইটার চার দিকে পা-চালি করছেন, আর এক-একবার নিজের দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে নিজেকে নিজে তারিফ করছেন, ‘ক্যা খপ্ -সু রতি ই-ই’। তাঁর মাথার মোরগফুলটা আর চোখের কোল থেকে ঝুলছে যে দাড়ি, তার মেহেদি রঙটা যে বনের টিয়া থেকে আরম্ভ করে লাল তুতির লালকেও হার মানিয়েছে, এটা কুঁকড়োকে আর বুঝিয়ে দিতে হল না। তিনি খড়ের গাদার উপরে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে একবার, মাঠের দিকে একবার, তাকিয়ে দেখলেন; সোনা আর মানিকের আভায় জল স্থল আকাশ রাঙিয়ে সন্ধ্যাটি কী চমৎকার সাজেই সেজে এসেছে। “আজকের মতো দিনের শেষ কাজ সাঁঝি-আলপনা দেওয়া হল, আজ করবার যা, তা সারা হয়েছে, কালকের চিন্তা কাল হবে, এখন আর কী, দুমুঠো যা জোটে, খেয়ে নিতে ছু-টি-ই-ই।” বলেই কুঁকড়ো একটিবার ডাক দিয়ে চালাঘরের মটকা থেকে নেমে বাসার দিকে দৌড়ে যাবেন, ওদিক থেকে শব্দ এল, 'রও-ও-ও'! উঠানের মধ্যে শুকনো ঘাসের বোঝাটা একবার খসখস করে উঠল, আর তার তলা থেকে জিম্মা কুত্তানী খড় আর কুটোয় ঝাঁকড়া মাথাটা বের করে জুলজুল করে কুঁকড়োর দিকে চাইতে লাগল।
কুঁকড়ো আর কুকুরের চেহারায় মিল না হলেও নামে নামে যেমন কতকটা, কাজেওতেমনি অনেকটা মিল ছিল। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন দুজনেরই জীবনের ব্রত। কাজেই দুজনে যে ভাব খুবই হবে, তার আশ্চর্য কী। তা ছাড়া সূর্য আর মাটি হয়েরই পরশ দুজনেরই ভালো লাগে। এই আকাশের আলো আর পৃথিবীর উপর ভালোবাসা এই দুটি জীবকে যেন একসূত্রে বেঁধেছে। সূর্যের দিকে মুখ করে মাটির কোলে দুই পা রেখে না দাঁড়ালে কুঁকড়োর গান মোটেই খোলে না; আর কুকুর তার আনন্দই হয় না, রোদে মাটির উপরে একএকবার না গড়িয়ে নিলে। জিন্মা প্রায়ই বলে, “সূর্যকে ভালোবাসে বলেই না সে চাঁদ দেখলেই তাড়া করে যায়, আর মাটিকে ভালোবাসে বলেই না সে গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মুখটি দিয়ে চুপটি করে থাকে।” ভালোবাসার বশে জিন্মা বাড়ির বাগানটায় এত গর্ত করে রাখত যে এক-একদিন বুড়ো ভাগবত মালি কর্তার কাছে কুকুরের নামে নালিশ জুড়ত। কিন্তু জিন্মার সব দোষ মাপ ছিল, গোলাবাড়ির সব জানোয়ারের খবরদারি, ক্ষেতে না গোরুবাছুর ঢোকে তার দিকে নজর রাখা, এমনি সব পাহারার কাজে জিম্মার মতো আর তো দুটি ছিল না। তা ছাড়া জিম্মার জিন্মায় অমন যে কুঁকড়ো এমন-কি, তাঁর অত্যাশ্চর্য সুরটি পর্যন্ত রাত্রে না রাখলে চলে না; কাজেই কুকুর হঠাৎ যখন বললে, ‘রও' তখন যে একটা বিপদের সম্ভাবনা আছে, সেটা জানা গেল। কিন্তু এমন কী বিপদ হতে পারে। কুঁকড়ো দেখলেন, অন্যদিন যেমন আজও সন্ধ্যাবেল ঠিক তেমনি চারি দিক নিরাপদ বোধ হচ্ছে, অন্তত তাঁর এই গোলাবাড়ির রাজত্বের বেড়ার মধ্যে কোনো যে শত্রু আছে, তা তো কিছুতেই মনে হয় না। সে যে মিছে ভয় পাচ্ছে সেটা তিনি জিম্মাকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। ভয় কাকে বলে কুকুরের জানা ছিল না; কিন্তু মিথ্যুক আর মিছে নিন্দে রটাতে গোলাবাড়িতে আর পাড়াপড়শীর ঘরেতে যারা, তাদের সে ভালোরকমই জানত। কুঁকড়ো না জানলেও ঐ বোঁচা-ঠোঁট চড়াই আর ডিগডিগে-পা ময়ূর যে কুঁকড়োর দুই প্রধান শত্রু, সেটা জিন্মা কুঁকড়োকে জানিয়ে দিতে বিলম্ব করলে না। তালচড়াই, যার নিজের কোনো আওয়াজ নেই, হরবোলার মতো পরের জিনিস নকল করেই চুলবুল করে বেড়ায়, পরের ধনে পোদ্দারি যার পেশা, আর ঐ ময়ুর, জরি-জরাবৎ আর হীরে-মানিকের ঝকমকানি ছাড়া আর-কোনো আলো যার ভিতরে বাহিরে কোথাও নেই, দরজি আর জহুরির দোকানের নমুনো-ঝোলাবার আলনা ছাড়া আর কিছুই যাকে বলা যায় না, এই অদ্ভুত জানোয়ার তাঁর প্রধান শত্রু শুনে কুঁকড়ো একেবারে 'হাঃ হাঃ' করে হেসে উঠলেন। জিন্মা বললে, “কারে সঙ্গে খোলাখুলি শক্রতা করবার সাহস আর ক্ষমতা না থাকলেও এর সবাইকে হেয় মনে করে, এমন-কি, কুঁকড়োর নিন্দেও সুবিধা বুঝে করতে ছাড়ে না। এবং খাওয়া-পর-সাজগোজের দিক দিয়েও এরা পাড়ার মধ্যে নানা বদ চাল ঢোকাচ্ছে। এদের দেখাদেখি অন্যরাও বেয়াড়া বেচাল বে-আদব হয়ে ওঠবার জোগাড়ে আছে। সাদাসিধেভাবে খেটেখুটে পাড়াপড়শীকে ভালোবেসে আনন্দে থাকতে চায় যে-সব জীব, তাদের এই-সব সাজানো পাখিরা বলে, “ছা-পোষার“দল। আর নিষ্কর্মা বসে-থাকা পালকের গদিতে কিম্বা মাথায় পালক গুঁজে হাওয়া খেয়ে ঘুরঘুর করাকেই এরা বলে চাল। সেটা রাখতে চালের সব খড় উড়ে গেলেও এর নিজের বুদ্ধির প্রশংসা নিজেরাই করে থাকে, আর অনেক সুবুদ্ধি পাখির মাথা ঘুরিয়ে দেয় দুর্বুদ্ধি এই দুই অদ্ভূত জানোয়ার, কথা-সর্বস্ব হরবোলা আর পাখা-সর্বস্ব চালচিত্র।”
কুঁকড়ো কাজে যেমন দড়ো, বুদ্ধিতে তেমনি; চড়াই আর ময়ূরের চেয়ে অনেক বড়ো, দিলদরিয়া, কাজেই পৃথিবীতে অন্তত এই গোলাবাড়িতে যে তাঁর কেউ গোপনে সর্বনাশের চেষ্টায় আছে, এটা বিশ্বাস করা কুঁকড়োর পক্ষে শক্ত। তিনি বললেন, “জিন্মা নিশ্চয়ই একটু বাড়িয়ে বলছে, অন্যের সামান্য দোষকে সে এত যে বড়ো করে দেখছে, সে কেবল তাঁকে সে খুবই ভালোবাসে বলে। চড়াই হল তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু আর ময়ুরটা লোক তো খুব মন্দ নয়। আর যদিই বার্তার শত্রু সবাই হয়, তাতেই বা ক্ষতি কী। তিনি তার গান এবং মুরগিদের ভালোবাসা পেয়েই তো সুখী, নেইবা আর কিছু থাকল।”
জিন্মা অনেকদিন এই গোলাবাড়িটায় রয়েছে, এখানকার কে যে কেমন, তা জানতে তার বাকি ছিল না। কুঁকড়োর উপরে মুরগিদেরও যে খুব টান নেই, তারও প্রমাণ অনেকবার পাওয়া গেছে। “বিশ্বাস কাউকে নেই।” বলেই জিম্মা এমনি এক হুংকার ছাড়ল যে পাঁচিলের গায়ে চড়াই পাখির খাঁচাটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। “ব্যাপার কী!” বলে চড়াই কুঞ্জলতার মাচা বেয়ে নীচে উপস্থিত। জিন্মা চড়াইকে সাফ জবাব দেবার জন্যে চেপে ধরলে। আড়ালে একরকম আর কুঁকড়োর সামনে অন্যরকম ভাব দেখানে আর চলছে না। বলুক সে-চড়াইটা সত্যিই কুঁকড়োকে পছন্দ করে কি না, না হলে আজ আর ছাড়ান নেই। চড়াই মনে মনে বিপদ গুনলে। কিন্তু কথায় তার কাছে পারবার জো নেই। সে অতি ভালোমানুষটির মতো উত্তর করলে, “কুঁকড়োকেও টুকরো-টুকরো ক’রে দেখলে বাস্তবিকই আমার হাসি পায়; আর তার খুঁটিনাটি এটি-ওটি নিয়েই আমি তামাশা করে থাকি। কিন্তু সবখানা জড়িয়ে দেখলে কুঁকড়োকে আমার শ্রদ্ধাই হয় বলতে হবে। শুধু তাই নয়, কুঁকড়োর খুঁটিনাটি নিয়ে আমি যে ঠাট্টা-তামাশাগুলো করে থাকি, সেগুলো সবাই যে অপছন্দ করে না, সে তো তুমিও জানো জিন্মা।”
জিম্মা ভারি বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, “শোনো একবার, কথার ভাঁওরাটা শোনো। বাইরের বনে সোনার আলো, ফুলের মধু থাকতে যে পাখিটা দরজা-ভাঙা খাঁচায় বসে বাসি ছাতু খেয়ে পেট ভরাচ্ছে, তার কাছে পরিষ্কার জবাব আশা করাই ভুল।”
চড়াই বলে উঠল, “সাধ করে কি আমি খাচায় বাসা বেঁধেছি। বাইরে সোনার আলো আর সোনালি মধু সময়ে সময়ে যে শীসের গরম-গরম ছররা গুলি হয়ে দেখা দেয় দিদি।”
জিন্মা ভারি চটেছিল। উত্তর করলে, “আরে মুখখু, কোন্দিন কবে একটা-আধটা কার্তুজের খোলা ঢেলার মতো খুরে লাগল বলে বনের হরিণ সে কি কোনোদিন বনের থেকে তফাত থাকতে চায়, না আকাশে বাজ আছে বলে কেউ আকাশের আলোটা আর আকাশে ওড়াটা অপছন্দ করে। ভাঙা খাঁচার পুষ্যিপুত্তর হরবোলা। ফুলে-ফলে আলোতে-ছায়ায় অতি চমৎকার বনে-উপবনে যে মুক্তি, তুই তার কী বুঝবি।”
চড়াই উত্তর দিলে, “বেঁচে থাক্ আমার ভাঙা খাচার দাঁড়খানি। কাজ নেই আমার মুক্তিতে। রাজার হালে আছি, পরিষ্কার কলের জল খাচ্ছি, মস্ত সাবানদানিতে দুবেলা গরমের দিনে নাইতে পাচ্ছি, দোলনা চৌকি, চানের টব বনে এ-সব পাই কোথা, বলে তো দিদি।”
জিন্মা এমন রেগেছিল যে, গলার শিকলিট খোলা পেলে সে আজ চড়াইটার গায়ের একটি পালকও রাখত না, মেরেই ফেলত।
এই ব্যাপার হচ্ছে, এমন সময় বাড়ির মধ্যে ঘড়ি বাজল, ‘পি-উ'।
যেমন ‘পিউ' বল, অমনি খাকি মুরগি ঝুড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে সেদিকে দৌড়। গর্তের মধ্যে মুখ দিয়ে সে কিন্তু কিছুই দেখতে পেলে না; এবারও তার আশা পুরল না, সময় উতরে গেছে, পিউ-পাখি পালিয়েছে।
চড়াই খাকিকে বললে, “কী দেখছ গো। এক-পহরের ঘড়ি পড়ল নাকি।”
কুঁকড়ো খাকিকে গোলাবাড়িতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “তুই যে চরতে যাস নি?”
খাকি চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে ডানার ঘোমটায় মুখ ঝাঁপলে।
কুঁকড়ো শুধোলেন, “গর্তটার মধ্যে মুখ গুঁজড়ে হচ্ছিল কী, শুনি।” খাকি আমতা-আমতা করে বললে, “এই চোখ আর ঘাড়ট টনটন করছিল—”
“কাকে দেখবার জন্যে।” কুঁকড়ো শুধোলেন। খাকি বললে, “কাকে আবার” কুঁকড়ে বললেন, “হা, শুনি, কাকে।”
খাকি কান্নার স্বর ধরলে, “তুমি বল কি গো।” কুঁকড়ো ধমকে বললেন, “চোপরাও, সত্যি কথা বল।” খাকি বিনিয়ে-বিনিয়ে বললে, “পিউ পাখিকে।”
কুঁকড়ে খাকির দিক থেকে একেবারে মুখ ফেরালেন, খাকি আস্তে আস্তে পগার পারে দৌড় দিলে।
কুঁকড়ো কুকুরকে বললেন, “একটা ঘড়িকে ভালোবাসা, এমন তো কোথাও শুনি নি। এ বুদ্ধি খাকিকে দিলে কে বলে তো।”
“ওই ছিটের মেরজাই-পর চিনে মুরগিটার কাজ।” কুকুর উত্তর দিলে।
কুঁকড়ো শুধোলেন, “কোন্ মুরগিটি, বলে তো। ওই যেটা বুড়ো বয়েসে ঠোঁটে আলতা দিয়ে বেড়ায় সেইটে নাকি।”
কুকুর উত্তর করলে,“হঁ। হাঁ, সেই বটে। তিনি যে আবার সবাইকে বৈকালি পার্টি দিচ্ছেন।”
“কোথায় সেটা হচ্ছে।” কুঁকড়ো শুধোলেন।
চড়াই উত্তর দিলে, “ওই কুল গাছটার তলায় যেখানে পাখি তাড়াবার জন্যে একটা খড়ের সাহেবি কাপড়-পরা কুশোপুতুলের কাঠামো মালী খাড়া করে রেখেছে, সেইখানে। খুব বাছা-বাছা নামজাদা পাখিরাই আজ যাবেন। কাঠামোর ভয়ে ছোটোখাটো পাখিরা সেদিকে এগোতেই সাহস পাবে না।”
কুঁকড়ো আশ্চর্য হয়ে বললেন, “বল কি, চিনে মুরগির বৈকালি।”
চড়াই ঠিক তেমনি সুরে উত্তর দিলে, “হাঁ মশায়, প্রতি সোমবার পাঁচ হইতে ছয় ঘটিকা পর্যন্ত মুরগি-গিন্নির ঘোরো মজলিস হইয়া থাকে।”
“তা হলে আজ বৈকালে—”কুঁকড়ো আরো কী শুধোতে যাচ্ছিলেন, চড়াই বলে উঠল, “না, আজ ভোরবেলায়।”
“ভোরবেলায় বৈকালি তো কখনো শুনি নি হে।” কুঁকড়ো আশ্চর্য খুবই হলেন। চড়াই তখন কুঁকড়োকে বুঝিয়ে দিলেন, “ভোর পাঁচটায় বাগানে মালী তো থাকে না, তাই বিকেল ৫টা না করে সকাল ৫টাই ঠিক হয়েছে।”
“এ কী বিপরীত কাও।” বলে কুঁকড়ে ‘হো হো' করে হেসে উঠলেন। চড়াই অমনি বলে উঠল, “বিপরীত বলে বিপরীত।” জিন্মা তাকে ধমকে বললে, “তোমার আর খোশামুদিতে কাজ নেই, তুমি নিজে তো কোনো সোমবারে পার্টিগুলো কামাই দাও না দেখি।”
চড়াই উত্তর করলে, “সত্যি যাই বটে, সবাই আমাকে খাতির করে কিনা।”
জিম্মা গজগজ করে খানিক কী বকে গেল। জিন্মা কী বকছে শুধোলে কুঁকড়োকে সে জবাব দিলে, “কোনদিন হয়তো তোমাকেও কোন্ -এক মুরগি এই পার্টিতে নিয়ে হাজির করেছে, দেখব।”
কুঁকড়ো হেসে বললেন, “আমাকে হাজির করে দেবে, চা-পার্টিতে, কোনো এক মুরগি।”
জিন্মা বললে, “হাঁ মশায়, এমনি হাজির করা নয়, মাথার ঝুঁটিটি ধরে টানতে টানতে না হাজির করে।”
কুঁকড়ো একটু চটেই জিন্মাকে বললেন, “এ সন্দেহটা তোমার করবার কারণটি কী।”
জিন্মা জবাব দিলে, “কারণ নতুন মুরগির দেখা পেলে মশায়ের মাথা সহজেই ঘুরে যায় এখনো।”
চড়াই বলে উঠল, “জিন্মা-দি ঠিক বলেছে, নতুন মুরগি যেমন দেখা, অমনি কুঁকড়ো-মশায় এমনি করে ঘাড় বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে 'কুক কুক’ বলে নৃত্য করতে থাকেন, মুরগিটির চারি দিকে।” বলে চড়াইটা একবার কুঁকড়োর চলনবলন হুবহু দেখিয়ে দিলে।
কুঁকড়ো হেসে বললেন, “আচ্ছা বেকুফ পাখি যাহোক।”
চড়াইটা তখনো ডান কাঁপিয়ে লেজ তুলিয়ে কুঁকড়োর মতো তালে তালে পা ফেলে মোরগ মুরগির নকল দেখাচ্ছে, ঠিক সেই সময় ওদিকে হম করে বন্দুকের আওয়াজ হল। চড়াই অমনি কাঠের পুতুলের মতো এক পা তুলেই দাঁড়িয়ে গেল। কুঁকড়ো গলা উঁচু ক'রে, আর কুকুর কান খাড় ক’রে নাক ফুলিয়ে শুনতে লাগল। আর-এক গুলির আওয়াজ। চড়াইট গিয়ে মুরগি-গিরির ভাঙা পেটরার আড়ালে লুকিয়েছে, এমন সময় উহু-উ-উ-উ বলতে বলতে সোনার টোপর সোনালিয়া বন-মুরগি কুঞ্জলতার বেড়ার ওপার থেকে ঝপাং করে উড়ে এসে উঠোনের মধ্যে পড়ল।
কুঁকড়ে বলে উঠলেন, “একী। এ কে! কে এ।”
সোনালিয়া কুঁকড়োর কাছে ছুটে গিয়ে বললে, “পাহাড়তলির ‘সা মোরগ’, আপনি আমায় রক্ষে করুন।” আবার দুম করে আওয়াজ। সোনালিয়া চমকে উঠেই অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লেন, পালাবার আর শক্তিই ছিল না। কুঁকড়ো অমনি একখানি ডানা বাড়িয়ে সোনালিয়াকে তুলে ধরে আর-এক ডানার ঝাপটা দিয়ে গামলা থেকে জলের ছিটে আর বাতাস দিতে থাকলেন খুব আস্তে আস্তে। তাঁর ভয় হচ্ছিল পাছে পাতার সবুজ, ফুলের গোলাপি, সোনার জল আর সন্ধ্যাবেলার আলো দিয়ে গড়া বাসন্তী শাড়িপরা এই আশ্চর্য পাখিটি জল পেয়ে গলে যায়, কি বাতাসে মিলিয়ে যায়। একটু চেতন পেয়ে সোনালিয়া আবার কুঁকড়োকে মিনতি করতে লাগল, “ওগো একটু আমায় লুকোবার স্থান দাও, আমাকে পেলে তারা মেরেই ফেলবে।”
চড়াই সোনালিয়ার গায়ে টকটকে লাল সাটিনের কাঁচুলি দেখে বললে, “এতখানি লালের উপর থেকে শিকারীর বন্দুকের তাগ কেমন করে যে ফসকাল, তাই ভাবছি।”
সোনালিয়া বললে, “সাধে কি গুলি ফসকেছে, চোখে যে তাদের ধাঁধা লেগে গেল। তারা মনে করেছিল, ঝোপের মধ্যে থেকে ছাই রঙের একটা তিতির-মিতির কেউ বার হবে, কিন্তু আমি সোনালি যখন হঠাৎ বেরিয়ে গেলুম সামনে দিয়ে তখন শিকারী দেখলে খানিক সোনার ঝলকা, আর আমি দেখলেম একটা আগুনের হলকা। গুলি যে কোন্দিকে বেরিয়ে গেল কে তা দেখবে। কিন্তু ডালকুত্তোটা আমায় ঠিক তাড়া করে এল। কুকুরগুলো কী বজ্জাত।” এমন সময় জিম্মাকে দেখে “অন্য কুকুর নয়, ওই ডালকুত্তোগুলোর মতো বজ্জাত দেখি নি, বাপু।” এই বলে সোনালিয়া একটু লুকোবার স্থান দেখিয়ে দিতে কুঁকড়োকে বারবার বলতে লাগল। কুঁকড়ো একটু সমিস্যায় পড়লেন। আগুনের ফুলকি এই সোনালিয়া পাখি, একে কোন্ ছাইগাদায় তিনি লুকোবেন। তিনি দু-একবার এ-কোণ ও-কোণ দেখে, এখানটা-ওখানটা দেখে বললেন, “না, এঁকে আর রামধনুককে লুকোতে পারা কঠিন।”
জিম্মা বললে, “আমার ওই বাক্সটার মধ্যে লুকোতে পার যেতে পারে,ইনি যদি রাজি হন।”
“ভালো কথা।” বলেই সোনালি গিয়ে বাক্সে সেঁধোলেন, কিন্তু অনেকখানি সোনালি আঁচল বাক্সের বাইরে ছড়িয়ে রইল, জিম্মা সেটুকু ঢেকে চেপে গম্ভীর হয়ে বসল।
জিন্ম বেশ বাগিয়ে বসেছে, এমন সময় বেড়ার ওধার থেকে ঝোলা-কান গালফুলো ডালকুত্তে ‘তম্মা’ উকি দিলেন। জিম্মা যেন দেখতেই পায় নি এই ভাবে রুটিই চিবচ্ছে। তম্মা বললে, “উঃ কিসের খোসবো ছাড়ছে।” জিম্মা সামনের থালাখানা দেখিয়ে বললে, “আজ একটু বনমুরগির ঝোল রাঁধা গেছে।”
ডালকুত্তো এবার পষ্ট করে শুধোলে, জিন্ম এদিকে একটা সোনালিয়া পাখিকে আসতে দেখেছে কিনা। কুঁকড়ো সে কথা চাপা দিয়ে বলে উঠলেন, “তম্মার মুখটা কেমন গোমস দেখাচ্ছে-না, জিম্মা।”
জিম্মা ধীরে সুস্থে উত্তর করলে, “একটা সোনালী টিয়ে মাঠের উপর দিয়ে উড়ে গেল দেখিছি, ওই ওদিকে—।” তম্মাটা আকাশে নাক তুলে কেবলি শুঁকতে লেগেছে, বনমুরগির গন্ধটা সত্যিই জিম্মার থালা থেকে আসছে কি না। কুঁকড়োর বুকের ভিতরটা বেশ একটুখানি গুরগুর করছে, এমন সময় দূর থেকে শিকারী সিটি দিয়ে তম্মাকে ডাক দিলে। তম্মা চলল দেখে কুঁকড়ো আর জিম্মা “রাম বলো” বলে হাফ ছাড়তেই চড়াইট ডাক দিলে, “বলি তম্মা।”
“করো কী।” বলে কুঁকড়ো তাকে এক ধমক দিলেন, কিন্তু চড়াইটা আরো চেঁচিয়ে বলে উঠল, “বলি, ও তম্মা।” তম্মার গোমসা মুখটা আবার বেড়ার উপর দিয়ে উঁকি দিলে। কুঁকড়ো রেগে ফুলতে লাগলেন, চড়াই তম্মাকে বললে, “খুঁজে খুঁজে নারি যে পায় তারি।”
তম্মা শুধোলে, “কী খুঁজে দেখি, বলো তো ভাই?”
“চটপট তোমার ফোগলা গালের চির-খাওয়া দাঁতটি।” বলেই চড়াই সট করে নিজের খাঁচায় ঢুকল; “চোপরাও” বলে তম্মা সে তল্লাট ছেড়ে চোঁচা চম্পট।