ডালকুত্তোটা মাঠের ওপারে চলে গেছে। কুঁকড়ো সবাইকে অভয় দিয়ে ঘরের মটকা থেকে হাঁক দিলেন, “ত-ত-তফাত গিয়া।” অমনি সে-মোনালিয়া বাক্সের মধ্যে থেকে বেরিয়ে উঠোনময় নেচে বেড়াতে লাগল যেন আলোর চরকিবাজি। কুঁকড়ে তার সেই ঝকঝকে রূপ দেখে ভারি খুশি হয়ে মনে মনে বললেন, ‘আহ, এমন পাখিকেও কেউ গুলি করে। এর দিকে বন্দুক করা, আর একটি মানিকের পিদুমে তাগ করা একই।’ মোনালির কাছে আস্তে আস্তে এসে কুঁকড়ো শুধোলেন, “সূর্যের আলোর মতো কোন্‌ পুব-আকাশের সোনার পুরীথেকে তুমি এলে সোনালিয়া বনমুরগি।”

 মোনালি মাখমের মতো নরম স্বরে বললে, “আমি ওই বনে আছি বটে কিন্তু ওটা তো আমার দেশ নয়।” কুঁকড়ো তার সবচেয়ে মিষ্টি স্বরে শুধোলেন, “তবে কোথায় তোমার দেশ সোনালিয়া বিদেশিনী।” মোনালি উত্তর করলে, “তা তো মনে নেই। শুনেছি বরফের পাহাড়ের ওপারে যে-দেশ, সেখানকার মাটি ফুল-কাটা গালচেতে একেবারে ঢাকা, সেইখানের কোন অশোক বনের রানীর মেয়ে আমি। আমার একটু একটু স্বপ্নের মতো মনে পড়ে— চমৎকার নীল আকাশের তলায় বড়ো বড়ো গাছের ছাওয়ায় সখীদের সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছি অশোক বনের দুলালী। আমাদের ঘরের চারি দিকে কত রঙের ফুল ফুটেছে, ভোমরা সব উড়ে উড়ে পদ্মের মধু খেয়ে যাচ্ছে। কেবল পাখি আর প্রজাপতি আর ফুল। একটাও শিকারী ডালকুত্তো নেই। মানুষরা পর্যন্ত সেখানে আমাদের মতো চমৎকার সব রঙিন সাজে সেজে রাজা-রানীর মতো বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নন্দন-কাননে আনন্দে ঘুরে বেড়াতেই আমি জন্মেছি, ডালকুত্তোর তাড়া খেয়ে ছুটোছুটি করে মরতে তো নয়। আহা, সেখানকার সূর্যের লাল আভা রক্ত-চয়ন আর কুসুম-ফুলের রঙে মিশিয়ে বুকে মেখে রেখেছি, এই দেখো।” ব'লে সোনালিয়া কুঁকড়োর গা-ঘেঁষে দাড়াল। কুঁকড়ো আনন্দে ডগমগ হয়ে ঘাড় ছলিয়ে ডানা কাঁপিয়ে তালে তালে পা ফেলে সোনালিয়ার চারি দিকে খানিক নৃত্য করে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বললেন, “মনো মোনালিয়া। শোনো সোনালিয়া বিদেশিনী বনের টিয়া—” হঠাৎ মোনালি বলে উঠল, “ইস্।” কুঁকড়ো একটু খতমত খেয়ে গেলেন। বুঝলেন সোনালিয়া সহজে ভোলবার পাত্রী নয়। যে-কুঁকড়ো তাদের দিকে একটিবার ঘাড় হেলালে সাদি কালি গোলাপি গুলজারি সব মুরগিই আকাশের চাঁদ হাতে পায় মনে এমনি করে সেই জগৎবিখ্যাত কুঁকড়োকে মোনালি মুখের সামনে শুনিয়ে দিলে যে জগতের সবাই যাকে ভালোবাসে এমন কুঁকড়োয় তার দরকার নেই! সে বেছে বেছে সেই কুঁকড়োকে বিয়ে করবে যার নাম-যশ কিছুই থাকবে না; থাকবার মধ্যে থাকবে যার মনমোনালিয়া বনের টিয়া একমাত্র মুরগি।

 কুঁকড়ো খানিক চুপ করে থেকে বললেন, “একবার গোলাবাড়ির চার দিক দেখে আসবেন চলুন।” বলে তিনি সোনালিয়াকে খুব খাতির করে সব দেখাতে লাগলেন। প্রথমেই, যেটা থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়লে সোনালিয়ার মুখে চোখে জল ছিটিয়ে কুঁকড়ো তাকে বাচিয়েছিলেন সেই টিনের গামলাটা আর যে কাঠের বাক্সটায় সোনালিয়াকে লুকিয়ে রেখে তন্মার চোখে ধুলো দিয়েছিলেন সেই ছটাে জিনিস দেখিয়ে বললেন, “এগুলো নতুন কিনা, কাজেই কুচ্ছিৎ; কিন্তু পুরোনো দেয়াল, ভাঙা বেড়া, ফাটা দরজা, পুরোনো ওই মুরগির ঘরটি আর কতকালের ওই লাঙল, ধানের মরাই আর ওই শেওলায় সবুজ খিড়কির হুয়োর আর পানাপুকুর আর ওই কুঞ্জলতার থোকা-থোকা ফুল, কী স্বন্দর এগুলি।”

 সোনালিয়া কোনোদিন তো ঘরকন্নার ব্যাপার দেখে নি, সে কেবলি কুঁকড়োকে শুধোতে লাগল, “এ-সব নতুন জিনিসের মধ্যে থাকায় কোনো ভয় নেই তো।” কুঁকড়ে তাকে বললেন, “আমরা বেশ নির্ভয়ে আছি— মোরগ মুরগি হাস এবং মানুষ। কেননা, এ-বাড়ির কর্তা— তিনি নিরামিষ খান, কাজেই আগু বাচ্ছা নিয়ে আমাদের মুখে থাকবার কোনো বাধা নেই। ওই দেখুন-না, বেড়াল পাচিলের উপর ঘুমিয়ে আছে, আর ঠিক তার নীচেই আমার সব-ছোটো বাচ্ছাটা খেলে বেড়াচ্ছে গাদা গাছটার তলায়।” ইতিমধ্যে চড়াইটা চট করে কখন চিনে-মুরগিকে সোনালিয়ার খবরটা দিয়ে ফুড়ৎ করে উঠোনে এসে বসল। সোনালিয়া শুধোলেন, “ইনি?” চড়াই অমনি উত্তর দিলে, “ইনি এইমাত্র চিনে-মুরগিকে আপনার শুভ আগমন জানিয়ে এলেন। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলেন বলে।” কুঁকড়ো পরিচয় দিলেন, “ইনি তাল-চটকমশায়, সর্বদা কাজে ব্যস্ত।” সোনালিয়া শুধোলে, “কী কাজ।” চড়াই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করলে, “বড়ে কঠিন কাজ, নিজের ধন্ধায় ফিরছেন ইনি, পাছে কেউ উপর-চাল চেলে টেক্কা দেয়।” -

 সোনালিয়া বললে, “হ্যাঁ কাজটা শক্ত বটে, কিন্তু অতি ছোটো।”

 কুঁকড়ো অন্য কথা পেড়ে সোনালিয়াকে চুন-খসা দেয়ালের ধারে পুরোনো জাতাটা দেখিয়ে বললেন, “ওই পাঁচিলটার উপরে দাড়িয়ে আমি যখন গান করি তখন সোনালী রঙের গিরগিটিগুলো দেয়ালের গায়ে চুপ করে বসে শোনে। মনে হয় যেন ওই জাতার মোট পাথর খানাও দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে-বসে আমার গান শুনছে। এইখানটিতে আমি গান গাই, এইখানের মাটি আমি পরিষ্কার করে আঁচড়ে রেখেছি। আর এই যে পুরোনো লাল মাটির গামলা, গানের পূর্বে ও পরে প্রতিদিন এরি থেকে এক চুমুক জল না খেলে আমার তেষ্টাও ভাঙে না, গলাও খোলে না।” সোনালিয়া একটু হেসে বললে, “তোমার গলা খোলা না-খোলায় বুঝি খুব আসে যায় তোমার বিশ্বাস।”

 “অনেকটা আসে যায় সোনালি।” গম্ভীরভাবে কুঁকড়ো বললেন।

 “কী আসে যায় শুনি?” সোনালিয়া নাক তুলে বললে।

 কুঁকড়ো বললেন, “ওই গোপন কথাটা কাউকে বলবার সাধ্য আমার নেই।”

 “আমাকেও না?” কুঁকড়োর দিকে এগিয়ে এসে অভিমানের সুরে সোনালিয়া বললে, “আমি যদি বলতে বলি, তবুও না?”

 কুঁকড়ো কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে সোনালিকে এক বোঝা কাঠ দেখিয়ে বললেন, “আমাদের প্রিয়বন্ধু, রান্নাঘরে শ্মশানে চ, ইনি চালা কাঠ।” “এ যে আমার বন থেকে চুরি করা দেখছি।” বলে সোনালিয়া আবার শুধোলে, “তবে তোমারও একটা গুপ্ত মন্তর আছে।”

 “হ্যাঁ বন-মুরগি। এই কথাটা কুঁকড়ো এমনি সুরে বললেন যে সোনালিয়া বুঝলে গোপন কথাটা জানবার চেষ্টা এখন বৃথা।

 কুঁকড়ো সোনালিকে নিয়ে গোলাবাড়ির বাইরের পাঁচিলে উঠলেন। সেখান থেকে তিনি দেখালেন দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে জলের মতো সাদা একটা সরু সাপ কতদিন ধরে যে নামছে তার ঠিক নেই।  সব দেখে শুনে সোনালিয়া কুঁকড়োকে বললে, “এইটুকু জায়গা, তাও আবার নেহাত কাজ-চলা-গোছের জিনিসপত্তরে ভরা, এখানে একঘেয়ে দিনগুলো কেমন করে তোমরা কাটাও বুঝি না। আকাশ দিয়ে যখন পাখিরা উড়ে চলে তখন তোমার মন নতুন দেশ বড়ো-পৃথিবীটা দেখবার জন্যে একটুও আনচান করে না?”

 কুঁকড়ো বললেন, “একটুও নয়। পৃথিবীতে একঘেয়ে দিনও নেই, পুরোনোও কিছু হয় না। আমি এইটুকু জায়গাকেই প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবে দেখতে পাই। কিসের গুণে তা জান? আলোর গুণে।”

 মোনালি অবাক হয়ে বললে, “আলোর গুণে। সে আবার কী রকম।”

 “দেখো'সে।” বলে কুঁকড়ে একটি স্থলপদ্মের গাছ দেখিয়ে বললেন,“দিনের আলোর সঙ্গে এই ফুলের রঙ ফিকে থেকে গাঢ় লাল হবে দেখবে। এই খড়ের কুটিগুলো আর এই লাঙলের ফলাটা আলো পেয়ে দেখো কত রকমই রঙ ধরছে। ওই কোণে মইখানার দিকে চেয়ে দেখে ঠিক মনে হচ্ছে নাকি এটা যেন দাড়িয়ে ঘুমচ্ছে আর ধানখেতের স্বপ্ন দেখছে। আর মানুষ যেমন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে, ঠিক তেমনি করে ওই পিপড়েগুলো দেখো এই চিনেমাটির জালাটার চারি দিক প্রদক্ষিণ করে আসছে আট পল এক বিপলের মধ্যে। পলকে পলকে এখানকার সব জিনিসই নতুন নতুন ভাব নিয়ে দেখা দিচ্ছে নতুন আলোতে। আর আমিও কুঁকড়ো ওই মইখানার মতো আপনার কোণটিতে দাড়িয়ে রোজ রোজ কত আশ্চর্য ব্যাপারই দেখছি। দেখে দেখে চোখ আর তৃপ্তি মানছে না; চোখের দৃষ্টি আমার নতুনের পর নতুন, ছোটাে এই গোটাকতক জিনিসের অফুরন্ত শোভা, এই ক-টা সামান্য জিনিসের অসামান্য রূপ দেখতে দেখতে দিন দিন খুলেই যাচ্ছে, বেড়েই চলেছে, ডাগর হয়ে উঠছে মহা বিস্ময়ে। ওই কুঞ্জলতার কুঁড়িটি ফুটতে দেখে যে আনন্দ পাই, মুরগির ডিমগুলি যখন ফোটে বাচ্ছাগুলির চোখ যখন ফোটে তখনো আমি তেমনি আনন্দ পেয়ে গেয়ে উঠি। এইটুকু জায়গা, এখানে কী যে সুন্দর নয় তা তো আমি জানি নে৷”

 কুঁকড়োর কথা শুনতে শুনতে সোনালিয়া ক্রমেই অবাক হচ্ছিল। ছোটােখাটাে সব সামান্য জিনিসের উপরে আলো ধ'রে এমন চমৎকার ক’রে তো কেউ তাকে দেখায় নি। আপনার ছোটো কোণটিতে চুপচাপ বসে থেকেও যে সবই খুব বড়ো করে দেখা যায় আজ সোনালি সেটি বুঝে অবাক হল।

 কুঁকড়ো বললেন, “সব জিনিসকে যদি তেমন করে দেখতে পার তবে সুখদুঃখের বোঝা সহজ হবে; অজানা আর কিছু থাকবে না। ছোটো একটি পোকার জন্ম-মরণের মধ্যে পৃথিবীর জীবন আর মৃত্যু ধরা রয়েছে দেখো, একটুখানি নীল আকাশ ওরি মধ্যে কত কত পৃথিবী জ্বলছে নিভছে।”

 মুরগি-গিন্নি অমনি পেটরার মধ্যে থেকে গা-ঝাড় দিয়ে উঠে বললে, “কুয়োর তলে পানি, আকাশকেই জানি।” পেটরার ডালা আবার বন্ধ হবার আগেই কুঁকড়ো সোনালিকে মায়ের সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন। মুরগি-গিন্নি চোখ মটকে চুপি চুপি বললেন, “বড়ে জবরদস্ত কুঁকড়ো, না?” -

 সোনালি মিহি স্বরে বললে, “হু, উনি খুব বিদ্বান বুদ্ধিমান।”

 এদিকে কুঁকড়ো জিন্মাকে বলছিলেন, “সোনালিয়ার সঙ্গে দুদণ্ড কথা কয়ে আরাম পাওয়া যায়, সব-বিষয়ে সে কেমন একটু উৎসাহ নিয়ে জানতে চেষ্টা করে দেখেছ।”

 এমন সময় কিচমিচ চেঁচামেচি করতে করতে মাঠ থেকে দলে-দলে হাস মুরগি ধাড়ি বাচ্ছা সবাইকে নিয়ে চিনে-মুরগি উপস্থিত। এসেই সবাই সোনালিয়াকে ঘিরে ‘আহ কী সুন্দর’ ‘ক্যাব্যাৎ’ ‘বাহবা’ ‘বেহেতর’ এমনি-সব নানা কথা বলতে লাগল। কুঁকড়ো একটু দূরে দাড়িয়ে হাসিমুখে এই ব্যাপার দেখছিলেন। কী মুন্দর দেখাচ্ছে সোনালিয়াকে। তার চলন বলন সবই বেশ কেমন একটু ভদ্দর রকমের। গোলাবাড়ির কোনো মুরগিই এমন নয়। চিনে-মুরগিরও সোনালি বউ করবার সাধ একটু যে না হয়েছিল তা নয়; সে তাড়াতাড়ি নিজের ছেলের সঙ্গে সোনালিয়ার ভাব করে দিতে দৌড়ল।

 কুঁকড়ো এইবার তার সব মুরগিদের ঘরে যেতে হুকুম দিলেন। সোনালিয়া আরো খানিক তাদের সঙ্গে গল্প করবার ইচ্ছে করায় কুঁকড়ো বললেন, “ওদের সব সকাল সকাল ঘুমনো অভ্যেস।” মুরগিরা একটু বিরক্ত হয়ে সব শুতে চলল মই বেয়ে নিজের নিজের খোপে। সোনালিয়া শুধলে, “কোথায় যাচ্ছ ভাই।”  এক মুরগি বললে, “বাড়ি চলেছি। এই যে আমাদের ঘরে যাবার সিঁড়ি।”

 মই বেয়ে মুরগিদের উঠতে দেখে সোনালিয়া অবাক হয়ে গেল। বনের মধ্যে তো এ-সব কিছুই নেই।

 চিনে-মুরগি সোনালিয়ার সঙ্গে খুব আলাপ জমিয়ে বন্ধুত্ব করবার চেষ্টায় আছেন, সোনালিয়া তাকে বললে যে, এখনি তাকে আবার বনে ফিরে যেতে হবে, গোলাবাড়িতে সে কেবল দুদণ্ডের জন্য এসেছে বৈ তো নয়। ঠিক সেই সময় দূরে হম করে আবার বন্দুকের আওয়াজ হল। এখনো শিকারীগুলো বন ছেড়ে যায় নি, কাজেই সোনালিকে কিছুতেই বনে একলা পাঠাতে কুঁকড়োর একটু ইচ্ছে নেই। গোলাবাড়ির সবাই তাকে আজকের রাতটা কোনোরকমে সেখানে কাটাতে অনুরোধ করতে লাগল। জিম্মা নিজের বাক্সটা রাতের মতো সোনালিকে ছেড়ে দিয়ে বাইরে শুতে রাজি হল। বন্ধ ঘরের মধ্যে সোনালি কোনোদিন শোয় নি; কিন্তু কী করে। প্রাণের দায়ে তাতেই সে রাজি হল। চিনে-মুরগির আহ্লাদ আর ধরে না, সে সোনালিকে তার সকালের মজলিসে যাবার জন্যে আবার ধর-পাকড় করতে লাগল। এমন সময় অন্ধকার হয়ে আসছে দেখে কুঁকড়ো ডাক দিলেন, “চুপ রহ। চুপ রহ।” তার পর মইটা বেয়ে মটকায় উঠে তিনি চারি দিকটা একবার বেশ করে দেখে নিলেন, হাস মোরগ মুরগি কাচ্ছা বাচ্ছা সবাই আপনার আপনার খোপে যে যার মায়ের কোলে ডানার নীচে সেঁধিয়েছে কি না। চিনে-মুরগি সোনালির কানে কানে বললে, “মনে থাকবে তো ভাই, কুলতলায় ভোর পাচটা থেকে ছটার সময়। ময়ুর নিশ্চয় আসবেন, কাছিম বুড়োও আসবেন বোধ হয়, আর সুরকি-দিদি বলেছে কুঁকড়োকেও নিয়ে যাবে।” কুঁকড়ো একবার সুরকির দিকে চেয়ে দেখলেন, সুরকি খোপ থেকে আস্তে আস্তে মুখটি বার করে গিন্নিপনা করে বললে, “তুমিও যাবে তো। চিনি-দিদির ভারি ইচ্ছে। আমারও ইচ্ছে তুমি পাঁচজনের সঙ্গে একটু মেশো, ছেলেমেয়ের তো বিয়ে দিতে হবে।”

 কুঁকড়ো সাফ জবাব দিলেন, “না।” সোনালি মইখানার নীচে থেকে কুঁকড়োর দিকে মুখ তুলে খুব মিষ্টি করে বললে, “যেতেই হবে তোমায়।”

 কুঁকড়ো মুখ নিচু করে বললেন, “কেন বলে তো।” সোনালিয়া বললে, “সুরকি-দিদির আবদারে তুমি অমন ‘না করলে যে।”

 কুঁকড়ে একটু গললেন। “আমি তা—” তার পর খুব শক্ত হয়ে বললেন, “ন, কিছুতেই যাব না। রাত হল,” বলে কুঁকড়ো অন্য দিকে চাইলেন। মোনালি একটু বিরক্ত হয়ে কুকুরের বাক্সতে গিয়ে সেঁধলেন।

 রাত্রির নীল অন্ধকার ক্রমে ঘনিয়ে এসেছে। একে-একে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। জিন্ম ঘরের দাওয়ায় পা ছড়িয়ে শুয়েছে। চিনি-দিদি ঘুমের ঘোরে এক-একবার বকতে লেগেছে, “৫টা থেকে ৬টা।” তাল-চড়াইট তার খাচার এককোণে গুটিমুটি হয়ে ঘুম `ಿ তখনে মটকার উপরে খাড়া দাড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন আর চারি দিক চেয়ে দেখছেন। একটা দুষ্ট বাচ্ছা রাতের বেলায় চুপি চুপি উঠোনে বার হয়েছে দেখে কুঁকড়ে তাকে এক ধমক দিয়ে তাড়িয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন। তার পর আস্তে আস্তে সোনালির বাক্সটার কাছে গিয়ে কুঁকড়ে বললেন, “মোন।” ঘুম ঘুম স্বরে সোনালিয়া উত্তর দিলে, “কী।” কুঁকড়ে একবার বললেন, “না।” তার পর আবার নিশ্বেস ছেড়ে বললেন, “না, কিছু নয়।” বলে কুঁকড়ে মই বেয়ে উপরে চলে গেলেন। উপরে গিয়ে কুঁকড়ে একবার ডাক দিলেন, “রাত, ভারী রাত।” তার পর কুঁকড়ে সে রাতের মতো চোখ বুজলেন খোপে ঢুকে।

  চারি দিক নিশুতি হল আর অমনি কালো বেড়ালের সবুজ চোখদুটো অন্ধকারে ঝকঝক করে উঠল। অমনি ভোদড় বললে, “আমিও তবে চোখ খুলি।” ভাম বললে, “আমিও।” দুজোড়া চোখ ছাদের আলসেতে জলজল করে ঘুরতে লাগল। ছুচে ইছর আর বাছড় তিনজনেই বললে, “আমরাও তবে চোখ খুললেম।” কিন্তু এদের চোখ এত ছোটো যে খুলল কি না বোঝা গেল না, কেবল তাদের চিক চিক আওয়াজ শোনা গেল। একটু পরেই অন্ধকার থেকে তিনটে পেচা আগুনের মতো তিন জোড়া চোখ খুলে মুট করে দেখা দিলে। তখন সবুজ হলদে লাল— সব চোখ এ ওর দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকল আর বলাবলি করতে লাগল, “আছ তো? এসেছ? আছ তো, এ এ এ্য।” বেড়াল পেচাকে শুধল, “আছ তো।” পেচা ভোঁদড়কে, ভোদড় বাদুড়কে, এমনি সবাই সবাইকে শুধলে, “আছ তো। ঠিক আছ তো। ঠিক আজকে তো। আসছ তো ঠিক।” বেড়াল শুধলে, “আজই নাকি।” পেঁচা-তিনটে জরাব দিলে, “হাঃ হাঃ হাঃ।” চড়াই খাচার মধ্যে জেগে উঠে শুনলে এক পেচা আর-এক পেঁচাকে শুধচ্ছে, “ঘোট কিসের।” অন্য পেচা বলছে, “কুঁকড়োর সর্বনাশের ঘোট রে ঘোট।” ভোদড় অমনি শুধলে, “কো-ও-থায়।” পেচারা উত্তর দিলে, “পাকুড়তলে, পাকুড়তলে, পাকুড় পাকুড় পাকুড়তলে।” ভাম শুধলে, “ক-খ-ন।” উত্তর হল, “আটটায় ঘুট। আটটায় ঘুট। আটটায় ঘুট। ঘুট ঘুটে রাতে। যুট ঘুটে রাতে।”

 রাতের আঁধারে বাহুড়গুলো জাদুকরের হাতে তাসের মতো একবার দেখা দিচ্ছিল আবার কোথায় উ যাচ্ছিল। বেড়াল পেঁচাকে শুধলে, “বাদুড় তো আমাদের দলে বটে।” পেচা বললে, “ই নিশ্চয়।” “ছু চো ইদুর?” “হঁ। তারাও।”

 বেড়াল বাড়ির দরজা আঁচড়ে বললে, “পিউ পিউ পিউ। দিয়ে পিউ আটটায় ঘড়ি দিয়ে। দিয়ে দিয়ো।” পেচা শুধলে, “ঘড়িটাও এ দলে নাকি।” বেড়াল উত্তর করলে, “নি-শ-চয়। নিশাচর সবাই এ দলে; তা ছাড়া দিনের বেলারও দু-চার জন আছেন।” পেরু আর দু-চার জন উঠোনের এককোণে লুকিয়ে ছিল, আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। পেরু শোধালে, “ড্যেবা চোখ, চাকা মুখ। সব ঠিক তো” উত্তর হল, অন্ধকার থেকে—“হাঃ হাঃ হঁ। সব ঠিক, ঘুটিটা ঠিক, এ পাড়া ঠিক, ও পাড়া ঠিক।” তাল-চড়াই মনে মনে বললে, ‘সেও যাচ্ছে ঠিক?

 কুকুর এমন সময় গা-ঝাড়া দিয়ে বলে উঠল, “কে ও।” অমনি সব নিশাচরগুলো চমকে উঠে এদিক ওদিক চাইতে লাগল। বেড়াল তাদের সাহস দিয়ে বললে, “ও কিছু নয়, বুড়িটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বকছে।” কিন্তু এবার কুঁকড়ে যেমন একটু গা-ঝাড় দিয়ে সাড়া দিয়েছেন, “কি-ই-ও * অমনি সব নিশাচর— পেচ, বেড়াল, এমন-কি, পেরু পর্যন্ত ‘ওইগো বলেই পালাই পালাই করতে লাগল। পেরু, তিনি পালানোই স্থির করলেন, তার গলার থলি থেকে পা পর্যন্ত ভয়ে কঁপিছিল; বেড়ালের যেন জ্বর এসে পড়ল, পেচাগুলো চোখ বুজলেই অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে জানে, তারা অমনি খপ করে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেললে। একসঙ্গে সব জ্বলন্ত চোখ নিভে গেল। রাত্রি যে অন্ধকার সেই অন্ধকার। কুঁকড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চড়াইকে শুধলেন, “কারা যেন ফুসফাস করছিল না।”  চড়াই বললে, “শুনছিলেম বটে একটা ঘোট চলেছে।” যুটফুটে অন্ধকারে সব ঘুটেগুলো এমন কাপতে লাগল যে রাত্রিটা তুলছে বোধ হল।

 কুঁকড়ে বললেন, “বটে, ঘোট চলেছে?” চড়াই বললে, “ই তোমার সর্বনাশের, সাৰধান।” “বয়ে গেল।” বলে কুঁকড়ে আবার গিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

 চড়াই আবার ভালোমানুষটির মতো গা-ঝাড় দিয়ে বসল। সে ঠিক-ঠিক কথাই বলেছে কিন্তু কেমন হদিক বাচিয়ে বলেছে। যুধিষ্ঠিরের অশ্বথামাহত-ইতি-গজ গোছের। কথাটা চড়াইয়ের মুখে শুনে কিন্তু পেচাদের সন্দেহ বাড়ল। “চড়াই সত্যিই তাদের দলে কি না” —শুধতে অন্ধকারের মধ্যে একটার পর একটা চোখ চড়াইয়ের দিকে চাইতে লাগল। চড়াই বললে, “আমি বাপু কোনো দলে নেই; তবে ঘোটটা কেমন চলে দেখতে ইচ্ছে আছে।” পেচাতে চড়াই খায় না, কাজেই ঘোটে গেলে কোনো বিপদ তার নেই বলে পেচার চড়াইকে মন্ত্রণাসভায় যাবার স্থানটি বাতলে দিয়ে বললে, “চোরের মন পুইআঁদাড়ে', এই শোলক বললেই সে দরজা খোলা পাবে।”

 এ দিকে ঘরের মধ্যে থেকে সোনালিয়ার ইপি ধরছিল; সে একটু ভালো হাওয়া পেতে ঘর থেকে মুখ বার করেই সব নিশাচরকে দেখে একি? বলে চমকে উঠল। অমনি সব চোখ একসঙ্গে ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ আর সাড়া-শব্দ নেই। তখন অন্ধকারে একটির পর একটি চোখ খুলল আর বলাবলি শুরু হল। সোনালিয়া চুপ করে শুনছে কে একজন উঠোনের ও-কোণ থেকে বললে, “বেঁচে থাকো পেচা-পেচিরা।” পেচার শুধলে, “আমরা তো ওর নামটি পর্যন্ত সইতে পারি নে তা জানে, কিন্তু তোমরা তার উপর চটা কেন বলো তো।”

 দিনের বেলায় যারা দুষ্টবুদ্ধি লুকিয়ে বেড়ায়, রাত্রে তাদের পেটের কথাটা আপনিই যেন প্রকাশ হয়ে পড়ে। বেড়াল খুব চাপা জন্তু কিন্তু আগেই তার কথা বেরিয়ে পড়ল, “ওই কুকুরটার সঙ্গে অত তার ভাব ব’লেই কুঁকড়োটাকে চক্ষে আমি দেখতে পারি নে।” পেরু বললেন, “যাকে সেদিন জন্মাতে দেখলেম, সে আজ কর্তা হয়ে উঠল, এটা আমি কিছুতেই সইব না।

এইজন্যে আমার রাগ ওটার উপর।” রাজহাস বললে, “ওর পা দুখান। বড়ে বিস্ত্রী, একেবারে হাসের মতো নয়। দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে ওঠে, গোড়ালির ছাপ তে। নয়, চলবার বেলায় মাটির উপরে বাবু যেন তারাফুল কেটে চলে যান। কী দেমাক।” কেউ বললে, “কুঁকড়োর চেহারাটা ভালো বলেই সে তাকে পছন্দ করে না। কেন সে নিজে কুচ্ছিত হল কুঁকড়োটা হল না।”

 আর কেউ কেউ বললে, “সব ক-টা গির্জের চুড়োতে তার সোনার মূর্তি দেখলে কার না গা জ্বালা করে। নিশ্চয়ই ও পাখিটা কিস্টান। ওকে জাতে ঠেলাই ঠিক। মোচনমানের সঙ্গে এক ঘটিতে জল খেতে আমি ওকে স্বচক্ষে দেখেছি। ওর কি বাচবিচার আছে। ওর ছায়া মাড়াতে ভয় হয়।”

 ঠিক সেই সময় ঘড়ি পড়ল আর ঘড়ির মধ্যে কলের পাখি বলে উঠল, “পি-পি-পিরা-আ-আ-লি।”

 মেঘের আড়াল থেকে চাদ অমনি উঁকি দিলেন। উঠোনের এক কোণে খানিক আলে। পড়ল। ছুঁচে আস্তে আস্তে মুখ বার করে পেঁচাকে বললে, “আমার সে পাজিটার সঙ্গে কোনোদিন চোখোচোখিই নেই।”

 ঘড়িকলের পাখিটাকে আর শুধতে হল না; সে আপনিই বললে, “একটুতে আমার দম ফুরিয়ে যায়, রোজ দম না দিলে মুশকিল, আর কুঁকড়োর দমের শেষ নেই।” ব'লেই গল। ঘড় ঘড় করে ঘড়িপাখি চুপ করলে। টং টং করে আটটা বাজল। পেচারা সব ডানা মেলে বললে, “আর আমরা কুঁকড়োকে একটুও ভালোবাসি নে, কেননা—কেননা ও কিনা— সে কিনা” বলতে বলতে অন্ধকারের মধ্যে পেচার উড়ে পড়ল নীল রাত্রির মধ্যে। একলা সোনালিয়া উঠোনে দাড়িয়ে বললে, “আর কুঁকড়োকে আমি এখন খুব ভালোবাসি, কেননা —কেননা— সবাই তার শত্রু।”